#অচেনা_মায়া [পর্ব ১] (সায়েন্স ফিকশন)
নুসরাত জাহান লিজা
জ্ঞান ফিরতেই অদ্ভুত ঘড়ঘড় শব্দে ভড়কে গেল রোহান, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে বিফল হলো। এবার খেয়াল করল হাত-পা স্ট্র্যাপ দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। নাকের উপরে অক্সিজেন মাস্কের মতো কিছু একটা লাগানো। মুখ ঘুরিয়ে আশেপাশে নজর বুলালো সে। ধবধবে সাদা রঙের দেয়াল দেয়া একটা ঘর, অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি চারপাশে। রোহানের মনে হলো এটা বুঝি একটা ল্যাবরেটরি।
“ওয়েলকাম টু আওয়ার গ্যালাক্সি, রোহান।”
কিছুটা মেয়েলী আর যান্ত্রিক গলার স্বরে মাথা ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখল অতি রূপবতী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু মেয়েটার কোথায় যেন একটা অস্বাভাবিকতা রয়েছে! সে ঠিক ধরতে পারছে না।
“তুমি ‘প্ল্যানেট সিক্সটিন’ এ সারভাইভ করতে পেরেছ। কংগ্রাচুলেশনস।”
“মানে কী? তুমি কে? এটা কোন জায়গা? আমি এখানে কেন?”
“আমি ড. নোরা। এটা ‘প্ল্যানেট সিক্সটিন’। আমাদের গ্রহের সন্ধান এখনো তোমরা পাওনি।”
“তুমি মজা করছো আমার সাথে?”
“আমরা মজা করতে পারি না। সেটা মানুষরা পারে।”
রোহান এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকালো, নীলচে চোখ দুটো বড্ড যান্ত্রিক। ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি মুখাবয়বে। ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল রোহানের মেরুদণ্ড বেয়ে।
“যা বলার পরিষ্কার করে বলো। তোমরা কারা? তোমাদের উদ্দেশ্যই বা কী? আমাকে এখানে কেন আর কীভাবে আনা হয়েছে?”
হতবিহ্বল হয়ে একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল রোহান। যতদূর মনে পড়ছে, বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। পিঠের দিকে মেরুদণ্ডের মাঝ বরাবর ব্যথা পেয়েছিল সে। চিকিৎসক এমআরআই করাতে বললে, খুব ভয় পেয়েছিল। ছোটবেলায় একবার খেলতে গিয়ে পানিতে ডুবে প্রায় মরতে বসেছিল, সাথের ছেলেটা দ্রুত বাড়িতে খবর দিলে কোনোক্রমে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। তারপর থেকে আবদ্ধ জায়গার একটা তীব্র ভীতি মনে জেঁকে বসে আছে। ওর প্রবল আপত্তির মুখে চিকিৎসক অগত্যা চেতনানাশক ইনজেকশন প্রয়োগ করেন। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে এখানে আবিষ্কার করল।
“আমরা অনেকদিন ধরে তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু অনেকরকম সিগনাল পাঠিয়েও কোনো লাভ হয়নি। পৃথিবীর আবহাওয়ার জন্য আমরা সরাসরি সেখানে যেতে পারছিলাম না।”
নোরা কিছুটা হেঁটে সামনে এগিয়ে গেল, একটা সুইচ চাপতেই ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে সেই এমআরআই কক্ষ চোখে পড়ল, আস্তে আস্তে কক্ষের বাইরে আলোকপাত করল যন্ত্রটা। এবার দেখল তার মা বসে বসে কাঁদছেন। ভেতরে ভেতরে ভীষণ বিচলিতবোধ করল রোহান।
“অবশেষে সুযোগ এলো, তোমাকে এমআরআই মেশিনে ঢুকানোর পর আমাদের কমিউনিকেশন মডিউল সিগনাল পেল। তারপর সেটার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তোমাকে এখানে আনা হয়েছে।”
এতক্ষণে একবারের জন্যও রোহান নোরার মুখে অন্যকোনো অভিব্যক্তি দেখেনি।
“এত ঝামেলা করে আমাকে এখানে নিয়ে আসার কারণটা জানতে পারি?” অধৈর্য্য হয়ে প্রশ্ন করল রোহান। ভেতরের ভয়টা ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে৷
“তোমার কাজ হলো ‘ডায়াটনিক স্কেল ইকুয়েশন’ সমাধান করা। কারণ পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র মানুষ যে এই ইকুয়েশনের প্রায় এইটটি ওয়ান পার্সেন্ট সমাধান করেছো৷ দ্বিতীয়জন এখনো থারটি সিক্সে আটকে আছে।” কোনোরকম ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি কাজের কথা বলল নোরা।
রোহান চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “এটা তোমাদের কেন প্রয়োজন?” সে অত্যন্ত ক্ষুরধার মস্তিষ্কের একজন গণিতবিদ। অসীম কৌতূহল দমাতে না পেরেই এই সপ্তক সমীকরণ সমাধানে নেমে পড়ে। শতকরা একাশি ভাগ সমাধানের পরে এসে বুঝতে পারে এটা পুরোপুরি সমাধান করলে পৃথিবীর বিপদ। অক্সিজেন এমনভাবে হ্রাস পাবে যে কোনো প্রাণী টিকতে পারবে না।
“এটা সলভ হলে আমরা অনেক সম্বৃদ্ধ হবো। এমনিতে আমরা কয়েকটা দিক দিয়ে মানুষের চাইতে এগিয়ে থাকলেও কিছু দিক থেকে পিছিয়ে আছি৷ আমরা পৃথিবীর অক্সিজেনে সার্ভাইভ করতে পারি না। তোমাদের মতো আমরা অনুভূতিপ্রবণ নই, মানবিক কিছু অনুভূতিও প্রয়োজন আমাদের।” যান্ত্রিক গলায় বলে চলছে নোরা।
“আমি যদি না রাজি হই? এটার সমাধান হলে পৃথিবীর উপরে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, অনেককিছু বদলে যাবে। তাই কাজটা করছি না আমি।”
“কিন্তু আমাদের গ্রহের কল্যাণের জন্য এটা অবশ্যই লাগবে। তুমি যদি সাহায্য না করো, তবুও তুমি আমাদের কাজে আসবে, আমরা চেষ্টা করছি তোমার ব্রেইনের একটা রেপ্লিকা তৈরি করার। তুমি সাহায্য করলে দ্রুত হতো, না করলে কাজটা একটু পিছিয়ে যাবে এই আরকি। তুমিও চিরতরে আটকা পড়ে যাবে এখানে।”
কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল নোরা। রোহান ভয়ে ঢুক গিলল, এসব নিশ্চয় একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন হবে বলে ভাবছে সে। চারপাশটায় আবার ভালো করে চোখ বুলাল, বড় একটা ভল্টের মতো মনে হচ্ছে। রোহান ছাড়া মায়ের আর কেউ নেই, সে যদি পৃথিবীতে না ফিরতে পারে, মা একা একা কী করে থাকবেন? যদি সত্যিই সমীকরণটার সমাধান হয়ে যায় তাহলে পৃথিবীর মানুষের ভয়ঙ্কর বিপদ। সেজন্যই সিংহভাগ সমাধানের পরেও পিছিয়ে এসেছে। আর ভাবতে পারল না সে। ভেতরে একটা তীব্র হাহাকার টের পায়। মনে মনে বেশ কয়েকবার আল্লাহকে ডাকল, সাহায্য প্রার্থনা করল পরম করুণাময়ের কাছে।
কিছুক্ষণ পরে ভল্টের প্রবেশপথ ক্যাচক্যাচিয়ে খুলে যায়, নোরাকে আবার আসতে দেখল।
রোহানের মাথার চারপাশে অদ্ভুতদর্শন একটা যন্ত্র সেট করল। এতে ভীত হয়ে মাথা এদিক-ওদিক নাড়ানোর চেষ্টা করতেই যন্ত্রের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা একটা শক্ত কিছু মাথাটাকে এঁটে ধরল। মাথা নাড়াবার কোনো উপায় থাকল না।
“কী করছো? আমাকে পৃথিবীতে যেতে দাও, প্লিজ।”
কাতর গলায় আর্তি জানালো ভীত রোহান, ছেলেবেলার ভয় ফিরে আসছে মস্তিষ্কে। কিন্তু নোরার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নির্বিকার থেকে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। যন্ত্রটা কাজ শুরু করার পরে বুঝতে পারল এটা একটা স্ক্যানার। কিন্তু এমনটা আগে দেখেনি রোহান। কিছুক্ষণ পর মাথাটা মুক্ত করে দিল নোরা।
“ভেরি স্ট্রেঞ্জ! তোমার মস্তিষ্কের পুরো ইমেজ পাওয়া যাচ্ছে না। একবার তীব্র ভয়, একবার বিস্ময়, একবার খুব অন্যরকম কিছু অনুভূতি। একটা স্পষ্ট হবার আগে অন্যটা এসে পড়ছে বলে একটাও ঠিকঠাক ধরা যাচ্ছে না।”
নোরার চেহারায় বিস্ময়ের ছিটেফোঁটা নেই, একইরকম ভাবলেশহীন।
নোরার কথায় রোহান যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, তবে সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
“পুরো ইমেজ না পেলেও অর্ধেকের বেশি পেয়েছি। আমাকে নিয়ে সেখানে একটা অদ্ভুত অনুভূতি দেখলাম, আমি তার সাথে পরিচিত নই। এটা কিসের অনুভূতি?”
“এটাকে বলে ভালোলাগা। তোমাকে প্রথম দেখে আমার বেশ ভালো লেগেছিল।” কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে কথাটা বলল রোহান।
“এটা কী ভালোবাসা ধরনের কিছু?”
“না, ভালোবাসা অনেক বৃহৎ একটা ব্যাপার। তুমি বুঝবে না।”
“কেন বুঝব না?”
“কারণ তুমি অনুভূতিহীন। ভালোবাসা, মায়া, টান এসব মানবীয় বৈশিষ্ট্য তোমাদের মধ্যে নেই। অন্য কোনো গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীর আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে তোমার মধ্যে নেই এটা নিশ্চিত।” নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল রোহান।
“কাজের কথায় আসি, বাকি অংশ সমাধান করবে কিনা বলো?”
“না, করব না। আমি চাই না পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হোক।” দৃঢ় গলায় বলল রোহান।
“আমি বললাম তো বড় কোনো ক্ষতি হবে না।”
“তুমি এতটা নিশ্চিত হচ্ছো কীভাবে?”
“ইকুয়েশন সলভ হবার সাথে সাথে একটা তীব্র ঝাঁকুনি হবে। খুব অল্প পরিমাণে জলবায়ু পরিবর্তন হবে। আমরা সব গ্রহে টিকে থাকতে পারব তখন। পৃথিবীর এখনকার খারাপের দিকে যাওয়া জলবায়ুর পরিবর্তন থেমে যাবে। এটা ভালো হবে বরং।”
সশব্দে হেসে ফেলল রোহান,
“তোমাকে এই আজগুবি তথ্য কে দিয়েছে?”
“এটা মোটেও আজগুবি তথ্য নয়। স্বয়ং আমাদের বিজ্ঞান পরিষদের চেয়ারম্যান দামির এই তথ্য দিয়েছেন।”
“তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন।”
“তুমি খুব ভালো করে জানো আমরা মিথ্যা বলতে পারি না।”
“আমি এতক্ষণ ভেবেছিলাম তুমি যথেষ্ট বুদ্ধি রাখো। আসলে তা নয়। আমাকে বিশ্বাস না করলে তুমি নিজেই পরীক্ষা করে দেখতে পারো।”
“এই পরীক্ষা শুধুমাত্র মহামান্য চেয়ারম্যান করেন। আমাদের অনুমতি নেই।”
দু’বার শুধু চোখের পলক পড়ল। রোহান খেয়াল করেছে নোরা যখন দ্বিধায় থাকে তখনই কেবল দ্রুত চোখের পাতা নড়ে।
“কেন নেই? এই প্রশ্ন তোমাদের মনে আসেনি? আসলে পুরোটাই তার একটা ফাঁকি।”
এবার চোখের নড়াচড়া দ্রুততর হলো,
“তুমি মিথ্যা বলছো।”
“মোটেও না। মিথ্যা বলায় আমার কোনো স্বার্থ নেই। ভেবে দেখো, যদি পৃথিবীর ক্ষতি না হতো তবে আমার বাধাটা কোথায় ছিল? সমাধান করে ফিরে যেতাম। এটা বোঝার জন্য খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না।”
“আমি আসছি।” বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল নোরা।
***
নোরা তাদের প্রধান কক্ষের দিকে এগুলো, যেখানে বিজ্ঞান পরিষদের চেয়ারম্যান দামির বসেন। এখানে তাদের মোট জনসংখ্যা সর্বসাকুল্যে ঊনপঞ্চাশ। এই কক্ষে কেবল তিনজনের প্রবেশাধিকার আছে। নোরা তাদের একজন। বিশেষ ধরনের একটা পাসকোড ব্যবহার করে সে ভেতরে এলো।
“রাজি হলো?”
নোরা জানে এখানে বসে তিনি সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন। তবুও প্রশ্নটা করলেন।
“না, স্যার। এখনো হয়নি।”
“তুমি মনে হয় ছেলেটার কথায় বিভ্রান্ত হয়েছো?”
“কিছুটা হয়েছি। স্যার, পৃথিবী ঠিক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে?”
“তুমি বেশ ভালো মতো প্রভাবিত হয়েছো। তুমি আমাদের অত্যন্ত চৌকস বিজ্ঞানী। তোমাকে একজন মানুষের কথায় বিভ্রান্ত হওয়া মানায় না।” কটাক্ষের সুরে বললেন তিনি।
“আমি নিজে একবার টেস্ট করে দেখতে চাই।”
মুহূর্তেই তার চোখে ক্রোধ ফুটে উঠল, রাগে কাঁপতে থাকলেন দামির। হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,
“তুমি আমাদের প্রাইমারি রুল ভেঙেছো। এর শাস্তি তুমি জানো।”
নোরা উত্তর পেয়ে গেছে, “আমাদের কোনো অনুভূতি নেই, রাগ, ক্ষোভ, মায়া কিছুই নেই। কিন্তু আপনি রেগে গেছেন। তাহলে তো মিথ্যাও বলতে পারেন আপনি, অস্বাভাবিক নয় সেটা।”
“তুমি ভীষণ ভুল করেছো নোরা। তুমি, রোহান আর পৃথিবীর মানুষ কেউ বাঁচবে না। সব ধ্বংস হয়ে যাবে।”
দামিরের অভিব্যক্তিতে তীব্র প্রতিহিংসার ছাপ ফুটে উঠেছে, চোখ দুটোতে হিংস্রতা! এক অন্য দামির যেন নোরার সামনে বসে আছে। তিনি একটা বিশেষ সুইচ টিপলেন, এটা একটা বিপদ সংকেত। সিকিউরিটি রোবট আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। এরমধ্যেই এখান থেকে পালাতে হবে। রোহানের জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। জীবনে প্রথমবার ভয় পাচ্ছে সে।
নোরা কিছুক্ষণ আগে আরেকটা নিয়ম ভেঙেছে। রোহানের মস্তিষ্কের রেপ্লিকা নিজের মাথায় প্ল্যান্ট করেছে। নোরার নিজের ঘরে কোনো সেন্সর লাগানো নেই। সেখানে সে কিছু বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। অনুমতি আছে অবশ্য। সেসব কাজে লেগেছে আজ। তারপর থেকেই নানারকম অনুভূতির খেলা চলছে তার মনে, মস্তিষ্কে। এখন একটাই ভাবনা যেভাবেই হোক রোহানকে পৃথিবীতে পাঠাতে হবে। নয়তো সর্বনাশ হয়ে যাবে!
চলবে