অনুভূতির_সংঘাত_৬

অনুভূতির_সংঘাত_৬
ছামিনা_বেগম

এত রাতে ড্রয়িং রুমে আলো জ্বলতে দেখে একটু অবাকই হয় শিমুল । গাড়ি পার্কিং এ রেখে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় সোফায় চিন্তিত হয়ে বসে আছে মা এবং পুতুল অনবরত কাউকে কল করে যাচ্ছে । শিমুলকে দেখেই শেফালী বেগমের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে যায় । ঘুমের ওষুধ খেয়েও এতরাতে জেগে থাকার কারণে তার মাথা ভারী ঠেকছে সাথে অহনার এভাবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ায় তিনি এতক্ষণ দিশেহারা হয়ে বসেছিলেন সোফায় । বকুল ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়েছে অহনাকে খুঁজতে । ঘন্টাখানেক হয়ে গেছে এখনো কোনো সুখবর আসেনি । শিমুল সোফায় ব‍্যাগ রেখে শেফালী বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল ,

– “তোমরা এত অব্দি জেগে আছ কেন ? আর আমাকে এভাবে তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালে ….কোনো সমস্যা ? অহনা কোথায় ? ঘুমাচ্ছে মনে হয় ! ”

শিমুলের কথায় অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ঝড়ে পড়ে শেফালী বেগমের চোখ দিয়ে । শিমুল ভ‍্যাবাচেকা খেয়ে যায় । পুতুল শিমুলকে উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেয় কালো ডায়েরিটা । আচমকা পুতুলের এমন আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় শিমুল । ডায়েরিটা মুঠো বন্দি করে বলল ,
– এসব কি ধরনের অসভ্যতা পুতুল ?

ততোধিক ক্রুদ্ধ স্বরে পুতুল চেচিয়ে ওঠে ,
-এখনো গলাবাজি করছ তুমি ? তোমার লজ্জা করছে না দাদা ?
ভাবি চলে গেছে । বুঝতে পারছ তুমি ? চলে গেছে সে । এই যে তুমি তোমার রাসলীলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জমিয়ে রেখেছ এই ডায়েরিতে । সব দেখে ফেলেছে ভাবি । এবার নিশ্চিত ভালো আছ তুমি ? ভালো লাগছে তোমার , তাই না ?

পুতুলের এমন উগ্ৰ আচরণে শিমুল ভ‍্যাবাচেকা খেলেও পরক্ষণে পুতুলের কথা গুলো ওর চেতনায় আঘাত করে প্রবলভাবে । হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে দেখে কালো ডায়েরিটা। হঠাৎ করেই মনে হয় পৃথিবীটা বুঝি থমকে গেছে । হাতটা কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে খসে পড়ে ডায়েরিটা । পিনপতন নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে ওই শব্দ আর্তনাদের মতো শোনায় । শিমুলের হাতপা আসাড় হয়ে আসে , হাটু ভেঙে বসে পড়ে মেঝেতে ।

– “এতটা নিষ্ঠুর কি করে হতে পারলে তুমি ? কি করে পারলে ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়েকে চিট করতে ? তোমার বিবেকে বাধলো না একবার ও ? ….. ছিঃ , আমার লজ্জা হচ্ছে তোমাকে নিজের ভাই বলতে । ”
– ” আহঃ পুতুল !! থামবি তুই ? ”
শেফালী বেগমের কঠিন ধমকে চুপ করে যায় পুতুল । নীরব আস্ফালনে দাপাতে থাকে সে । শেফালী বেগম এগিয়ে আসেন শিমুলের কাছে । শিমুলের মাথায় হাত রেখে কোমল স্বরে বলেন ,

– তোদের মধ্যে কি হয়েছে আমি জানি না ? আমি জানতেও চাই না । কিন্তু একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ শিমুল, কাল সকালের মধ্যে আমার ঘরের আমানত আমার ফেরত চাই । তুই কি করবি ? কোথায় খুজবি ? তুই জানিস , কিন্তু অহনাকে ফিরিয়ে আন বাবা । না জানি , মেয়েটা কি অবস্থায় আছে ? যাহ ,বাবা , ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আয় । যাহ ….. দাড়িয়ে আছিস কেন ?”

অশ্রু সিক্ত নয়নে শিমুল তাকায় নিজের মায়ের দিকে । বলল,

-আমাকে ক্ষমা করে দিও মা । আমি …. আমাকে যে ওকে খুঁজে পেতেই হবে ……

বলতে বলতে শিমুল পাগলের মতো ছুটে যায় সদর দরজার দিকে ।

*****

-দেখুন ম‍্যাডাম , এটা তো একটা পুলিশ কেস । পুলিশ না আসা পর্যন্ত আমরা চিকিৎসা শুরু করতে পারি না । চাইলেই আমরা আইনি বিষয় গুলো এড়িয়ে যেতে পারি না ম‍্যাডাম ।

হসপিটালে পৌঁছে একজন পুরুষ চিকিৎসকের এহেন গা ছাড়া কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল বৃষ্টি । চিৎকার করে উঠল সে ,
– চুপ করুন । অনেক হয়েছে ! আর নয় । আমি আপনাদের কাছে আইন শিখতে আসিনি । আপনারা প্লিজ ওনার ট্রিটমেন্ট শুরু করুন ।প্লিজ , হাত জোড় করছি ….প্লিজ । ওনার অবস্থা তো আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন । যত দেরি হবে তত ওনার কন্ডিশন খারাপ হবে ….

– সেটা আমরা জানি ম‍্যাম । কিন্তু আমাদেরকেও তো কিছু ফর্মালিটিস মেনে চলতে হয় । তাছাড়া ওনার অবস্থা বেশ ক্রিটিক্যাল । গার্জেনের অনুপুস্থিতিতে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না ।

চিকিৎসকের এই কথায় বৃষ্টি এবার যেন একটু মুষড়ে যায় । আসলেই তো , গার্জেনের অনুপস্থিতিতে চিকিৎসকরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না ‌ । যদি পরে রোগির পরিবার এসে হাঙ্গামা বাধায় সব দোষ তো হসপিটাল অথোরিটির ওপর এসে পড়বে । সেধে তো কেউ সমস্যায় পড়তে চাইবে না । কিন্তু কখন ওনার গার্জেন আসবে আর কখন চিকিৎসা শুরু হয়ে সেই অপেক্ষা করলে তো মা বাচ্চা দুজনেরই জীবন সংশয়ে পড়বে ! বৃষ্টি একরাশ হতাশা নিয়ে তাকায় কাচের জানালার ওপাশে কেবিনে শুয়ে থাকা অহনার দিকে । ডাক্তাররা ফাস্ট এইড দিয়ে দিলেও অপারেটিং রুমে নিয়ে যেতে দ্বিধায় পড়েছে । বৃষ্টি আবার তাকাল দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকের দিকে । বলল,

-স‍্যার , কিছুই কি করা যায় না ? এভাবে চোখের সামনে তিলে তিলে দুজনকে মরতে দেখা যে খুবই কষ্টকর । প্লিজ , স‍্যার কিছু তো করুন ।

চিকিৎসক নিজেও অহনার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ,
-ঠিক আছে , আপনি রিসেপশনে গিয়ে ফর্মালিটিস পূরণ করে দিন । আমরা ওনাকে অপারেটিং রুমে নিয়ে যাচ্ছি । নার্স ? ডাক্তার রেশমিকে দেখুন তো ‌। উনি আছেন কি না ? ”

নার্স মেয়েটি বলল , স‍্যার ম‍্যাডামের তো আজ ডে সিফট ছিল । উনি চলে গেছেন অনেক আগে । ”

– ওহ ! চিকিৎসক কে কিছুটা চিন্তিত দেখাল । তিনি কিছু একটা ভেবে বললেন ,
– আজকের অপারেশনটা বেশ ক্রিটিক্যাল । আমার অভিজ্ঞ একজন সহকারী সার্জেন দরকার । আপনি ডাক্তার রেশমিকে কন্টাক্ট করুআর চেষ্টা করুন । ইমিডিয়েটলি আসতে বলুন ওনাকে ।

ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে কামাল মিঞাকে সঙ্গে করে বৃষ্টি রিসেপশনে চলে আসে । রিসেপশনিস্ট মেয়েটি একটি ফর্ম এগিয়ে দেয় বৃষ্টির দিকে । অভিভাবকের জায়গায় এসে থমকে যায় বৃষ্টি । কি সম্পর্ক লেখা উচিত ? বৃষ্টির মনে পড়ে প্রথম যখন মেয়েটির মাথা নিজের কোলের ওপর রেখেছিল । মেয়েটি ওকে আপা ডেকেছিল । ছলছল করে ওঠে বৃষ্টির চোখ দুটো । আনমনেই শূন‍্যস্থানটি ভরাট করে দেয় ‘ সিস্টার ‘ লিখে । রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে ফর্মটা ফেরত দিলে সে পেমেন্ট অপশন কি হবে জিজ্ঞেস করায় বৃষ্টি নিজের ডেবিট কার্ডটা এগিয়ে দেয় ।

টানা চার ঘন্টা ধরে অপারেশন চলছে । অপারেটিং রুমের দিকে তাকিয়ে অস্থির চিত্তে পায়চারি করছে বৃষ্টি । ভেজা পোশাক গায়েই শুকিয়ে গেছে । কামাল চাচা চেয়ার বসে বসে ঝিমুচ্ছে । বৃষ্টির মাঝে মাঝে অবাক হয়ে আশেপাশে দেখছে । আশ্চর্য হয়ে ভাবছে ওনার পরিবারে কি কেউ নেই নাকি ? এরকম একটি ঘটনা ঘটে গেছে অথচ কারোরই দেখা নেই । এখনো অব্দি কেউ খোঁজ নিল না কেন ?এরই মধ্যে পুলিশ এসে অ্যাক্সিডেন্টের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে গেছে । বৃষ্টির চিন্তিত মন অহনার কথা ভেবে একটু বেশিই দুঃখ পেল । এরকম সময়ে প্রত‍্যেকটা মেয়েই নিজের পাশে সবথেকে কাছের মানুষটাকে আশা করে । অথচ মেয়েটা এখানে একা একা বাঁচার লড়াই করে যাচ্ছে । কে সেই দূর্ভাগা কে জানে ? নিজের প্রিয় মানুষটিকে আগলে রাখতে পারল না ।

সারাদিনের ক্লান্তি বৃষ্টিকে জোরজবরদস্তি ঘুম পাড়িয়ে দিতে চাইছিল । চেয়ারে বসে একটু পিঠ এলিয়ে দিতেই তাই চোখ বুজে আসছিল বৃষ্টির , ছোট্ট বাচ্চার কান্নার আওয়াজে চমকে তাকাল । অহনাকে আইসিইউতে শিফট করে দিয়েছে ডাক্তাররা । বৃষ্টি তড়িঘড়ি এগিয়ে গেল । নার্সের কোলে সাদা তোয়ালেতে মোড়ানো পুতুলটার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে । কাঁপা কাঁপা হাতে কোলে নিতেই ডাক্তার রেশমি এগিয়ে এলে বৃষ্টি প্রশ্ন করল ,
– উনি কেমন আছেন ডক্টর ?
রেশমিকে বিমর্ষ দেখাল । বৃষ্টির আর প্রশ্ন করার সাহস হলো না । এই কয়েকবছরে হসপিটাল নামক জায়গাটির সাথে ওর নামবিহীন সখ্যতা তৈরি হয়ে গেছে । প্রতিবার এই জায়গা গুলোতে পা ফেললে অজানা আতঙ্কে শরীর হীম হয়ে আসে । বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল ,
-ওনার পরিবারের সাথে এখনো কোনো কন্টাক্ট করা সম্ভব হলো না !
-আমি ইনফর্ম করে দিয়েছি । ওরা আসছে …..

বৃষ্টি সপ্রশ্ন তাকালে রেশমি বলল,
-অহনা আমার রেগুলার পেশেন্ট ছিল ……

রেশমির ডাক পড়তেই তিনি চলে গেলেন । বৃষ্টি শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আইসিইউ এর কাঁচের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রইল অহনার দিকে । ডাক্তারদের নিজেদের চেষ্টায় কমতি নেই ……

পাশেই কোথাও আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে । ভোর হয়ে এলো । কামাল মিঞা বৃষ্টির দিকে ফোন এগিয়ে দিল । স্ক্রিনে ইশানের নামটা জ্বলজ্বল করতেই বৃষ্টির বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল । অপর পাশ থেকে যা শুনল তাতে বৃষ্টিকে কিছুটা উত্তেজিত দেখাল । বলল,

– ইশান , ইশা-ন, প্লিজ কাম ডাউন । একদম প‍্যানিক করবি না । টেক আ ডিপ ব্রেথ । ওকে ,। এখন তুই অ্যাম্বুলেন্স কল করবি । আব্বুর ঘরে টেবিলের ড্রয়ারে ডেবিট কার্ড আছে । ওটা সাথে নিস , দরকার পড়বে । আর আমি ম‍্যানেজার আঙ্কেলকে কল করে বলে দিচ্ছি, উনি তোর হেল্প করবে । আর শোন , আমি দুপুর হতে হতে পৌঁছে যাব । একদম টেনশন করবি না । আমি আসছি ….

কল কেটে অহনার দিকে একবার তাকাল বৃষ্টি । তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে চাইল কামাল মিঞার দিকে । বলল,

-চাচা , এবার আমাদের ফিরতে হবে । ওনার পরিবারকে তো ইনফর্ম করে দিয়েছে । যে কোনো মুহূর্তে এসে পড়বে । আমাদের ও ফেরা উচিত । আব্বুর হেল্থ কন্ডিশন আবার ফল করেছে । ইশান একা সামলাতে পারবে না । চলুন ….

বৃষ্টিদের গাড়িটা গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতেই আর একবার পিছন ফিরে চাইল । আকাশ এখনো পরিষ্কার হয়নি । কিন্তু হসপিটাল চত্ত্বরে আলোর অভাব নেই । বড়ো বড়ো ল‍্যাম্প পোস্ট গুলোর আলোতেই দেখল পরপর দুটো ঝড়ের গতিতে পার্কিং জোনে গিয়ে থামল । একজন যুবক পড়িমড়ি করে ছুটে গেল ভেতরে । পরের গাড়ি থেকেও দুজন মহিলা অনুসরণ করল প্রথম পুরুষটিকে ।পথের বাঁকে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বৃষ্টি মাথাটা গাড়ির ব‍্যাক সিটে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রইল ।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here