অতঃপর প্রণয়,পর্ব:১৩
অরিত্রিকা আহানা
ইত্তি আর মিতু এতক্ষনযাবত ইরিনের জন্য অপেক্ষা করছিলো। কথা ছিলো আয়াজ হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসবে ইরিনকে। কিন্তু সে মত পাল্টে ফেলেছে। ইরিন টুঁ শব্দটিও করলো না। শ্বশুর শাশুড়ি,মা বাবাসহ বাড়ির বড়দের সালাম করে ইত্তিদের সাথে বেরোনো জন্য তৈরী হয়ে নিলো। আয়াজ সোফায় বসে তুতুরী সাথে দুষ্টুমি করছে। ইরিন সদর দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় শুধু বলল,
—“আসি।”
আয়াজ একবার তাকিয়ে আবার তুতুরীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ইত্তি টেনশনে পড়ে গেছে। ইরিন রেগে আছে কি না সে বুঝতে পারছে না। মিতুকে ইশারা করলো সে। মিতু যেহেতু একটা মেয়ে এইমুহূর্তে আরেকটা মেয়ের মনের অবস্থা সে নিশ্চই বুঝতে পারবে। মিতু তাকে ইশারায় বুঝিয়ে দিলো সে কনফিউজড। ইত্তি বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো,
—“তুই ঠিক আছিস?”
ইরিন জবাব দিলো না। পূর্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। ইত্তি আবার জিজ্ঞাসা করলো,
—“ইরিন? ”
ইরিন গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলল,
—“আমি ঠিক আছি ইত্তি।
হেলাল সাহেবের গাড়িতে করে ওদের যাওয়ার ব্যবস্থা করছে। আয়াজের বড় ভাই মহসিন যাচ্ছে তাদের সাথে। তিনি এখনো নামেন নি, তাই ওরা অপেক্ষা করছে।
দশমিনিটের মাথায় মহসিন নেমে এলো। ইরিন দীর্ঘশ্বাস চেপে বিড়বিড় করে বলল,
—আমি আর আসবো না মি.আয়াজ। আপনি আমার পা ধরে মাফ চাইলেও আমি আসবো না।
বস্তুত ইরিনের মনের অবস্থা হচ্ছে আয়াজ যদি এইমুহূর্তেও এসে তাকে বলে হোস্টেলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই সে অতিউৎসাহের সহিত গাড়ি থেমে নেমে যাবে। কিন্তু আয়াজ আসে নি। ইরিন হতাশভাবে হোস্টেলে ফিরে এলো।
★
বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আয়াজের ঘুম আসছে না। অনেক্ষন যাবত বারান্দায় বসে আছে সে। ইরিন চলে যাওয়ার পর থেকেই ফাঁকা ফাঁকা অনুভূরি হচ্ছে তার। হঠাৎ করে কেন এমন হচ্ছে? অনেকদিন যাবত ইরিনের ওপর রাগ করে ছিলো সে। কিন্তু কখনো এমন অনুভূতি হয় নি। এখন কেন এমন হচ্ছে? ইরিনকে ভীষণ ভাবে মিস করছে সে। ভীষণ, ভীষণ, ভীষণভাবে।
ইরিনকে কি একটা ফোন করবে সে? ইরিন ধরবে? ধরবে না। নিশ্চই তার ওপর রেগে আছে।
দ্রুত গায়ে শার্ট চড়িয়ে নিলো আয়াজ। এইমুহূর্তে ইরিনকে তার সামনে চাই। কেন চাই? কি কারনে চাই? সে কিচ্ছু জানে না। কিন্তু চাই। গাড়ির চাবি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো সে। তাদের এপার্টমেন্টের দারোয়ান মোতালেব হোসেনকে ঘুম থেকে টেনে তুলে গেট খোলার ব্যবস্থা করলো।
ইরিনের হোস্টেলের সামনে এসে ইরিনের নাম্বারে ডায়াল করলো। ইরিন ফোন সাইলেন্ট করেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি ঘুম চলে এসেছে তার। ফলাফল স্বরূপ ফোন ধরতে পারলো না। আয়াজ গেটের নিচে দাঁড়িয়ে বারবার ফোনে ট্রাই করে যাচ্ছে, রিং হচ্ছে কিন্তু ইরিন ফোন ধরছে না। ইরিন কি তাহলে ঘুমিয়ে পড়েছে? অস্থির ভাবে এদিক ওদিক পায়চারি করছে সে। যতক্ষণ পর্যন্ত না ইরিনের সাথে দেখা হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত শান্তি পাবে না সে।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো ইরিনের। বিছানা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। কফি তে চুমুক দিয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। সে ঠিক করেছে আজকের পরীক্ষাটা সে দেবে না। কফি খেতে খেতে ঠান্ডা বাতাসে নিজেকে সিক্ত করার অনুভূতি নিচ্ছে সে। হোস্টেলের রাস্তায় চোখ পড়তেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলো। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভালো করে লক্ষ্য করলো। মানুষটা এদিক ওদিক হাঁটাহাটি করছে। কাছেই গাড়ি পার্ক করা। কপালে হাত রেখে কিছুক্ষন চিন্তা করলো ইরিন। ঘটনার আগাগোড়া কিছুই বুঝত পারছে না। দ্রুত রুমে ঢুকে ফোন চেক করলো সে। সাতটা মিসড কল উঠে আছে। প্রথমটা রাত তিনটায়। তারপরেরটা তিনটা দুই, তারপর তিনটা চার, তিনটা সাত।সবশেষে পৌনে চারটায়। ইরিনের বুক ধড়ফড় করছে। আয়াজের নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়ে কেটে দিলো। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিচে নেমে এলো। তখনও বাইরে আবছা অন্ধকার। গেটে দারোয়ান ঘুমাচ্ছে। ইরিন গেট খোলার জন্য অনুনয় বিনয় করলো। কিন্তু তিনি গেট খুলতে নারাজ। এত সকালে গেট খোলার পারমিশন নেই। ইরিনের প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। মানুষটা নিশ্চই সারারাত এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো। অবশেষে মর্নিং ওয়াকের অযুহাত দিয়ে গেট খুলতে সক্ষম হলো সে। দ্রুত পা চালিয়ে গাড়ির কাছে গেলো সে। আয়াজ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইরিনকে দেখে হতবম্ভ হয়ে গেলো। আগুনলাল চোখজোড়ায় ঢুলুঢুলু ভাব। অপ্রস্তুত ভাবে হাসলো। দুজনের কেউই কোন কথা বলতে পারলো না। তবে এইমুহূর্তে আয়াজের শান্তি লাগছে। আবছা আলোতে ইরিনকে ভীষন সুন্দর লাগছে। আলতো করে তার গালটা টেনে দিতে ইচ্ছে করছে।
নিরবতা ভেঙে আয়াজ বলল,
—“তুই কি আজকে পরীক্ষা দিবি?”
—“হ্যাঁ।”
—“প্রিপারেশন আছে?”
—“না।এখন গিয়ে পড়বো।”
—“না দিলে হয় না?”
আয়াজের আকুতিভরা চাহনি ইরিনের একেবারে কলিজায় গিয়ে লেগেছে। নিজেকে সংযত করে বলল,
—“না হয় না।”
—“আমার ওপর রাগ করে বলছিস?”
—“না।”
—“তবে?”
—“তবে আর কি? পরীক্ষা যখন দিতেই হবে শুধু শুধু পিছিয়ে লাভ কি?”
আয়াজ নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কেন এতরাতে ইরিনের হোস্টেলে ছুটে এসেছে, কেন সারারাত জেগে হোস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো এই নিয়ে একটা প্রশ্নও করলো না ইরিন তাকে। বলল,
—“আপনি কি কিছু বলবেন?”
—“কেন?”
—“আমি পড়তে বসবো।”
—“তুই সিউর পরীক্ষা দিবি?”
—“তাই তো বললাম।”
—“ঠিক আছে যা। ”
ইরিনের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এইমানুষটা এমন কেন? সারারাত রাস্তায় জেগে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে অথচ ভালোভাবে দুটো কথা বলতে তার যত অসুবিধে। রাগে গটগট করে হোস্টেলের দিকে ফিরে গেলো সে। আয়াজ মূর্তির মত তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিন অদৃশ্য হতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। ইরিনের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অশ্রুবিসর্জনটাও অদেখাই থেকে গেলো তার। অথচ সে দিব্যি হাসছে।
★
পরীক্ষা কি দিয়েছে ইরিন নিজেও জানে না। উইদাউট প্রিপারেশন পরীক্ষা দিয়েছে সে। নির্ঘাত ফেল করবে। পরীক্ষা শেষে, সে আর ইত্তি একসাথে বেরোচ্ছিলো গেটে আয়াজকে দাঁড়ানো দেখে ইত্তি সটকে পড়লো। ইরিন একবার ভাবলো দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাবে। কিন্তু পরোক্ষনেই মত পরিবর্তন করে ফেললো। আয়াজ কেন এসেছে তার জানা দরকার! আয়াজের কাছে এগিয়ে যেতেই আয়াজ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
—“এক্সাম কেমন হয়েছে?”
—“ভালো না।”
—“জানতাম আমি। শুধুশুধু আমাকে আবার আসতে হলো।”
—“আপনার উদ্দেশ্য কি?”
ইরিনের কড়া জিজ্ঞাসাবাদ। আয়াজ মৃদু হেসে বলল,
—“তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
—“বলুন।”
—“এখানে না বাসায়।”
—“আমি বাসায় যাবো না।”
—“ইরিন প্লিজ! তোকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করার মত শক্তি আমার গায়ে নেই।বিশ্বাস কর, একফোঁটাও নেই। সোনা, বাবু, ময়না, আমি তোকে বিনীত ভাবে অনুরোধ করছি তুই প্লিজ গাড়িতে উঠে বস।”
ইরিন দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। আয়াজ এমন সিরিয়াস মুহূর্তে তার সাথে মশকরা করছে? দরকার নেই ইরিনের! আর কিচ্ছু শোনার দরকার নেই।
আয়াজ দ্রুত সামনে এসে দাঁড়ালো। ইরিনের হাত ধরে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে বলল,
—“সত্যি ইরিন বিশ্বাস কর, সারারাত দাঁড়িয়ে থেকে আমার খুব কষ্ট হয়েছে।”
—“আপনি শুধু শুধু তামাসা করছিলেন কেন?
—“তুই বাসায় যাবি না বললি কেন?”
আয়াজ গাড়ি স্টার্ট দিলো।সারারাস্তায় ইরিন একটা কথাও বলে নি। চুপচাপ বসে ছিলো। বাসায় পৌঁছাতে সোহেলি বেগম আয়াজ আর ইরিনকে দেখে চমকে উঠলেন।ইরিনের হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গেলেন। ফিসফিস করে বললেন,
—“ঘটনা কি?”
ইরিন কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। আয়াজ ফ্রেশ হয়ে মায়ের ঘরে এলো। ইরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—“রুমে আয়। তোর সাথে কথা আছে।”
ইরিন শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকালো।তিনি ইশারায় যেতে বললেন। আয়াজের পিছু পিছু রুমে ঢুকলো সে। আয়াজ আবারও ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি দিলো। বেরিয়ে এসে দেখলো ইরিন খাটের ওপর বসে পা দোলাচ্ছে। চেয়ার টেনে ইরিনের মুখোমুখি বসলো। সে তাকাতেই ইরিন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
—“এই হরিণ তাকা আমার দিকে। তাকা না?
ইরিন আগের মত বসে রইলো।
—“তোকে হরিণ কেন ডাকি জানিস?”
ইরিনের কোন নড়চড় নেই। আয়াজ নিজে নিজেই বলল,
—“তোর চোখদুটো হরিণের চোখের মত মায়াবী তাই।”
ইরিনের হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে,তীব্রগতিতে লাফাচ্ছে। তবুও জবাব দিলো না সে। আয়াজ ওর হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
—“আমি তোকে সেই ছোটবেলা থেকে ভালোবাসি।”
ইরিন অবাক চোখে আয়াজের দিকে তাকালো। আয়াজ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
—“তোর মনে আছে প্রথমবার সবাই মিলে যখন আমাদের দুজনের বিয়ে ঠিক করেছিলো? তখন আমি টুয়েলভ এ ছিলাম। সারাদিন তোর সাথে ঝগড়া? বড়আপু যখন আমাকে ফিসফিস করে জানালো মা আমাদের বিয়ে দিতে চাইছেন তখন আমি কিন্তু মনে মনে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম তুই না করে দিবি। তাই আমিও না করে দিয়েছিলাম। ”
ইরিন অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছে। আয়াজ বলল,
—” তারপর তোর এইচ এসসি পরীক্ষার আগে বাবা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো তোকে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি আছে কি না তখন কিন্তু আমি আর না করি নি। তবে আমার ইচ্ছে ছিলো তোর পড়ালেখা যখন মোটামুটি শেষের পর্যায়ে আসবে তখন বিয়েটা হবে। কিন্তু তোর পাগলামির জন্য হুট করে আমাকে ডিসিশন চেইঞ্জ করতে হলো। এবার আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিবি তুই?”
—“কী?”
—“তুই আমাকে ভালোবাসিস?”
ইরিন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
—“কখনো না। ”
আয়াজ হাসলো। ইরিনের খোঁপা করা চুল গুলো টেনে দিয়ে বলল,
—“ইশস!কখনো না! বললেই হলো? কালতে রাতে তুই মায়ের সামনে কি বলেছিলি মনে আছে?”
—“ভুল বলেছি। একদম ভুল।”
—-“হুম। আর?”
—“আর মানে?”
—“আচ্ছা যা, বিশ্বাস করে নিলাম। তুই রাগিস না।”
—“আপনি আর কিছু বলবেন?”
—-“হুম। আমি বুঝতে পেরেছি বিয়ের পর সত্যি মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে থাকা উচিৎ। স্বামীর সেবা করা উচিৎ। সেই হিসেবে তোরও তোর শ্বশুর বাড়িতে থাকার অধিকার আছে।”
ইরিনের মাথায় আসছে না আয়াজ হঠাৎ মত পরিবর্তন করলো কেন? গতকাল রাতে সে নিজেই ইরিনের থাকা নিয়ে তুলকালাম বাধিয়েছে অথচ আজকেই মত পরিবর্তন করে ফেলেছে? রহস্যটা কি?
আয়াজ বলল,
—“তবে আমার একটা শর্ত আছে। তুই যদি আমাকে কথা দিস, পড়াশোনা ঠিকমত করবি তাহলে হোস্টেলে থাকার দরকার নেই। বাসায় থাকতে পারবি। কারণ আমি আন্টিকে কথা দিয়েছি তোর পড়াশোনা শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেবো না। এবার তুই বল, তোর কি মতামত? বাসায় যদি থাকতে চাস তাহলে পড়াশোনায় কোন ফাঁকিবাজি করা যাবে না। মন দিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে হবে। যতদিন আমি আছি সকালে দিয়ে আসবো। ছুটির সময় নিয়ে আসবো।”
—“ঠিক আছে।”
—“তবে নেক্সট উইক থেকে আমি কিন্তু ঢাকায় থাকছি না।”
আজকে সকালেই খবরটা পেয়েছে আয়াজ। সরকারি হাসপাতালে চাকরী হয়ে গেছে তার। তবে পোস্টিং হয়েছে ঢাকার বাইরে।
—“কোথায় যাবেন আপনি?”
—“আমার পোস্টিং ঢাকার বাইরে পড়েছে। যশোরে। তোর সমস্যা হবে না। তুই বাবার সাথে কলেজে আসা যাওয়া করবি।”
ইরিন জবাব দিলো না। মৌনমুখে বসে রইলো। আয়াজ মুচকি হেসে বলল,
—“ভালো হয়েছে না? আমি চলে গেলে শান্তিতে থাকতে পারবি।”
—“কবে যাবেন?”
–“নেক্সট উইক।”
—“ভালো।”
আয়াজ হঠাৎ লম্বা হয়ে ইরিনের পাশে খাটে শুয়ে পড়লো। ইরিনের হাতটা টেনে বুকের ওপর রেখে বলল,
—“অনেক ভালোবাসার কথা বলে ফেলেছি। এবার তুই একটু ভালোবাসা দেখা। স্বামীর সেবা কর। সারারাত তোর জন্য মশার কামড় খেয়েছি। মহিলা হোস্টেলের মশাগুলো কম করে হলেও আমার লিটার খানেক রক্ত খেয়েছে। দুর্বল হয়ে গেছি আমি।এবার তুই সেবা করে সুস্থ কর।”
আয়াজ চোখ বন্ধ করে ইরিনের কোমর জড়িয়ে ধরলো। ইরিনের আবার বুক ধড়ফড় করছে।সারা শরীরঝিমঝিম করছে। আয়াজ চোখ বন্ধ করেই বলল,
—“হরিণ? কি ভাবছিস তুই?
ইরিনের হঠাৎ রেশমার কথা মনে পড়ে গেলো। কৌতুহল বশতই জিজ্ঞেস করলো,
—“রেশমার সাথে আপনার কি সম্পর্ক? আপনি যদি আমাকেই ভালোবাসেন তাহলে রেশমাকে বিয়ে করবেন বলেছেন কেন?”
—“এত ঘটনা ঘটে গেলো তুই এখন রেশমাআপুকে নিয়ে পড়ে রইলি?”
—“কথা ঘোরাচ্ছেন কেন? রেশমা আবার আপনার আপু হলো কবে থেকে?”
—“উনি আমার সিনিয়র। আমার রাগ উঠে গিয়েছিলো তোর ওপর। তাই রাগ করে বলেছিলাম। ”
—“রেশমার কথাই কেন বলেছিলেন?
—“কারণ রেশমা আপুর একটা ছেলে আছে। আমি জানি তুই পরে আমাকে প্রশ্নটা করবি। তাই ভেবেচিন্তা উনার নামই বলেছি। তুই তো আবার ঝগড়ুটে!”
—“মিথ্যে বলার আর জায়গা পান না তাইনা? ঐ মেয়েকে দেখলে কেউ বলবে না তার ছেলে আছে।”
আয়াজ তাল মিলিয়ে বলল,
—“ঠিক বলেছিস। হট না?”
ইরিন সরু চোখে আয়াজের দিকে তাকালো।আয়াজ চোখ বন্ধ রেখেই হাসছে। দুম করে আয়াজের পিঠে কিল বসিয়ে দিলো সে। রাগে চোখমুখ লাল করে ফেললো। তাকে কষ্ট দিয়ে কি শান্তি পায় আয়াজ? আয়াজের চুল গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে ইচ্ছেমত টানলো। আয়াজ তখনো হাসছে।
—“এত জোরে টানছিস কেন? ব্যথা পাই তো।”
ইরিন চুল টানাটানির পরিমান বাড়িয়ে দিয়ে আবারও কৈফিয়ত নেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
—” আমি কি আরাম পাওয়ার জন্য টানছি?” কি বলেছেন আপনি? রেশমা, হট না? খুব হট? ”
—“ইরিন লাগছে। টাক বানিয়ে ফেলবি নাকি?”
—“হ্যাঁ ফেলবো।”
—“এই যে তুই বউদের মত আচরণ শুরু করে দিলি। বিয়ে হয়ে গেছে বলে ভাবিস না আমি তোর সাথে মারামারি করবো না? ছাড় বলছি! আমি ধরলে কিন্তু রেহাই নেই। পরে আমার দোষ দিতে পারবি না।”
ইরিন আয়াজের গায়ের ওপর উঠে গেছে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
—“কি বললেন আপনি? নিজে দোষ করে আবার আমাকে মারবেন বলছেন? মারবেন আমাকে? ”
—“না। চুমু খাবো। আয় চুমু খাই! যদিও সকালে ব্রাশ করি নি ব্যাপার না। আমি নিশ্চিত এলাচির সুঘ্রাণ পাবি।”
টেনে নিজের চুল থেকে ইরিনের হাত দুটো সরিয়ে নিলো আয়াজ। দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
—“লেট’স স্টার্ট?”
ইরিন নাকমুখ বিকৃত করে বলল,
—“আপনি একটা খাটাস।আমার বোধশক্তি থাকতে এই জীবনেও কোনদিন আমি আপনাকে চুমু খাবো না।”
—“খাবি না?”
—“জীবনেও না।”
—“ঠিক আছে, আমি আয়াজ রহমান শপথ করে বলছি তোকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বানিয়ে হলেও আমি চুমু খাবোই খাবো। ব্রাশ না করেই খাবো। আহা! কি সুন্দর এলাচির সুঘ্রাণ! তুই একবার চুমু খেয়েই দেখ না।”
ইরিনের বমি আসছে। আয়াজের রুচিবোধ এত জঘন্য কেন? ওয়াক!থু!
আয়াজ আবারও ভিলেনটাইপ হাসি দিয়ে বলল,
—“ইরিন? জাস্ট একটা।”
আয়াজের রীতিমত তার হাতদুটো নিজের হাতের বাধনে আটকে ফেলেছে। ইরিন অবস্থা কাঁদোকাঁদো। তার এমন অবস্থা দেখে আয়াজের দম ফেটে হাসি আসছে। ইরিন পা দুটো এলোমেলো ছুঁড়ে সতর্ক করে বলল,
—“আমি কিন্তু সবাইকে বলে দেবো? খবরদার না। আঁআঁআঁআঁ!”
আয়াজ তাকে আধশোয়া করে ফেলেছে। ইরিন কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
—“আপনি প্লিজ ব্রাশ করে আসুন।”
—“তুই কোন দেশের হেলথ মিনিস্টার, তোকে চুমু খেতে আমার ব্রাশ করা লাগবে?”
আয়াজ আলগোছে একটা চুমু খেয়েই নিলো ইরিনের ঠোঁটে। তারপর মুচকি হেসে ইরিনের ইরিনের হাতদুটো ছেড়ে দিলো। সাথে সাথেই ইরিন হামলে পড়লো তার ওপর।এলোপাথাড়ি কিল দিয়ে বলল,
—“খবিশ লোক! আমি এখন আপনার গায়ে বমি করবো। করবই করবো। ”
সোহেলি এসেছিলেন নাস্তার জন্য ডাকতে। রুমে ঢুকে এদের দুজনের অবস্থা দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেলো। এসব কি হচ্ছে? বিছানার বালিশ নিচে পড়ে আছে। চাদরের অবস্থা এলোমেলো। এদের কি বিয়ের পরেও কোন কান্ডজ্ঞান হয় নি? এসব ছেলেমানুষি করছে কেন? তাঁকে দেখে দুজনেই ভদ্র হয়ে বসেছে। সোহেলি ধমকে উঠে বললেন,
—“এসব কি আয়াজ?”
আয়াজ সুবোধ বালকের মত বলল,
—“আমি কিছু জানি না মা। হরিণকে জিজ্ঞেস করো।”
ইরিন রাগে ফেটে যাচ্ছে।ইচ্ছে করছে সোহেলি বেগমের সামনেই থাবড়া মেরে আয়াজের নাক ফাটিয়ে দিতে। বদ লোক! কি সুন্দর তার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে।সোহেলি রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ওদের দুজনকে ডাইনিং টেবিলে যাওয়ার কথা বলে গেলেন। তিনি বেরিয়ে যেতেই শুরু হলো পুনরায় মারামারি, কাটাকাটি।
.
.
.
চলবে