অগত্যা_তুলকালাম,শেষ পর্ব

#অগত্যা_তুলকালাম,শেষ পর্ব
নাফীছাহ ইফফাত

এলোমেলো ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম তখনই রাফিন এলো। ড্রেসিং টেবিল থেকে সাদার ওপর সোনালী চেইন বসানো পাগড়িটা নিয়ে মাথায় দিয়ে আমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো। নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো খানিকক্ষণ। তারপর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। ওর হাতে হাত রাখতেই নিঃশব্দে আমার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর হাঁটতে থাকলো। যতটুকু দেখছি মনে হচ্ছে রাস্তাটা কাশবনের দিকে গেছে। গভীর রাতে বড় রাস্তায় তেমন গাড়ি নেই। মাঝেমধ্যে সাই করে ছুটে চলেছে মালবাহী বড় বড় গাড়ি। আমরা দুজন ধবধবে সাদা বিয়ের পোশাকে চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটছি। আমাদের শুভ্র পোশাকগুলো অন্ধকার রাস্তায় অদ্ভুত এক আলো হয়ে ফুটছে। ল্যাম্পপোস্টগুলো আমাদের আলো দিচ্ছে, সামনের পথ দেখিয়ে দিচ্ছে আর স্বাক্ষী হচ্ছে এক পবিত্র ভালোবাসার পথচলায়। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ল্যাম্পপোস্টের আলো শেষ হয়ে গেল। এরপরের রাস্তাটা ঢুকেছে কাশবনের দিকে। এদিকে কিছুদূর পর পর ছোট ছোট সাদা আলোর বাল্ব লাগানো আছে। মৃদু আলোয় আমরা পাশাপাশি হেঁটে চলেছি। একসময় মৃদু আলোগুলোও হারিয়ে গেল। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। আমার ঘোমটা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাঁইসাঁই করে মনের আনন্দে ঘোমটাটা খেলা করছে বাতাসের সাথে। এদিকে আমি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। একদম ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা হাঁটছি। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটায় অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছে। রাফিন আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
“ভয় লাগছে?”
প্রথম কথা বললো আমার সাথে। শিউরে উঠলাম। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল। এতে ওর হাতে চাপ লেগে গেল। আমি দু’পাশে মাথা নেড়ে আস্তে উচ্চারণ করলাম, “উঁহু- হু।”
“আমি আছি তো।” অস্পষ্ট গলায় বলে রাফিন। রাতের নিস্তব্ধতায় রাফিনের বুকের ভেতরের ঢিপঢিপ শব্দও যেন আমার কানে আসছে।
খানিকবাদে ও আবার প্রশ্ন করলো, “হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?”
“নাহ” গলার স্বর পরিষ্কার করে বললাম।
ও আমার হাত চেপে ধরে থামালো। হাঁটুমুড়ে বসলো রাস্তায়। আমার পায়ের পেছনে হাত নিয়ে হিলের ফিতে ধরলো। আমি খানিকটা সরে এসে বললাম,
“কি হয়েছে?”
“জুতো খুলে হাঁটো, ভালো লাগবে।”
আমি নিচু হয়ে নিজেই হাত দিলাম এবার জুতোয়। ও আমার হাত সরিয়ে বললো,
“আমি করছি তো। অন্ধকারে পারবে না তুমি।”
“আমারই তো জুতো।”
“কিনেছি তো আমি।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না। ও জুতো জোড়া খুলে একহাতে নিয়ে অন্যহাতে আমার হাত ধরলো। তারপর হাঁটতে শুরু করলো।

অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছি অন্ধকারে। আর কতদূর কে জানে? আকাশে বড় চাঁদ। গাছের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো রাস্তায় উপচে পড়ছে। ভালোই লাগছে হাঁটতে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। অন্যরকম ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল। আমরা থামছি না, হেঁটেই চলেছি। রাতের আঁধারে একটা দ্রুতগামী রেল ছুটে গেল। হাঁটতে হাঁটতে আকাশের দিকে মুখ করে তাকালাম। টুপটাপ পানি পড়লো আমার চোখেমুখে। স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। স্বপ্নটা কি আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের এই পরিণয়ের ইঙ্গিত ছিল?

রাফিন বললো, “ইশ! একটা ছাতা থাকলে ভালো হতো।”
“ভিজতে ভালো লাগছে।” মৃদুস্বরে বললাম।
ও আমার কাঁধে হাত দিয়ে বাহু চেপে ধরে বললো,
“আরেকটু কাছে আসার জন্য হলেও একটা ছাতার প্রয়োজন ছিল।”
আমি আঁড়চোখে তাকালাম ওর দিকে। ও মুচকি হাসলো। চাঁদের আলোয় সেই হাসি বুক ছাপিয়ে হৃদয়ে গিয়ে বিধলো। এত সুন্দর করে মানুষ কিভাবে হাসে? আমি নতুন করে নতুন রাফিনের প্রেমে পড়লাম। হালাল, বৈধ প্রেম। বৈধ ভালোলাগায় অন্যরকম স্নিগ্ধতা কাজ করছে। আগের চেয়েও অনেক বেশি মুগ্ধতা কাজ করছে আজ। বুকের ভেতরের ঢিপঢিপ শব্দটা যেন একমুহূর্তের জন্যও বন্ধ হচ্ছে না।

রাফিন হঠাৎ কবিতা আবৃত্তি শুরু করলো। আবৃত্তি না ঠিক, গল্পে গল্পে কবিতা পড়ছে ও।

“শীত যখন আসার খবর জানান দেয়,
হালকা কুয়াশায় যখন চারপাশটা একটু ধূসর হয়,
দূরের আকাশটাও হয় অস্পষ্ট, ঝাপসা।
তখন সোডিয়াম লাইটের আলোগুলো বুকে তীব্র
ব্যাথা হয়ে বিধে।
রাতের আঁধারে দ্রুতগামী রেলের শব্দ
বুকের ধুকপুকানি বাড়িয়ে তোলে শত সহস্রগুণ।
তীব্র ব্যাথায় বারান্দায় যেতে পারি না রাতে,
কোথায় যেন হাজারটা স্মৃতি মনে এসে গাঁথে।
জানান দেয়,
তারা একসময় জীবন্ত ছিল।
কিন্তু কোন সেই স্মৃতি মনে পড়ে না আমার!

আচ্ছা, এরমধ্যে কি আমি একবার স্মৃতি হারিয়েছি? সোডিয়াম লাইট সম্পর্কিত কিছু কি ঘটেছিল আমার জীবনে? যা এই আমি ভুলে গিয়েছি?
সোডিয়াম লাইটগুলো যেন আমার দিকেই তাকিয়ে উপহাস করে বলছে,
কুয়াশায় ঢাকা আমার মতোন তোমার স্মৃতিগুলোও হয়েছে অস্পষ্ট, মলিন। আসলে সবই ধোঁয়াশা, কোনো স্মৃতিই নেই, সব মনের খেয়াল।
আসলেই কি তাই?”

“আরোহী, আসলেই কি তাই?” প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে।
আমার বুকের ভেতর তখন ধ্বক করে উঠলো। অনেক অনেকদিন পর ডাকটা শুনলাম। মনটা বিশুদ্ধতায় ছেঁয়ে গেল। গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম,
“সব মনের খেয়াল। অবৈধ অতীত ভুলে যাওয়া ঢের ভালো।”
অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকতে থাকতে গলার স্বর একদম বসে গেছে।
“তাই না?” রাফিন মুচকি হাসলো। ও কি জানে ওর এই হাসিটা আমাকে প্রতিনিয়ত নিহত করছে?

অনেকটা পথ আসার পর ঘন জঙ্গল শুরু হলো। আমি ভেবে পেলাম না জায়গাটা কোথায়? এমন জংলী এলাকা তো আগে কখনো দেখিনি। নাকি অনেকদিন এই পথে পথচারীরা আসে না বলে এমন জঙ্গল তৈরী হয়েছে?অনেকক্ষণ পর এক চিলতে ফিকে আলোর দেখা পেলাম। সেই আলো ধরেই এগোচ্ছি আমরা। কোনো এক অজানা কারণে রাফিনকে জিজ্ঞেস করতে পারছি না কোথায় যাচ্ছি আমরা। আলোর খানিকটা কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়লো বিশাল লাভ শেইপের একটা বিল্ডিং। অর্ধেকাংশ ধবধবে সাদা, বাকী অর্ধেক নীল। অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো, “মা শা আল্লাহ।”
রাফিনের ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি। আমরা আলোর দিকে আরো এগিয়ে গেলাম। সামনে বিশাল লোহার গেইট। এটাকে গেইট বলা যায় না ঠিক। ইংরেজিতে ‘LOVE’ লেখার ইয়া বড় বড় চারটা দেয়াল। ‘O’ অক্ষরটা হলো গেইট। সেটা ঠিক ‘O’ লেটার না, বিশেষভাবে লাভ বানানো হয়েছে। যার কিছু অংশ মাটির নিচে পুঁতে গেছে। আমরা সেই বিশেষ লাভ চিহ্নের গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। চারপাশে বিশাল বিশাল অজস্র নাম না জানা গাছের ডালপালা এসে পড়েছে বাড়িটার চারপাশে। আর গেইটের ভেতর ঢুকতেই দেখা গেল লম্বা একটা রাস্তা। যেটা গিয়ে থেমেছে বাড়ির দরজায়৷ দরজাটাও লাভ শেইপের। রাস্তার চারপাশে সারিবদ্ধভাবে লাগানো আছে অনেকগুলো গাছ। সবগুলো সমানভাবে ছাঁটাই করা। বিস্ময়কর হলো বাড়িটার ভেতর থেকেও মোটা মোটা গাছ ডালপালা ছড়িয়ে বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে। চারপাশে আরও কত কি যে আছে আমি দেখার সময়টুকুও পেলাম না। তার আগেই রাফিন আমাকে দরজার সামনে নিয়ে এলো। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম দরজায় ঝুলন্ত তালাটা লাভ শেইপের এমনকি তালার চাবিটাও। এত আশ্চর্য আমি জীবনে হইনি। রাফিন চাবি ঘুরিয়ে তালা খুললো। তালা খুলতেই স্ক্রিন ভেসে উঠলো দরজায়। পাসওয়ার্ড দিতে বলা হলো। রাফিন পাসওয়ার্ড লিখলো, “আমার হৃদয়ের আরোহী”।

এরপর আমাকে ভেতরে নিয়ে এলো। লাইট জ্বালালো। লাইটটাও লাভ শেইপের। ঘরের মাঝখানে মস্তবড় ঝাড়বাতি, সেটাও লাভ শেইপের। কি আশ্চর্য! আমি চারপাশে তাকালাম। ঘরের প্রতিটা জিনিস লাভ শেইপের। এ কোন ভালোবাসার রাজ্যে চলে এলাম? আমি কি স্বপ্ন দেখছি? ভেবে পেলাম না।

রাফিন আমার হাতে চাবির তোড়াটা দিয়ে বললো,
“আজ থেকে এটাই আমাদের বাড়ি। আমাদের লাভ ম্যানশন। এখানে থেকে আমরা সারা দুনিয়ায় ভালোবাসা বিলাবো।”
আমি তখনও ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারিনি। অস্ফুট স্বরে শুধু বললাম, “লাভ ম্যানশন?”

বিল্ডিংয়ের অর্ধেক অংশ মাটির নিচে। লাভের নিচের অংশটা মাটির নিচে। ওখানেও ঘর আছে। পাতালপুরি। সে এক অন্য রাজ্য। বিল্ডিংটা সর্বমোট চারতলা। প্রথম দরজা দিয়ে ঢোকার পর সামনের অংশটুকু লম্বা খোলা বারান্দার মতো। মাঝখানে কোনো দেয়াল নেই, এমনকি কোনো আসবাবও নেই। পুরো ঘরজুড়ে চারটা দরজা। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর শুরু হয় আসল থাকার ঘর। রাফিন আমাকে নিয়ে এলো বেডরুমে। এই বেডরুমে বিশেষ কিছু নেই, একটা খাট আর ড্রেসিল টেবিল বাদে। বেডরুমে ঢুকেই মেঝের এককোণায় পা দিয়ে জোরে আঘাত করলো রাফিন। অবাক হয়ে দেখলাম, ফ্লোরের কিছু অংশজুড়ে লাইট জ্বলে উঠলো। তারপর শব্দ বেরুতে লাগলো, “পাসওয়ার্ড, পাসওয়ার্ড” বলে। রাফিন আমার সামনেই টাইপ করলো,
“আমার শুদ্ধতম ভালোবাসা”
লক খুলে মেঝে পুরোটা ফাঁক হয়ে গেল। অন্য একটা সুইচ টিপতেই নেমে গেল সিঁড়ি। রাফিন আমাকে আলগোছে ধরে নামালো সিঁড়ি দিয়ে। তারপর আবার ডোর লক করে দিলো। এবার চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম সাদা আর নীলে ভরপুর। সবকিছু নীল-সাদা, ফার্ণিচার ছাড়া। ফার্নিচারগুলোও এমন রঙ্গে বানানো যে সাদার সাথে একদম ফুটে রয়েছে।

ও আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো বেডরুমে। বেডরুমে ঢুকতেই অন্যরকম শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়লো আমার হৃদয়ের আনাচে-কানাচে। সারাঘরে আয়না। যেদিকে তাকাই শুধু আমরা দুজন ছাড়া কেউ নেই। আয়নায় সাদা দুজন কপোত-কপোতী। অদ্ভুদ মোহনীয় ভঙ্গীতে আমি রাফিনের হাত চেপে ধরলাম শক্ত করে। রাফিন গিয়ে ব্যলকনির গ্লাসের দরজাটা খুললো। দরজা খুলতেই দেখলাম; ব্যলকনি নয়, সবুজের গালিচা বিছানো ঘাসভর্তি মস্তবড় উঠান। রাফিন বললো,
“এসো। আচ্ছা ওয়েট, তুমি বরং একটু সাজগোজ করে নাও। এতদূর হেঁটে আসার পর নিশ্চয়ই টায়ার্ড হয়ে গেছো।”
“আচ্ছা।”

রাফিন আমাকে রেখে কোথায় যেন চলে গেল। আমি ঝটপট হিজাব খুলে ফেললাম। চুলগুলো একটু আঁচড়ে নিলাম। হাতমুখ ধুয়ে সাজটা আবার সাজলাম। এবার অনেকটা ফ্রেশ লাগছে। ততক্ষণে রাফিন চলে এলো। একদম অন্যরকমভাবে পরিপাটি করে সেজেছে ও। মাথায় পাগড়ি পরেছে। বাহ! এসেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“সামথিং মিসিং! ইয়াহ!” বলেই একটানে চুল খুলে দিলো।

পাতালপুরীতেই ও আমাকে উঠানে নিয়ে এলো। মাথার ওপর খোলা আকাশ। আশ্চর্য! পাতালপুরীতে আকাশ কিভাবে দেখা যাচ্ছে?

আকাশে বিশাল গোল চাঁদ। আমরা দুজন দাঁড়িয়ে আছি খোলা আকাশের নিচে।
“আজ কত তারিখ বলতো?” রাফিন আমার চোখে চোখ রেখে বললো।
আকস্মিক প্রশ্নে থতমত খেয়ে বললাম,
“মনে পড়ছে না।”
রাফিন হো হো করে হাসলো৷ ওর হাসির দাপটে আমার সামনের চুলগুলো পর্যন্ত নড়ে উঠলো।
“নিজের বিয়ের ডেট মনে পড়ছে না তোমার?”
আমি আহত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এত সুন্দর হাসি দেখার জন্য হলেও এরকম আরও কিছু বোকামি করা যায়।

রাফিন হাসি থামালো। মুখে মুচকি হাসি ধরে রেখে আমার থুঁতনিতে হাত রেখে বললো,
“আজকে আরবী মাসের চৌদ্দ তারিখ। আজ আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদ থাকবে সেটা আমার জানা ছিলো। আমি চেয়েছিলাম তোমার সাথে আমার প্রথম রাতটা খোলা আকাশের নিচে চাঁদকে স্বাক্ষী রেখে কাটুক। আমি চাইনি আমাদের বিয়েতে কেউ সাজুক। আমাদের বিয়ে তাই আমরাই সাজবো শুধু। তুমি কি রাগ করেছো, তোমার সাথে পরামর্শ করা ছাড়াই সব সিদ্ধান্ত একা নিয়েছি বলে?”
আমি দু’পাশে মাথা নাড়লাম। রাফিন আকাশের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,
“দেখো, আমি চেয়েছিলাম মস্ত আকাশটা আজ সাজুক। আকাশ সাজলো মানে পুরো পৃথিবী সাজলো। দেখো, তারায় তারায় ভরে গেছে আকাশ। তোমাকে কৃত্রিম আলোয় দেখবো না বলে খোলা আকাশের নিচে চাঁদের প্রাকৃতিক আলোয় নিয়ে এসেছি। মিছেমিছি বৈদ্যুতিক তারার লাইটে আমাদের বিয়ের আয়োজন চাই না বলে স্রষ্টা প্রদত্ত তারায় ভরপুর খোলা আকাশের নিচে তোমায় নিয়ে এসেছি। আজ আমার জীবন স্বার্থক।”

একটু থেমে রাফিন বললো,
“এই পৃথিবীতে এই মুহুর্তে তোমার মতো রূপবতী কেউ নেই আমার কাছে। চাঁদের আলোয় কাউকে এত মোহনীয় লাগতে পারে আমার জানা ছিলো না। তোমাকে না পেলে বোধহয় কখনোই জানা হতো না। ”

আমি অপলক তাকিয়ে আছি রাফিনের দিকে। সে কি জানে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষটা এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে? সে কি জানে, চাঁদের আলোয় তার দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে? সে কি জানে, এই মুহুর্তে তাকে আমার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে? ছুঁয়ে দিলে কি রাগ করবে? আমি কি রাগ দেখাবো একটু? অযথাই? ধমকে বলবো, আর কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবে আমাকে? আমি কি তোমার অনারে চাকরী নিয়েছি?

রাফিন আমার চোখের পাতায় ফুঁ দিয়ে আমার ধ্যান ভাঙ্গালো। বললো, “বসো, আর কত দাঁড়িয়ে থাকবে?”
ঘাসের উপর বসলাম। ও আমার গাউনটা চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে মোহনীয় ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। কতসময় পেরিয়ে গেল জানা নেই। আমারও ভালো লাগছে চুপচাপ বসে থাকতে। আমি হাঁটুতে থুঁতনি রেখে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আজ আর কোনো বাঁধা নেই। হালাল পাওয়ার আনন্দে আমি আত্মহারা।

দীর্ঘসময় পর বললো, “তোমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে জানো? আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো পরী। নাহ! আমার মনে হয় আজকে তোমার রূপের কাছে পরীর রূপও হার মানবে। তুমি এত সুন্দর আগে কখনোই মনে হয়নি আমার। ট্রাস্ট মি! এটাই বোধহয় হালালের মাধুর্যতা। তোমার একটা ছবি তুলে রাখি কি বলো?”

আমি মাথা নেড়ে সাঁয় দিলাম। রাফিন ফোন বের করে আমার ছবি তুললো। তারপর দুজন একসাথে ছবি তুললাম। এরপর আমাকে নিয়ে ঘাসে শুয়ে পড়লো ও। দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছি। রাফিন একপাশ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক অব্দি পড়ছে না। আমি কি স্বপ্নে দেখছি? ঘুমিয়ে পড়েছি নাকি? এসব তো বেহেশতে গেলে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, দুনিয়ায় তো এতকিছু চাইনি। সফর শেষেই পাড়ি জমাবো। এতসব কিছু কার জন্য তাহলে?

“আজকে আর কোনো বাঁধা নেই ঐ চোখে চোখ রাখবার,
কোনো বাঁধা নেই চুলে হাত রাখবার,
কোনো বাঁধা নেই হাতে হাত রাখবার, ছুঁয়ে দেওয়ার।”
রাফিনও শুয়ে পড়লো সটান। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। হাজার হাজার তারা মিটিমিটি জ্বলছে। যেন আমাদের বিয়ের জন্য আকাশ সেজেছে। আমরাও খুশিতে জ্বলছি মিটিমিটি।

আজকে মানুষটার পাগলামি দেখেই কেটো যাচ্ছে সময়। আমি কথা বলার কোনো সুযোগ-ই পাচ্ছি না। মৃদুকণ্ঠে কথা বলার চেষ্টা করলাম। গলা খাঁকারি দিয়ে কোনোরকমে বললাম,
“আপনি আগে থেকে জানতেন আমার সাথেই আপনার বিয়ে হচ্ছে?” আপনা থেকেই মুখ দিয়ে ‘আপনি’ সম্বোধন বেরিয়ে এলো।

রাফিন হেসে জবাব দিলো, “প্রথমে জানতাম না, বাড়িতে যাওয়ার পর জেনেছি। তোমাকে ওখানে দেখে শক্ড হয়েছিলাম প্রচন্ড। পরে জানলাম যে, ইতিমধ্যেই আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। শুধু আমার মত নেওয়ার অপেক্ষা।”
“জানার পর কি করেছেন?”
“জানার পর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করার ভাষা ছিল না আমার। তোমার একটিমাত্র সঠিক পদক্ষেপ আমাকেও পাল্টে দিলো। আর আমাদের আল্লাহর দিকে বাড়ানো একটি পদক্ষেপ আল্লাহকে আমাদের দিকে দশ পদক্ষেপ কাছে নিয়ে এসেছে। তুমি জানতে না আমাদের বিয়ের বিষয়টা?”
“উঁহু।”
“বিয়েতে তো রাজি ছিলে।”
“বাবা-মা যাকেই পছন্দ করবে তাকে বিয়ে করবো কথা দিয়েছিলাম। তবে আপনার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে সেটা জানতাম না।”
“আমাদেরকে কথা বলতে বলা হয়েছিলো। নাকীব জানালো, তুমি এই বিষয়ে কিছুই জানো না। বললো সারপ্রাইজ দিতে।”
“নাকীব জানতো সবটা?”
“আমি যেদিন ও-বাড়ি যাই সেদিনই ও জেনে যায় সবটা। শুধু ও না, পুরো বাড়ির সবাই জানতো তুমি ছাড়া। যেদিন নদীতে আমাদের দেখা হয় সেদিন-ই আমাদের কথা বলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সবাই। কিন্তু তুমি না থাকায় আর কথা বলা হয়নি। তখন আমিও আবার কাজে গিয়েছিলাম।”
“আচ্ছা।”

রাফিন গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“তোমাকে ফলো করতে যাইনি। নদীর ওপাড়ে মায়ের নামে একটা জমি ছিলো। সেটা দেখতে গিয়েছিলাম।”
“ওহ।” লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে জবাব দিলাম।
“তুমি কি করে ভাবলে, আমি কোনো মেয়েকে ফলো করবো? এটা কি আমার স্বভাবে ছিল কখনো?”
“তখন ভয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বলেছি।”

রাফিনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টালাম।
“নাকীবের সাথে কখন থেকে যোগাযোগ হয় আপনার?”
“ঠিক তোমার সাথে সম্পর্কের শুরুর দিন থেকে।”
“কিহ?”
“তুমি হয়তো জানো না, ও আমার গুপ্তচর ছিল। তোমার প্রতিটা খবর পাই টু পাই আমাকে জানাতো। আর আমাদের সম্পর্ক শেষ হলেও নাকীবের সাথে সম্পর্কটা রয়ে যায়।”
“বাহ! খুব ভালো। এজন্যই নাকীব বারবার বলছিলো কাশবনের গহীনে অন্যরকম শেইপের একটা বিল্ডিং উঠছে, তার মালিককে তুমি বিয়ে করে নাও যাতে আমরা কাছাকাছি থাকতে পারি।”
“তাই বলছিলো নাকি? হাহা!”
“হ্যাঁ, আরও বলছিলো, রাফিন ভাইয়াকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করো না। তাই তো বলি, পরে সে আমার বিয়ে নিয়ে টু শব্দ করলো না কেন? আগে থেকে সব জানতো বলে।”
“হাহা!” রাফিন হাসলো একটুখানি। তারপর বললো,
“বাই দ্যা ওয়ে, তুমি আমাকে আপনি করে বলছো কেন?”
“আপনি করে বলতে ভালো লাগছে।”
“আমারও শুনতে ভালো লাগছে।” মিষ্টি করে হাসলো সে।

রাফিন দাঁড়িয়ে বলে,
“শেষবারের মতো অতীতের কিছু কথা খোলাসা করতে চাই। করবো আরোহী?”
“আচ্ছা।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললাম।
“তুমি হয়তো ভেবেছো তখন তোমাকে বিয়ে করার কথা বাবাকে জানাইনি। জানিয়েছি৷ জানোই তো, আমি আমাদের পুরো বংশের সবার চেয়ে ছোট। আমার বিয়ে নিয়ে তাই সবার অনেক প্ল্যান ছিল। অনেক ধুমধাম করে বিয়ে হবে। তখন আমি কিছুই করতাম না। আর ঠিক এটা নিয়েই একদিন বাবা আমাকে বকা দেয় খুব। রাগ করে তোমার সাথে দেখা করতে আসলাম তুমিও সেম কথাই বললে৷ রাগে আঙ্কেল-আন্টি আই মিন তোমার বাবা-মাকে নিয়ে খারাপ কথা বলে ফেলেছি৷ আর তুমি প্রায়ই বলতে না, বিয়ে করতে? বাবাকে বললেই বলতো, পড়াশোনাই শেষ হয়নি এখন কিসের বিয়ে? বিয়ে করলে বউকে খাওয়াবে কি? বাবা-মায়েদের কমন ডায়লগ। অথচ আল্লাহ নিজেই বলেছেন, যার যার রিজিকের ব্যবস্থা তিনি আলাদাভাবে করে রেখেছেন৷ এসব বাবাকে বলতাম, বুঝতো না। অবশেষে নিজেকে পরিবর্তন করলাম। এতই পরিবর্তন করলাম যে, আজ আমার সিদ্ধান্তের ওপর কথা বলতে সবাই আগে দশবার ভাবে। যাদের প্ল্যান ছিলো মহা ধুমধামে বিয়ে দেওয়ার তারাই আজ আমার সিদ্ধান্তে চুপসে গেছে। আমার মতের বিরুদ্ধে একজনও যেতে পারেনি। তখন আসলে আমার যোগ্যতা ছিলো না, ছিলো না কাউকে নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর ক্ষমতা। বাবার টাকায় নিজের যোগ্যতা জাহির করা যায় না তুমি ঠিকই বলেছিলে। আসলে তোমাকে আমি বুঝতে দিতাম না যে, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি৷ আমি চাইতাম তুমি বুঝে নাও নিজ থেকে। আর তোমাকে এমন ভাব দেখাতাম যেন আমি অনেককিছু। ভেতরে যে কত ক্রাইসিস চলছে সেটা কখনো বুঝতে দিইনি। তোমার চলে যাওয়ার সেই কষ্টটাও আমি মানতে পারছিলাম না। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতেই মা আমাকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন। তারপর সবকিছু আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়ে পাড়ি জমালাম অন্য জেলায়। তখন থেকেই আমার পরিবর্তন শুরু। হেদায়েত পাই ওখানেই।”

আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর অনেকটা আড়ষ্টতা নিয়ে জীবনে প্রথমবার ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম,
“এখন থেকে সব বুঝবো। রাগেন, কাটেন, মারেন সব বুঝে নিবো৷ তখন তো অবৈধ সম্পর্ক ছিল তাই হয়তো গভীরে ঢুকতে পারিনি আপনার। এখন তো সব হালাল, সব পারবো। শুধু আর কখনো অতীত মনে করাবেন না বলেন? অনেক কষ্টে অবৈধ অতীতকে ভুলেছি আমি।”
“কি পারবে শুনি একটু?”
“সময়মতো দেখবেন সব৷ তার আগে বলেন ভেতরে আর কোনো ক্রাইসিস, যন্ত্রণা, টেনশন কিচ্ছু লুকিয়ে রাখবেন না? সব আমার সাথে শেয়ার করবেন?”
মুচকি হেসে বললো, “ইন শা আল্লাহ চেষ্টা করবো।”
“আমার সাথে না পারলে আল্লাহর সাথে অন্তত শেয়ার করবেন।”
“সে তো করবোই।”
“ওহ হ্যাঁ, আমার একটা বিষয় জানার আছে।”
“কি?”
“আপনার মতো দেখতে হুবুহু একজন, সে কে?”
“আমার মামাতো ভাই শামীম।”
“মামাতো ভাই? অথচ দেখতে হুবুহু এক! কিভাবে সম্ভব?”
“ও মূলত আমার-ই ভাই। মামার কোনো সন্তান নেই তাই ওকে দত্তক নেয় মায়ের কাছ থেকে। মায়ের এবং মামীর প্রায় একই সময়ে বাচ্চা হয়। অর্থাৎ আমরা দুই ভাইয়ের যখন জন্ম হয় তখন মামারও একটা সন্তান হয়। এর আগে টানা বারো বছর মামার কোনো সন্তান ছিল না। প্রথম সন্তান জন্মের পরপরই মারা যায়। মামী সন্তান জন্মের খুশিতে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর সংবাদটা কেউ তার কানে দেয়নি। আমার মা-ও বিষয়টা জানতে পেরে, মামীর কষ্টের দিকে তাকিয়ে নিজের নাড়িছেঁড়া সন্তানকে মামীর কোলে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মামীর অজান্তেই বাবা-মা আর মামা মিলে মামীর কোলে শামীমকে দিয়ে আসে। মামী মহানন্দে নিজের সন্তানের মতো কোলে তুলে নেয় শামীমকে।”
“মা কষ্ট পায়নি?”
“কষ্ট পাবে না? মায়ের অনেক কষ্ট হয়েছিলো। বাবাও রাজি ছিলো না প্রথমে। এর কিছুদিন আগে মায়ের মানে তোমার খালামণিরও একজন সন্তান মারা যায়। চারপাশে যখন সন্তান হারানোর আর্তনাদ তখন আমার মায়ের কোলজুড়ে দুটো সন্তান। মা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যদি ওদের কষ্ট দেখে চুপ করে থাকার ফলে আল্লাহ তার সন্তানকেও কেঁড়ে নেন? এই ভয়ে মা শামীমকে দিয়ে দেয় মামীর কোলে। আর আমি পেয়ে যাই শামীমের ভালোবাসার ভাগটুকুও। মামী অবশ্য ধীরে ধীরে বুঝতে পারে। যেহেতু বড় হতে হতে আমরা দুজন হুবুহু একইরকম হয়ে যাচ্ছিলাম। শামীম আর আমার মধ্যে বেশ কিছু ফারাক আছে, চেহারাটা শুধু মিল আমাদের। ওর চুল কোঁকড়া, আমার স্ট্রেইট; ওর চোখ ব্রাউন কালার আর আমার ঘনকালো; ওর স্বভাব নরম, আর আমার…”
“কড়া!”

রাফিন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। আমি জিভ কাটলাম। ও আবার বলতে লাগলো,
“আর ও কথা বলার সময় একটু তোতলায়। কিছু ব্যাপার বুঝতে ওর খানিকটা সময় লাগে। ওর ব্রেইন খানিকটা শর্ট। হয়তো যে একটুখানি ব্রেইন ওর শর্ট পড়েছে সেগুলো আমার ব্রেইনে অ্যাড হয়ে গেছে। এজন্য আমি অতি ট্যালেন্টেড।”

রাফিন জিভের কোণ বের একচোখ টিপে হাসলো। আমিও মুচকি হাসলাম, দুষ্টুমির হাসি।

“এমনিতে হলে কিন্তু মামী শামীমকে নিতে পারতো না। দুধ মা হয়েছে বিধায় তিনি শামীমের জন্য বৈধ হয়েছেন। এসব আমরা কেউ জানতাম না এতদিন। মা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে আমায় বিস্তারিত বলেছিলো।”

আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকলাম রাফিনের দিকে। ও বললো,
“জানো, ও কি করেছে? ওর তো তোমাকে ভালো লাগতো। আরে আমার যমজ বলে কি তোমাকেই ওর ভালো লাগতে হবে? সেদিনও তো, আমার পরিবার যখন তোমায় দেখতে গেল সে ড্যাংড্যাং করে চলে গেল তোমাদের বাড়ি, তোমাকে বিয়ে করতে। ভাবো একবার? তারপর আমি গিয়ে বোঝালাম, “এখানে একটা প্রবলেম ক্রিয়েট হয়েছে। আঙ্কেল তোকে আমি ভেবেছে দ্যাটস অল। তুইও চলে এলি নাচতে নাচতে বিয়ে করতে?”
তারপর সে রেগেমেগে চলে গেল। আমি ভেবেছিলাম, আমরা দুজন একসাথে তোমার সামনে এসে তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু সে এখন আমার সাথে মহারাগ! তাছাড়া নন-মাহরাম ট্যাগ তো আমারটা মুছেছে, তারটা মুছেনি।” রাফিন একচোখ টিপে হাসলো।

কিল দেওয়ার ইচ্ছেটাকে বহুকষ্টে সামলে বললাম,
“কি আশ্চর্য! আপনি এখনো আমাকে জড়িয়ে ধরেননি কেন? আমি কখন থেকে জড়িয়ে ধরে আছি?”

রাফিন হাত বাড়াতেই আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে বললাম,
“ওয়েট, ওয়েট! আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কি?”
আমি ওর ডায়েরিটা বের করে দিলাম। সাথে করেই নিয়ে এসেছিলাম। ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বললো,
“কােথায় পেলে এটা? কত্ত খুঁজেছি জানো?”

আমি বিস্তারিত বললাম৷ রাফিন শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমার মিষ্টি বউ। সব তো জেনে গেছো তাহলে। আর কিছু জানানোর নেই। অতীত নিয়ে আর কখনো কথা তুলবো না ইন শা আল্লাহ।”

দুজনই কিছুক্ষণ নিরব রইলাম। রাফিন বললো,
“যদিও এখন ডায়েরিটার প্রয়োজন নেই। এখন তো তুমি আছো।”
“ডায়েরিটার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। এখানে এমন সব কথা লিখা আছে যা আপনি কখনোই আমাকে বলেননি। আমি সবসময় দোটানায় ছিলাম আপনাকে নিয়ে। কখনো মনে হতো ভালোবাসেন, কখনো মনে হতো বাসেন না৷ এমনকি ছেড়ে যাওয়ার পরও আমি দোটানায় ছিলাম। কখনো মনে হতো আমার মতো আপনিও আমাকে মিস করেন, আবার মনে হতো করেন না। ডায়েরিটা পড়েই আপনার সব অনুভূতি আমি অনুভব করতে পেরেছি।”

“এখন তো সব অনুভূতি শেয়ার করতে পারবো ইন শা আল্লাহ।”
“তবুও ডায়েরিটার গুরুত্ব অনেক।”
“আচ্ছা আচ্ছা রাখো তো তোমার কাছে৷”
“হুম রাখবোই তো।”
সাথে সাথে আবার মত পাল্টে বললাম,
“আচ্ছা, এটা তো অবৈধ ভালোবাসার গল্পের ডায়েরি। এটা বরং পুড়িয়ে ফেলি।”
“যা ইচ্ছে করো তো, আমার এখন তুমি হলেই চলবে।” আমার থুঁতনিতে হাত রেখে বললো রাফিন।
“আচ্ছা, চলেন দু’রাকায়াত শুকরিয়ার নামাজ আদায় করি।”
“হুম ঠিক বলেছো, চলো।”

অতঃপর দুজনে ওযু করে শুকরিয়ার নামাজ আদায় করলাম। সেদিন এই বিশ্বাসে রাফিনকে ছেড়েছিলাম যে, “তুমি যদি আল্লাহর জন্য কোনোকিছু ছেড়ে দাও, তাহলে আল্লাহ অবশ্যই তার চেয়েও উত্তম কিছু দিয়ে তা পূরণ করবেন।” সত্যিই আল্লাহর জন্য কোনোকিছু ত্যাগ করলে তা উত্তমরূপে ফিরে আসে কথাটার আজ যথাযথ প্রমাণ পেলাম। আজ রাফিনকে আমি উত্তমরূপেই পেয়েছি। সেদিনের রাফিন আর আজকের রাফিনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আর আমার মধ্যেও। সেদিন ওকে ছেড়ে দ্বীনকে আঁকড়ে না ধরলে হয়তো আজ এত মর্যাদা পেতাম না আল্লাহর কাছে।

ফজরের নামাজ পড়ে কয়েক ঘন্টা ঘুমালাম আমরা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মৃদু কন্ঠের গান শোনা গেল রাফিনের কন্ঠে। গান না ঠিক, এটা আসলে রোমান্টিক নাশীদ। ও মৃদু কন্ঠে গাইছে,

“শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে হাঁটবো যখন থেকো পাশে
দেখবো দুজন প্রথম কিরণ সূর্য যখন মুচকি হাসে।”

আমি উঠতেই ও মুচকি হাসলো। তারপর বললো,
“উপরের লনে যাই। ওখানে হ্রদ আছে। হৃদির হ্রদ।”
ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। “হৃদির হ্রদ?”
“হু চলো, দেখেই আসি।”

দুজনে বিয়ের পোশাক পাল্টে সাদা ছিমছাম পোশাক পরে উপরে গেলাম। নিচে আমাদের সব জিনিস গুছিয়ে রাখা ছিল। অনেকক্ষণ পর নিজেকে তুলার মতো হালকা লাগছে। আমি ভাবতেও পারছি না এত ভারি পোশাক পরে এতক্ষণ আমি ছিলাম। উপরের লনে এসে দেখি এখানেও সুন্দর সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো। ঘাসে শিশির ফোটা জমে আছে।
লাভ ম্যানশনের পেছনে বয়ে গেছে শীতল পানির হ্রদ। লনের পেছনে গেলেই দেখা মেলে হ্রদের। হ্রদের পাশে সাইনবোর্ড লাগানো, “হৃদির হ্রদ”।
আমি হেসে বললাম, “এটা কি?”
“এটা তোমার।” রাফিন হাসলো মিটিমিটি।

হ্রদের ওপারে রেললাইন। সামনে দোলনা টাঙ্গানো আর চারপাশে বাহারি রকমের গাছপালা। গেইটের বাইরে একপাশ ধরে কাশফুলের ছড়াছড়ি। জায়গাটা একদম অক্ষত রেখেছে রাফিন। তার পাশ থেকে সরায়নি সেই বেঞ্চিটাও। বেঞ্চিটা গেইটের ভেতরেই রেখেছে। বাড়ির পেছনেও দিয়েছে আরেকটা করে দোলনা এবং বেঞ্চি।

ও আমাকে সাথে নিয়ে খালিপায়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরো লন চার-পাঁচবার ঘোরাঘুরি করেছে এরমধ্যেই। চারপাশটা খতিয়ে খতিয়ে দেখছি। সবটা আগের মতো। কিচ্ছু বদলায়নি। একটা গাছ পর্যন্ত কাটেনি। দিনের বেলায় লাভ ম্যানশনকে আমি নতুনরূপে আবিষ্কার করলাম। বিল্ডিংটার অন্যরকম সৌন্দর্য হচ্ছে এর ভেতর দিয়ে দিব্যি গাছ উঠে গেছে। যেখানে গাছ ছিল সেখানটায় ফাঁকা রেখে বিল্ডিং উঠেছে। বাসার ভেতরেও গাছগুলো অক্ষত রয়েছে। শুধুমাত্র কাঁচ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে গাছের চারপাশ। ওর বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। যতক্ষণ হেঁটেছি ততক্ষণ রাফিনের হাতে টেপ রেকর্ডারে অনবরত নাশিদটা বাজছিলো।

“শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে হাঁটবো যখন থেকো পাশে
দেখবো দুজন প্রথম কিরণ সূর্য যখন মুচকি হাসে।
দিনের শুরু থেকে শেষে থেকো তুমি মোর পাশে
ভালোবেসে ভালোবেসে চলো হারাই প্রেমের দেশে

উদাস হৃদয় জুড়ে তুমি হয়ে এলে শীতলতা
তোমার ব্যথায় হই ব্যথিত বাড়ে মনের ব্যাকুলতা
তোমার ছবি আছে আঁকা আমার হৃদয়ের বা’পাশে।
দিনের শুরু থেকে শেষে, থেকো তুমি মোর পাশে
ভালোবেসে ভালোবেসে চলো হারাই প্রেমের দেশে।

ধরার মাঝে শুধু তুমি হলে আমার প্রিয়তমা
প্রণয় মাখা যত কথা তোমার জন্য আছে জমা।
দুজন দুজনার ছায়া হবো যতদিন না মরণ আসে।
দিনের শুরু থেকে শেষে থেকো তুমি মোর পাশে
ভালোবেসে ভালোবেসে চলো হারাই প্রেমের দেশে”

একসময় রাফিন আমাকে নিয়ে আসে লাভ ম্যানশনের পেছনে। সেই বেঞ্চিটা আজও আছে, যেখানে আমরা আগে দেখা করতাম। আর সেটাকে রাফিন লাভ ম্যানশনের ভেতরেই রেখেছে। পেছনে এসে বেঞ্চিতে আমরা দুজন পাশাপাশি বসি৷ আগের মতো দূরে দূরে নয়, একদম কাছাকাছি। রাফিন আমাকে লাভ ম্যানশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়।

“মূলত এই বাড়িটাই আমাদের দুজনের। উপরে যা দেখলে, তারও উপরে আরও তিনতলা আছে। সবগুলো আমরা দাওয়াহর কাজে ব্যবহার করবো। লাভ ম্যানশনে দিনে হাজার হাজার মানুষ ইসলামের দাওয়াহ নিতে আসবে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো মানুষের তরে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেবো। মানুষ নিজেদের জন্য ঘর বানায় সুন্দর। আমরা আল্লাহর পথে মানুষকে ফেরাতে সবচেয়ে সুন্দর ঘর বানালাম। তাছাড়া এমনিতে ইসলামের জন্য ডাকলে তো কেউ আসবে না তাই এই সুন্দর ব্যবস্থা। অন্তত সুন্দর শেইপের বাড়িটায় ঢোকার জন্য হলেও হাজার হাজার মানুষ এখানে আসবে। সারাদিন চলবে দাওয়াহ কার্যক্রম। আর অভুক্ত, আশ্রয়হীনদের আসল ঠিকানা হবে এই লাভ ম্যানশন। তাদের পদচারণা হবে সবচেয়ে বেশি।”

রাফিন আমাকে পেছনের দিকে দূরে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো, “ঐ যে টাওয়ার দেখছো?”
আমি দেখলাম, ‘এইচ’ অক্ষরের সাথে লাগিয়ে ‘আর’ অক্ষরের বিশাল একটা টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে।
“আমাদের দুজনের নামের ফার্স্ট লেটার। ঐটা আমাদের অফিস। ঐখানে নিচতলায় খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন চলবে, উপরে দাওয়ার অফিস হবে।”

আমি আমার সমস্ত ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। অনেকক্ষণ পর বললাম,
“মা শা আল্লাহ! এতকিছু?”
“সবই আল্লাহর জন্য। লাভ ম্যানশন সবাইকে ভালোবাসা বিলানোর কাজে নিয়োজিত থাকবে দিনভর। প্রথম তলায় বাচ্চারা কুরআন শিখবে। দ্বিতীয় তলায় হাসপাতালের ব্যবস্থা আছে। তৃতীয় তলায় যুবক-বৃদ্ধদের জন্য আলাদা আলাদাভাবে দাওয়াহ কার্যক্রম সম্পাদন হবে। চতূর্থ তলার পুরোটা জুড়ে আবার আশ্রয়হীনরা থাকবে।”
“এতগুলো মানুষ?”
“হুম। তোমার একটু আনইজি ফিল হতে পারে ভেবেই এই পাতালপুরীর সৃষ্টি মূলত। প্রথমে বাসায় ঢোকামাত্র আমরা যে ঘরে গিয়েছিলাম সেটাও আমাদের ঘর। ঐ ঘর সবসময় লক করা থাকবে। শুধু তালা না, লোকজন দেখবে তালাটা। আসলে ওখানে পাসওয়ার্ড দেওয়া আছে। তোমার জন্য সর্বোচ্চ সিকিউরিটির ব্যবস্থা। ওখানে ঢুকে পাসওয়ার্ড দিয়ে পাতালপুরীতে চলে আসবে। পাতালপুরীর পুরোটা আবার আমাদের ঘর সংসার। এখানে অন্যকেউ আসতে পারবে না। এটা আমাদের শুভ্রাচিনপুর।”
“শুভ্রাচিনপুর?” আমি বিস্ময়ে হতবাক। আমার আনমনে বলা নামটা ও কিভাবে জানলো? আর আমার কল্পনা তো হুবুহু মিলে গেল।

এরপর রাফিন আবার আমাকে নতুনভাবে সবচেয়ে সাংঘাতিক একটা সারপ্রাইজ দিলো। আমার জীবনের একমাত্র এবং সবচেয়ে প্রিয় চাওয়াটা রাফিন পূর্ণ করে দিলো এমনিমেষেই। আমার হাতে দিলো দুটো সৌদি আরবের ভিসা ও পাসপোর্ট। আমি উল্টেপাল্টে দেখলাম। রাফিন সমাধান দিলো।
“আমাদের দুজনের পাসপোর্ট এগুলো। দু’মাস পর আমরা হজ্জে যাবো ইন শা আল্লাহ।”

আমি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে রাফিনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলাম। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে থাকলো। আল্লাহ এত্ত মহান! আর কয়বার প্রমাণ মিলবে আমার সামনে? এই জীবনে বহুবার আল্লাহর মাহাত্ম্য উপলব্ধি করার সুযোগ মহান রব আমাকে দিয়েছেন। আমি প্রত্যেকটা তাহাজ্জুদের সিজদাহয় এমন একজন জীবনসঙ্গী চেয়েছি, যে আল্লাহর জন্য আমাকে ভালোবাসবে। আল্লাহর প্রতি তার ভালোবাসা দেখে আমারও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাবে। যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় দুনিয়া ত্যাগ করতে পিছপা হবে না। আর যার সাথে সর্বপ্রথম আমি আল্লাহর ঘরে, পবিত্র কা’বায় এবং প্রিয় নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মোবারক এবং প্রিয় নবীজির দেশে অবস্থান করবো। আল্লাহ আমার প্রত্যেকটা দোয়া অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করে দিয়েছেন। আমার তাহাজ্জুদে করা কোনো দোয়া-ই বিফলে যায়নি আলহামদুলিল্লাহ।

রাফিন আমার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললো,
“হয়েছে, আর ইমোশনাল হতে হবে না। আল্লাহকে শুকরিয়া জানাও যে তিনি আমাদেরকে হজ্জে যাওয়ার তাওফিক দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।”

আমি অবাক হয়ে দেখলাম সবকিছু। রাফিন আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। আমি ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললাম,
“এমন সুন্দর একটা দিন আসবে কখনো কল্পনাও করিনি।”
“আমাদের ভাবনার বাইরেও এমন অনেককিছুই থাকে, যা কল্পনা করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব।”

তারপর রাফিন আপনমনে গাইলো,
“দিনের শুরু থেকে শেষে, থেকো তুমি মোর পাশে”
আমিও গাইলাম,
“ভালোবেসে ভালোবেসে, চলো হারাই প্রেমের দেশে।”
“চলো হারাই নবীর দেশে।” মুচকি হেসে বললো সে।

আমাদের সামনে মাটিতে দুটো পাখি খেলা করছে অনেকক্ষণ যাবৎ। আমরা দুজনই সেদিকে তাকিয়ে আছি মনোযোগ সহকারে। খেলতে খেলতে প্রথম পাখিটা দূরে সরে দাঁড়ালো। দ্বিতীয় পাখিটা কাছে গেল। প্রথম পাখিটা আরও সরে দাঁড়ালো। দ্বিতীয় পাখিটা এবার প্রথম পাখিটার উপর চেপে বসলো। প্রথম পাখিটা ঝাঁড়া দিয়ে দ্বিতীয় পাখিটাকে ফেলে দিলো। দ্বিতীয় পাখিটা এবার প্রথম পাখির ঠোঁট চেপে ধরলো নিজের ঠোঁট দিয়ে। প্রথম পাখিটা প্রাণপণে চেষ্টা করলো ঠোঁট ছাড়িয়ে নেওয়ার। দুটো পাখি ধস্তাধস্তি করতে করতে রীতিমতো তুলকালাম বাঁধিয়ে ফেললো।

রাফিন আমার দিকে তাকালো। আমিও ওর দিকে তাকালাম। তারপর দুজনই একসাথে হেসে ফেললাম। মুখ ফুটে একইসাথে বেরিয়ে এলো,
“অগত্যা তুলকালাম।”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here