অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী #দ্বিতীয়_অধ্যায় #পর্ব_১৪ #জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

জোরেসোরে বাতাস বইছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। খানিক বাদে বৃষ্টি নামবে বলে! জানালার ফাঁকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো সুহা। মিঠুর গাড়ি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে ফোনের মেসেজ টিউন বেজে উঠলো। স্ক্রিন অন করতেই ভেসে উঠলো মিঠুর মেসেজ।
“আমাকে দেখছেন সুহা? আমিও দেখছি, এক বিষন্ন চাঁদকে।”

সুহা জানালার পাশ থেকে দ্রুত সরে গেল। মিঠুর মেসেজকে অগ্রাহ্য করে ফোন রেখে বসে রইলো থম ধরে। সে কিছুতেই সামনে এগোতে চায়না। শূন্যে ছেড়ে দিয়েছে জীবন। নিজেকে আড়াল করতে সিদ্ধান্ত নিলো বাসা পরিবর্তন করার। পরক্ষণেই নতুন বাসা নেওয়ার ঝা*মে*লা মাথায় আসতেই তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। এই বাসাটা নিতেই অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। ইবতেসামের বাহ্যিক আচরণ দেখে তাকে ভালো মানুষ মনে হলেও তার ভেতরটা সুহার অজানা। একজন মানুষ আমাদের যতটুকু দেখায়, আমরা ঠিক ততটুকুই দেখি, বিশ্বাস করি। পরবর্তীতে ইবতেসাম যে তাকে বি*প*দে*র মুখে ঠে*লে দেবে না, তার কী নিশ্চয়তা আছে! সুহা আপন ভাবানায় বিভোর হয়ে থাকে। জীবনে করা চরম ভু*ল*টা তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
সন্ধ্যা নামার আগে সুহা আড়াল থেকে আরও একবার বাইরে তাকালো। এখন আর গাড়িটি দেখা যাচ্ছে না। অস্পষ্ট থেকে ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে গ্রিলে হাত রাখলো। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো ধরনীর বুকে। সুহা বৃষ্টির পানিতে হাত বাড়িয়ে দিল। বহুদিন পর আজ আবার বৃষ্টি দেখে তার ভালোলাগছে, ভেজার ইচ্ছে হচ্ছে ভীষণ! একটা ভয় থেকেই আর ভেজা হলোনা। নাজুক শরীর অল্পতেই অসুস্থতায় ডুবে যায়। অসুস্থ হলে নিজেকে নিজে ছাড়া দেখার মতো আর কেউ নেই। এসব ভেবেই মনের সুপ্ত ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দেয়।

★★★

অন্ধকার ছাপিয়ে ঝলমলে রোদ উঠেছে আকাশে। বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে থাকা দুজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তরী। জানালার পর্দা দুহাতে সরিয়ে দিতেই সূর্যের আলো এসে চোখে পড়লো। চোখমুখ কুঁচকে বাবার বুকে মুখ মিশিয়ে দিল অমি। মাহমুদ নিজেও চোখ কুঁচকে নিলো। চোখে আলো সয়ে যেতেই ক্ষীণ চোখে তাকালো তরীর দিকে। স্বভাবসুলভ ঠান্ডা গলায় শুধালো,
“আমাদের দুজনের সাথে তোমার কীসের শ*ত্রু*তা?”

তরী হেসে বলল,
“আমাকে রেখে বাবা-ছেলে আরাম করে ঘুমাচ্ছেন। এটা আমার সহ্য হলোনা।”

অমির ঘুম হালকা হয়েছে। বাবার বুকে থেকেই চোখ কচলে জবাব দিলো,
“তুমিও আসো। একসাথে ঘুমাবো।”

“আমিও তোমাদের সাথে যোগ দিলে সকালের নাস্তা কে তৈরি করবে?”

অমি ভাঙা গলায় বলল,
“মা আছে।”

তরী নিষ্পাপ চেহেরা বানিয়ে বলল,
“মা একা একা কাজ করবে? আম্মু না গেলে তো পিট্টি দিবে।”

অমি গোলগাল চেহারা নিয়ে পিটপিট করে তাকালো। মিষ্টি কন্ঠে বলল,
“মা ভালো। তোমায় পি*ট্টি দেবে না।”

তরী বলল,
“আচ্ছা এখন উঠে পড়ো।”

অমির এখন বিছানা ছাড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। সে বাবার দিকে আরেকটু চেপে ছোটো ছোটো দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরলো। বলল,
“আমি আর পাপা ঘুমাবো। উঠবো না।”

তরী অমিকে টে*নে তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। মাহমুদ অমি দুজনই একজোট হয়ে তরীর বিপক্ষে ল*ড়ে যাচ্ছে। দুজনকে তুলতে গিয়ে সে নিজেই পাশে ধপ করে বসে পড়লো। অমি খিলখিল করে হেসে উঠলো। মাহমুদও হাসছে। তরী কান্না মাখা গলায় বলল,
“উঠো না বাবা! ব্রাশ করিয়ে দিচ্ছি। নয়তো দাঁতে পোকা হবে।”

অমি উঠে বসলো। মাহমুদকে হা করিয়ে দাঁত চেইক করে তরীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাপার দাঁতে পোকা নেই তো।”

তরী বলল,
“তোমার পাপা তো ভোরে নামাজ পড়তে উঠে ব্রাশ করে ফেলেছে। তুমিই এখন বাকি।”

অমি গালে আঙ্গুল ডুবিয়ে কিছু একটা ভাবলো। বলল,
“আমি ব্রাশ করবো না। আগে দেখবো দাঁতে পোকা হলে কেমন লাগে।”

তরী কপাল চাপড়ে বলল,
“তুমি কি আমার ছেলে নাকি অরুর? স্বভাব দেখি তার মতোই হচ্ছে।”

মাহমুদ শব্দ করে হাসলো। বলল,
“জন্মের পর থেকেই তো অরু, রামি, মিঠুকে দেখে এসেছে। স্বভাবটা তাদের মতো হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।”

★★★

অরুর পড়াশোনার পাশাপাশি রুটিনে আরও একটি বিষয় যোগ হয়েছে। রামির সাথে কথা বলা। একদিনও দুজনের ভালোভাবে কথা হয়না। প্রতিদিন কাটে ঝগড়ায়। ক্লাস শেষ দিয়ে বের হতেই একজন সহপাঠী এগিয়ে এসে বলল,
“অরু বিয়ে করে ফেলেছো?”

অপরজন বলল,
“আবির ভাইয়ার সাথে তো মাস দু-য়েক আগেই বিয়ে হলো তোমার। তাহলে৷ এখন আবার!”

অরু মৃদু হেসে বলল,
“যার সাথে বিয়ে হয়েছে, তার সাথেই স্ট্যাটাস দেওয়া আছে। লোকমুখে শোনা কথা বিশ্বাস করতে নেই।”

কাল রাতেই রামি ম্যারেড স্ট্যাটাস শেয়ার করলো। সেখান থেকেই সবাই অরুর বিয়ের ব্যাপারে অবগত হলো। যাদের মনে আবির পূর্বে সন্দেহ ছাড়িয়েছে, তাদের মনে প্রশ্ন জমা হচ্ছে। অরু পাশ কাটিয়ে চলে এলো। গোসল করে এসে প্রথমেই খেয়ে নিলো। আজ সকালেও খাওয়া হয়নি। পেটে প্রচুর খিদে ছিল। পড়তে পড়তেই চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠলো। টেবিলে মাথা রেখে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়লো অরু। তার ঘুম ভাঙলো রাত আটটায়। ফোনের শব্দে হুড়মুড়িয়ে উঠলো। রামির ফোন। সময় দেখে চোখ চড়কগাছ৷ জুমান তাকে একবারও ডাকে নি! মেয়েটার উপর মেজাজ খা*রা*প হলো। সেই মেজাজ ঝাড়লো রামির উপর। কল রিসিভ করেই ঝাড়ি দিলো,
“ভিডিও কল দিতে কে বলেছে? আমি এখন পড়াশোনা করবো।”

রামি আজ নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। প্রতিদিন দুজন ঝ*গ*ড়া করেই কাটিয়ে দেয়। স্ক্রিনে অরুর ফোলা চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে। তৈলাক্ত মুখ, এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে চুল। এখন আর চোখে চশমা নেই। ঘুমানোর সময় খুলে রেখে দিয়েছে অরু। রামি এই এলোমেলো মেয়েটাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এখন সে দেশের বাইরে আছে। গোসল করেই অরুকে কল দিল। শান্ত স্বরে বলল,“রেগে আছিস কেন?”

অরু উত্তর খুঁজে পেল না। হাই তুলে থমথমে গলায় বলল,
“রা*গ করতে যাবো কেন?”

মাঝেমাঝে অযথাই সবার উপর রাগ চলে আসে। অরু নিজেও রাগের কারণ স্পষ্ট খুঁজে পায়না। একজনের উপর রেগে থাকলে তা সবার উপর ঝাড়বে। রামি বলল,“তোকে দেখে মনে হচ্ছে রেগে আছিস। পড়ার প্রেশার খুব বেশি?”

এবার রাগ গিয়ে পড়লো পড়ার উপর। রাগে গজগজ করতে করতে অরু বলল,
“জীবনে এত পড়া কেন থাকতে হবে? একটা বই থাকবে। মাসে দুই-তিনটা ক্লাস থাকবে, শেষ। এত কেন পড়তে হবে?”

রামি ঠান্ডা গলায় বলল,
“আচ্ছা মিঠু বা ভাইয়াকে বলে দিচ্ছি, কোথাও গিয়ে ঘুরে আয়, ভালোলাগবে।”

“আমার সময় নেই।”

রামি ঠোঁট টিপে হাসলো। একটু আগে নিজেই পড়া থেকে বাঁচার উপায় বলছিল। এখন নিজেই পড়ায় ডুবে থাকতে চাইছে। অরু গরম চোখে তাকিয়ে বলল,
“হাসছো কেন তুমি?”

রামি বলল,
“এমন তেঁতুল গাছের ভূত হয়ে বসে থাকলে কী করবো? চুল বাঁধছিস না কেন?”

অরুর কেন যেন রাগ হলো না। গাল ফুলিয়ে বলল,
“চুল বাঁধার সময় পাইনি। ঘুম ভেঙেছে তোমার ফোনকলের শব্দে। এখন অ্যাসাইনমেন্ট করতে হবে বসে বসে। কালই জমা দিতে হবে। এখন ফোন রাখো।”

রামি বলল,
“আমি কলে থাকছি। তুই অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি কর।”

অরু কথা বাড়ালোনা। রামিকে কলে রেখেই একটা ক্লিপ দিয়ে চুল আটকে নিলো। চা বানিয়ে এক কাপ নিজের জন্য নিয়ে এলো। জুমানকে দিলো না। মেয়েটার উচিত ছিল তাকে জাগিয়ে দেওয়া। বিকেল থেকে মোট চার ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে অরু।
রামি মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। অরুকে ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে। যখন রেগে গিয়ে কোমর বেঁধে ঝগড়ায় নামে, তখন তাকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে ভীষণ ভালোলাগে রামির। ছোটো থেকেই সবার সাথে ঝগড়ায় পারদর্শী মেয়েটা। কিছু বললেই তেলে বেগুনে ছ্যাৎ করে ওঠে। অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে করতে রাত দুটো বাজলো। এতক্ষণ কলে ছিল রামি। বিকেল চারটায় তার ফ্লাইং। অরুকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর জন্য এখান থেকে কিছু আনবো?”

অরু বই খুলে বসলো। একবার স্ক্রিনে তাকিয়ে বলল,
“কী আনবে? আমার তো এখন কিছু লাগবে না।”

রামি বলল,
“আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে যা। ভোরে উঠে পড়তে পারবি। এখন জেগে থাকলে ক্লাসে ঘুম পাবে।”

অরু বলল,
“আচ্ছা, এখন কল কাটো।”

“ঠিক আছে।” বলে রামি কল কেটে দিল।
সকাল দশটায় বের হলো শপিংমলে। অরুর জন্য পছন্দমতো বেশ কিছু কেনাকাটা করলো। অমি আর ঈশিতার জন্যও কেনাকাটা করলো। শপিংমল থেকে বের হওয়ার সময় চোখ গেল বাঁ দিকে। একটা কালো রঙের ড্রেস পছন্দ হলো। সেটাও অরুর জন্য নিয়ে নিল। এই প্রথম তার নিজের পছন্দে অরুর জন্য কেনাকাটা করা। রামি উৎফুল্ল মেজাজে কেনাকাটা করে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো দুপুরের খাবার খেতে।

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here