অফুরন্ত প্রণয়,পর্ব-২
তারিন_জান্নাত
চারিদিকে সোডিয়ামের আলো জ্বলছে। রাস্তার কিনারা ধরে গুটিগুটি পায়ে হাঁটছে ইয়াশা। রাস্তায় কয়েকজন পরিচিত দেখতে পেলো ইয়াশা।মুখ স্পর্শ করে মাস্কটা ঠিক করলো সে। আর বেশিদূর নেই।
সামনের মোড়ে গেলে একটা চিকন গলি পড়ে।গলি দিয়ে প্রবেশ করে কিছুদূর এগোলেই দেখা যায় তাদের একতলা বাড়িটি। আর পনেরো মিনিট সময় লাগবে পৌঁছাতে। ইয়াশা চুপচাপ হাঁটছে।
একটু পর অন্ধকার গলিতে প্রবেশ করলো সে।পার্স থেকে ছোট্ট টর্চলাইট বের করে জ্বালালো। একটু হাঁটতেই ইয়াশা অস্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনতে পেলো।তড়িৎ গতিতে পেছনে তাঁকালো। রাস্তা ফাঁকা। নিজের ভ্রম ভেবে হাঁটায় মনোযোগ দিলো আবার।একটু পর সে পায়ের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পায়।
পূর্বের রেশ ধরে হঠাৎ ইয়াশার মন আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। ঘর্মাক্ত হাত মাথায় রেখে লম্বা হিজাব পিন বের করলো। পায়ের শব্দ তীব্র হতেই দিন-দুনিয়া ভুলে চোখমুখ খিঁচে লম্বা পিন দ্বারা আগুন্তুকটির শরীরে আঁচড় কাটলো। অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমনে অপ্রস্তুত হয়ে মৃদু আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো নওশাদ। ইয়াশা অস্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে অচেনা পুরুষটির আর্তনাদ।ইয়াশা ফুস করে নিঃশ্বাস ফেললো।তার ধারণা সত্যি প্রমাণ হলো।লোকটির হয়তো কোন খারাপ অভিসন্ধি ছিলো।আঘাত করে ভুল করেনি সে।
ইয়াশা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।ইয়াশাকে চলে যেতে দেখে নওশাদ কন্ঠে কাতরতা ঢেলে বলল,
— ” শুনোন? আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি মারা যাচ্ছি। আমাকে বাঁচান। আমার প্রথমিক চিকিৎসা দরকার।’
সুমিষ্ঠ পুরুষালী কন্ঠে ইয়াশার পা থেমে গেলো। এবার সে পেছনে ফিরে তাকালো। অন্ধকারে একটা অবয়ব দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। ইয়াশাকে চুপ দেখে নওশাদ বলল,
–” আমার কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিলোনা।আমি আপনাকে চিনি। আপনাকে রাস্তায় একা দেখে এগিয়ে এসেছিলাম।তাছাড়া
আমি এটাও জানি আপনি এখন একটা
বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছেন।”
নওশাদের কথায় ইয়াশা চমকে যায়।এবং ভাবনায় পড়ে যায়।মানুষটাকে আঘাত করে এবার ইয়াশার মায়া হচ্ছে কেন যেনো।ভাবলো হয়তো সরাসরি আঘাত না করে তাকে অনুসরণ করার কারণটা জেনে নিতে পারতো সে। পরক্ষণে ভাবলো,কার মনে কী চলছে সেটাও কীভাবে সে জানবে।নওশাদ আবারও আর্তনাদ করতে লাগলো। ইয়াশা মুখের মাস্ক
খুলে মৃদু কন্ঠে বলল,
— ” এতটুকু আঘাতে কেউ মারা যায়না।আপনি উঠে দাঁড়ান।সামনেই ফার্মেসি আছে আপনার প্রাথমিক চিকিৎসাটা সেখান থেকে সেরে ফেলুন।”
ইয়াশা সময় নষ্ট না নিজ গন্তব্যে ফেরার উদ্দেশ্য হাঁটতে লাগলো। নওশাদ কাতর চোখে চেয়ে বলল,
— ” প্রথম দেখায় একেবারে হৃদপিণ্ডে আঘাত করলেন,আর এখন বলছেন এতটুকু আঘাতে কেউ মারা যায়না। হার্টল্যাস গার্ল!”
নওশাদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বিড়ালচোখী মেয়েটির দিকে। কী নিষ্টুর, আঘাত করে চলে যাচ্ছে। ফিরেও তাকাচ্ছেনা। নওশাদ উঠে দাঁড়ালো। তার এতটাও আঘাত লাগেনি।শুধু বুকে দিকে আঁচড় কাটা স্থানে ব্যাথায় একটু পর পর চিনচিন ব্যাথা করছে শুধু। সে তো বিড়ালচোখীর মনোযোগ পাওয়ার জন্য এমনটা করেছিলো। নওশাদ হাসফাস করতে লাগলো। নামটাও জানতে পারলো না। মন্দ কপাল।
কিছুদূর হেঁটে সত্যিই ফার্মেসি দেখতে পেলো নওশাদ। প্রয়োজনী জিনিস স্যাভলন,তুলা,আর বেন্ডেজ নিয়ে চলতে লাগলো গাড়ির উদ্দেশ্যে। নওশাদকে আসতে দেখে ইমরোজ আর সায়ন হাসিমুখে গাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়ালো। নওশাদ এগিয়ে আসতেই তার অসহায় মুখটা সোডিয়াম আলোতে ভেসে উঠলো। ইমরোজ নওশাদকে জিজ্ঞেস করলো,
–” কি রে এমন লাগছে কেন তোকে?”
নওশাদ জবাব দিলোনা।পেছনের সিটের দরজা খুলে বসে পড়লো।পরিহিত পাঞ্জাবিটা খুলে ক্ষতস্থানটা দেখিয়ে বলল,
— ” দেখ ইমরোজ হার্টল্যাস মেয়েটা কী অবস্থা করেছে আমার।”
ইমরোজের মুখে থমথমে ভাব নেমে আসলো।সায়ন কিটকিটিয়ে হেসে উঠে বলল,
–” বাহ! ইমরোজ আমাদের ভাবী প্রথম সাক্ষাৎে বেশ ভালোয় আপায়ন করেছে তাই না।”
নওশাদ বিরস কন্ঠে বলল,
–” সাক্ষাৎ আর পেলাম কই।তার আগেই সে চলে গেলো।”
ইমরোজ বলল,
–” এখন কী করবি তাহলে?”
নওশাদ বলল,
–” গাড়ি ঘুরা, তাউসিফের শালীর সাথে দেখা করতে হবে আমার।”
ইমরোজ ব্যান্ডেজটা লাগিয়ে দিয়ে চুপচাপ ড্রাইভিং সিটে বসলো।
ইয়াশা বাড়ির পেছনের দরজার এসে দাঁড়ালো। হালকা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে যায়।ইয়াশার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বুঝলো কাজটা তার মায়ের। তারমানে তার বাবা অফিস থেকে চলে এসেছে।ইয়াশা দৃঢ়পায়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো। দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই গলি দেখা যায়।গলি দিয়েই রুমে যেতে হয়। ড্রয়িংরুম আর ডাইনিং রুম থেলে গলি দেখা যায়না।যার ফলে ইয়াশা রুমে প্রবেশ করার সময় কারো নজরে পরেনি। সে ফ্রেস হয়ে দ্রুত বিছানায় শুয়ে পড়লো।
ইয়াশার বাবা ইউসুফ আহমেদ অফিস থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে রাতের খাবার খেয়ে কিছু সময় টিবিতে প্রাচার হওয়া সংবাদ দেখবেন।এরপর ঘুমানোর পূর্বে বাড়ির মেইন দরজা,পেছনের দরজা,এবং ছাদের দরজায় তালা দিয়ে দিবেন। নিজের কক্ষে প্রবশের পূর্বে আদরের ছোটকন্যার কক্ষে যাবেন।
মাথায় স্নেহমাখা পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেয়ে ইয়াশার মন তৃপ্ত হলো। প্রতিটি মেয়েরই প্রিয় ব্যাক্তি।
ইউসুফ আহমেদ যেতেই ইয়াশা দরজার দিকে ফিরলো।তার বাবা চলে গেছে। যাক তার বাবা জানতে পারেনি। হঠাৎ অচেনা পুরুষটিকে আঘাত করাই ইয়াশার মনটা খারাপ হয়ে যায়।মনে মনে এখন অনুতপ্ত সে।ইয়াশার মনে পড়ে যায় একবছর আগের একটা ঘটনা।সেদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে অন্ধকার গলিতে অনাকাঙ্খিত একটা নোংরা স্পর্শের সম্মুখীন হয় ইয়াশা।সেদিন তার মনে এতো সাহস ছিলোনা। ছিলো ভয়ের সমুদ্র। কোনমতে পালাতে সক্ষম হয়েছিলো সে। বাড়ি এসেই মাকে সে ঘটনাটা জানালো। ইয়াশার মা মিনু আরা চিন্তিত হয়ে বিষয়টা ইউসুফ সাহেবকে জানান। ব্যস, সেদিন থেকে সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো ইয়াশার জন্য।
ইয়াশাও বাবা মায়ের বাধ্য মেয়ে হয়ে তাদের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে লাগলো।কিন্তু আজ তাকে যেতেই হলো।রিদিতার অনুরোধ রাখতে। তার মাও সায় দিয়েছিলো তাই ইয়াশা যেতে পেরেছে।আয়েশে চোখ বুঁজলো ইয়াশা।
নওশাদের কথামতো সায়ন রিদিতাকে নওশাদের সামনে এনে হাজির করলো। রিদিতা সায়নের আচরণে বেশ বিরক্ত হয়। কীভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা বলে ছেলেটা। বিরক্তিকর। শুরু থেকেই বিয়াইন বিয়াইন করে মাথা খাচ্ছিলো সায়ন। অবশেষে যখন শুনলো নওশাদ ডাকছে তখন রিদিতা কাল বিলম্ব না করে একেবারে নওশাদের সামনে এসে হাজির।সায়নও অবাক হয়।যে এতক্ষণ আসতে চাইছিলো না নওশাদের নাম শুনতেই হাজির।
রিদিতাকে দেখে নওশাদ তেড়ে আসার মতো এগিয়ে আসলো।রিদিতা খানিকটা চমকে যায় নওশাদের আচরণে।পরক্ষণে লজ্জামিশ্রিত হাসি হেসে নওশাদকে বলল,
–” ভাইয়া কিছু বলবেন?”
নওশাদ মূল প্রসঙ্গ টেনে বলল,
–” কিছুক্ষণ আগে এখান থেকে একটা মেয়ে চলে গিয়েছিলো। হালকা পেস্ট কালারের ড্রেস পরা। মেয়েটি কে?”
রিদিতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ভাবতে লাগলো কোন মেয়ে? রিদিতাকে ভাবতে দেখে নওশাদ আবারও বলল,
–” মেয়েটির চোখ বিড়ালের চোখের মতো।”
রিদিতা এবার পিলে চমকে উঠলো।নওশাদ সেটা দেখে মৃদু হাসলো। রিদিতা বলল,
–” চিনতে পেরেছি।”
একটু থেমে আবার বলল,
–” ওর নাম ইয়াশা। আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড।”
নওশাদ চোখেমুখে উপচে পড়া হাসি নিয়ে বলল,
–” আচ্ছা তাহলে আপনার ফ্রেন্ডের নাম্বারটা যদি আমাকে দিতেন, তাহলে আমি খুব খুব এবং খুবই উপকৃত হতাম।”
রিদিতা সায়নের দিকে একবার
চেয়ে স্মিথ হেসে বলল,
–” কিন্তু ইয়াশার তো কোন ফোন নেই। সে ফোন ইউস করেনা।”
এবার নওশাদের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ম্লানমুখে হালকা হেসে বলল,
— “আচ্ছা তাহলে আপনার নাম্বারটা দিন।আমি সময় মতো আপনার সাথে যোগাযোগ করবো।আর হ্যাঁ একটা রিকুয়েস্ট আমার বিষয়ে কোন কিছু উনাকে জানাবেন না।এ ই মুহূর্তে হওয়া কথোপকথনের ব্যাপারে উনাকে জানাবেন না।কেমন? ”
রিদিতা হেসে মাথা নাড়ালো।নওশাদও হেসে বলল,
–“এবার আপনি আসুন।সায়ন উনাকে ভেতরে দিয়ে আয়।”
রিদিতা আগে আগে হাঁটছে।সায়ন পেছনে। সায়নে কানে ফোন ঠেকিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
–” হে হে হে! এজন্যই বলি ধুরুম-ধারুম যেখানে সেখানে ক্রাস না খাইতে।দিলো তো ছ্যাকা! আহারে বুকটা ফাইট্টা যায়।”
রিদিতা দাঁতের সাথে চেপে পেছন ফিরে সায়নের দিকে তাঁকালো। সায়ন ফোনে কথা বলতে বলতে রিদিতা চোখাচোখি হয়। সায়ন রিদিতাকে তাকাতে দেখে ভেংচি কাটলো একটা। রিদিতা দ্রুত পা পেলে হাঁটতে লাগলো।
(চলবে)