অফুরন্ত প্রণয়,১৪ পর্বের শেষাংশ
তারিন_জান্নাত
আজ চতুর্থ বারের মতো জেলেপাড়ায় প্রবেশ করলো নওশাদ। জেলেপাড়ার লোকজন বেশ উৎসুক্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো নওশাদের দিকে। তাদের মতো দরিদ্রের ঘরে এমন সাহেবের বেশে কোন মানুষ আসার কথা নয়।তাহলে অচেনা ছেলেটা যায় কোথায়?
চারপাঁচ জন ব্যাক্তিদের দিকে নওশাদ একচোট তাকালো।এরপর জেলেপাড়ার শেষ প্রান্তের দিকে হেঁটে চলে গেলো। অতঃপর ছোটখাটো একটা কুঠিরের মতো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজাটা বন্ধ দেখাচ্ছে।হয়তো ভেতরে কেউ নেই,নয়তো ছেলেটা মাছ ধরতে গিয়েছে। নওশাদ আশেপাশে তাকিয়ে গলার স্বর বাড়িয়ে ডাকলো,
–” সাকিন?
–” সাকিনন?
বার দুয়েক ডাকার পর ছোট বাড়ির পেছন থেকে লুঙ্গি পরিহিতা একটা ছোট কিশোর বেরিয়ে এলো।কিশোরকে দেখে নওশাদ ঠোঁটের কোণোর হাসিটা প্রশস্ত হলো।নওশাদ নিজের ডানহাতটা এগিয়ে দিলো। মুহূর্তে সাকিনের হাতে থাকা তোতাপাখিটি উড়ে নওশাদের হাতের তালুর উপর এসে বসলো।
নওশাদ তোতাপাখির ঠোঁটের দিকে চেয়ে বলল,
–” তোমাকে যা শেখাতে বলেছিলাম শিখিয়েছো?”
সাকিন নাকের সর্দি সম্পূর্ণ ভেতরে টেনে নিয়ে বলল,
–” ভাইয়া কাল সারাদিন সারারাত ধরে শিখিয়েছি।”
নওশাদ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল,
–” সারারাত?
–” ইয়ে মানে সকাল থেকে সন্ধ্যা।”
নওশাদ হাসলো। বলল,
–” শোনাতে বলো। দেখি কী শিখিয়েছো?
সাকিন প্রথমে বলল,
— টুটি,কও ‘ ইয়াশা আই লাভ ইউ।’
তোতাপাখি অর্থাৎ টুটি অতি চিকন স্বরে বলল,
–” শা..শা.. লাপ ইউ,লাপ ইউ!”
নওশাদ সাকিনের দিকে চেয়ে বলল,
–” এটা শিখিয়েছো? স্পষ্ট তো শুনা যায় না।”
সাকিন হেসে বলল,
–” ভাইয়া আপনি টানা এক সপ্তাহ শেখাবেন
তাহলে শিখে যাবে।”
তাদের কথার মাঝে টুটি বলে উঠে,
–” চাকিন চাকিন!”
নওশাদ আগ্রহ নিয়ে বলল,
–” টুটি বলো নওশাদ,নওশাদ।”
–” চাদ চাদ।
সাকিন ফিক করে হেসে দিলো। নওশাদও হাস্যময় দৃষ্টি নিয়ে তোতাপাখিটির দিকে তাকিয়ে রইলল।
বাঁ হাতের টোঙাটা সাকিনের হাতে দিলো নওশাদ।এরপর পকেট থেকে টিস্যুর প্যাকেটটা দিয়ে বলল,
–” সর্দি ভেতরে টেনে না নিয়ে ফেলে দিও।”
সর্বশেষে একটা কাগজের খাম ধরিয়ে নওশাদ বলল,
–” এই নাও এটা তোমার পাওনা।মূল্য
কিন্তু দ্বিগুন দিয়েছি।’
নওশাদ দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে আসতে লাগলো। সাকিন খাম ছিঁড়ে টাকা বের করলো। দেখতে পেলো নতুন চকচকে এক হাজার টাকার ছয়টি নোট। সাকিনে চোখেমুখে খুশী উপচে পড়লো দ্রুত পায়ে ছুটতে লাগলো। তার মায়ের দিকে। অভাবের সংসারে এই চকচকে কাগজের নোট কতোটা মূল্যবান সেটা শুধু তারা বুঝবে যারা দিনের আয় দিনে করে। সাকিনের কিশোর মন একটা চিন্তা উদয় হলো। সে ভাবলো এভাবে যদি পাখি বিক্রি করে করে টাকা আয় করতে পারে তাহলে তো তাদের আর অভাব ছুঁতেও পারবে না।
সূর্যের তীক্ষ্ণ আলো নওশাদের শরীরে ল্যাপ্টে আছে। গরমে গা জ্বলে উঠছে তার।উপরন্তু কাঁধের অবস্থা যা-তা। টুটি পটি করে দিয়েছে। বাসায় গিয়ে শাওয়ার নিতে হবে। নওশাদ দ্রুতপায়ে ইয়াশাদের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। সোফায় ইউসুফ সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন। মিনু আরার মুখেও চিন্তা।নওশাদকে দেখে ইউসুফ সাহেব সৌজন্য হাসি হাসলো। নওশাদ ও হাসলো। টুটি নওশাদের ডানকাঁধে ছিলো বলে তারা কেউ দেখতে পায়নি।
নওশাদ রুমে ঢোকার পূর্বে ইয়াশার রুমের দিকে তাকালো। গত চারদিন ধরে সে ইয়াশার সাথে একটা শব্দও ব্যায় করে কথা বলেনি।মনের ভেতরে প্রচণ্ড রাগ পোষে রেখেছে সে।
মিনু আরা চিন্তিতমুখে বললেন,
–” কথা ছিলো আজ শুক্রবারে আন্টি বদলের অনুষ্ঠান হবে। হঠাৎ করে মত পাল্টে সে অনুষ্টান বিয়ে অবধি গড়ালো।এখন বলছেন বিয়ের কার্যক্রম আরো এক সপ্তাহ পেছাতে। আপনি চাইছেন টা কী বলুন তো।”
ইউসুফ সাহেব ভাবলেশহীন কন্ঠে বললেন,
–” দেখো মিনু বিয়েশাদির অনুষ্ঠানে তাড়াহুড়ো করতে নেই।ধীরেসুস্থে করা উচিত। মেয়েতো আর পালিয়ে যাচ্ছেনা।”
–” তবুও বিয়াইন-আপা কি ভাববেন?”
ইউসুফ সাহেব ককিয়ে বলে উঠলো,
–” আগে ঠিক করো বিয়াইন ডাকবে নাকি আপা? দুটো একসাথে না। আর জাবিরের মার মতামত নিয়েই আমি সবটা করছি।তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।”
ইউসুফ সাহেব ঘড়িতে সময় দেখে বললেন,
–” সেজো,আর ছোট বউ কোথায় দেখছিনা যে।”
মিনু আরা বললেন,
–” বড়ভাবির শরীর খারাপ নাকি বেড়ে গিয়েছে।তাই তারা সকালে চলে গেলো।আরিফা আছে। তারউপর আপনি বাইরে যাওয়ার আগে বিয়ে পেছানোর কথাটা বলেছিলেন আমি সেটাও তাদের জানিয়ে দিয়েছি।তাই তারা আরো কয়েকদিন পর ফিরবে।”
–” ভালো কথা।”
বলেই ইউসুফ সাহেব উঠে চলে গেলেন।এরপর নওশাদের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিলেন। নওশাদ দরজা খুলেই দেখলো ইউসুফ সাহেবকে দাঁড়ানো দেখলেন।
নওশাদ বলল,
–” কিছু বলবেন আঙ্কেল?
–‘ হ্যাঁ! মসজিদে একসাথে যাবো আমরা।”
নওশাদ মাথা নাড়ালো।তখনি টুটি উড়ে এসে ইউসুফ সাহেবের মাথায় বসে চিকন ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মারতে লাগলো। আকস্মিক ঘটনায় ইউসুফ সাহেব হকচকিয়ে গেলেন।দ্রুত মাথায় হাত দিয়ে টুটিকে সরালো। নওশাদে হেসে উঠলো। টুটি আবার নওশাদের কাঁধে গিয়ে বসলো। নওশাদ বলল,
–” টুটি দুষ্টুমি করিওনা।আঙ্কেলকে সালাম দাও।”
–” চালাম চালাম।!
নওশাদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।সাকিন বলেছিলো টুটি সুন্দর করে সালাম দিতে পারে।অনেকদিন ধরে নাকি পোষছিলো।সে অনুযায়ে যা শিখিয়েছে তা জানার কথা। আরো একটা কথা বলেছিলো সাকিন।টুটির নাকি যাকে পছন্দ হয় তার সাথে চলে যায়।নওশাদকে প্রথম দেখায় পছন্দ করেছিলো হয়তো।দেখার সাথে সাথে নওশাদের টানটান গালে ঠোকর মেরেছিলো। নওশাদের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলো ইউসুফ সাহেবের হাসিতে।
–” এই পাখিটা কোথায় পেয়েছো? দুষ্টু তো।”
নওশাদ মনে মনে বলল,
–” আপনার মেয়ের জন্য কিনে এনেছি আঙ্কেল। এ পাখি নাকি মানুষের কথা হুবহু রিপিট করতে পারে। আমি ঠকে গেলাম না তো?”
ইউসুফ সাহেব আর কিছু না বলে হাসতে হাসতে রুমের দিকে পা-জোড়া অগ্রসর করলেন।
মসজিদ থেকে ফেরার পথে নওশাদ ইউসুফ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
–” আঙ্কেল বিয়ে ক্যান্সেল করেছেন? আপনার মেয়েকে আমার হাতে কখন তুলে দিচ্ছেন?”
ইউসুফ সাহেব হতবিহ্বল হয়ে বললেন,
–” আচ্ছা তোমার ভয় নেই? মেয়ের বাবাকে সরাসরি এভাবে কেউ প্রশ্ন করে?তোমার কলিজা কাঁপে না?
নওশাদ আশ্চর্যান্বিত রূপ ধারণ করে বলে,
–” আঙ্কেল কলিজা কাঁপবে কেন? একজন দায়িত্ববান ছেলের, একজন বাবার কাছে তাঁর মেয়ের হাত চাইতে কলিজা কাঁপে আমার তো জানা ছিলোনা। আমার তো কিছুই কাঁপছে না।”
ইউসুফ সাহেব মুখের গম্ভীর্যভাব সরিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। নওশাদও হালকা হাসলো।হঠাৎ তার নিজের বাবার কথা মনে পড়ে। তার বাবাও একজন চঞ্চল মানুষ।সর্বদা হাসিখুশি থাকেন।
বিকেলের দিকে রুমবন্দি থেকে নিজেকে মুক্ত করলো ইয়াশা। নওশাদ তাকে চরমভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে। যেটা ইয়াশার মনটাকে আরো বিষন্ন করে দিয়েছি।আগে দেখা হলে কথা না বললেও নওশাদ সরাসরি তাকাতো। কিন্তু চারদিন ধরে নওশাদ না কথা বলছে,না তার দিকে তাকাচ্ছে। ইয়াশা নিজেকে এটা বলে শান্ত করেছিলো যে হয়তো নওশাদ এতদিন মজা করেছিলো। ওর মতো মোটা মেয়েকে ভালোবাসবে এমন সুদর্শন যুবক।
ইয়াশা নিজেকে ধাতস্ত করলো। এটা নিছকই কল্পনা মাত্র।ভালোবাসা তার কপালে নেই। পরক্ষণে নিজের নিশ্চল অনুভূতিকে দমালো।সামনে তার বিয়ে।সম্পূর্ণ ফোকাস বিয়েতে দেওয়া উচিৎ।অথচ নওশাদের উপস্থিত তাকে দিনদিন বেহায়া করে তুলছে।
কপালের শক্ত কিছুর আঘাতে চমকে উঠলো ইয়াশা।
টুটি ইয়াশার কাঁধে জায়গা ধকল করলো,ইয়াশা দ্রুত নিঃশ্বাস টেনে তোতাপাখির দিকে নজর নিবদ্ধ করলো। টুটি ইয়াশার ফোলা ফর্সা গালে হালকা ঠোকর দিয়ে বলল,
–” য়াশা-লাপ ইউ,লাপ ইউ!
ঠোকর দেওয়া জায়গা লাল হয়ে উঠে মুহূর্তে।ইয়াশা গালে হাত বুলাতে বুলাতে টুটিকে ধরতে চাইলো। ইয়াশাকে মোহঘোরে রেখে টুটি উড়ে চলে গেলো মুহূর্তেই…!
(চলব)