অবান্তর_চিরকুট,পর্ব-3,04

#অবান্তর_চিরকুট,পর্ব-3,04
♡আরশিয়া জান্নাত
03

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটা কলোনী, রোজ বিকেলে এক ঝাঁক বাচ্চারা উঠোনে খেলাধুলা করে। এ সময়টায় রাফসান দোতলার বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে তাদের দেখে। কত দুষ্টুমি হৈ হুল্লোড়,কখনো বা ঝগড়া মারামারি এসব দেখে আনমনেই হেসে উঠে সে। জীবনটা তাদের কত সহজ হিসাবেই না চলছে! জীবনের বাস্তবতা আঁচ করার বয়স এখনো হয়নি বলেই হয়তো এমন প্রাণোবন্ত। অথচ এই বয়সেই রাফসান এতিম হয়েছিল। দস্যিপনার বয়সে অগ্নিকাণ্ডে বাবা-মাকে হারিয়ে একদম অনাথ হয়ে গিয়েছিল।
বারো বছর বয়সে বুঝেছিল এই পৃথিবীতে ওর কেউ নেই। রাফসানের বাবা ছিল একজন মোদি ব্যবসায়ী। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হবার সুবাদে আত্মীয় বলতে তেমন কেউই ছিল না। মায়ের অবশ্য দুই ভাই ছিল সুদূর কুষ্টিয়ায়। সেখানেও তেমন যোগাযোগ নেই, এতিম ছেলেটার দায়িত্ব নেবে এমন কেউই ছিল না আশেপাশে। তার উপর ঘরের সবকিছু আগুনে পুড়ে ছাই, কারো সঙ্গে যোগাযোগ করবে তেমন কোনো মাধ্যমই পাওয়া গেল না। এলাকার মানুষ অনেক ভেবেচিন্তে তাকে এতিমখানায় রেখে আসে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন এক মহিলা তার সন্ধানে আসে, তাঁর সেই দূরসম্পর্কের ফুফু আফিয়া। এই নিষ্ঠুর দুনিয়াতে পরমাত্মীয় হয়ে। যদিও নিজের সংসারে নেওয়ার জো ছিল না তার, তবুও প্রায় এসে খোঁজখবর নিতেন এটাসেটা কিনে দিয়ে যেতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন করে খরচ চালানো,অসুখে পড়লে একটা স্নেহের পরশের অভাব কত যন্ত্রণা দিয়েছে বলে শেষ করা যাবেনা। দিনশেষে ঘরে ফিরে যখন বাবা মায়ের অভাববোধ হতো রাফসান বেড়িয়ে পড়তো শহরের পথে। যেখানে একাকিত্ব নেই, ঘুমন্ত শহরের অলিতেগলিতে ঘুরে বেড়ানোতে কিছু হারানোর ভয় নেই। কি হারাবে? জীবন ছাড়া আর কি ই বা আছে তার হারানোর জন্য? মানুষ না খেয়েও হয়তো কিছুদিন বাঁচতে পারে, কিন্তু একাকী জীবনে বাঁচতে পারেনা। রাফসান কিভাবে বেঁচে ছিল কে জানে!

বান্দরবান আসার আজ প্রায় তিনমাস হলো, তার বহু পুরোনো স্কুলফ্রেন্ড মংশানু এখানের স্থায়ী বাসিন্দা। এখানে এসে অবশ্য বেকার বসে থাকেনি, পাশের স্কুলে অস্থায়ী টিচার হিসেবে ক্লাস নিচ্ছে।
পাহাড়ী অঞ্চলে খাপ খাওয়াতে প্রথম প্রথম তার খুব কষ্ট হয়েছিল। অসমতল রাস্তা,পাহাড়ের এলোপাথাড়ি পথ মারিয়ে চলাফেরা সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাহীন। এখন অবশ্য অনেকটা অভ্যাস হয়েছে। অনেক ভেবে ঠিক করলো ঢাকায় ব্যাক করবে, সাফা নিশ্চয়ই ডিভোর্সের জন্য মরিয়া হয়ে আছে। তাকে সে মুক্তি দেবে, আটকে রাখবেনা। এই কঠিন বাস্তবতা মেনে নিতে তার তিন মাস সময় লেগেছে, তাও মন এখনো পুরোপুরি শক্ত হতে পারেনি। সাফা তাকে ছেড়ে দিচ্ছে ভাবলেই চোখভরে আসে। কথায় বলে একা চলা মানুষ আজীবন একা চলতে পারে, তবে মাঝে কেউ সঙ্গী হলে বাকীপথ আর একা চলতে পারেনা। খুব কষ্ট হয়। রাফসানের জীবনের পাঁচটা বছর সে সাফার সঙ্গে কাটিয়েছে। এই পাঁচ বছরের স্মৃতি বুকে নিয়েই নাহয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে।
______________

ফোন হাতে নিয়েই বিধ্বস্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সিতারা। তাহজীব তাকে ফোন করেছে, কেন করেছে! এখন তো সব শেষ তবে কিসের জন্য কল করলো?
ফোনের রিংটোনে চমকে উঠলো সিতারা। নামটা এখনো জ্বলজ্বল করছে, কলটা রিসিভ করে কানে তুলতেই তাহজীব ঝরঝরে গলায় বললো, যাক বাবা কলটা ধরলে অবশেষে। আমি তো ভেবেছি এখনো রিসিভ হবেনা।
সিতারা স্বাভাবিক গলায় বললো, কেন ফোন করেছেন?
— স্ট্রেট ফরওয়ার্ড বলতে হবে দেখছি! একটু ফর্মালিটি মেইনটেইন করে কেমন আছ জিজ্ঞাসা করার সুযোগ দিলেনা। এনিওয়ে কল করেছি ইনভাইট করতে, আফটার অল তুমি আমার একমাত্র মামাতো বোন। তোমাকে ইনভাইট না করলে চলে? শোনো যেখানে গিয়েই লুকিয়ে থাকোনা কেন আমার বিয়েতে তোমায় প্রেজেন্ট থাকতেই হবে।
— অবশ্যই থাকবো ভাইয়া। আপনার বিয়েতে আমি থাকবো না এ হতে পারে নাকি? ভাইয়ের প্রতি তার একমাত্র বোনের দায়িত্ব আপনাকে শেখাতে হবেনা, আমি খুব ভালো করেই জানি। আর আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ কষ্ট করে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। বোঝেন ই তো আমি মহাব্যস্ত মানুষ। এসব ছোটখাটো ইভেন্টের কথা মাথায় থাকেনা।
— তাঁরা তুই সত্যিই আসবি?
তাহজীবের কথা শুনে সিতারার চোখের পানি আটকানো গেল না, গলা সমান কান্না আটকে স্বাভাবিক গলায় কথা বলার ক্ষমতা তার যে অনেক বেশি সে আজ আবারো প্রমাণ করলো। অকপট গলায় বললো, অবশ্যই আসবো। শুধু যে আসবো তা নয় অনেক হৈ হুল্লোড় করবো, সবাই চেয়ে দেখবে ভাইয়ের বিয়েতে কিভাবে আনন্দ করতে হয়। আমি এখন খুব ব্যস্ত আছি আর কিছু বলার আছে আপনার?
তাহজীব রাগের চোটে ফোন ছুড়ে মারলো ফ্লোরে।
মুহুর্তেই চোখ রক্তিমবর্ণ ধারণ করলো, রাগে চিৎকার করে বললো, এতো শক্ত কেন তুই তাঁরা! তোকে আমার পাথুরেমূর্তি মনে হয়। তোর মনে আমার জন্য ভালোবাসা তো দূর একটু করুণাও নেই। I hate you so much Tara…

কল কেটে যেতেই বুঝতে বাকি রইলোনা এই ফোনটাও গেছে। এতো রাগ এই মানুষটার, মাঝেমধ্যে সামলানো যায়না। সিতারা হাঁটু ভাঁজ করে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। কি দরকার ছিল কল করার। সে তো ভালোই ছিল এতোদিন, কেন অযথা ফোন করে দূর্বল করতে আসে? বোন লাগি আমি তার! একমাত্র মামাতো বোন। হাহাহা
এবার আপনাকে আমি বোঝাবো মিস্টার তাহজীব সিতারার মন কতোটা শক্ত। আপনি যেই সিতারাকে ইচ্ছেমতো কাঁদিয়েছেন তাকে আর সেই রূপে কখনোই ফেরত পাবেন না।

রৌদ্রোজ্জল সকালে সকলকে বিদায় জানিয়ে ঢাকায় ফিরছে রাফসান। অল্প ক’দিনে অনেকের সঙ্গেই বেশ সখ্যতা তৈরি হয়েছে তার। এদের ছেড়ে যেতে কিছুটা মন খারাপ লাগছে বটে। সাফার ব্যাপারটা মিটমাট করে ভবঘুরে হয়ে যাবে, একেকবার একেক শহরে বসবাস করে কাটিয়ে দেবে এমনটাই পরিকল্পনা তার। পিছুটানহীন মানুষের কোনো সমস্যা নেই, এই বিশাল পৃথিবীর প্রকৃতিই তার জন্য অনাবিল সুখ নিয়ে বসে আছে। যা ঘুরে দেখার মাঝেও আনন্দ আছে। এই আনন্দের সন্ধান সে পেয়েছে বান্দরবান এসে। “যাঁর কেউ নেই তার আল্লাহ আছে” এই কথাটা সবসময় আফিয়া ফুফু বলতো। এটা রাফসান মনেপ্রাণে বিশ্বাস ও করে। আসলেই তো ঐটুকু বয়সে যে ছেলেটা স্ট্র্যাগল করে আল্লাহর রহমতে বেঁচে থাকতে পেরেছে, সে এখন স্বাবলম্বী হয়ে একা বেঁচে থাকতে ভয় পাবে? মোটেও না। জীবন নামক এই যুদ্ধটা সে আবারো একাই লড়বে।
মনে মনে নিজেকে হাজারটা অনুপ্রেরণা দিলেও ঘুরেফিরে সাফার স্মৃতিই ভেসে উঠে মানসপটে।
এই যেন সেদিনকার গল্প, প্রথমবার ভাত রাঁধতে গিয়ে কিভাবে হাত পুড়িয়েছিল সাফা। রাফসান নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছিল আর আবেগে চোখের পানিতে ভেসে হাসিমুখে খাচ্ছিলো সাফা।
রাতে নাকি তাঁর বুকে মাথা না রাখলে ঘুমই আসতোনা। অথচ সে এখন দিব্যি আছে তাকে ছাড়া। কত রাত বুক খাঁ খাঁ করতো সাফার অভাবে, পাশের বালিশে বেঘোরে ঘুমানো মেয়েটাকে মনে হতো দূরের নীল নক্ষত্র। যাকে দেখা যায় ছোঁয়া যায়না। একই ছাদের নীচে থেকেও তাদের মাঝে সহস্র মাইলের দূরত্ব। কেন এলো এই পরিবর্তন? তবে কি ভালোবাসার কমতি ছিল? নাকি অন্য কিছু!
যে মেয়েটা দিনে কয়েকবার ফোন করে খোঁজ নিতো সে দিনশেষে ভুলেও জিজ্ঞাসা করেনা, দুপুরে খেয়েছিলে তো?
আগের মতো টিফিন প্যাক করার সময় কই? সেও যে নামী কর্পোরেট অফিসের মেম্বার। তার ব্যস্ততা রাফসানের চেয়ে হাজারগুণ বেশি। অবশ্য বিকেল পাঁচটায় ছুটির পর সে কার সঙ্গে কফিশপে যায় তা তার অজানা ছিল না। কতদিন অফিস শেষে সাফাকে রিসিভ করতে গিয়েছে সে খবর সাফা জানেনি কখনো। রাফসান শুধু নিরবে দেখছিল রংধনুর সাতটি রঙে রাঙিয়ে কেমন ডানা জাপটে উড়ছিল তার সাধের ময়নাপাখিটা,,,,

চলবে,

#অবান্তর_চিরকুট (পর্ব-4)

♡আরশিয়া জান্নাত

“আস্সালামু আলাইকুম চাচা। কেমন আছেন?”

“ওয়ালাইকুম আস্সালাম, আরেহ রাফসান যে! কোথায় ছিলে এতোদিন? শরীর স্বাস্থ্য ভালো তো?”

“জ্বি চাচা ভালো আছি। আপনি ঠিক আছেন তো? আমার খোঁজে কেউ এসেছিল?”

“এইতো রাখছে আল্লাহ কোনোরকম। বৌমা আসছিল এক সপ্তাহ আগে। তোমার খোঁজখবর নিলো, কি ব্যাপার ঝগড়াঝাটি হইছে নাকি?”

“না তেমন কিছুনা, কিছুদিন একা থাকার ইচ্ছে হইছিল, তাই আর কি। আচ্ছা চাচা যাই খুব ক্লান্ত লাগতেছে।”

“দেখো কান্ড সেইদিকে আমার খেয়াল ই নাই। যাও যাও বিশ্রাম নাও।”

রাফসান সিঁড়ি ধিঙ্গিয়ে তার ফ্লাটে ঢুকলো। দরজা খুলতেই মনে হলো সাফার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সেই চিরচেনা অস্তিত্বের উপলব্ধি। এখুনি বুঝি এসে বলবে, এই ফিরেছো তুমি! ঘড়িতে ক’টা বাজে দেখেছ? যাও চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নাও তোমার প্রিয় শুটকির ভর্তা করেছি।
বেডরুমে বড় করে বাঁধানো বিয়ের ছবিটাতে চোখ পড়তেই আনমনে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। শাওয়ার নিয়ে বের হতে ডোরবেল বাজলো। কিছুটা অবাক হয়েই দরজা খুলতেই দেখে সাদেক চাচা তার ছোট ছেলেকে দিয়ে খাবার পাঠিয়েছেন। এই মানুষটা পারেন বটে!
খাবার খেয়ে রাফসান তাঁর কলিগ আফজাল ভাইকে কল করলো লয়্যারের সন্ধানে। সাফা যেহেতু মিউচুয়াল ডিভোর্স চাইছে রাফসানের কিছুই বলার নেই। হয়তো এন্টিমনি চাইতেও এখন তার ইগোতে বাঁধে।

ইসমা– সত্যি করে বলোতো আপু তাহজীব ভাই সত্যিই অন্য কোথাও বিয়ে করছে!
সিতারা ছাদে কাপড় মেলতে মেলতে বললো, এখানে মিথ্যে বলার কি আছে? তাঁর বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে করছে। অবাক হবার কি আছে?
ইসমা সিতারার দুই কাঁধ ধরে থামিয়ে বললো, মানে কি এসবের তোমরা না দুজন দুজনকে ভালোবাসো? এখন অন্য কোথাও বিয়ে করবে কেন? তাহজীব ভাইয়া কিভাবে এটা হতে দিচ্ছে?
সিতারা শান্তস্বরে বললো, মেয়েটা তাহজীব নিজে পছন্দ করেছে ইসমা! শুধু তাই নয় ফুপ্পী যখন বিয়ের আলাপ নিয়ে এসেছিল তখন সে-ই সকলের সামনে বলেছে আমাকে সে বোন ছাড়া কিছুই ভাবেনা। আত্মীয়র মধ্যে বিয়ে করার ইচ্ছেই নেই তাঁর।
ইসমা রেগে বললো, প্রেম করার সময় এসব মনে ছিল না? বিয়ের কথা উঠতেই বোন হয়ে গেলে!! স্ট্রেইঞ্জ! তুমি কিছু বলোনি?

“আমি কি বলবো ইসমা? আমাদের রিলেশনটা তো ওপেন সিক্রেট ছিল। মা-বাবা, ফুপী সবাই ই তো গেস করে রেখেছিল আমরা একসঙ্গে আছি। তাই তো পারিবারিকভাবে সব হচ্ছিল কিন্তু ,,,,,,,”

“তুমি উনার নাক ফাটালে না কেন? আমি থাকলে নিশ্চিত রক্তারক্তি হয়ে যেত। তবে কি সে কেবল তোমার ইমোশন নিয়ে খেলা করছিল এতো বছর! কেউ প্রপোজ করলে তাঁকে মেরে হসপিটালে পাঠানো, কোনো ওকেশনে সেজেগুজে বের হতে না দেওয়া, কোনো ছেলের সাথে বন্ধুত্ব তো দূর ফেসবুকে পর্যন্ত এড করতে না দেওয়া। এতো এতো পজেজিবনেস এখন ফুড়ুৎ??”

“বাদ দে না। সে যা ইচ্ছে করুক গিয়ে হু কেয়ার্স?”

“ইউ কেয়ার্স আপু। এজন্য এমন শুকিয়েছ তাইনা? এতোদিন বুঝতেও দিলেনা। তাইতো বলি এবার আসার পর একবারো কেন ফোনে কথা বলতে দেখলাম না। আপু শোনো তুমি উনার বিয়ে এটেন্ড করবেনা। অযথা কষ্ট পাওয়ার কোনো দরকার নেই। তোমার এখন ঢাকা যাওয়ারও দরকার নেই এখানেই থাকো।”

সিতারা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বললো, তুই কি চাস তোর বোন কারো সামনে আজীবন দূর্বল হয়ে থাকুক? কেউ একজন এই ভেবে পৈশাচিক আনন্দ পাক যে তাঁকে অন্যের হতে দেখার ক্ষমতা আমার নেই? শোন ইসমা আমি উনার বিয়েতে যাবো, উনার প্রত্যেকটা আচার অনুষ্ঠানে আমি থাকবো। ইভেন তার বাসরঘরটা পর্যন্ত আমি সাজাবো। সে কি ভেবেছে সবসময়ের মতো এবারো আমি তার সামনে কান্নাকাটি করে আকুতিমিনতি করবো? একটা মানুষ সবসময় নত হয়ে থাকতে পারেনা, আত্মসম্মানবোধ নষ্ট করতে করতে আজ আমার নিজেকে তুচ্ছ কীট মনে হয়।

“কিন্তু আপু তোমার কষ্ট হবে। আমিতো দেখেছি তুমি কতোটা ভালোবাসো উনাকে। মুখে যতোই বলো সামলাতে পারবেনা। অযথা সেখানে যাওয়ার দরকার নেই।”

সিতারা হাসতে হাসতে কান্না করে দিলো, চিৎকার করে বললো, তোরা সবাই আমাকে ননীর পুতুল ভাবিস। সবাই মানে সবাই, আমার মা-বাবা, তাহজীব, এমনকি তুই ও। সবাই ভাবিস আমি খুব উইক, আমি নিজেকে সামলাতে পারবোনা, আমার এখন নিজেকে অসহ্য লাগে। নিজেকে এমন দূর্বল ভাবতে ভালো লাগেনা ইসমা। এবার আমি দেখাবো আমি কতটা শক্ত তুই দেখিস।

ইসমা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো গলায় বললো, আপু তুই উইক না, তোর মনে ভালোবাসা বেশি। এমন নরম মনের অধিকারী সবাই হয়না। দেখিস তোর জীবনে এমন একজন আসবে যে তোকে এই দিকটার জন্যই অনেক অনেক ভালোবাসবে।
_____________

কোর্ট থেকে বের হয়ে রাফসান হাসিমুখে বললো, Congratulation Safa! এখন নিশ্চিন্তে প্রিয় মানুষের সঙ্গে সুখের সংসার বাঁধো। Wish u a very very happy married life.

সাফা হেসে বললো, Thank u .

সাফার চোখেমুখে উচ্ছাস দেখে যদিও রাফসানের বুক ভেঙে আসছিল, সোহেলের সঙ্গে কি সুন্দর হাত জড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছিল সে! এই দৃশ্যও দেখতে হলো তাকে?
ইপ্সিতা রাফসানের পাশে দাঁড়িয়ে বললো, এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হবেনা দেখবেন। ও যে মোহে হারিয়েছে খুব শীঘ্রই তা কেটে যাবে। তখন আপনার কাছেই ফেরত আসবে।

“না না ইপ্সিতা এমন কিছু বলোনা। আমি চাই আমার কাছে আর ফিরে না আসুক। ও যেন সুখী হয় সেই কামনা করি। আমি অন্তত ওর খারাপ চাইবোনা।”

“ভাইয়া আপনি কি একবার আঙ্কেলের সঙ্গে দেখা করবেন? তিনি বারবার আপনার খোঁজ নিচ্ছিল। লজ্জায় আসতে পারছেন না। সাফাতো সেখানে ভুলেও যায় না। বাবা-মাকে পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছে।”

“যাবো সুযোগ করে। আপাতত কিছুদিন ব্যস্ত আছি। আচ্ছা যাই ভালো থেকো।”

হাঁটতে হাঁটতে কতোটা দূর চলে এসেছে হুশ নেই রাফসানের।

“ওহ হ্যালো মিস্টার একটু হেল্প প্লিজ।”

রাফসান চারদিকে তাকাতেই সে বললো, আরেহ আপনাকেই বলছি। উপরের বক্সটা একটু ধরেন প্লিজ আমি ব্যালেন্স করতে পারছিনা।

রাফসান বোকার মতো উপরের বক্স দুটো নিলো।
কিছুটা বিরক্তস্বরে বললো, এমন ভারী বাক্স হাতে নিয়ে একা ঘুরছেন কেন? সঙ্গে কাউকে আনতে পারেননি? এই হলো আপনাদের মেয়েদের সমস্যা সবকিছুতে একাই একশো মনোভাব!

সিতারা একগাদা বক্সের ডানপাশে মাথা হেলিয়ে তাকাতেই রাফসান থমকে গেল। মেয়েটার কপালজুড়ে এলোমেলো সিল্কি চুলগুলো মৃদুবাতাসে উড়ছে, চোখের কাজল লেপ্টে গেছে, নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম, চেহারায় রাজ্যের ব্যস্ততা। ইষৎ হলদে বর্ণের এমন সুন্দর মেয়ে সে আগে দেখেছে কি না কে জানে!

“শুনুন জনাব সবকিছুতে নারীবাদী টপিক তুলে আনেন কেন হু? কে বলেছে আমরা সবাই একাই একশো ভাবি নিজেকে? নারীবাদী যেমন ভালোনা নারীবিদ্বেষীও কিন্তু ভালোনা। হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে আমার সাথে ভাই এসেছিল, হঠাৎ সে কোথায় হারিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। আর বক্সগুলো এলোপাথাড়ি হয়ে গেছে বলেই হেল্প চেয়েছি ,কাউকে ফোন পর্যন্ত করতে পারছিলাম না। কিন্তু কে জানতো হেল্প চাইলে আপনি এতো কথা শুনিয়ে দেবেন?”

রাফসান দৃষ্টি এড়িয়ে বললো, দুঃখিত আমি বুঝতে পারিনি। আর শুনুন বুদ্ধি থাকলে খেটে মরতে হয় না। আপনার পেছনের বেঞ্চিতে সব রাখলেই পারতেন।

সিতারা জিভ কামড়ে হেসে বললো, দেখেছেন এই সিম্পল বুদ্ধিটা মাথায়ই আসেনি,হিহিহি। থ্যাঙ্কস মি. ?

“রাফসান”

“ওহ। আমি সিতারা”

“আচ্ছা”

“শুধু আচ্ছা! নামটা সুন্দর না?”

রাফসান অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। সিতারা ইতস্ততবোধ করে বললো, আসলে একটা প্রাইভেট বিপদে পড়েছি। তাই আর কি,,,,,

“কি বিপদ?”

সিতারা চোখ বুজে কাঁচুমাচু হয়ে বললো,
“I’ve to go to washroom. প্লিজ এগুলো একটু পাহারা দিন। আমি পাঁচ মিনিটে যাবো আর আসবো।”

রাফসানের জবাবের অপেক্ষা না করেই সিতারা দৌড়ে কোথায় যেন চলে গেল।
এরকম অচেনা লোকের দায়িত্বে কেউ এতোগুলো জিনিস ফেলে যায়? তাও এই জাদুর শহরে! মেয়েটা অদ্ভুত তো!!!

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here