অবেলার_প্রেম #পর্বঃ৪ শেষ

#অবেলার_প্রেম
#পর্বঃ৪ শেষ
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

দুটো দিন কেটে গেছে।
ফাগুনের কাছে দীর্ঘ দু’দিন! এই দু’দিনে দিগন্তের দেখা পায়নি একবারও। দিগন্তকে ছাদে আসতে দেখা যায়নি। তার বাসার সামনেও দেখা যায়নি। বাহির থেকে স্থির ফাগুনকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না সে কতটা ছটফট করছিল ভেতরে ভেতরে। দিগন্তকে এক পলক দেখার আশায় সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটা অবধি এক নাগাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো কোনো ভয় ছাড়াই। ফলাফল শূন্য। রাতের ঘুম উড়ে গেছে। স্নুপিকে আগের মতো আদর করতেও মন লাগে না। স্নুপি ঘেউঘেউ করে বাড়ি মাথায় তোলে। আদর চায়। ফাগুন একটা ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয় তাকে। এ যেন অন্য এক ফাগুন। ডানা ভাঙা চড়ুইর মতো উড়ার জন্য ছটফট ছটফট করছে!
বাড়ির কেউ ফাগুনের পরিবর্তন না বুঝলেও মিলি আপা বুঝলো। তৃতীয় দিন, কলেজ থেকে ফেরার পর আগের মতোই ফাগুনকে তার রুমে ডেকে নিলো। এসির ঠান্ডা বাতাসে গা জুড়ালেও মন জুড়ালো না। স্থবির মতো দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
-‘কিছু বলবে আপা?’
-‘বস আগে।’
আদেশ করে মিলি। ফাগুন যেন শুনলোই না। দৃঢ়চিত্তে বলল,
-‘গোসলে যাবো। কী বলবে বলো।’
রাগ হয় মিলির। এর আগে এভাবে মুখের উপর তর্ক করেনি ফাগুন। নিজের রাগটা চেপে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
-‘কী সমস্যা তোর? ইদানীং কেমন পাগলের মতো করিস। কিছু হয়েছে?’
ফাগুন স্পষ্ট চোখে তাকাল।
-‘নাহ। কী হবে? কিছুই না।’
-‘লুকোস না। তোর চোখ এত লাল কেন? রাতে ঘুমাস না?’
-‘ঘুমাই। এমনিতেই লাল। ফ্রেশ হলেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি যাই আপা।’
বলে এক পা বাড়াতেই পেছন থেকে মিলি বলে উঠল,
-‘এই ফাগুন, তুই নেশা টেশা করিস নাকি?’
ফাগুন চমকে পেছন ফিরে তাকাল।
-‘আজব! এগুলা কী বলতেছো?’
-‘তোর চোখমুখ লাল..’
-‘এইজন্য আমি নেশা করি? আজব চিন্তাভাবনা তোমার আপা।’
-‘অনেকক্ষণ ধরে তোর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনতেছি। আগ বাড়িয়ে ডাকি দেখে ভাব বেড়ে গেছে নাকি?’
আচানক মাথায় চড়া রাগটাকে দমানোর চেষ্টা করল ফাগুন। পারছে না। তার কেন যে এত মেজাজ গরম হচ্ছে কথায় কথায়, কে জানে! কোনোমতে ‘আসি’ বলেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। সোজা বাথরুমে ঢুকে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে কলেজের জামাকাপড় পরা অবস্থাতেই ভিজতে শুরু করল। ভিজতে গিয়ে একসময় চোখ বেয়ে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ফাগুন টের পেল না। মনের উত্তাপ গুলো ফেঁপে উঠেছে। সেগুলো আর আঁটকানো যাচ্ছে না। ঝড়ছে,ঝড়ুক- মনের অশান্তি থেকে মুক্তি চায় সে।

আরও একটা দিন কেটে গেল। ফাগুনের চেহারার দিকে এখন আর তাকানো যাচ্ছে না। মনে হয়, যখন তখন দু’চোখ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। আলুথালু চুল, মলিন চেহারা, শুষ্ক ঠোঁট, টলটলে দীঘির মতো একজোড়া চোখ নিয়ে ভূতের মতো ছাদে গিয়ে অপেক্ষা করে সে। দিগন্তকে একটিবার যদি দেখা যায়! নাহ, দেখা যায় না। উত্তপ্ত রোদে চুলের ভেতর থেকে ঘাম পড়ে চুইয়ে চুইয়ে। তবুও দিগন্তের দেখা নেই। ফাগুনের বুকে আগুন অনুভূতি জ্বালিয়ে দিয়ে নিজে আরামে বসে আছে? নাহ, এটা হবে না। তাকে এত আরামে থাকতে দেওয়া যাবে না।
ফাগুন অন্তত দিবে না। ফাগুন চুপচাপ বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলো। এখন বিকেল। সোজা গিয়ে ঢুকলো দিগন্তদের বিল্ডিংয়ে। ভাগ্য ভালো, দারোয়ানকে দেখা গেল না। কিন্তু কোনটা দিগন্তের বাড়ি? এতগুলো ফ্ল্যাট..! সিড়ির উপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো ফাগুন। ঝোঁকের মাথায় চলে তো এসেছে কিন্তু যাবে কই এখন? এমন সময়ে একজনকে নিচে নামতে দেখা গেল। ফাগুন পিঠ সোজা করে দাঁড়াল। চোখমুখে স্বাভাবিকতা ফুঁটিয়ে তুলে নেমে আসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ফাগুনের ঠিক সামনেই থমকে দাঁড়াল।

-‘একটু সাহায্য করবেন আপু? দারোয়ান কোথায় বলতে পারেন?’

মিষ্টি রিনরিনে কণ্ঠ ফাগুনের। আহ্লাদে গদগদ। তাকে যেন কোনোভাবেই কেউ সন্দেহ না করে, তাই কথার টোন পাল্টেছে। মেয়েটির কপালে সূক্ষ্ম রেখার ভাঁজ, খানিকটা বিরক্তি নিয়েই বলল,
-‘আমি কীভাবে বলব? আর তুমি কে?’
-‘আমি দিগন্ত ভাইয়ার কাছে আমার বই নিতে এসেছি। কিন্তু উনার ফ্ল্যাটটা চিনি না। দারোয়ানকেও পাচ্ছি না জিজ্ঞেস করার জন্য। আপনি কী দিগন্ত নামের কাউকে চেনেন?’
-‘উমমম..’
মেয়েটার চোখেমুখে সন্দেহের ছাপ। ফাগুন সাফাই গাইলো,
-‘ভাইয়া আমাকে বোনের মতোই ভালোবাসে। উনার থেকে আমি অনেক বই নিয়ে পড়ি। উনিও আমার থেকে বই নেন। একটা বই আছে উনার কাছে। ওটা একটু আর্জেন্ট দরকার তাই আমি নিজেই এসেছি। আপনি যদি জানেন উনার ফ্ল্যাট কোনটা তাহলে একটু উপকার হতো আপু।’
একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটা বলল,
-‘বি ২। ওই ফ্ল্যাটেই থাকে। নাম কী তোমার? আগে তো দেখিনি। কই থাকো?’
-‘পাশের এলাকায় আপু। আমার নাম লিলি। আমি এর আগে আসিনি এই এলাকায়।’
-‘ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে।’
বলে মেয়েটা চলে গেল। তার ফোন বাজছে। একটু তাড়াহুড়ো করেই বেরোলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে ফাগুনের। যাক, তাকে সন্দেহ করা হয়নি। এবার কেউ আসার আগেই দ্রুত উপরে উঠল সে। বি ২ ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে ক্ষণকাল দাঁড়িয়ে বেলটা টিপে দিলো সাহস করে। বুকটা ধুকপুক করছে তার। হঠাৎ মাথায় এলো যদি দিগন্তের বাবা থাকে! সর্বনাশ হবে তাহলে!
ফাগুনের মস্তিষ্ক বলল,
-‘এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো দরজা খোলার আগে।’
কিন্তু মন বলল,
-‘যা হবার দেখা যাবে। দিগন্ত কেন তার সাথে এমন করল সেটার একটা বিহিত হওয়া দরকার।’
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই দরজাটা হাঁট করে খুলে গেল। দীর্ঘ তিনদিন পর চোখের সামনে দিগন্ত! শর্টস পরনে, উন্মুক্ত বুক। ঘুম জড়ানো চোখজোড়া অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে। ফাগুনের চেপে রাখা কষ্টগুলো কখন যে চিবুক স্পর্শ করল, সে নিজেও টের পেল না। যখন টের পেল, চট করে চোখজোড়া মুছে নিয়ে মাথানিচু করে ফেলল। ভেজা গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-‘আপনি এমন কেন করলেন আমার সাথে?’
-‘তুমি এখানে কেন?’
পাল্টা প্রশ্নবাণ দিগন্তের। একটা হাত বাড়িয়ে প্রায় ছো মেরে ফাগুনকে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। ফাগুনের পিঠ বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেল। ভয়ে আর আড়ষ্টতায় জমে গেল মুহূর্তেই। দরজা আঁটকে ফাগুনের দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে ধমক মিশিয়ে দিগন্ত বলল,
-‘তুমি এখানে কেন এসেছো?কেউ দেখে ফেললে কী মনে করতো? মাথায় কোনো কমনসেন্স নেই!’
অপমানে চোখের পানির বেগ বাড়তে লাগল।
-‘না নেই। কোনো কমনসেন্স নেই। কেউ ভালোবাসায় ফেলে হুট করে হারিয়ে গেলে তখন মানুষের কোনো কমনসেন্স থাকেও না।’
সমান তালে প্রত্যুত্তর করে ফাগুনও।
-‘আমাকে ভালোবাসো তুমি? সত্যি?’
ঠান্ডা গলা, সেই ঘন গলার স্বর। ফাগুনের ভেতরটা কাঁপিয়ে তুললো। এবার আর পালালো না ফাগুন। নিজের অনুভূতি গুলোকে এড়িয়ে চলল না। মাথা নিচু রেখেই যতটা সম্ভব আস্তে করে বলল,
-‘বাসি।’
প্রায় ফিসফিস করে বললেও দিগন্ত শুনতে পেল। তার ঠোঁটের কোণায় অল্প একটু হাসি।
-‘এই স্বীকারটা করানোর জন্যই আমি হারিয়ে গেছিলাম মেয়ে।’
ফাগুন বাকরুদ্ধ, তার মুখ থেকে শোনার জন্য তিনদিন দূরে দূরে ছিল!
অবাক চেয়ে ফাগুন প্রশ্ন করল,
-‘যদি আমি স্বীকার না করতাম কোনোদিন?’
-‘তাহলে ভেবে নিতাম তোমার মনে আমি নাই। আর আগাতাম না তখন। একটা সাধারণ সাক্ষাৎ ভেবে এড়িয়ে যেতাম সবকিছুকে।’
-‘বাহ! কত স্বার্থপর আপনি। নিজের জন্য আমাকে এতটা কষ্ট দিলেন! ভালো।’
ফাগুন ভেজা কণ্ঠে অভিযোগ করল।
-‘দেখি সরুন, আমি বাড়ি যাবো।’
বলে দরজার দিকে এগোতেই থাবা মেরে তাকে নিজের বুকের খুব কাছে মিশিয়ে ধরল দিগন্ত।
মাদকভরা গলায় বলল,
-‘আসছো নিজের ইচ্ছায়, যাবা আমার ইচ্ছায়।’
-‘মানে কী!’
চোখ বড় ফাগুনের।
দিগন্ত বুঝতে পেরে তাকে ছেড়ে দিলো দ্রুত। তড়িঘড়ি করে বলল,
-‘প্লিজ নেগেটিভ মাইন্ডে নিও না।’
ফাগুনের মন খারাপ সরে গিয়ে এক মুঠো রোদ উঁকি দিচ্ছে মনের আকাশে। সে একটু দূরে সরে দুষ্টুমি নিয়ে কোমরে হাত চেঁপে বলল,
-‘আপনি আমাকে একা পেয়ে এভাবে যেতে ধরছিলেন কেন? আপনি এইরকম হবেন আমি ভাবতেও পারিনি ছিঃ!’
দিগন্ত হতভম্ব। বোকার মতো চেয়ে আছে। অপরাধী কণ্ঠে শুধালো,
-‘প্লিজ ভুল বুঝো না! প্লিজ! আমি আসলে অন্য কোনো মাইন্ডে তোমাকে…আচ্ছা আই এম সরি।’
চুপসানো মুখটা ফাগুনের পেটে খিল ধরায়। উচ্চশব্দে হেসে উঠে সে। দিগন্ত দ্রুত ওর মুখটা চেপে ধরে। মিনতি নিয়ে বলল,
-‘কেউ শুনলে গণধোলাই পড়বে। চুপ, প্লিজ!’
ফাগুন হাসি থামালো। দিগন্ত তখনো কাছে,খুব কাছে,ওর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফাগুনকে উষ্ণ করে তুলছে। ফাগুন সরে যাওয়ার জন্য মোচড় কাটলে দিগন্ত ছেড়ে দিলো। গম্ভীর ঘন স্বরে বলল,
-‘চলে যাও ফাগুন। কেউ দেখে ফেললে যা তা হবে।’
-‘আপনি আসবেন তো রোজ ছাদে?’
আকুতি মাখা প্রশ্ন। দিগন্ত নির্নিমেষ চেয়ে থেকে বলল,
-‘আসবো।’

ওদের ভালোবাসার গল্পটা শুরু হয়েছিল এভাবেই। তারপর কত দিন গড়ালো,মাস গড়ালো! প্রথম রিলেশনশিপ এনিভার্সারিটাও ওরা ছাদে উদযাপন করেছিল। কত সুন্দর সেইসব দিনগুলি! ফাগুনের আব্বু বা আম্মু কেউ টের না পেলেও মিলি ঠিক টের পেয়েছিল। ফাগুনও সব শেয়ার করেছিল আপার সাথে। ভেবেছিল আপা সবাইকে বলে দেবে। কিন্তু মিলি অবাক করে দিয়ে কাউকে কিছু বলেনি। বরং রোজ দিগন্তের ব্যাপারে এটাসেটা জানতে চাইতো ফাগুনের কাছে। ফাগুনও খুশি মনে বলে দিতো। কে জানতো, দুধকলা দিয়ে সে সাপ পুষতেছিল এতদিন!

বর্তমান…

ফাগুনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। মৃত্যু যতটা সহজ মনে হয়, আসলেই কী এতটাই সহজ? এই পৃথিবীতে আসতে যেমন কষ্ট ভোগ করতে হয়, এই পৃথিবী ছেড়ে যেতেও কষ্ট ভোগ করতে হয়। আফসোস, জন্মের কষ্টটা আমাদের মনে থাকে না। যদি থাকত তাহলে কেউ স্বেচ্ছায় সু’ই’সা’ইডের মতো ঘৃণিত অপশনটি চুজ করত না। যখন পেটের ভেতর হালকা জ্বালাপোড়া ভাব অনুভূত হলো, তখনো ফাগুন চুপচাপ শুয়ে রইলো। কিছু সেকেন্ড গড়াতেই যখন জ্বালাপোড়া ভাবটা তীব্র আকার ধারণ করে গলা,বুক,ফুসফুস ছুঁলো, তখন কা’টা মাছের মতো লাফাতে শুরু করল সে। মনে হলো,কেউ তার ভেতরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। মৃত্যু এত কষ্ট! সহ্য হলো না ফাগুনের। ছুটে রুম থেকে বেরিয়েই সোজা মিলি আপার ঘরে গেল। মিলি আপা তখনো পড়ছিল। তার সামনে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়তেই তিনি চমকে উঠে দাঁড়াল। ফাগুন হাসফাস করে বলল,
-‘হা..হাসপাতাল আপা। হাসপাতালে নাও আমাকে। আমি..’
কথা শেষ করতে পারল না। হাতে থাকা ওষুধের প্যাকেট টা ফেলে দিলো। মিলি আপা চিৎকার করে সবাইকে ডেকে তক্ষুনি ফাগুনকে নিয়ে ছুটল। এই প্রথম নিলুফার ছোট মেয়ের জন্য আয়োজন করে কাঁদতে বসলেন। ফাগুনের বাবার মুখ গম্ভীর। কত টাকা খরচ হবে সেই চিন্তায় নয়, তার মেয়েটা সুস্থ হবে কীনা এই চিন্তায় চিন্তিত তিনি। জীবন এমনই। যখন তুমি থাকবে কেউ তোমার মূল্য দেবে না। যখন তুমি চলে যাবে তখন সবাই বুঝতে শুরু করবে,কী হারালাম!

গলা দিয়ে পেট অবধি লম্বা নল ঢুকিয়ে পরিষ্কার করা হলো। সে যাত্রায় ফাগুন বেঁচে গেলেও শরীরের অবস্থা রফাদফা। ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় হাসপাতালের বেডে ম’রার মতো ঘুমিয়ে রইলো। সেই ঘুম ভাঙলো পরদিন বিকেলে। চোখ মেলে বেডের পাশে মিলি আপাকে আবিষ্কার করল ফাগুন। অস্ফুটস্বরে ডাকল,
-‘আপা..’
মিলি ঠা’স করে একটা চড় বসিয়ে দিলো। ফাগুন নিস্তব্ধ, মিলি দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠল। এই প্রথম ফাগুন বুঝল, তাকে সবাই ভালোবাসে। অনেক ভালোবাসে। সে এতদিন নির্বোধ ছিল, শাসনের আড়ালের ভালোবাসাটুকু বুঝতে পারেনি। ভাগ্যিস এত কাহিনি ঘটলো। নইলে বুঝি কোনোদিনই বুঝতে পারতো না। মিলি আপা কান্না থামিয়ে রাগী কণ্ঠে বলল,
-‘যে দিগন্তের জন্য তুই ম’রতে বসেছিস,তার আসল রূপটা আদৌও জানিস? তোকে…তোকে আরেকটা থা’প্প’ড় দিতে পারলে মন ভরতো আমার। দিগন্তই তোর সব? আমরা কেউ না? আমাদের কথা একবারও ভাবলি না? এতই যখন ম’রার শখ তখন আমাকে বলতি। আমি নিজেই গলা টিপে মেরে ফেলতাম তোকে।’
ফাগুন হেসে ফেলল।
মিলি বলে চলেছে,
-‘তোকে দিগন্ত ভালোবাসে না ফাগুন। কখনোই ভালোবাসেনি। ওর কাছে তুই টাইম পাস ছাড়া আর কিছুই ছিলি না। শুধু তুই-ই না,আরও অনেকের সাথেই ওর সম্পর্ক ছিল। এমনকি, আমার সাথেও..!’
ফাগুন চমকে উঠল। তার মুখের হাসি গায়েব, চোখজোড়া গোল গোল। মিলি আপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-‘দিগন্তকে আমি পছন্দ করতাম তোর আগে থেকে। কিন্তু কখনো নাম পরিচয় জানতে পারিনি। তোর থেকেই প্রথম ওর নাম জানলাম।এরপর ফেসবুকে ওকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন পেয়েও গেলাম। ততদিনে তোদের ভেতর সম্পর্ক শুরু হয়েছে, কিন্তু আমি জানতাম না। আমি রিকোয়েস্ট দিলাম। সে এক্সেপ্ট করে নিজে থেকে আমাকে নক করল। এক কথায় দুই কথায় তার প্রতি আমার দুর্বলতা প্রকাশ করলাম। সেও আমাকে ভালোবাসে এমন প্রতিশ্রুতি দিলো। এর চারদিন পর আমি জানতে পারি, তোর সাথে ওর সম্পর্ক!!আমি তোকে কিছুই বলিনি। ভার্সিটির শেষে ওর বাসায় যাই সাহস করে। ওর বাবা প্রায় সবসময়ই বাইরে থাকে। জানিসই তো। ওর সাথে চেঁচামেচি করি, কান্নাকাটি করি, তখন ও আমাকে বলে, তুই-ই নাকি ওর পেছনে ঘুরিস। ওর জন্য ম’রে যাবি। অনেক সিনক্রিয়েট করছিস। তাই তোকে স্বাভাবিক রাখতে ও এসব প্রেম ভালোবাসার কথা বলে। এর বেশি কিছুই না। আর সেদিন..ও আমার সাথে..আই মিন আমরা ইন্টিমেট হই।’

ফাগুনের দু’চোখে বন্যা তখন। সুপুরুষের আড়ালে এ কোন প’শুকে ভালোবেসে ছিল এতদিন!

-‘তারপর আর চেয়েও আর ফিরে আসতে পারিনি ওর থেকে। ও কথা দিয়েছিল, তোর সাথে আস্তে আস্তে বোঝাপড়া করবে। তুই-ই একসময় ওর থেকে সরে যাবি যখন দেখবি ওর অবহেলা তোকে ঘিরে। আর তখন আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। আমাকে বিয়ে করবে। সরি টু সে, আমি নিজেও স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম। তুই যেমন ওর প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছিলি, আমিও ওর প্রেমে অন্ধ ছিলাম। ও ক দিয়ে কলা বোঝালে আমি সেটাই বুঝে বসে থাকতাম। ও যে কী মায়া করেছিল আমার উপর, জানা নেই! অনেকবার ভেবেছিলাম তোকে সব খুলে বলি। কিন্তু তোর মন ভেঙে গেলে কী অবস্থা হবে সেইটা আঁচ করতে পেরে আমি চুপ ছিলাম। একবার বিয়ে হয়ে গেলে তুই আপনা আপনি সব মেনে নিবি, এমনটাই মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু তুই যে এতবড় স্টেপ নিবি, তা বিন্দুমাত্র ভাবনায় ছিল ন।’

ফাগুন নিস্তেজ গলায় বলল,
-‘দিগন্ত জানে?’
-‘কোন বিষয়ে?’
-‘এই যে, হাসপাতালে আমি।’
-‘হুম। বলছি। সব শুনে চুপ ছিল। কিছুই বলে নাই।’
ফাগুন আচানক কান্নায় ফেটে পড়ে বলল,
-‘আমি কেমনে একটা জা’নো’য়া’রকে আমার এত দামী ভালোবাসা দিলাম আপা? কেন একবারও বুঝিনি আমি! আমি এতটাই বোকা? এতটাই পাগল ছিলাম! ইশশিরে…’
মিলি দ্রুত ফাগুনকে চেপে ধরল।
তার নিজের চোখেও পানি। কতদিন বাদে দুই বোনের অনুভূতি এক হলো! এক বোন আরেক বোনের কষ্ট বুঝতে পারল! দুই বোন নিরবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে গেল। সাক্ষী রইলো হাসপাতালের সাদা দেয়াল গুলো।

দিগন্তের বাবা ফাগুন ও মিলির কাছে মাফ চাইতে এসেছে। দিগন্ত যখন মিলিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, তখন তিনি কোনো দিক বিবেচনা না করেই বিয়ের প্রস্তাব দেন উনি। মিলির বাবাও রাজী হন। সমাজের চোখে দিগন্ত লাখে একটা টাইপ ছেলে! এমন ছেলেকে জামাই হিসেবে কে না চাইবে?
ফাগুনকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়ার পরদিনই মিলি এই বিয়ে করবে না, জানিয়ে দিয়েছে। তার নিজের অন্ধ চোখও যেন খুলে গেছে। এতদিনের মায়া কেটে গেছে। ফাগুন নিজেও দিগন্তের সাথে সমস্ত যোগাযোগ, দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করে দিয়েছে। দিগন্ত বারবার দু’বোনের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে চেয়েছে। পারেনি।
দিগন্তের বাবাকে ফাগুন বলল,
-‘দোষ তো আপনার না আংকেল। আপনার সুপুত্র কে বলে দিবেন, আপনার মান সম্মানের কথা ভেবেই আমরা আইনী স্টেপ নেইনি কোনো। কিন্তু নেক্সট যদি কোনোদিনও আমাদের লাইফে ইন্টারফেয়ার করে তবে স্টেপ নিতে দ্বিতীয়বার ভাববো না।’
মিলিরও একই কথা। দিগন্তের বাবা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে চলে গেলেন।

বিকেলের দিকে ড্রয়িং রুম থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসতে লাগল। মিলি, ফাগুন, দুজনেই রুম থেকে বেরিয়ে তাজ্জব বনে গেল! দিগন্ত এসেছে!
দিগন্তকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। নিলুফার চেঁচিয়ে যাচ্ছে ওর সাথে। ফাগুনের বাবা বাসায় নেই। উনি থাকলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতেন বোধহয়। মিলি এগিয়ে গেল। নিলুফারকে বলল,
-‘মা,থামো। আসতে দাও ওকে। ওর যা বলার বলে দ্রুত কেটে পড়ুক। লোক হাসিয়ে লাভ নেই।’
নিলুফার রাগে গজগজ করে সরে দাঁড়ালেন। দিগন্ত ঢুকে ডিরেক্ট মিলির পায়ের উপর পড়ে গেল।
-‘আমাকে ক্ষমা করে দাও মিলি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও! আমি…আমি অনেক খারাপ জানি। কিন্তু তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছি। তুমি আমার সত্যিকারের প্রেম ছিলে মিলি। আমি আর কখনো এমন কিছু করব না প্রমিস। আমরা সবটা গুছিয়ে নেবো। তুমি চাইলে আবার আমাদের বিয়েটা হবে। প্লিজ মিলি, রাজী হয়ে যাও।’

মিলি গলা শক্ত করে সরে দাঁড়াল। পেছনে ফাগুন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। যাকে এতদিন ভালোবেসেছিল পাগলের মতোন, সে আজ অন্য কাউকে ভালোবাসি বলছে! বাহ…ফাগুন ভেতরের রুমে ঢুকে গেল। মিলি সেটা খেয়াল করে বলল,
-‘ক্ষমা করার আমি কেউ না। যদি কেউ ক্ষমা করে তবে সেটা ফাগুন। ওর সাথে যা করছো,সেটা ক্ষমার অযোগ্য, তবুও বলব ক্ষমা চাও ওর কাছে। ভাগ্য ভালো হলে ক্ষমা জুটতেও পারে। কিন্তু আমাকে পাওয়ার আশা ভুলে যাও। আমি তোমার মতো ছেলেকে ডিজার্ভ করি না।’

ফাগুন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। হালকা বাতাসে তার চুল উড়ছে। এই কয়দিনের ঝড়ে তার শরীর অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচ ডেবে গেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে,ঝড়ে আহত পাখি! দিগন্ত পা টিপে টিপে বারান্দায় ঢুকে ডাকল,
-‘ফা..ফাগুন।’
ফাগুন চট করে তাকাল। মুহূর্তেই ছোট্ট চেহারাটায় গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো। তারস্বরে বলল,
-‘এখানে কী? বের হন আপনি..আপনার সাহস তো কম না।’
-‘ফাগুন প্লিজ..! দেখো, মানুষ মাত্রই ভুল। আমিও ভুল করছি। এখন আমি অনুতপ্ত। আমাকে ক্ষমা করে দাও,প্লিজ!’
-‘ভুল? না জেনে করলে সেটাকে ভুল বলে। কেউ জেনে বুঝে করলে সেটা অপরাধ বলে। ভুলের ক্ষমা হয়, অপরাধের শাস্তি হয়। আপনারও শাস্তির প্রয়োজন। বের হন এখান থেকে। এই মুহূর্তে, নইলে..আমি কী করে বসব জানি না।’
দিগন্ত সরলো না। বেহায়ার মতো তবুও ‘ক্ষমা করে দাও,ক্ষমা করে দাও’ বলে বলে মুখে ফেনা তুলল। একসময় টিকতে না পেরে ফাগুন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল। দিগন্তের গালে নিজের পাঁচ আঙুলের ছাপ সজোরে বসিয়ে দিয়ে হিসহিস করে বলল,
-‘বের হ তুই। নইলে এক্ষুনি গলায় পাড়া দিয়ে দম বের করে ফেলব। যে কষ্ট তুই আমাকে দিছিস,তার ক্ষমা হয় না কোনো। যদি বিন্দুমাত্র সম্মানবোধ থাকে তবে চলে যা। পুলিশ ডাকি যদি, তখন কিন্তু আর যাওয়ার সুযোগ পাবি না।’
দিগন্ত স্তব্ধ। পুচকে একটা মেয়ে,তাকে কীনা থা’প্প’ড় মেরেছে! দিগন্ত আর কিছুই বলল না। চলে গেল ধুপধাপ শব্দ করে। ফাগুন চোখে জল নিয়েও হাসে। বাতাস ভরে নেয় ফুসফুসে। বিড়বিড় করে বলল,
-‘আমি নিজেকে ভালোবাসি। অবেলার প্রেম যদি আমার ভালো থাকাটুকু কেড়ে নেয়, তবে চাই না এমন ভালোবাসা। এমন অবেলার প্রেম অবেলাতেই শেষ হোক।’

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here