#অবান্তর_চিরকুট (পর্ব-২)
♡আরশিয়া জান্নাত
“Jindegi lambi nehi badi honi chahiye babu moshai” বলেই খিলখিলিয়ে হাসলো সিতারা।
তাঁর হাসির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন জহির সাহেব।
সিতারা তাঁর বাবাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে ততক্ষণে ট্রেনটি ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে চলছে সুদূর সিলেটে।
জহির সাহেব চিন্তিত চেহারায় ট্রেনের দিকে চেয়ে বাসার পথে হাঁটা দিলো।
কলোহলে পরিপূর্ণ ব্যস্ত নগরী ঢাকা ছেড়ে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ক’টা দিন প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার লোভে ঘরছাড়া হয়েছে সিতারা। পেছনে পড়ে থাক দমবন্ধ করা অপ্রাপ্তি আর ব্যর্থতার গল্প।
হবিগঞ্জ রেলস্টেশনে সেই কখন থেকে পায়চারি করছেন কবির সাহেব। তাঁর একমাত্র ভাগ্নি এই প্রথম একা একা সিলেট আসছে,আগে বললেই পারতো তিনি নিজে গিয়ে নিয়ে আসতো তাঁকে।টেনশনে একটু পরপর কল করে খবর রাখছেন তিনি। একটু পরেই বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন থামলো।সিতারা ব্যাগপত্র নিয়ে নেমে সেই চিরচেনা বুকস্টলের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর মামা কবিরকে কল করলো।কবির সিতারাকে দেখতে পেয়ে হন্যি হয়ে এসে বললো,পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো? পাশের সিটের পেসেঞ্জার কে ছিল?ছেলে নাকি মেয়ে?কোনো ডিস্টার্ব করে নি তো?
সিতারা হাসতে হাসতে বললো,মামু ফোনে কতবার জিজ্ঞাসা করেছ এই কথা জানো?আমি এখন ছোট্ট খুকী নেই তো গ্র্যাজুয়েট কমপ্লিট করা এডাল্ট পার্সন।এখনো যদি একা চলতে না পারি কি বড় হলাম?
–আমাদের জন্য তুই এখনো ছোট্ট খুকী।যতোদিন বেঁচে আছি খুকীর মতোই ট্রিট করবো।এখন চল তাড়াতাড়ি সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
সিতারা এক পাও নড়লো না।স্টলের সামনেই দাঁড়িয়ে রইলোই।
কবির সাহেব তাঁর ইশারা বুঝতে পেরে বললো,নে কোন বইটা নিবি।আমিতো ভুলেই গেছিলাম আম্মাজানের এইখান থেকে বই না নিলে চলবেনা।
সিতারা উৎচ্ছাসিত ভঙ্গিতে একটা বই নিলো।
তারপর গল্প করতে করতে মামারবাড়ি চললো।
হানিফা বেগম আজ মহাব্যস্ত।বৌদের ডেকে রান্নার তদারকি করছেন,কি কি রান্না হলো উপরের ঘরটা পরিষ্কার করানো হয়েছে কিনা ইত্যাদি।ইসমা দাদীর এই উত্তেজনা দেখে টিপ্পনী কেটে বলল,হুহ সব আদর তোমার মেয়ের ঘরের নাতনীর জন্য।আমরা কাছে থাকি তো দাম নেই।
হানিফা ওর কান মলে বললো,কাছে রেখে যে এতো আদর করি ওটা চোখে পড়েনা হতচ্ছাড়ি?অল্প ক’দিনের জন্য আসে তাঁর বেলা এতো হিংসা তোর?
ইসমা হেসে বললো,এখন তো আমায় হিঃসুক মনে হবেই।কিন্তু দাদু একটা ব্যাপার বুঝলাম না এবার সিতারা আপু একা একা আসছে কেন?কখনো তো এভাবে আসেনা।কোনো সমস্যা হলো নাকি??
হানিফা বেগম নিজেও এ নিয়ে চিন্তিত তবুও সামলে বললেন,একা একা চলা শিখতে হইবো না?মনে হয় বাকি সবাই ব্যস্ত।
–আস্সালামু আলাইকুম এভ্রিওয়ান।হেই সুন্দরী দিনদিন এতো গ্লো করছো কেন?নানাজান তো কবরে গিয়েও শান্তি পাচ্ছেনা।(নানুর গলা জড়িয়ে বললো সিতারা)
–পাজি মাইয়া।কেমন আছিস সেইডা ক বাসার সবাই ভালো?
–আছে সবাই ভালো আমিতো বেশি ভালো।
বড় মামী– রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয় নি তো?
–নাহ কোনো অসুবিধা হয়নি। ওয়াও মামী তোমার চুলগুলো তো বেশ ঝলমল করছে কি ইউজ করো?
বড় মামা–হবেই তো কিসব মশলাপাতি দিয়ে রাখে মাথায়! এসেছিস তো দেখবি সব এই বয়সেও তাঁর রূপচর্চা কমে নাই।
বড় মামী– এই বয়স মানে কি? তুমি বুড়ো হয়েছ আমি না।
–একদম ঠিক! আমার মামীরা সব এভার গ্রীণ।
ছোটমামী এসে হাত ধরে সোফায় বসিয়ে বললো,তুই এমন রোগা হয়েছিস কেন?শরীরের সব হাঁড় যেন বেরিয়ে আসছে!!
সিতারা–ইসমা জুলোজি নিলো শুনলাম তাই ওর নমুনা হয়ে এসেছি। ঐ ইসমা আমারে দেখে হাঁড়ের নাম মুখস্থ করতে পারবিনা?দেখি বলতো মানবদেহের সবচেয়ে বড় হাঁড়ের নাম কি?
ইসমা– বলতে পারলে কি দিবা?
–বলতে পারলে আমি তোকে চুমু দিবো।জানিস তো সিতারার চুমু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
ইসমা– ওলে বাবালে,,,
সবার সাথে টুকটাক আলাপ করে সিতারা ফ্রেশ হতে গেল।এর মাঝে বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিল পৌঁছানোর খবর।
সিতারার মা সুফিয়া আহমেদ মুখ ভার করে বসে আছেন।কবির সাহেব রুমে ঢুকে বেডের একপাশে বসে বললেন,এমন মন খারাপ করে বসে থেকোনা।যা হয় ভালোর জন্যই হয়,ধৈর্য ধরো।
সুফিয়া উত্তেজিত গলায় বললেন,আমায় শান্ত থাকতে বলছো?আমার মেয়ের সাথে এতোবড় একটা ঘটনা ঘটলো আর আমি মা হয়ে মন ভালো করে বসে থাকবো?
–আমাদের রিয়েকশন দেখেই মেয়েটা সিলেট গেছে সুফি।ও ভাবছে ও এখানে থাকলে আমরা ভালো থাকবোনা।এই দুঃসময়ে মেয়েটাকে মনমতো কাঁদতেও দিলেনা তুমি।
সুফিয়া আর কিছুই বললোনা।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সিতারা,ইসমা,ফাইজা,নাফিজ হাঁটতে বের হলো। গা হিম করা শীতে কুয়াশার ঘন আবরণ পেরিয়ে চার ভাইবোন গল্প করতে করতে অনেকটা পথ হেঁটে গেল। শীতে সিলেট আসার মজাই আলাদা। সকালে এমন হাঁটতে বের হওয়া যায়, সাথে ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো। ঢাকায় শীত মানেই কম্বলের নীচে পড়ে থাকা। ইট পাথরের দেয়ালের ভীড়ে শীত তেমন একটা গায়ে লাগেনা। অবশ্য বাইরের চিত্র ভিন্ন।
খোয়াই নদীর পাড়ে বসতেই সিতারা বললো,যা তো নাফিজ ননীগোপালের দোকান থেকে চা নিয়ে আয়। বেশি করে মালাই দিতে বলবি।
নাফিজ চা আর বিস্কুট নিয়ে এলো।
সূর্য্যিমামা তাঁর মিষ্টি রোদ্দুর ছড়িয়ে বেশ খানিকটা উপরে উঠেছে। রোদের তাপে শিশির গলে চুইয়ে পড়ছে,নদীর পাড়ের ধমকা বাতাসে শরীর কেমন কাপুনী দিয়ে উঠে।
ফাইজা–আপু তুমি আসলে আমার এজন্য অনেক ভালো লাগে। রোজ সকালে গল্প করতে করতে কত জায়গায় বেড়ানো যায়। অন্য সময় আপু ভাইয়ারা তো আসতেই চায় না।
ইসমা– মিথ্যুক সেদিন ও তো আনলাম তোকে?
ফাইজা–সেদিন বললেও এক সপ্তাহের উপরে।
নাফিজ– আপুর সাথে এতো পথ হাঁটতেও কষ্ট লাগেনা।তোরা দুইটা সারাদিন ঝগড়া করোস তোদের নিয়ে আসতে গেলে রিকশাভাড়া যায় খালি,সেজন্য আনিনা।
ইসমা– হ তোরা তো আপুর ভক্ত।আমারে তোদের কারোই ভাল্লাগেনা।
সিতারা– তোকে ভাল্লাগেনা কে বলছে।ওরা তোকেও অনেক ভালোবাসে।মেহমান হয়ে আসি তো তাই আমার প্রতি ওদের আকর্ষণ বেশি।
ফাইজা মনে মনে বললো,উহু আপু মেহমান বলে না।তোমাকে আমি এমনিতেও অনেক ভালোবাসি।
____________
–হ্যালো ইপ্সিতা
–হুম বল
–রাফসান কোথায় আছে জানিস কিছু?
— নাহ কেন? এই সাফা তুই ব্যাক করছিস উনার কাছে?যাক তোর বুদ্ধি হলো তাহলে।
–আরেহ না। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছি কত আগে কিন্তু ওখানে কেউ নেই। এদিকে সোহেল তাড়া দিচ্ছে। ডিভোর্সটা হলেই আমরা কোর্ট ম্যারেজ করে নিতাম
–ওহ তাহলে সোহেলকে বিয়ে করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস!
— এ কেমন কথা ওকে ভালোবাসি তো বিয়ে করবোনা?
–হু সেটাই। রাফসান ভাইয়ের সাথে আমার লাস্ট কথা হয়েছে দুই মাস আগে। আমি জানিনা উনি কোথায় আর ফোনেও পাওয়া যাচ্ছেনা।
–ভং ধরেছে। নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে পালিয়েছে, পারে আর কি এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া। গেল যখন ডিভোর্সটা দিয়েই যেত। অযথা ঝুলিয়ে গেল কেন? উফফ ডিসগাস্টিং!
ইপ্সিতা ফোন রেখে দিলো। এই মেয়ের কথা শুনতেও তার বিরক্ত লাগে। সাফা তো আগে এমন ছিল না। কত মিষ্টি একটা মেয়ে ছিল রাফসান বলতেই পাগল টাইপ। কি এমন হলো যে সব ভালোবাসা কর্পূরের মতো উবে গেল?! মানবমন বোঝা সত্যিই বড় দায়।
সবার সঙ্গে হাসি আনন্দে বেশ কাটছে সিতারার দিন।মামার বাড়ি মধুর হাঁড়ি,কথাটা আসলেই সত্যি।রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ফোন হাতে নিতেই সিতারার বুকটা ধ্বক করে উঠলো।তাহজিবের চারটা মিসড কল! এতোদিন পর হঠাৎ সে কেন ফোন করলো?
চলবে,,,