অবান্তর_চিরকুট,পর্ব-17 শেষ

#অবান্তর_চিরকুট,পর্ব-17 শেষ
♡আরশিয়া জান্নাত

তাহজীবের খুব সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। চেহারার গড়ন মায়ের মতো হলেও চোখ দুটো আর নাকটা হয়েছে বাবার মতো। তাহজীব যখন তাঁর মেয়েকে কোলে নিলো আবেগে চোখ বেয়ে দু ফোঁটা পানি পড়লো। বাবা হবার অনুভূতি এমন প্রশান্তিময় সে তো কল্পনাই করেনি। মেয়েকে দেখতে সিতারা আর রাফসান যখন হসপিটাল গেল আফসানা নিজে তার মেয়েকে সিতারার কোলে দিয়ে বললো, ওকে একটু আদর করোতো সিতারা আপু,ওর মাথায় হাত রেখে বলোতো ও যেন তোমার মতো হয়,,,
সিতারা হেসে বললো, ফুপ্পীর বৈশিষ্ট্য হালকা পাবেই। তবে তোমার মতো হোক সেই দোআ করি। তোমার সন্তান বাবা-মায়ের ছায়ায় বেড়ে উঠুক আর অনেক সুখে থাকুক।
তাহজীব মনে মনে বললো, তোর ইচ্ছেই পূর্ণ হবে তারা। আমিও মন থেকে দোআ করি তুই সুখে থাক।
___________

অফিস থেকে ফিরে বাসায় ঢুকতেই অন্যদিনের মতো হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালোনা সিতারা। রাফসান কিছুটা মনখারাপ করে ভেতরে যেতেই দেখে সাফা বসে আছে। প্রায় এক বছর পর সাফাকে দেখলো সে। সিতারা রাফসানের ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে চলে গেল। সাফা স্বাভাবিক গলায় বললো,সংসারটা বেশ সাজিয়েছ দেখছি, ফার্নিচার ও বদলেছ। আগের কিছুই নেই দেখি!

“মনে অবস্থানকারীকেই যখন সরাতে পেরেছি জিনিসপত্র সরানো আর কঠিন কি?”

“জিজ্ঞাসা করবেনা কেমন আছি?”

“ভালো থাকার জন্যই তো গিয়েছিলেন। খারাপ থাকবেন কেন? তা হঠাৎ এখানে কি মনে করে?”

“তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।”

“অপরাধ তো ছিল না! ক্ষমা চাওয়ার কি আছে? ইনফ্যাক্ট আমারতো আপনাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত,,,”

“মানে?”

“আপনি জীবন থেকে না গেলে সিতারার মতো ওয়াইফ পেতাম না। তাই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত না?”

“কিন্তু তুমিতো আমায় ভালোবাসো রাফসান! আমি জানি এই বিয়েটা নামমাত্র। তোমরা দুজনেই অন্যজনের মায়ায় পড়ে আছ। অযথা এটা টিকিয়ে রেখে কি লাভ। তারচেয়ে বরং আমায় সুযোগ দাও।আমি আর ভুল করবোনা রাফসান। তুমি যা বলবে তাই হবে। সিতারা বলেছে তুমি চাইলে সে চলে যাবে। তার কোনো অভিযোগ থাকবেনা”

“আমি চাইলেই তো! কিন্তু আমিতো চাইনা। আপনি প্লিজ আমার বাসা থেকে চলে যান আর কখনো এখানে আসবেন না। আর শুনুন আমাদের বিয়েটা মোটেও নামমাত্র না। এসব অহেতুক ট্যাগ দিয়ে আমাদের সম্পর্ককে জাস্টিফাই করার ভুল করবেন না। দরজাটা ওদিকে ,,,”

“অফিস থেকে এসেছ মাথা গরম বোধহয়। একটু বসে রেস্ট নাও তারপর নাহয় বলো, আমি তোমার এমন ব্যবহারে একটুও চমকাচ্ছিনা জানো! আমি জানি আমার দোষ আছে, এমন ব্যবহারই প্রাপ্য আমার। শুধু বলবো রাগের মাথায় ভালোবাসাকে অবহেলা করো না। আমি তোমাকে মিস করি রাফসান। তোমার অভাববোধ করি। আমার কিছু ভালো লাগেনা,,,”

রাফসান রেগে সিতারাকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। সিতারা ওর এমন গলারস্বর শুনে দৌড়ে এলো। রাফসান তখন চিৎকার করে বললো, আমি তোমাকে বলেছিলাম না অচেনা কাউকে বাসায় ঢুকতে দেবেনা? তুমি এই মহিলাকে কেন ঢুকিয়েছ? এনাকে তুমি চিনো?

সিতারা হতবিহ্বল চেহারায় তাকিয়ে রইলো। সাফা বিস্ফোরিত চোখে রাফসানকে দেখলো। রাফসানের এমন রণমূর্তি সে আগে কখনো দেখেনি! এতো শান্ত ছেলে এমন কঠিন করে কথা বলছে?
রাফসান সিতারাকে কাছে টেনে বললো, আমি আপনাকে ভালোবাসি। কি বলেছি বুঝতে পারছেন? আমি কেবল আপনাকে ভালোবাসি। অতীতের অবান্তর চিরকুট হয়ে আসা মানুষের জন্য আমি আপনাকে কখনোই হারাতে চাইবোনা। তাও এমন একজনের জন্য যে আমায় অযোগ্য বলে অপমান করে চলে গিয়েছিল। শুনুন সাফা ম্যাডাম আপনার মতো হাই কোয়ালিফাইড আমি নই, খুব সাধারণ এতিম ছেলে যার এই পৃথিবীতে এই সিতারা ছাড়া কেউ নেই। এখানে এসে আপনি নিজের দামি সময় নষ্ট করবেন না। ফিরে যান আপনার যোগ্য স্বামীর কাছে।
সাফা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে গেল। রাফসান ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সিতারা দরজা লক করতে যেতে নিলেই রাফসান তার হাত ধরে বলতে লাগলো, আপনি কি করে পারলেন এই কথা বলতে। আপনি ওর জন্য আমায় ছেড়ে যাবেন? আমাদের সম্পর্কটা সত্যিই এতো নড়বড়ে? আপনি কি এখনো বোঝেননি আমার মনে আপনার অবস্থান কোথায়? আপনি কেন এমন বললেন সিতারা?

“আপনি ভুল বুঝবেন না প্লিজ। আমি সেরকম কিছু ভেবে বলিনি। আপনি উনাকে কতোটা ভালোবাসেন তা তো আমার জানা, সে ব্যাক করতে চাইছে যখন আপনার উপর ছেড়ে দিয়েছি। আমার জন্য অন্তত স্যাক্রিফাইজ করতে হবেনা আপনাকে।”

“স্যাক্রিফাইজ মানে কি! অধিকারবোধ নেই এখানে? সাফা আসুক বা তাহজীব আমরা কি এইটুকু অধিকার পাইনি একেঅপরের উপর যে বাঁধা দিতে পারি? আপনি চাইলেই সাফাকে বলতে পারতেন তার মতো মেয়ের কাছে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ভুল আপনি করবেন না। আমি কিন্তু এটাই বলতাম তাহজীবকে,,,,,”

“আপনি শান্ত হন। আমি সত্যিই এতোকিছু ভেবে বলিনি। আর উনি যেভাবে কান্নাকাটি করছিল আমার মনে হলো সে এখনো আপনাকে প্রচুর ভালোবাসে। ভুল তো মানুষই করে তাই না? আর ভালোবাসার মানুষের ভুল হাঁসের গায়ে পানির মতো। কখনোই স্থায়ী হয়না।”

“আমি আপনার মতো উদার নই সিতারা। যে গেছে তাকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে রাখিনা। আমি এখন বর্তমানে বাঁচি। আপনাকে নিয়েই বাঁচতে চাই। প্লিজ আপনি অন্তত আমায় ছেড়ে যাবেন না সিতারা।”

রাফসানের চোখে পানি দেখে সিতারাও কেঁদে ফেললো। এতোদিন যেই ছেলেটার চোখে পানি দেখেছে কেবল সাফার কথা বলতে গিয়ে সে আজ সিতারার জন্য কাঁদছে? ছেলেদের চোখের পানি মিথ্যে হয়না রাফসানের তো কখনোই না। তবে কি সত্যিই তারা দুজন অতীতের গল্প শুনতে শুনতে একেঅপরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল?
সিতারা রাফসানের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, আপনি এভাবে কাঁদবেন না প্লিজ। আমি প্রমিজ করছি সাফা বা তাহজীব যেই আসুক না কেন আমি কখনওই আপনাকে ছেড়ে যাবোনা, যেতেও দিবোনা। আমাদের অতীত অবান্তর চিরকুট হয়েই পড়ে থাকবে। এখন আমাদের জীবনে তাঁদের কোনো প্রভাব পড়বেনা। আমাদের এই সংসারটা মোটেও নামমাত্র নয়। এটা আমরা দুজনেই ভালোবাসার মায়ায় জড়িয়ে গড়ে তুলেছি। এর ভিত্তিটা বন্ধুত্ব দিয়ে তৈরি, এটা কখনোই দূর্বল হতে পারেনা।
রাফসান সিতারাকে বুকে জড়িয়ে বললো, আমি খুব ভাগ্যবান সিতারা। আপনার মতো মানুষকে পেয়ে জীবনের প্রতি সব অভিযোগ ফুরিয়ে গেছে। এই জীবনে আপনাকে ছাড়া আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই আমার।
সিতারা চোখ বন্ধ করে রাফসানের বুকে মুখ গুঁজে রইলো। সে আর কিছু বলবেনা, এই মুহূর্তটা কাটুক নিরবে সহস্রকাল। অপ্রকাশিত মনের কথা বুঝে নিক মনের অধিকারী,,,,,

পরিশিষ্ট: রাফসান হসপিটালের করিডরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। আর একটু পরপর বলছে, আল্লাহ তুমি উদ্ধার করো। আমার সিতারার যেন কিছু না হয়।
সিতারার মা এই কঠিন মুহূর্তে মেয়ের জামাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন। ছেলেটা ভালোই বৌপাগল এ তো তার আগেই দেখা হয়ে গেছে।
নার্স এসে যখন বললো মেয়ে হয়েছে রাফসানের উচ্ছাস ছিল দেখার মতো। সবার সামনে যেভাবে খুশিতে লাফাচ্ছিল মনে হচ্ছে বিশ্বজয় করে ফেলেছে। সবাই ওর দিকে হা করে চেয়ে রইলো। জহির সাহেব হেসে তার কান্ড দেখছে। রাফসান লজ্জায় মাথা চুলকাতে লাগলো।

কপালে নরম স্পর্শ পেতেই চোখ মেলে ক্লান্ত চেহারায় হাসি দিলো সিতারা।

“আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ সিতারা।আপনি আমায় আজ এমন এক উপহার দিয়েছেন আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। আল্লাহর কাছে লাখ শুকরিয়া তিনি আমার জান্নাত সুরক্ষিত রেখেছেন।”

সিতারা রাফসানের গাল ছুঁয়ে বললো, আপনি বড্ড বেশি আবেগী। কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গেছিলেন নিশ্চয়ই?

“আমার কথা ছাড়ো। দেখো আমাদের মেয়ে কত্ত সুন্দর হয়েছে মাশাআল্লাহ। আমার দ্বিতীয় সিতারা!! এই এই সিতারা দেখো ওর চোখগুলো একদম আমার মায়ের মতো হয়েছে, বাদামি রঙের! সিতারা সত্যিই আমার মা এসেছে?”
সিতারা তাকিয়ে দেখতে লাগলো রাফসান কেমন ঠোঁটে হাসি নিয়ে অঝোরে কাঁদছে।
“ইশ মানুষটা যে কিভাবে এতো কাঁদতে পারে! মামণি তুই তোর বাবাইয়ের সব চোখের পানি ভ্যানিশ করে দিস তো। সে যেন তোর মাঝে তার মা-কে খুঁজে পায়। উনি যে বহুবছর মায়ের অভাবে ছিল তা যেন দূর হয়,,,

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here