আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥,পর্ব_২,৩
সাহেদা_আক্তার
পর্ব_২
আমি মনে মনে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ বলে লাভ নাই। এই পেত্মী থেকে আপনার পোলার মুক্তি নাই। ক্রাশ যেদিকে তাকাইবে, এই ছোঁয়াকে দেখিতে পাইবে।
আন্টি কিছুক্ষণ গল্প করেই চলে গেল। আমি নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে ফ্যানের ঘোরা দেখতেসি আর ভাবতেসি ফ্যান সব সময় ডান থেকে বামে ঘোরে কেন? আম্মা খাইতে ডাকল। আমি খাবার নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। তখন কানে এল আম্মা আব্বাকে আজকের ঘটনা তার কথার রঙে রঞ্জিত করে শুনাইতেসে। তার বর্ণনা শুনে আমি মুরগীর ঠ্যাং চাবাইতেসি আর মাথা চাপড়াইতেসি। হায়রে জননী!!!! এ কি করলা? আম্মা সব শেষে এটা যুক্ত করল যে, তোমার মেয়ের ভীমরতি হইসে? নইলে এমনভাবে কেউ পাসওয়ার্ড বলে? ব্যাপারটা কেমন সন্দেহজনক না?
– কেন?
– তোমার মেয়ের মাথায় যে বুদ্ধি ধরে তাতে সে কেমনে অর্ধেক পাসওয়ার্ড বলে, তাও আবার একটা ছেলেকে!? তোমার মেয়ের মতি গতি ভালা না। উঠতি বয়স। নাহ্, তুমি পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দাও।
– আচ্ছা।
আমি রুমে বসে বসে শুনতেসি আর মনে মনে চিল্লাইতেসি এটা তুমি কি কইলা আব্বা? তুমি রাজি হইয়া গেলা!!!! তোমার মেয়ে তার হবু জামাইরে ভালোবাসার কথা কওনে তোমরা এত বড় শাস্তি দিতে পারো না। আমি রুম থেকে চিল্লাই কইলাম, আম্মা আজকে কি লবণ মুরগী দি রানসো? আম্মাও চিল্লাই কইল, ভালো না লাগলে নিজে রাইন্দা খাও। আমি মনের দুঃখে আরেকটা ঠ্যাং আইনা চিবাইতে লাগলাম। আম্মা পিছন থেকে খোঁচা দিয়ে কইল, লবণ না বেশি তাহলে রাতে শুধু তরকারি দিয়ে ভাত খাইস। কথাটা শুনে মনের দুঃখ এক লাফে দশ গুন হইয়া গেল। সেই দুঃখে হাড্ডি গুলা এমনভাবে চিবাইলাম যে বিলাই দেখি কইব, কোন রাক্ষস আজকে মুরগী খাইসে, আমাদের জন্য হাড্ডিটা পর্যন্ত অবশিষ্ট রাখে নাই। শেষ পর্যন্ত আব্বা ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করছে কি না আর জানতে পারলাম না। কারণ আমার নিজের কোনো ফোন নাই।
.
.
.
.
রোজ বিকালে ক্রাশ মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাইতো। আমি ক্রিকেট একদম পছন্দ করতাম না। কিন্তু তার ঠেলায় ক্রিকেট এত ভালোবেসে ফেললাম যে নিজেই বাচ্চাদের একটা ব্যাট বল কিইনা নিয়ে চলে আসলাম দোকান থেকে। এখন প্রত্যেকদিন আমার একই কাজ। সকালে স্কুল, বিকালে ব্যাট বল আর রাতে পড়াশোনা। এই তিন নিয়াই আপাতত আমার সংসার। তারে নিয়া ডাইরিতে হাজার কথা লিখা পুরাই ফেলসি। এটাও লিখসি যে বিয়ার পরে ক্রিকেট টিম বানামু। লাইনটার কথা মনে কইরা নিজেই লজ্জায় মুচকি মুচকি হাসি। ভাবি আমার ক্রাশ জানলে কি কইব!!! একদিন বিকালে ব্যাট বল পাশে রাইখা বিছানায় শুইসি আর ছাদের দিকে তাকাই মুচকি মুচকি হাসতেসি। কোন ফাঁকে এটা আম্মার চোখে পড়ছে খেয়াল নাই। সাথে সাথে আম্মা রাতে আব্বারে কইল, শোনো, তোমার মাইয়া প্রেম করে। আব্বা চোখ কপালে তুলে বললেন, কি বলো!? আমি রুম থেকে আম্মার কথা শুনে চিৎকার দিয়া কইলাম, আম্মু, আজকে নাকি জবার একটা স্পেশাল পার্ট দিবো। আটটা বাজি গেসে। তুমি দেখবা নাকি আমি ডিস এ্যান্টেনা কাইটা দিমু? এই টনিকেই কাজ হইল। আম্মা মুখ বন্ধ কইরা রিমোট খুঁজতে লাগল। কারণ আমি যখন বলসি ডিস এ্যান্টেনা কেটে দিমু, তো কথা না শুনলে তাই করমু। এই নিয়ে দুই বার এমন হইসে। আব্বাকে অনেক বলে আম্মা লোক আনাই ঠিক করাইসে। এইবারও হইলে ডিস লোকদের কাছে লজ্জার আর শেষ থাকবো না। তাই কোনো কথা না শুনলে এই টোটকা রেডি রাখি। যাহা এক ফোঁটাই যথেষ্ট।
আমি পড়ার টেবিলে বসে আছি। সামনে বই খোলা। কিন্তু আমার মন মৌমাছির মতো ক্রাশ নামক ফুলে ঘুরে বেড়াইতেসে আর মধু সংগ্রহ করে বলতেসে, আর আছে মধু? আজ আমি হাঁড়ি ভর্তি করে নিয়ে গিয়ে মৌচাক বানাবো। ফুলও হেসে আমাকে একগাদা মধু দিয়া কইল, লও সখি, এই মধু শুধু তোমার জন্যই জমাই রাখসি। আমিও সেই মধু নিয়া মৌচাকে রাখসি এমন সময় কে যেন ঢিল মারল মৌচাকে। তাকিয়ে দেখি আব্বা দরজার সামনে দাঁড়াই আমাকে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে ডাক দিসে। আমি তাকাতেই বলল, পড়ার বই খোলা রেখে কোন দিকে তাকাই হাসতেছিস?
– কই, আব্বু?
– আমি তোরে ভালো করে চিনি। কার পাল্লায় পড়ছিস?
– তুমিও আম্মুর কথা বিশ্বাস করলা? কোন পাগলে আমার সাথে প্রেম করবো?
আব্বা আমার কাছে এসে সুন্দর করে উপদেশ দিয়ে গেলেন যে বই খোলা থাকলে শয়তানে পড়বো। অতএব পড়ায় মন দাও। আমি মনে মনে কইলাম, যে পড়া, শয়তানও বলব, থাক, তোর পড়া তুই পড়। আমার অন্য কাজ আছে। এটা বলে সেও পালাইব। ভেবেই ফিক করে হেসে দিলাম। আব্বা চলে যাচ্ছিলেন। হাসি শুনে আমার দিকে ফিরে বললেন, আবার হাসিস ক্যান?
– আব্বা, ভাবতেসি।
– কি?
– কালকে কয়টা রসগোল্লা তোমার পেটে গেসে।
এই কথাতেই আব্বা চোরের মতো উঁকিঝুঁকি দিয়ে বললেন, এই, তোর আম্মুকে বলিস না। আসলে দেখে আর লোভ সামলাতে পারি নাই।
– আমি বুঝি, চিন্তা কোরো না, আমার দিক থেকে এই কথা লিক হবে না।
কথায় বলে না যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয়। হঠাৎ কোথায় থেকে আম্মা এসে হাজির। আমার কথার শেষ অংশ শুনেই বললেন, কি লুকাইতেসো বাপে ঝিয়ে মিলা। আব্বা কিছু বলার আগেই বললাম, কালকে কয়টা রসগোল্লা খাইসে সেই সংখ্যাটা বলতে মানা করতেসিলো। আমিও বলসি আমার থেকে এই কথা লিক হবে না। আব্বা সাথে সাথে চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে তাকালেন। হাঁড়ি হাটে ভেঙে গেসে। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আবার খেয়েছো!? তোমার না ডায়াবেটিস। ব্যাস শুরু আম্মার ভাষণ। আমিও মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল আর শিখতে লাগলাম। ভবিষ্যতে ক্রাশকে এভাবে বলতে হবে না!? ভেবে এবার আটাশটা দাঁত বের করে হাসতে লাগলাম। আমার হাসি দেইখা আব্বা আম্মা ঝগড়া বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকাই রইল। যেন আমি তাদের মেয়ে না কোনো আজব চিড়িয়া চলে আসছে আমাদের ঘরে। তাদের দিকে তাকিয়ে আমার হাসি বন্ধ হইয়া গেল। আমি পড়ায় মনোযোগ দিলাম।
.
.
.
.
দিন দিন তার প্রতি দুর্বল হইতে লাগলাম। ক্রাশের প্রতি আমার হূদয় ক্রাশিত হইতে লাগিল। আমিও হাল ছাড়ার পাত্রী নই। আমি যখন তার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ খুঁজতেসি তখন সুযোগ নিজেই আমার কাছে এসে কইল, ছোঁয়া, তোর দুঃখে দুঃখিত হইয়া নিজেই চলে আসলাম তোর কাছে। একদিন আন্টি আমাদের পিঠা দিতে আসলেন। আমি তো পিঠার সেই লেভেলের ফ্যান। আমাকে কেউ সারাদিন পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করলে ওগুলো শেষ না করা অবধি আমার দুই পা দরজার দিকে নড়ে না। আমাকে যদি বলে তোকে পিঠাওয়ালার কাছে বিয়া দি দিমু তাইলে হাসতে হাসতে রাজি। তবে সেটা আগের কথা। এখন আমার জামাই আছে, মানে হবু জামাই আছে। এখন পিঠাওয়ালাকে বিয়া করা আমার জন্য জায়েজ নাই। যাই হোক, আন্টি মাত্র পিরিচটা রাখতেই আমি পিঠার সুগন্ধে মৌমাছির মতো উড়ে উড়ে বসার রুমে চলে এলাম। গিয়ে দেখি পিঠাগুলো আমার দিকে জুলুজুলু চোখে তাকাই আছে। কিন্তু আন্টির সামনে নিতে পারতেসি না। হবু শাশুড়ী বলে কথা। যদি দেখে ছেলের বউ রাক্ষসের মতো পিঠা গিলতেসে তাইলে আর জীবনেও ক্রাশ রে এই মুখো হতে দিবে না। আমি খালি পিঠার দিকে তাকাইতেসি আর চরকির মতো আন্টি আর আম্মার চারপাশে ঘুরতেসি। কি কপাল!!! আমার সাধের পিঠা করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাই আছে আর আমিও বুভুক্ষের মতো তাকাই আছি। আম্মা আমার হাবভাব দেইখা কইল, কি রে, কিছু বলবি?
– না।
আম্মা বলল, যা তো ছোঁয়া, তরকারির লবণ দেখে আয়।
আমি মুখ কালো করে রান্নাঘরে চলে এলাম। আরেকটা বিরক্তির কাজ। আমি যতদিন লবণ দেখসি ততদিন আম্মার একটা লম্বা ভাষণ শুনতে হইসে। হায় রে ক্রাশ!!! তোমার জন্য আমার মুখ এখন মিষ্টি না করে নোনতা করতে হবে। কোথায় আরাম করে পিঠা খাইতাম তার জায়গায় তরকারির ঝোল খাইতেসি। আমি লবন দেখে নিজের রুমে চলে এলাম। আম্মা আর আন্টি গল্প করতেসে। আমার ইচ্ছা করতেসে মনের দুঃখে গান গাই। কিন্তু আন্টি কি আমার গলা সহ্য করতে পারবে? কয়েক মুহূর্ত উপরের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করলাম। তারপর ভাবলাম, আমারে পিঠা খাইতে দিতেসে না, বইসা বইসা রসের আলাপ করতেসে। এইটুকু প্যারা তো দেওয়াই যায়। মাত্র গলা পরিষ্কার করে গান গাইব, এমন সময় আমার কান ওনাদের গল্পের দিকে চলে গেল। আমি ঠিক শুনছি? আমার ক্রাশ গাজরের হালুয়ার উপর ক্রাশ? ভালো করে শুনে দেখলাম ঠিকই শুনসি। শুনে আমি কপাল চাপড়াইলাম। আমার ক্রাশের সব সময় আমার অপছন্দের জিনিসগুলাই পছন্দ কেন? আমি গাজর দুই কেন চাইর চোক্ষে দেখতে পারি না। আর সেই গাজরের হালুয়া আমার ক্রাশ খায়। এবার আমার কান্দন আইতেসে। আন্টি কথা বলে চলে গেল। আমি তাড়াতাড়ি আম্মার ফোনে আব্বাকে ফোন করে কইলাম, আব্বু এক কেজি গাজর আনবা। আব্বা আমার কথা শুনে হার্টফেইল করল কি না বুঝলাম না। কারণ ফোনের ওপাশে নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত নাই। আমি কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করতেই আব্বা বলল, তোর শরীর ঠিক আছে তো?
– হ্যাঁ। মনে করে আনবা কিন্তু, পারলে দুই কেজি আনিও।
তারপর আর কথা নাই। আমি তাকাই দেখলাম ফোন কেটে দিসে। আমি ভাবি কি হলো!? ফোনে তো টাকা আছে, তাহলে মনে হয় আব্বা কেটে দিসে। থাক গা। আমি চার হাত পা মেইলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে গাজরের অপেক্ষা করতে লাগলাম। কখন যে ঘুমাই পড়ছিলাম টের পাই নাই। হঠাৎ তাকাই দেখি আব্বা আম্মা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাই আছে। আমি ইশারায় বললাম কি? ওনারাও ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন কি? আমিও আবার জিগাই, তারাও জিগায়। এভাবে কি কি খেলতে খেলতে বিরক্ত হয়ে উঠে বললাম, কি হইসে? আব্বা আমার কপালে হাত দিয়ে বললেন, চল ডাক্তারের কাছে।
– হঠাৎ ডাক্তারের কাছে যাবো কেন?
– শরীর ঠিক নাই।
আমার শরীর অথচ আমিই জানি না আমার শরীর খারাপ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, দুই কেজি গাজর আনসো? আব্বা আম্মা একে অপরের দিকে তাকাই আছে আর আমি তাদের দিকে। আমি ডায়নিংয়ে গিয়ে দেখলাম একটা কালো পলিথিনে কিছু গাজর উঁকি ঝুঁকি দিতেসে। আমি নাক কুঁচকে একটা মোটকা দেখে গাজর ধুয়ে নিয়ে সোফায় বসলাম। আব্বা আম্মা অবাক হয়ে আমার কান্ড কারখানা দেখতেসে। আমি গাজরে একটা কামড় দিতেই দুইজনে আঁতকে উঠল।
চলবে…
#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️
#পর্ব_৩
#সাহেদা_আক্তার
আমি নাক কুঁচকে একটা মোটকা দেখে গাজর ধুয়ে নিয়ে সোফায় বসলাম। আব্বা আম্মা অবাক হয়ে আমার কান্ড কারখানা দেখতেসে। আমি গাজরে একটা কামড় দিতেই দুইজনে আঁতকে উঠল। এভাবে আমি প্রথমটা শেষ করে দ্বিতীয়টা ধুঁয়ে নিতেই আম্মা বলল, রেডি হ।
– কেন?
– ডাক্তার দেখাবো। কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে।
আমি চোখ সরু করে বললাম, হঠাৎ?
– যে তুই গাজর বাসায় ঢুকতেই তার চৌদ্দ গুষ্টির উদ্ধার করে দিতি, সে আজ গাজর খাইতেসে।
আমি উদাস উদাস ভাব কইরা দার্শনিক ভঙ্গিতে কইলাম, গাজর খাইলে শরীর সুস্থ থাকে। তাই ভাবতেসিলাম এবার থেকে রোজ দুই না না তিনবেলা তিনটা গাজর খামু। আম্মা আব্বা কি বলবে বুঝতে না পাইরা নিজের কাজে চলে গেল। আমিও নাক মুখ কুঁচকে গাজর খাইতে লাগলাম। চারদিনে আমি দুই কেজি গাজর খেয়ে শেষ করলাম। তিনবেলায় তিনটা না করে ছয়টা করে গাজর খাইতে লাগলাম। আম্মা তো টেনশানে পড়ল, এই মেয়ের কি হল!? একদিন আম্মা নিজের ফোনে ভিডিও দেখতে গিয়া আঁতকে উঠল। মেমরি ভর্তি গাজরের হালুয়ার রেসিপি। অন্তত এদিক ওদিক করে বিশ পঁচিশটা হবে। আম্মা ডাক দিল। তখন আমি রান্নাঘরে গাজরের সাথে যুদ্ধ করতেসি। ডাক শুনে তার কাছে গেলাম। আমাকে দেইখা আম্মা চমকায় উঠল। আমি গাজর বানু হয়ে আছি। দুই হাতে গাজর। মাথায় গাজর কুচি, সারা শরীরের গাজর কুচি। আম্মা কইল, এই অবস্থা কেন?
– রান্না করতেসি।
আম্মা অবাক হইল। যে মেয়ে প্লেট ধোঁয়ার জন্য রান্নাঘরে যাইতে চায় না সে মেয়ে আজ রান্নাঘরে। আম্মা জিগাইল, কি রাঁনতেছিস আবার? আমি নিরাশ হয়ে কইলাম, সর্বাঙ্গে যাহার ছড়াছড়ি তাই রাঁনতেসি। কি জন্য ডাকছো? আম্মা আর কিছু বলল না। আমি বেশ বিরক্ত হয়ে চলে গেলাম। একে তো কখনো রান্না করি নাই, তার উপর গাজরগুলা নিয়া সিদ্দত করতেসি, এর মাঝে আম্মার হুদা ডাকটা ভালো লাগে নাই। যাই হোক, অনেক কষ্টে অনেক চেষ্টার পর গাজরের হালুয়া বানাইলাম। তারপর কাকের গলা ছেড়ে ইচ্ছামতো গোসল করে সেজেগুজে রেডি হয়ে নিলাম। সুন্দর করে চোখে গাঢ় কাজল দিলাম। বাসায় পরার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর লাল জামাটা পরসি। আলমারি খুলে জামা নিলে আম্মা কইব, এখানে কি বিয়া শাদি লাগসে যে নতুন জামা পরছিস।
আমি বড় একবাটি নিয়ে পাশের বাসায় নক করলাম। আন্টি দরজা খুলে বললেন, আরে ছোঁয়া ভেতরে এসো। এখানে আসার পর তো একবারো আসো নাই। আমি মিষ্টি করে সালাম দিলাম। মনে মনে বললাম, একেবারের জন্যই চলে আসমু, আপনার ছেলের লগে বিয়া দিয়া দেন। আন্টি আমাকে সোফায় বসালেন। আমি বাটিটা আন্টিকে দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললাম, এটা আমি বানিয়েছি। ভাবলাম আপনাদেরকেও একটু দিয়ে যাই। বাসায় কেউ নাই? আন্টি বললেন, ওমা! গাজরের হালুয়া! তোমার আঙ্কেল অফিসে। এখনো আসেনি। দাঁড়াও তোমাকে একটু দেই। আমি মনে মনে কইলাম, আঙ্কেলের খবর জাইনা আমি কি করমু। আমার জামাইর খবর বলেন। আমি বললাম, লাগবে না আন্টি, বাসায় আরও আছে। আন্টি তাও ছোট একটা পিরিচে আমাকে দিলেন। তখনই আমার ক্রাশ বাসায় ঢুকল। আমি তার দিকে হা করে তাকাই আছি। গায়ে ফুটবল জার্সি ঘামে লেপ্টে আছে। মুখ পানি দিয়ে ধোয়ায় কপালের চুলগুলো ভিজে কপালের সাথে লেগে আছে। সেগুলো থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। গরমে মুখের সাথে কাল অবধি লাল হয়ে আছে। ওকে আমার চেরি ফল!!!!! তোকে দেইখা আমার মনে গান বাজতেছে, তোরে হেব্বি লাগছে। সে এসে বলল, আম্মু আজকে আমাদের টিম জিতেছে। তারপর আমার পিরিচের দিকে দেখে বলল, গাজরের হালুয়া! বলেই পিরিচটা নিয়ে নিল টেবিল থেকে। আমার দিকে একবার তাকালোও না। আমি মনের দুঃখে বললাম, আমি আসি আন্টি।
– ওমা, চলে যাবে!
আমি যেই দরজা খুলেছি ক্রাশ বলল, এটা কে বানিয়েছে? বাপ রে, লবণ দিয়ে রান্না করেছে নাকি? লবণ ঢালতে তো কার্পণ্য করে নাই।
এমন প্রশংসা শোনার পর পা দুটো আর থাকতে চাইল না, সাথে সাথে বাসায় দৌঁড়। দরজা বন্ধ করে সেটার সাথে লেপ্টে দাঁড়াই আছি। বুকটা ঢিপঢিপ করতেসে। ব্যাঙও মনে হয় এতো জোরে লাফায় না। আমি গিয়ে হালুয়া একটু মুখে দিতেই মুখ বাংলার পাঁচ হয়ে গেসে। আসলেই লবণ দিতে কার্পণ্য করি নাই। আমি পানি দিয়ে ভালো করে কুলি করতেই আম্মার ডাক। আমি আম্মার কাছে গিয়ে দেখলাম আব্বা চলে আসছে এবং উনি কোনো কারণে মুখে চামুচ ঢুকাইয়া আটকে আছে। ঘটনা বুঝতে না পেরে হাতের দিকে তাকাতেই বুঝলাম তার আটকে যাওয়ার কারণ। আমার গাজরের হালুয়ার লবণের কেরামতি। আমি অপরাধীর মতো দাঁড়াই আছি। আম্মা বললেন, গত মাসের জন্য তোর আব্বুকে দিয়ে লবণ কিনাইসিলাম। এখন রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আয় তো লবণের ডিব্বা অর্ধেক খালি কেন? আমি মিনমিন করে বললাম, বুঝতে পারি নাই চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলসি। আম্মা তখন মুক্ষম প্রশ্নটা করলেন, তোর আন্টির কেমন লাগছে? আমি বললাম, আন্টি খায় নাই, তার ছেলে খাইসে। বলসে আমি লবণ দিতে কার্পণ্য করি নাই। শুনে আব্বা মুচকি হাসতেসে। আম্মাও মুখ টিপে হাসতেসে। আমি নিজের রুমের দরজার ছিটকিনি আটকাইয়া মনের দুঃখে বাপ্পারাজের মতো গান গাইতে লাগলাম,
গাজরের হালুয়া রে…
কার দুঃখে তুই লবণের সাগরে…
ডুব দিয়ে আমার মান ইজ্জত লুটিলি রে…
রাতে আবার ফ্যানের নিচে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে গাজর চাবাইতেসি আর ভাবতেসি কি করা যায়। ভাবছিলাম গাজর দিয়ে হাত করমু, কিন্তু গাজর আমার খবর করে দিল। কি করা যায়…… হাতের গাজরটারে জিজ্ঞাস করলাম, তুই বল কি করা যায়। হঠাৎ গাজরটাই আমারে আইডিয়া দিল। ব্যাস। আমি খুশির ঠেলায় গাজরের লগে নাচতে নাচতে তার মাথায় কামড় বসিয়ে বললাম, এই ল তোর বকশিস।
.
.
.
.
পরদিন স্কুল থেকে এসেই গোসল করে রেডি হয়ে নিলাম। উঁকি মেরে দেখলাম ক্রাশ কখন বের হয়। তিনটার দিকেই সে ব্যাট বল হাতে বেরিয়ে গেল। আমি আম্মাকে চিল্লাইয়া কইলাম, আম্মু আমি একটু বাইরে যাইতেসি। আম্মা চিল্লাইয়া কিসু কইল। কিন্তু আমি কান না দিয়া বেরিয়ে আসলাম। কলিং বেল টিপতেই আন্টি দরজা খুললেন। আমি হাসিমুখে সালাম দিলাম। আন্টি হেসে বললেন, কি খবর? আমি মুখ ভার করে বললাম, আন্টি, কালকে বুঝতে পারিনি চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছি।
– প্রথম রান্না করলে এমন একটু আধটু হয়।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কি করে বুঝলেন? আন্টি হেসে বললেন, আমিও প্রথম প্রথম এমন করে ফেলতাম। আমি যখন প্রথম বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি এসেছিলাম তখন রান্নার র ও জানতাম না। কোথাও হলুদের জায়গা মরিচ, আদার জায়গায় রসুন, এমন দিয়ে দিতাম। তারপর শ্বাশুড়ি আমাকে যত্ন করে রান্না শিখিয়েছেন।
ওনার কথা শুনে মনটা আনন্দে নাইচা উঠল। আজ আমিও আমার হবু শ্বাশুড়ির কাছে রান্না শিখমু। আমি মুখ কালো করে বললাম, আমাকে গাজরের হালুয়া বানানো শিখিয়ে দেবেন আন্টি? এজন্যই এসেছি। শ্বাশুড়ির কাছ থেকে কবে রান্না শিখবো তা তো জানি না আপাতত আপনার থেকে গাজরের হালুয়া বানানো শিখতে চাই। আন্টি রাজি হলেন কিন্তু তার কাছে গাজর নেই। আমি বললাম, আমি তাহলে বাসা থেকে নিয়ে আসি। আজকে আব্বু এক কেজি গাজর এনেছে। আমি পা টিপে টিপে রান্নাঘরে গিয়ে একটা বাটিতে গাজর নিলাম। যেই না দরজার কাছে গেলাম আম্মা দেখে ফেলল। ডাক দিলেন, ছোঁয়া… আমি দিলাম ভৌঁ দৌঁড়। চলে এলাম আন্টির কাছে। আন্টি আমাকে সুন্দর করে শিখিয়ে দিলেন। আধা ঘন্টায় রান্না শেষ। আমি এক চামুচ খেয়েই বুঝলাম কেন আমার ক্রাশ গাজরের হালুয়ার পাগল! আন্টি আমাকে একবাটি দিয়ে বললেন, চলো খাবে। আমরা বসার ঘরে আসতেই ক্রাশ ঢুকল। আমি তার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলাম। সে সোজা রুমে চলে গেল, একবার তাকালোও না। কষ্টে দুঃখে আমার কান্না চলে আসলো। আন্টি বললেন, খাও।
– জ্বি, আন্টি।
এমন সময় সে এসে বলল, আজকেও গাজরের হালুয়া? কয় মণ লবণ দিয়েছে? শুনেই অভিমান হইলো। মনে মনে কইলাম, এত তাড়াতাড়ি কেমনে আইলো! আন্টি প্রতিবাদ করে বললেন, কি হচ্ছে? আমি বললাম, আপনি তো গেলেন এক ঘন্টাও হয়নি। এত তাড়াতাড়ি আসলেন কি করে? ক্রাশ আমার দিকে ভ্রূ কুঁচকে বলল, তুমি জানলে কি করে? পাহারা দিচ্ছিলে নাকি? আমি পড়লাম ফাঁদে। মনে মনে বললাম, এটা তুই কি করলি, ছোঁয়া। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলাম!! একে তো কালকের লজ্জায় থাকতে পারতেছিস না। এখন যদি জানতে পারে তুই নজর রাখিস তাইলে তো এখানেই মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যেতে হবে। আন্টি আমাকে বাঁচাই দিলেন, মেয়েটাকে একটু শান্তি করে খেতে দে। আমি দুই চামুচ খেয়েই বললাম, আমার হয়ে গেছে। আপনার রান্না অনেক মজা আন্টি। ক্রাশ বলল, দেখতে হবে না কার আম্মু। ইস্, কতটা হালুয়া নষ্ট করতেসে। বলেই আমার হাত থেকে বাটিটা নিয়ে হালুয়াটা খাওয়া শুরু করল। আমি তো বেকুবের মতো তাকাই আছি। সে খাওয়া শেষ করে বলল, আম্মু, আজকের হালুয়াটা বেস্ট ছিলো। খুব ভালো হইসে। আজকে ভালো করে খেলতে পারিনি দেখে মন খারাপ ছিল। আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল। এটা খেয়েই মন ভালো হয়ে গেছে।
শুনেই আমার মাথায় বাজ পড়ল। আমি দরজার দিকে দৌঁড় দিয়ে বললাম, আমি আসি আন্টি। আরেক দিন আসবো। এক দৌঁড়ে ছাদে। আমার সাধের নীল ফ্রকটা ধুঁয়ে দিয়েছিল আম্মু। আমিই রোদে দিয়ে গেসিলাম। এসে দেখি এখনও বৃষ্টি শুরু হয় নাই। বাতাস ছুটেছে। বাতাস দেইখাই আমি ফ্রকের কথা বেমালুম ভুইলা গেসি। বাতাসে দাঁড়াই আছি। আমার খুশি আর দ্যাখে কে। আমি বাতাসে লাফাইতেসি আর ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাইতেসি। এর মধ্যেই ফোঁটা ফোঁটা করে ঝুম বৃষ্টি নামল। বৃষ্টিতে আমি পাগল হই গেলাম। বাচ্চাদের মতো লাফাইতে লাগলাম। আমার লাফানি দেখলে ব্যাঙও মনে হয় কইব, আমরাও বাচ্চা থাকতে এতো লাফাই নাই। কতক্ষণ লাফাইসি জানি না। এদিকে বৃষ্টিরও থামার নাম নাই। তখন পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, আগে কি বৃষ্টি দেখো নাই? আমি তাকাই দেখি ক্রাশ দাঁড়াই আছে। আমি তো সরমে শ্যাষ। বৃষ্টিতে জামা কাপড় সারা শরীরে সাপের মতো প্যাঁচাই আছে। তারে দেইখাই রশি থেকে আমার জামাটা একটানে নিয়া দৌঁড় দিলাম। ভাগ্য ভালো এত প্যাঁচের পরও হবু জামাইর সামনে উন্ডুস (ধাক্কা) খাই পড়ি নাই। খাইলে আমি মাটির ভেতর ঢুইকাও শান্তি পাইতাম না। আমি এসেই দরজা মেরে দিলাম। বুকের ব্যাঙটা তো দৌঁড় প্রতিযোগিতায় নাম দিসে। আমার শরীর থেকে টপ টপ করে পানি পড়তেসে। আমি ওয়াশরুমে চলে গেলাম। গোসল করতে করতে আম্মার চিৎকার শুনতে পাইলাম।
– এই মেয়ের কি জীবনে কান্ড জ্ঞান হবে না। একে তো এই ভর সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভিজে আসছে। সারা ঘর পানিতে ভাসাই দিয়ে এখন গোসল করতেসে।
আমি গোসল করে মাথা মুছতে মুছতে বের হতেই, হাচ্চি……। একবার দুইবার তিনবার… হাঁচতে লাগলাম। আম্মা এসে বললেন, হলো তো। ধর, পাশের বাসার ভাবি এই এক বাটি হালুয়া দিয়ে গেছে তোর জন্য। এটা খেয়ে একটা নাপা খেয়ে নে। আমি রাখলাম টেবিলে। আম্মা খাবার আর ঔষধ রেখে গেল। আমি নাক টানতে টানতে বাটিটা নিলাম। এক চামুচ মুখে দিতেই ক্রাশের কথা মনে পড়ল। সাথে সাথে লজ্জায় বিছানার সাথে মিইশা গেলাম। তাতেই ঘুম।
চলবে…