#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ২৯,৩০
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ২৯
নাকীব ফিরে আসে মাথা নাড়তে নাড়তে। জাফর কিংবা অন্যকেউ লাল শার্ট পরিহিত কাউকেই পায়নি ও। কাশবনে গিয়ে বাচ্চারা রীতিমতো লাফালাফি শুরু করে দিলো। আমি ও নাকীব ওদেরকে চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে সেই বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ালাম যেখানে আমি ও রাফিন বহুবার একসাথে বসেছি। ওখানে এসেই নাকীব বাদে সবাই হুড়মুড় করে বেঞ্চে বসে পড়লো। আবির বললো,
“এইখানে প্রেমিক-প্রেমিকারা বসে।”
“হ্যাঁ আমরা সিনেমাতে দেখছিলাম।”
“ঐ যে একবার.. কুলসুম আপা, নাম কি ছিল যেন?”
“আমার খেয়াল নেই।”
আমি একপাশে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলাম আর চারপাশে দেখছিলাম। এ কয়দিনে অনেক কিছু বদলে গেছে। বৃষ্টির কারণে চারপাশটা একটু স্যাঁতস্যাতে হয়ে আছে। তাকাতে তাকাতে হঠাৎ বইয়ের মতো কি যেন দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। খয়েরী রঙের শক্ত মোটা মলাটের একটা ডায়েরি। ডায়েরিটা তুলে পৃষ্ঠা উল্টালাম। কয়েকটা পৃষ্ঠা কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম কর্দমাক্ত পৃষ্ঠাগুলোয় কোনো লেখা নেই। প্রায় শ’খানেক কাগজে লেখা আছে। সেগুলো রেখে কর্দমাক্ত কাগজগুলো ছিঁড়ে ডায়েরিটা নিয়ে নিলাম। বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও মোটা ও শক্ত কভার থাকায় পেইজগুলো ভিজে যায়নি। কাশবনে ঘোরাঘুরি শেষে বাসায় এসে শুকোতে দিলাম। কেন ডায়েরিটা নিয়েছি, কেনই বা শুকোতে দিয়েছি নিজেই জানি না। তবে ইচ্ছে করছিলো ডায়েরিটা পড়তে।
কাশবন থেকে ফেরার পর থেকে নাকীবের শরীর খারাপ হতে থাকলো। জ্বরের সাথে মাথা ব্যাথা, কাশি, হাঁচি এবং কফ লেগে একাকার অবস্থা। আজ সকাল থেকে আবার পাতলা পায়খানাও শুরু হয়েছে। অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে দ্রুত। বিকেলে হাসপাতালে ভর্তি করালো ওকে। ভর্তি করাতে করাতে ওর স্ট্রং ডায়রিয়া শুরু হয়ে গেল। ওর অবস্থা দেখে ডায়েরির কথাও বেমালুম ভুলে গেলাম আমি।
দীর্ঘ পাঁচদিন হসপিটালাইজড থাকার পর ওর শরীরে কিঞ্চিৎ শক্তি ফিরতে শুরু করে। সন্ধ্যায় ওর পাশে গিয়ে বললাম,
“কিরে কেমন লাগছে এখন?”
“ভালো।”
“আলহামদুলিল্লাহ বল।”
“আলহামদুলিল্লাহ।” দূর্বল গলায় বললো ও।
“কাশবনে গিয়ে এখন কে অসুখে পড়লো আমি না তুই? আমার তো মনে হয় আমার চেয়ে তুই বেশি স্মৃতিকাতর রাফিনকে নিয়ে।”
নাকীব আহত দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে।
“মজা নিও না।”
আমি আরও মজা নিলাম। হে হে করে হেসে বললাম,
“আজকে কয়বার গিয়েছিস বাথরুমে?”
“আপু?”
মাহফুজ এলো স্যুপ নিয়ে। ও নাকীবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছে। নাকীবকে স্যুপের বাটি এগিয়ে দিয়ে পাশে বসলো।
“কয়েকদিন পর তোর পরীক্ষা আর এখনো হসপিটালে বসে আছিস?”
“ইচ্ছে করে বসে আছি নাকি? আজব!”
“দেখি আজকের মধ্যে সুস্থ হয়ে যা, কাল বাড়ি যাবি। আমি উঠছি এখন।” আমি বাসায় চলে এলাম।
এরপর প্রায় দু’বছর কেটে গেল। নাকীবের এইচএসসি পরীক্ষাও শেষ ততদিনে। আমার পড়ালেখা প্রায় শেষের দিকে। ব্যবসাও দাঁড়িয়েছে বেশ৷ ব্যবসায় এখন নাকীবও যুক্ত হয়েছে। আমরা ব্যবসার পাশাপাশি কুলসুম, মাহফুজ, আবরার, ঝিলিদের পড়াই। নাকীব ছেলেদেরকে আর আমি মেয়েদেরকে পড়াই। মাহফুজরা এখন বড় হচ্ছে তাই ওদের সামনে খুব একটা যাই না আমি। ওরাও আসে না মেয়েদের সামনে। এতদিনের দ্বীনি শিক্ষা খুব কাজে দিচ্ছে। ঝিলি প্রায়ই দাদুর সাথে থাকে। গল্প শুনে অবসর সময় কাটায়। এদিকে আমাদের অবসর সময়ই নেই। ইদানীং খুব ব্যস্ত থাকতে হয় আমাকে ও নাকীবকে। তবে শত ব্যস্ততার ফাঁকেও আমি আমার ইবাদত ছাড়িনি। বরং আরও কিছু যোগ করেছি। যেমন: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং তাহাজ্জুদ ছাড়াও এখন ইশরাক ও সালাতুত দোহার নামাজও আমি ছাড়ি না। সালাতুত দোহাকে বাংলায় চাশতের নামাজ বলা হয়। এই নামাজের ফজিলত যেদিন থেকে আমি জেনেছি সেদিন থেকে একদিনও বাদ দেইনি।
হযরত আয়েশা (রা.) চাশতের নামাজ আট রাকাত পড়তেন এবং বলতেন, ‘যদি আমার মা-বাবাও কবর থেকে উঠে চলে আসেন, তাহলেও আমি তা ছাড়ব না।’ [১]
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, “দৈনিক ভোরে প্রতিটি মানুষ (তার শরীরের) প্রত্যেক জোড়ার পক্ষ থেকে সদকা করা উচিত। প্রত্যেক ‘সুবহানাল্লাহ’ সদকা, প্রত্যেক ‘আলহামদুলিল্লাহ’ সদকা, প্রত্যেক ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সদকা ও প্রত্যেক ‘আল্লাহু আকবার’ সদকা। আর সৎ কাজের আদেশ করা সদকা ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা সদকা। চাশতের দুই রাকাত পড়ে নেওয়া তার পক্ষ থেকে (অর্থাৎ প্রত্যেক জোড়ার সদকার জন্য) যথেষ্ট।’’ [২]
অন্য হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি চাশতের দুই রাকাতের প্রতি যত্নবান হলো, তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার সমপরিমাণ হয়।’ [৩]
মহানবী (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি চাশতের বারো রাকাত নামাজ আদায় করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতে একটি স্বর্ণের ঘর নির্মাণ করবেন।’ [৪]
এই এত এত গুরুত্ব দেখে আমি নিজেকে নামাজটা পড়া হতে বিরত রাখতে পারিনি। যোগ দিয়েছি নিয়মিত এই নামাজে। আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহার মতো আমিও অটল, দুনিয়া উল্টে গেলেও যদি নামাজ পড়ার সুযোগ থাকে তাহলে এই নামাজ আমি ছাড়বো না। আমার দেখাদেখি নাকীবও নফল নামাজগুলো পড়তে শুরু করেছে।
দিনের তৃতীয়াংশে যখন দুনিয়াবি ব্যস্ততা আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে ঠিক তখনই এই নামাজের সময় শুরু হয়। তাই নামাজটা সবাই জীবনে ধরে রাখতে পারে না। শুধু তারাই পারে যাদের কাছে আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াবি জীবনটা অতি নগণ্য। আমি ও নাকীব এই সময়টায় খুব ব্যস্ত থাকি। কিন্তু আমরা দুজনই সকল ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে চাশতের নামাজে মন দিই। খানিক পর পর নামাজ পড়ার কারণে আমাদের মনও সবসময় প্রফুল্ল থাকে।
আজ চাশতের নামাজ সেরে উঠতেই ঝিলি আবদার করে বসলো ওকে ফুলের মালা কিনে দিতে হবে।
আমি বললাম,
“ফুলের মালা দিয়ে কি করবে?”
“লাগবে আমার, এনে দাও না।” ও আমার হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগলো।
“আচ্ছা রে বাবা, এনে দিবো।”
“এখনই।”
“এখনই আনতে হবে?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ এক্ষুনি।”
অগত্যা বাধ্য হয়ে বোরকা-নিকাব করে বেরিয়ে গেলাম ওর সাথে। রাস্তার ওপারে গিয়ে ঝটপট একটা মালা কিনে দিয়ে নিজের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনছিলাম। ঝিলি কখন যে রাস্তা পার হতে নিজেই এগিয়ে গেছে খেয়াল করিনি। জিনিস কিনে পেছন ফিরে দেখলাম ঝিলি ঠিক রাস্তার মাঝখানে। ওর সামনে এবং পেছন থেকে একটা ট্রাক এবং দুটো মাইক্রোবাস ধেয়ে আসছে। ও মনের সুখে মালা নিয়ে খেলতে খেলতে রাস্তা পার হচ্ছে। আমি সজোরে ডাক দিলাম,
“ঝিলি! পেছনে আয়।”
ও আমার ডাক শুনলো না। আমি ঝিলির দিকে ছুটতে লাগলাম এবং একসময় প্রচন্ড আওয়াজে চোখ বন্ধ করে কান চেপে ধরে রাস্তায় বসে পড়লাম। যখন চোখ মেললাম তখন সামনে ভীড় দেখতে পেলাম। কিছু দূরে গাছের সাথে লেগে উল্টে পড়ে আছে ট্রাকসমেত মালগুলো। অন্যপাশে মাইক্রোবাস দুটো একটার সাথে অন্যটা সাংঘর্ষিক অবস্থায় পড়ে আছে। আমি হন্য হয়ে চারপাশে তাকালাম, “ঝিলি কোথায়?”
ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখি ঝিলি প্রচন্ড ভয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরে আছে। অবয়বে বোঝা যায় একটা ছেলেকে আঁকড়ে ধরে আছে ও। আমি ওর সামনে গিয়ে ওর হাত ধরে নিজের দিকে ফেরালাম এবং জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। ঝিলির বুকের ভেতরের অসম্ভব দ্রুতগতির হৃৎস্পন্দন আমার হৃদয় ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। ভয়ে তখনও কাঁপছে ঝিলি। অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর ওকে ছেড়ে দিলাম। ততক্ষণে ভীড় কমে গেছে। সবাই যার যার গন্তব্যস্থলে চলে গেছে। শুধুমাত্র সেই ছেলেটা বাদে যে ঝিলিকে টেনে সরিয়ে এনেছে। মহান রবের রহমতে যে বাঁচিয়েছে ঝিলিকে। আমি তখনও তার চেহারা দেখিনি। ঝিলিকে ছেড়ে দিয়ে বললাম,
“জাযাকাল্লাহ্ ভাই…”
সামনের ব্যক্তিকে দেখে আমার কথা নয় শুধু হৃৎস্পন্দনও থেমে গেল। অবাক চোখে শুধু তাকিয়েই রইলাম৷ কতদিন পর, কত বছর পর মানুষটা আমার সামনে। আমার কি বলা উচিত, কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। সে-ই বললো,
“দেখে রাখবেন তো বাচ্চাকে। আরেকটু হলেই তো অঘটন ঘটে যাচ্ছিলো।”
আমি কিছু বললাম না। রাফিন হয়তো আমাকে চিনতে পারেনি। অচেনাই থাক তাহলে। কথাটা বলে ঝিলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“আর কখনো একা রাস্তায় আসবে না, বুঝেছো?”
ঝিলি মাথা কাৎ করে বললো,
“বুঝতে পারিনি যে আপু আমার সাথে আসেনি।”
“ভবিষ্যতে আর কখনো আপুর হাত ছাড়বে না, হুম?”
“আচ্ছা।” রাফিন ঝুঁকে এসে ঝিলির কপালে চুমু খেলো। ঝিলিও বিনাবাক্য রাফিনের গালে চুমু খেয়ে নিলো। রাফিন মুচকি হেসে ওকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।
কিছুদূর গিয়ে শুধু একবার, মাত্র একবার পেছন ফিরে তাকালো আমার দিকে। সে-ই তাকানোতে কি ছিল আমি জানি না, মুহুর্তেই আমার ভেতরটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেতে চাইলো। ও কি চিনে ফেলেছে আমাকে? ও দূরে থাকলে আমি দিব্যি ভালো থাকতে পারি, কোনো দুঃখ, হতাশা থাকে না আমার মধ্যে। কিন্তু ওর অল্প একটু তাকানো, ওর একটু স্বর শুনলেই আমি পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যাই। তিল তিল করে গড়ে তোলা নিজেকে মুহুর্তেই ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলি। এমন কেন হয়? এই যে এখন ওর জন্য আমার ভেতরে জ্বলছে এটার জন্য তো আমাকে শাস্তি পেতে হবে। কেন ওর দিকে তাকিয়েছি আমি? কেন দেখেছি ওকে? কেন তাকিয়েছি পরপুরুষের দিকে? এই প্রতিটা কাজের জন্য তো আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তারপরও কেন অবাধ্য মনটা এত বেয়াড়াপনা করে? কেন করে? আমি তো অবৈধ কাজগুলো করতে চাই না, তাও কেন করে ফেলি?
যদিও আজকের ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ছিল না এবং আমি রাফিনের সাথে একটাও কথা বলিনি তারপরও মনের মধ্যে খচখচ করছিলো। ‘কেন আজও ওর জন্য ভেতরটায় পুড়ছে’ এই ব্যাপারটা আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিলো। কি করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছে যদি এই মুহুর্তে মারা যাই রবের সামনে দাঁড়াতে পারবো তো? একই ব্যাপারে বারবার তওবা করছি আর পুনরায় ভুলটা হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছায়।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ সূরা যুমার এর ৫৩ নং আয়াতটা মনে পড়ে গেল আমার। মুহুর্তেই স্বস্তি ফিরে এলো মনে এবং তৎক্ষনাৎ তওবা করলাম। ঐ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
“বলে দিন, হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছো! আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ তো সব গুনাহ মাফ করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু।” [৫]
রেফারেন্স:
১. মিশকাত শরিফ
২. মুসলিম শরিফ
৩. তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ
৪. তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ
৫. সূরা যুমার – ৫৩
#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️
#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৩০
রাফিনের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে বেশ ঝামেলায় পড়ে গেলাম আমি। প্রতি ক্ষণে আমার পুরোনো কথা মনে পড়তে লাগলো। যতবার মনে হয় ততবার ইস্তেগফার-এ মশগুল হই। তবুও যেন ভুলতে পারছি না। তার সাথে আজ সকালে আবার যুক্ত হয়েছে সেই পুরোনো ডায়েরিটা। যেটা কয়েক বছর আগে কাশবনে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।
কয়েকদিন আগে চুক্তিপত্র নিয়ে ব্যবসায়ে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ব্যবসায় শুরু করার আগে কয়েকজনের সাথে চুক্তি করে টাকার লেনদেন হয়েছিল। সেসব লেনদেনের পাট তখনই চুকিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু তারাই আবার এতদিন পর এসে ঝামেলা করছে। রীতিমতো হুমকি দিচ্ছে ব্যবসায় বন্ধ করে দেওয়ার। তাই আমি ও নাকীব সকালে বিজনেসের ফাইল খুঁজছিলাম। ফাইল খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ সেই খয়েরী মলাটের পুরোনো ডায়েরিটা আমার হাতে লেগে উল্টে পড়ে আর বেরিয়ে আসে রঙ্গিন কিছু ছবি৷ ছবিগুলো হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখলাম। সবগুলো হাতের এবং কাশফুলের ছবি। হাতটা একটা ছেলের, হাতে দামী ঘড়ি। ছবিগুলো ঢুকিয়ে রাখতেই টুক করে কি যেন পড়লো নিচে। আগে ডায়েরির শেষ মলাট খুলে দেখলাম যেখান থেকে জিনিসটা পড়েছে। একটা পকেটের মতো আছে, ওখান থেকেই পড়েছে একটা ব্রেসলেট।
নিচ থেকে ব্রেসলেটটা কুড়িয়ে আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম। এটা আমার হারিয়ে যাওয়া ব্রেসলেট। সেদিন, সেই প্রথম যেদিন রাফিনের সাথে ধাক্কা লেগে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিলাম সেদিন এই ব্রেসলেটটা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি।
আমাকে ব্রেসলেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাকীব বললো,
“আপু, তাড়াতাড়ি খোঁজো, কি দেখছো এত?”
আমি ওকে ব্রেসলেটটা দেখিয়ে বললাম,
“দেখ, এটা কাশবনে হারিয়ছিলাম। এই ডায়েরির মধ্যে কি করে এলো?”
“তুমি রেখেছো হয়তো ডায়েরীর ভেতর। পরে ভুলে গিয়েছো।” আলমারির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে ফাইল খুঁজতে ব্যস্ত নাকীব। সেখান থেকেই কথাটা বললো।
“আমি কেন ডায়েরির ভেতর রাখবো? এটা তো আমার ডায়েরি না।”
“তাহলে?”
“এটা কাশবনে কুড়িয়ে পেয়েছি।”
“কখন?”
“দু’বছর আগে লাস্ট যখন কাশবনে গিয়েছিলাম তখন।”
“ওহ! তুমি যেমন দু’বছর আগের কুড়িয়ে পাওয়া পুরোনো ডায়েরি সযত্নে আলমারিতে তুলে রেখেছো তেমনই হয়তো ডায়েরির মালিকও তোমার হারিয়ে যাওয়ার পুরোনো ব্রেসলেট কুড়িয়ে তুলে রেখেছে।”
“ফাইজলামি রাখ। এটা সত্যিই আমার।”
“তোমার ব্রেসলেটের মতো দুনিয়ায় আর ব্রেসলেট থাকতে পারে না? নাকি এটা একমাত্র তোমার জন্য বানিয়েছে? শুধু শুধু বাহ্যিক একটা ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো। এদিকে বিজনেস ডুবে যেতে চলেছে সেই খবর নেই।”
আমি কোনো কথা না বলে ব্রেসলেটটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাকীব ডায়েরি ও ব্রেসলেট কেড়ে নিয়ে আগের জায়গায় রাখতে রাখতে বললো,
“তুমি আপাতত ডায়েরিটা রাখো আর চুক্তিপত্রের ফাইলটা খোঁজো। নাহয় ডুবতে হবে আমাদের।”
অগত্যা ডায়েরি ছেড়ে ফাইল ঘাঁটাঘাঁটিতে লেগে পড়লাম। ব্রেসলেটটা পাওয়ার পর থেকে ডায়েরিটা পড়ার অদম্য ইচ্ছেটাকে আমি কিছুতেই দমাতে পারলাম না। নাকীব যতই বলুক ব্রেসলেটটা অন্য কারো তা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ আমার ব্রেসলেটের কোণার একটা পাথর আগেই পড়ে গিয়েছিল। সেই সেইম পাথরটা এই ব্রেসলেটেও নেই। শুধু তাই না, আমার ব্রেসলেটে একটা লাল রংয়ের ফিতে আমি এড করেছিলাম যাতে সবার চেয়ে আলাদা দেখায়। সেই ফিতেটাও এই ব্রেসলেটে বিদ্যমান। সুতরাং আমি হলফ করে বলতে পারি, এই ব্রেসলেট আমারই।
রাতে সবাই ঘুমানোর পর ডায়েরিটা খুলে বসলাম। শুকিয়ে মড়মড়ে হয়ে গেছে পাতাগুলো। আমি পড়তে শুরু করলাম মনোযোগ দিয়ে। প্রথম পাতায় সুন্দর হাতের লেখা।
“ডায়েরিটা আমার বন্ধুর মতো। বন্ধু নয় ঠিক, প্রেয়সীর মতো। আমার প্রিয়তমাকে নিয়ে লিখা এই ডায়েরি। আমি কখনো ডায়েরি লিখিনি। অত সময়ও আমার নেই। কিন্তু ওকে দেখার পর যখন মনের কথাগুলো বলতে পারছিলাম না তখন সিদ্ধান্ত নিলাম ডায়েরি লিখার। ওকে যা মুখে বলতে পারবো না তাই আমি এই ডায়েরিতে লিখে রাখবো। তাই ডায়েরিটা আমার প্রিয়তমার মতোই। হয়তো আরও বেশি কিছু। কারণ এতে যা লিখা থাকবে তার অনেকাংশই হয়তো ওকে বলতে পারবো না কখনো। তাই না বলা কথাগুলো ডায়েরিতে লিখে আমি মনের খোরাক যোগানোর চেষ্টা করছি।”
আমি বেশ আকর্ষণ বোধ করলাম। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ বোধ করলাম ডায়েরীর প্রথম পাতায় লাগানো কাশবনের ছবিটা দেখে। ছেলেটারও হয়তো কাশবন নিয়ে কোনো স্মৃতি জমা আছে। তাছাড়া প্রিয়তমাকে নিয়ে লেখা ডায়েরি, নিশ্চয়ই রোমান্টিক হবে। যদিও বিবেকে বাঁধা দিচ্ছিলো অন্যের ডায়েরি না বলে পড়তে। তাও নিজেকে এই ভেবে স্বান্তনা দিলাম যে, এটা তো কুড়িয়ে পেয়েছি। না পড়লে ডায়েরির মালিককে খুঁজবো কিভাবে আর ব্রেসলেট রহস্যই বা জানবো কিভাবে? আচ্ছা, ডায়েরির মালিক কি এত বছর পরও ডায়েরিটার অপেক্ষায় আছে? হয়তো আছে। মানুষ প্রেমে পড়লে কত কিই না করে। আচ্ছা, এই ডায়েরির প্রেমটা হালাল তো? নাকি হারাম প্রেম? আমার আর রাফিনের সম্পর্কের মতো? নাহ! পড়েই দেখি।
পরের পৃষ্ঠায় গেলাম দ্রুত। এই পৃষ্ঠায় বড় করে হেডলাইন দেওয়া, “আমার প্রিয়তমা”।
আবার আরেকটু ছোট আকারে লেখা “সাক্ষাৎ”। তারপর থেকে কাহিনী শুরু।
“এই এলাকায় আসার পর থেকে কাশবনের গহীনে বাইক চালানো আমার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। কাশবনের গহীনে কেউ সচরাচর যায় না। তাই সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিদিন বিকেলে কাশবনের চিকন গলিতে বাইক রাইড করি আমি। কাশবন আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা। কাশফুলের মধ্যিখানে বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। তাই প্রায়ই নির্জনে একা বাইক চালাই। আজও রাইড করছিলাম হঠাৎ এক ডাগর চোখের রূপসী সাইকেল নিয়ে ঢুকে পড়ে আমার নির্ধারণ করা জায়গাটায়। ফলাফল ধাক্কা লেগে কুপোকাৎ। যদিও আমি পড়িনি কিন্তু মেয়েটা পড়ে গিয়ে একেবারে মাটিতে বসে পড়লো।”
এটুকু পড়ে আমার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। এ তো আমার আর রাফিনের সাক্ষাৎ। এই ডায়েরিতে কি করে এলো? দ্রুত সামনে আগালাম।
“আর ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা বল এসে ওর মাথায় পড়লো। ব্যাথায় একেবারে কঁকিয়ে উঠলো মিস পিছলাবতী। আমার হাসি পেলেও সেটা চেপে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “স্যরি মিস! আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি!”
সে আমার হাত ধরে উঠে এলো। সে-ই প্রথম ছোঁয়া, যেটা আমার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দিলো। বলে রাখা ভালো, আগের এলাকায় থাকতে আমার আরও অসংখ্য মেয়েবন্ধু ছিলো। তারা সবাই নিজ থেকে এসেছে আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে এবং আমার কাউকেই ভালো লাগতো না। তখন আমার একমাত্র ভালোবাসা ছিল বাইক। তাই আমি সবাইকে উপেক্ষা করে বাইক রাইডে মেতে থাকতাম৷ আমার বাইকে কখনো কোনো মেয়েকে তুলিনি এবং একটা ফুলের টোকাও কোনোদিন বাইকে আমি পড়তে দিইনি৷ এমনকি সেসব মেয়েরা চাইতো আমার বাইকে উঠতে কিন্তু তাদেরকে কখনোই সেই সুযোগ দিইনি। আমার এহেন উপেক্ষা সহ্য করতে না পেরে তারা নিজেরাই চলে গিয়েছিলো। কিন্তু এই প্রথমবার আমি আমার বাইক তোলার জন্য হাত না বাড়িয়ে কোনো মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। বাইক কুপোকাৎ হয়ে পড়ে রইলো অনতিদূরে। পরবর্তীতে ভাবলাম, আশ্চর্য!বাইকের চেয়ে মেয়েটাকে তোলা অতীব জরুরী কেন মনে হয়েছে আমার?
মেয়েটা সমস্ত দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে যা বললো তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। সে-ও আমার মতো সেম কারণে এই নির্জন জায়গায় সাইকেল চালায়।
মেয়েটার মাথায় যার বল এসে পড়েছে সেই ছেলেটা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে মেয়েটার কাছে এসে দাঁড়ালো। ডাগর চোখের রূপসী তার চুল টেনে দিয়ে বললো, খেলতে যেতে। ছেলেটাও মহাউৎসাহে ছুটে গেল। ব্যাপারটা আমাকে এত মুগ্ধ করলো যে বলার বাহিরে। এরপর মেয়েটা সাইকেল নিয়ে চলে যায়। সে যাওয়ার পরপরই তার একটা জিনিস আমি খুঁজে পাই৷ সেটা সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিলাম। সেই প্রিয় জিনিসের ছবি পরবর্তী পৃষ্ঠায়…”
পরবর্তী পৃষ্ঠায় গিয়ে দেখলাম, আমার সেই ব্রেসলেটের ছবি। কাশবনের বেঞ্চের ওপর রাখা আছে ব্রেসলেটটা এবং তার পাশেই কাশফুলের গুচ্ছ। এবার আমার আর কোনো সন্দেহ রইলো না ডায়েরিটা কার তার ব্যাপারে। পরের পৃষ্ঠায় গেলাম দ্রুত।
এই পৃষ্ঠায় মাঝারি আকারের হেডলাইন দিয়ে লিখা, “উপলব্ধি”।
“কেন বাইক ছেড়ে মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়েছিলাম
সেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম রাতে ঘুমানোর সময়। আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলাম না। বারবার চোখে ভেসে উঠছে সেই ডাগর চোখের মেয়েটার মুখাবয়ব, তার পড়ে যাওয়া, আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া, হাত ধরে উঠে আসা, পিচ্চি ছেলেকে চুল টেনে দেওয়া, তারপর মুচকি হাসি, এরপর সাইকেল চালিয়ে মৃদু কদমে সামনে হেঁটে যাওয়া সবটা, সবটা আমার ব্রেইনের আনাচে-কানাচে বিচরণ করতে থাকলো।”
পরবর্তী পৃষ্ঠায় আবার মাঝারি সাইজের হেডলাইন, “অপেক্ষা এবং পুনরায় সাক্ষাৎ”।
“পরের সারাটাদিন আমি কাশবনে বসে থেকেছি কিন্তু সে আসেনি। তারপরদিনও সারা বিকেল বসেছিলাম। সেদিনও সে আসেনি। তারও পরদিন বিকেলে মাঠেই বসেছিলাম। ওখানে একদল ছেলেপিলেরা ক্রিকেট খেলছে। আমি নজর রাখছিলাম তার আসার দিকে। হঠাৎ পিচ্চি ছেলেগুলো আমাকে টেনে নিয়ে গেল। তাদের দলে নাকি দুজন প্লেয়ার শর্ট পড়েছে। আমিও খেলায় মেতে উঠলাম অনেকদিন পর। একটা সময় আমার ড্রিম ছিল জাতীয় দলে খেলার। এখন আর খেলা হয় না। খেলার একপর্যায়ে হঠাৎ মেয়েটা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি থমকে গিয়ে মুখ ফসকে বলেই ফেললাম, “আরে আপনি?” সে হয়তো ধরে ফেলেছে আমার ব্যাপারটা এই ভয়ে আধমরা হয়ে রইলাম। তারপর খানিক কথা হয়। কথার ফাঁকে জানলাম, ক্রিকেট টিমটাই নাকি তার। মনে মনে ভাবলাম, মিস পিছলাবতী ক্রিকেটও খেলে? বাহ! পিছলাবতীর সাথে তার ভাইও ছিল। সে আমাদেরকে রেখে সাইকেল নিয়ে চলে গেল। তখন আবার এক পিচ্চি আসে মেয়েটার কাছে। আবার সেই আগের দিনের মতো পিচ্চিকে আদর করে মিস পিছলাবতী। চুল এলোমেলো করে দেয়, চুমু খায় কপালে। ওর এই ব্যাপারগুলো আমাকে ভীষন টানছিলো। আমার মনে হয় যারা পিচ্চিদের বেশি ভালোবাসে তাদের মনটাও পিচ্চিদের মতোই হয়৷
সেদিন অনেক কথা হয় তার সাথে। এপর্যায়ে তার নামটা জানা হয় অবশেষে। মিস পিছলাবতীর নাম আরোহী। এজন্যই সে সাইকেলে আরোহণ করতে করতে ধপাস করে পড়ে যেতে ভালোবাসে বোধহয়৷ হাহা! সেদিন সুযোগ বুঝে তার ঠিকানাও নিয়ে নিলাম। যদিও শুধু বাসাটাই দেখিয়েছিলো সে। অজস্র বিল্ডিংয়ের ফাঁকে তার সেই সাদা বিল্ডিং খুঁজে পেতে কি বেগ আমাকে পোহাতে হয়েছে সেটা তো শুধু আমিই জানি।”
এটুকু পড়ে ডায়েরি রেখে দিলাম। আপাতত আর পড়ার সময় নেই৷ তাহাজ্জুদের সময় হয়ে গিয়েছে। তবে পড়ে যা বুঝলাম, এটা আমার ডায়েরীর উল্টোপিঠ৷ আমার অজানা ঘটনাগুলোই এখানে লিখা এবং হারিয়ে যাওয়া খয়েরী মলাটের ডায়েরীর মালিক কে সেটাও আমার কাছে স্পষ্ট। এবার শুধু পুরো ডায়েরিটা পড়ে তাহার অনুভূতিটুকু জানার অপেক্ষায়…
#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️