অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ২৭,২৮

#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ২৭,২৮
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ২৭

মাস দুয়েক পর হঠাৎ আবার একটা প্রস্তাব আসে আমার জন্য। আবার পাত্রপক্ষ আসে৷ এবার বেশ প্রস্তুতি নিয়ে তাদের সামনে গেলাম। ছেলেদেরকে আগে থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু পাত্র আছে মা-বোনদের সাথে। আমি যেতেই আমাকে প্রথম প্রশ্ন করলো,
“রান্না জানো?”
আশ্চর্য! আমার নাম জানতে চাইলো না, কোয়ালিফিকেশন জানতে চাইলো না, কোথায় পড়ি, কি করি, কিচ্ছু না। ফার্স্ট কুয়েশ্চন, রান্না পারো? নিজের মনেই বললাম, “হোয়াট ইস দিজ? আজব!”

থমথমে মুখে বললাম, “পারি না, মা আমাকে কখনোই রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় না।”

ছেলের মা ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আর কি পারো?”
“আপনি কি কোনোভাবে ভুল করে কাজের লোক খুঁজতে এসেছেন এই বাড়িতে? দুঃখিত! এখানে কাজের লোক সাপ্লাই দেওয়া হয় না।” কথাটা বলার খুব ইচ্ছে হলেও বলতে পারলাম না।
মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললাম, “কিছুই পারি না।”

ছেলের খালা বললো, “আপা, ছেলে-মেয়ে দুজন নাহয় একা কথা বলুক।”
খালার কথায় আমার হাসি পেয়ে গেল। দুজন আবার একা! হাহা!

যাইহোক, ছেলেটার সাথে আমাকে আমার রুমে পাঠানো হলো। ছেলেটা ঘুরেফিরে আমার রুম দেখতে দেখতে বললো,
“প্রেম আছে তোমার?”
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। প্রথমেই তুমি সম্বোধন। মিনিমাম ভদ্রতাটুকুও নেই। আবার জিজ্ঞেস করছে প্রেম আছে কিনা? আমার নাম-ধামের কোনো মূল্য নেই? আমি কি গুণের আধার হয়ে, ওদের কামলা খাটতে বিয়ে করবো? মগের মুল্লুক নাকি?”

আমি বললাম, “সেই জবাব তো আমি আপনাকে দেবো না।”
“মানে?” বেশ অবাক হয়ে তাকালো ছেলেটা।
আমি সাথে সাথে জবাব দিলাম না। কিছুটা সময় নিয়ে বললাম,
“মানুষকে কখনোই এমন কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত নয় যেটা তার একান্ত গোপন। যদি বলার হয় সে নিজ থেকে বলবে। ধরুন, আমার প্রেম ছিল, আমি তওবা করে নিয়েছি৷ যখন কোনো মানুষ তার অতীত গুনাহ থেকে তাওবা করে ফিরে আসে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। তাই এধরণের প্রশ্ন করাটাই অযৌক্তিক। আমি যে গুনাহ গোপনে করেছি এবং যে গুনাহের জন্য তাওবা করে নিয়েছি সে বিষয়ে প্রশ্ন করাই উচিত না। একজন মানুষ অতীতে কেমন ছিলো তা দিয়ে তার বর্তমান সময় বিবেচনা করা উচিত না। সাহাবাগণ (রাঃ) যখন কাফের ছিলেন তারা পাপাচারে লিপ্ত ছিলেন, তারা যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন সাথে সাথে সকল গুনাহ ছেড়ে দিলেন। একেকজন হয়ে গেলেন আমাদের জন্য আদর্শ। যারা ঈমান আনার পূর্বে ছিলেন হাজারো পাপাচারে লিপ্ত, তারা ঈমান আনার পর হয়ে গেলেন উত্তম আখলাকে উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সন্তান।”

ছেলেটা এরপর জঘন্য একটা কথা বললো। ঠিক তখনই আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। ছেলেটা বললো,
“বাই দ্যা ওয়ে, আপনি ভার্জিন তো?”

আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলাম। এতক্ষণ কাকে কি বললাম? ঠান্ডা মাথায় এই জানোয়ারকে হ্যান্ডেল করতে হবে। আমিও পাল্টা জবাব দিলাম,
“মে বি আপনি না, ঐ যে যেটা বললেন সেটা আর কি! ঐরকম লেভেলের মেয়ে খুঁজছেন? দুঃখিত! এটা পতিতালয় না। যান, পতিতালয়ে যান। আর আপনার মাকে সুন্দর দেখে একজন সেফ এনে দিয়েন। ফার্দার ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে যেন আর রান্নার লোক না খুঁজে। আপনার ব্যবস্থা তো বলেই দিলাম, পতিতালয়…”

রাগে নাকেমুখে ঝাল উঠে গেল ছেলেটার। ওহ হ্যাঁ, একটু আগে তো নুডলস গিলছিলো। বেশ হয়েছে। ছেলেটা বেরিয়ে গেল কাশতে কাশতে। বেরুলো তো বেরুলো, সরাসরি ‘না’ করে দিয়ে একেবারে বাড়ি থেকে বিদায় নিলো।

ছেলেটা বেরোতেই বাসার সবচেয়ে বড় ফুলদানিটা আছাড় মেরে ঝরঝর করে ভেঙে ফেললাম। বাবা-মা, নাকীব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো।

আমি রাগে,ক্ষোভে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
“তোমরা আর কখনো আমার জন্য পাত্র দেখবে না, কক্ষনো না। দেখতে হলে দ্বীনদার পাত্র দেখো। আমার সামনে যেন কোনো নরপশু আর না আসে। আমি আর কারো সামনে গিয়ে লাঞ্ছিত হতে পারবো না। আমাকে এই বাড়িতে রাখতে অসুবিধা হলে বলো আমি চলে যাই।”

বাবা-মা দুজনই এগিয়ে এলেন। বাবা বললেন,
“কি হয়েছে? কি বলেছে ছেলেটা?”
“এখন ঐ নোংরা কথা আমি তোমাকে বলবো বাবা? আমি একটু একটু করে ইসলামের পথে আসছি, আমাকে চলতে দাও না আমার মতো। কেন এরকম আজেবাজে ছেলেকে ধরে এনে আমাকে দেখাচ্ছো? আমি এতটাই মূল্যহীন?”

মা তক্ষুনি বললেন, “ঠিক আছে আর কাউকে বাড়ি আনবো না। সব দেখেশুনে তারপর… নায়হ আগে তোর ছবি দেখবে…”
মায়ের কথা কেঁড়ে নিয়ে নাকীব বললো “ছবি দেখবে মানে? মা, ধরো ছবিটা তুমি ছেলেকে দেখানোর জন্য দিলে। তখন ছেলেটার বাবা, ভাই, বন্ধু থেকে শুরু করে সবাই দেখবে। দেখছো না, এখানে এলেও প্রতিবার পাত্রের বাবাদেরকে মেয়ে দেখানোর জন্য মা’রা কেমন করে? তখন ছবিটা শেয়ার হতে হতে কোন পর্যায়ে যাবে ভাবতে পারছো? তাহলে আপুর আর এত লোকের সামনে নিকাবে আবৃত হয়ে যাওয়ার কি আছে? ও তো খোলামেলা ঘুরতে পারে।”

বাবা বললেন, ”ঠিকই তো, ঠিকই তো। এখন থেকে যা করার বুঝেশুনে করবো।”
এরপর নাকীবকে ডেকে বললেন,
“দেখি এদিকে আয়। আমার ছেলেমেয়েগুলো কত বড় হয়ে গেছে। সব বুঝতে শিখে গেছে।”
বাবা-মা দু’পাশ থেকে আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন।

মা অস্ফুট স্বরে বললেন, “টবটা কিন্তু শুধু শুধু ভাঙলি। রাগ শয়তানের কাছ থেকে আসে৷ এত রাগ ভালো না। নিয়ন্ত্রণ করতে শেখ।”
বাবা বললেন, “তাই তো। এই প্রথমবার আমার সাথে তোমার কোনো কথা মিললো।”
নাকীব বললো, “হাদীস সবসময় একই হয় বাবা। না মিলে উপায় নেই।” বাবা-মা হেসে ফেললেন আর আমিও৷

আমি নিজ হাতে টবের ভাঙ্গা টুকরোগুলো পরিষ্কার করলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কখনো জিনিস ভাঙবো না।

এরমধ্যে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। আমার হঠাৎ দাদুর কথা মনে পড়লো। সেদিনের পর থেকে আর দাদুর সাথে দেখা করা হয়নি। দাদু কেমন আছে কে জানে? নাকীবকে বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওকে খুঁজতে খুঁজতে শান্তি কুঠিরের বারান্দায় পাওয়া গেল। বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরছে ও। আমি কাঁধে হাত রেখে বললাম,
“কয়েকদিন পর পরীক্ষা, না পড়ে বৃষ্টিবিলাস করছেন আপনি?”
ও চমকে তাকিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়ে বললো,
“সবাই ঘুমাচ্ছে, একা কি করবো তাই…”
“চল দাদুকে দেখে আসি।”

নাকীব রাগী দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। বললো,
”আবার?”
“অনেকদিন খোঁজ নেওয়া হয়নি। কেমন আছে কে জানে?”
“রাফিন ভাইয়াকে নিয়ে যাও।”

আমি কটমট করে তাকাতেই ও ফিক করে হেসে ফেললো। সেদিন বিকেলেই আমি ও নাকীব বের হলাম দাদুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ির বাইরে পা রাখতেই মাহফুজ ছুটে এলো। সে-ও নাকি সাথে যাবে। মাহফুজকে সাথে নিয়ে চললাম। আমরা আস্তে আস্তে গিয়ে দাদুর জানালার পেছনে লুকালাম। জানালায় উঁকি দিয়ে দেখলাম রুম ঝকঝকে পরিষ্কার। কোথাও দাদুর ছিঁটেফোঁটা চিহ্নও অবশিষ্ট নেই। আমার বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। ওরা দাদুকে কোথাও সরিয়ে দেয়নি তো? নাকি মেরে-টেরে ফেলেছে? উহ! ভাবতে পারছি না।
আমরা অন্য জানালায় গেলাম। ফুফি আরাম করে বসে পান চিবোচ্ছে। আমরা চলে এলাম। আসার পথে নাকীবকে বললাম, “দাদুর খোঁজ নিতে হবে৷ দাদুকে ওরা কোথায় লুকিয়েছে কে জানে?”
মাহফুজ বললো, “আপা, দাদুর বয়স কত হবে আনুমানিক?”
“বয়স তো বলতে পারবো না, অনুমানও করতে পারবো না ঠিক। অত্যাচারের কারণে এমনিতেই দাদুকে বয়স্ক দেখাতো।”
“তারমানে বয়স্ক মতন, অত্যাচারও করতো।” ঠোঁটে তর্জনী দিয়ে মৃদু টোকা দিতে দিতে মাহফুজ কি যেন ভাবলো। তারপর বললো,
“আপা, আমার মনে হয় বৃদ্ধাশ্রমে রাইখা আসছে। বুড়ো মানুষরে আর কই সরাইবো? ঐ একটা জাগাই তো আছে। বুড়োগো লাইগা বৃদ্ধাশ্রম, বাচ্চাগো লাইগা অনাথ আশ্রম। তয় অনাথ আশ্রমের ভূমিকা কম আমগো…”

নাকীব ধমকে বললো, “মাহফুজ, সুন্দর করে কথা বলো। এসব কি ভাষা? তয়, আমগো… কতবার বলেছি না সুন্দর করে কথা বলবে। ঝিলিকে দেখেছো, কি সুন্দর করে কথা বলে?”

নাকীবকে থামিয়ে বললাম, “ওয়েট! ও উচিত কথা বলেছে। দাদুকে বৃদ্ধাশ্রমেই নিতে পারে। শোন, কাল থেকে আমরা ভালোমতো খোঁজ চালাবো।”
“অকে।”

সেদিন সারারাত জেগে আমি ও নাকীব এই এলাকায় কয়টা বৃদ্ধাশ্রম আছে সেটা খুঁজে বের করলাম। মাত্র একটা বৃদ্ধাশ্রম। ঠিকানাও জোগাড় করে রাখলাম। নাকীব পার্শ্ববর্তী কয়েকটি এলাকার বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানাও সংগ্রহে রাখলো। বলা তো যায় না, এই এলাকা থেকে সরিয়ে দাদুকে অন্য আশ্রমেও রাখতে পারে।

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ২৮

পরদিন মাহফুজকে সাথে নিয়ে আমি ও নাকীব বের হলাম। আমাদের এলাকায় যে বৃদ্ধাশ্রমটি রয়েছে তার নাম “ছায়া সঙ্গী”। এমন অদ্ভুত নাম দেওয়ার মানেটা আমরা ঠিক বুঝলাম না৷ মেইন রোড থেকে পঁয়ত্রিশ মিনিট বাসে চড়ে আমরা বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছালাম। তখনও ঠিক পৌঁছাইনি। বাস থেকে নেমে মেঠোপথ ধরে আরও অনেকটা ভেতরে হেঁটে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় আধঘন্টা পর দেখা মিললো একটা পুরোনো লাল রঙের লোহার গেট। গেটের কাছে গিয়ে মধ্যবয়সী দারোয়ানের সাথে বেশ খানিকটা কথা কাটাকাটি হলো। তিনি কিছুতেই আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিবেন না। বাড়াবাড়ির একপর্যায়ে ভেতর থেকে এক যুবক বেরিয়ে এলো। তাকে দেখেই দারোয়ান সাথে সাথে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। যুবক জানতে চাইলেন কি হয়েছে। দারোয়ানও যা বলার বললো। এরপর যুবক আমাদেরকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো।

দারোয়ান গেট খুলে দিলেন। ভেতরে ঢুকে পায়ে পায়ে হাঁটতে থাকলাম। চারপাশে সারি সারি আম, জাম, লিচু, পেয়ারা, কাঁঠাল গাছ, শুকনো খড়ের পালা, কতশত পাখির মধুর ডাক হৃদয় জুড়িয়ে যায় একেবারে। এরই মধ্যে একটা কাঁচা-পাকা পথ ভেতরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমায়। সঙ্গে থাকা যুবক পাশ থেকে বললেন,
“আপনারা কোথায় যাবেন? বাবাদের ঘরে না মায়েদের ঘরে?”
কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর বললাম, “মায়েদের ঘরে।”
“আপনারা মূলত কার সাথে দেখা করতে এসেছেন?”
“দেখা হলে তারপর বলতে পারবো। সামনাসামনি দেখলে চিনবো।” নাকীব বললো।
“দূর সম্পর্কের কেউ?”
“দূরের বটে কিন্তু আত্মার সম্পর্কের কেউ।”
“বেশ তাহলে চলুন। দেখা হলেই বলবেন।”

হাঁটার জন্য ইট বিছানো একটা সবুজ শ্যাওলা ধরা সরু রাস্তা। কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটু দূরে তাকালেই চোখে পড়ে বেশ বড় কুমড়োর মাচা, শত শত হলুদ কুমড়ো ফুল ফুটে আছে যেন পাতায় পাতায়, মাচার শুকনো কঞ্চির ওপর বেশ কয়েকটা ভেজা সাদা শাড়ি রোদে শুকাতে দেওয়ায় বাতাসে দুলছে। আশেপাশে অনেক বৃদ্ধারা আড্ডা দিচ্ছে। পাশ দিয়ে হেঁটে আসছেন বয়সের ভারে ন্যুজ একজন বৃদ্ধা। সোজাসুজি আকারের বেশ লম্বা একতলাবিশিষ্ট আধপাকা ঘর, খোলা বারান্দায় পায়চারি করছেন কেউ কেউ। কারও কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াতের মধুর সুর কানে আসছে, কেউ গীতা পাঠ করছে আবার কেউবা বারান্দার খুঁটিতে ভর করে এক ধ্যানে দূরে তাকিয়ে আছেন শালবনের দিকে কারও অপেক্ষায়।

পথ শেষ হতেই বৃহৎ আকারে “ছায়া সঙ্গী নিবাস” লেখাটা চোখে পড়লো। জীর্ণ-শীর্ণ, পরিত্যক্ত দোতলা বাড়ি। দালানের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলে বৃদ্ধাদের বাসস্থান। নিচতলায় তাদের জন্য রান্নাবান্না করা হয়। অপরপাশের বিল্ডিংয়ে বাবাদের বাসস্থান এবং নিচে রান্নাঘর। দুটি দোতলা ভবনের যে ভবনে বৃদ্ধা মহিলারা থাকেন সেটায় লেখা “মমতাময়ী মা” আর অপরটায় লেখা “দায়িত্বশীল বাবা”। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, “মমতাময়ী মা” লিখাটার নিচে ছোট করে লেখা, “সারাজীবন মায়া-মমতায় ভরিয়ে রাখা হয়েছে যাদের জীবন তাদের মায়ার ছায়াতলে আশ্রয় না পেয়ে এক টুকরো আশ্রয়ের খোঁজে।”
আর “দায়িত্বশীল বাবা” লিখাটার নিচে লেখা, “দায়িত্বের ভার আজীবন কাঁধে নিয়ে বইতে বইতে নুয়ে পড়া কাঁধটা এক টুকরো আশ্রয়ের খোঁজে…”

লেখাগুলো আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করলো। আশ্রমের মালিক বেশ দায়িত্বশীল এবং সৌখিন বলেই মনে হলো। কথায় কথায় নাকীব জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
“আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা কি আপনি ভাইয়া?”
“প্রতিষ্ঠাতা আমার বাবা। বর্তমানে আমি দেখাশোনা করি।”

যুবকটি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। একেকটি কক্ষের সামনে এসে রীতিমতো থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছি আমি। এখানে এমন অনেক বৃদ্ধাও আছেন যারা ঠিকমতো হাঁটতে চলতে পারে না৷ নিজে নিজে বাথরুমে যেতে পারেন না। ফলাফল বিছানাতেই বাথরুম সারেন। জীর্ণ শীর্ণ, হাত-পায়ের চামড়া শুকিয়ে ঝুলে পড়া এই বৃদ্ধাদের কিভাবে মানুষ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যায়? একটুও কি দয়া হয় না? যে সন্তান বাবা-মাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারতো না, মা-বাবাই ছিল যার সারা জীবনের আশ্রয়স্থল, সে কিনা আজ বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না। বাবা-মাকে ঝামেলা মনে করছে। তাঁদেরকে রেখে আসছে বৃদ্ধাশ্রমে। এত নিষ্ঠুর মানুষ হয়? অথচ আল্লাহ তাআলা মায়ের কষ্ট ও তাদের প্রতি সন্তানদের করণীয় বর্ণনা করে কুরআনে ইরশাদ করেছেন-
“আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি- (কারণ) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’ বছরে- তুমি শোকর কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার। আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসতে হবে।” [ সূরা লোকমান (৩১) : ১৪ ]

আয়াতটা তো একথাই বলে, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের পিতা-মাতার শোকর কর। কারণ তারা তোমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। তোমাদেরকে আদর-যত্নে মানুষ করেছেন। পিতা-মাতার শোকর আদায়ের সবচে’ উপযুক্ত সময় তো তাদের বার্ধক্য। কারণ এ সময় তারাও শিশুর মত হয়ে যান। নিজেরা কিছুই করতে পারেন না। অথচ ঠিক সেই সময়েই সন্তানেরা তাদের ফেলে যান এই বৃদ্ধাশ্রমে। এদিক ইঙ্গিত করেও আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,

“তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া আর কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদেরকে উফ্ (পর্যন্ত) বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত কর এবং দুআ কর, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।” [ সূরা বনী ইসরাঈল, (১৭) : ২৩-২৪ ]

যেখানে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সাথে ‘উফ’ পর্যন্ত না বলতে বলা হয়েছে সেখানে তারা বোঝা মনে করে আশ্রমে এনে ফেলে রাখছে বাবা-মাকে। বৃদ্ধাশ্রমে বাবা-মাকে রেখে যাওয়া সন্তানেরা কি এসব কথা জানে না? তাদের মনে কি একটুও দয়ামায়া নেই?

অনেকক্ষণ পর একটা কক্ষে গিয়ে আমরা থমকে দাঁড়ালাম। ঐ তো দাদু। ময়লা, সাদা, কুঁচকানো একটা শাড়ি পরে বারান্দায় বসে আছেন। আকাশপানে তাকিয়ে আছেন উদাস মনে। কি ভাবছেন কে জানে?

আমি আলতো করে দাদুর কাঁধে হাত রাখলাম। দাদু ফিরে তাকালেন। আমাকে দেখতে পেয়ে যেন আকষ্মিক থমকে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আমাকে দেখলেন। খুব ভালো করে দেখলেন। নিকাব করে থাকায় চিনতে পারলেন না। আমি ম্দু কন্ঠি বললাম, “দাদু, আমি হৃদিতা।” কন্ঠ শুনেই দাদু আমাকে চিনতে পারলেন। তাঁর হাত-পা কাঁপতে লাগলো। তিনি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে জাপ্টে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।

অনেকক্ষণ সেভাবে থাকার পর দাদু আমাকে ছাড়লেন। সেই যুবক দাদুকে পানি এগিয়ে দিলেন। ঢকঢক করে সবটা পান করলেন তিনি। ধীর গলায় বললেন,
“তিনটা মাস পার হয়ে গেল কেউ আসলো না দেখতে।”
“আমি এসেছি তো, নিয়ে যাবো আপনাকে।”
“না, না নিতে হবে না। ওদের ওখানে থাকার চাইতে ভালো এইখানে থাকি।” আতঙ্কিত কন্ঠে বললেন দাদু।
“ওদের ওখানে তো ভুলেও দিয়ে আসবো না। আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো আপনাকে।”

সেই যুবকটির বাবা ছিল বৃদ্ধাশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা। সে খুব আন্তরিকতার সাথে এই বৃদ্ধাশ্রমের দেখাশোনা করে। সে-ই দাদুকে আমাদের সাথে আসার ব্যবস্থা করে দিলেন। আসার সময় যুবকটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দাদু দোয়া করলেন।
“অনেকদিন বেঁচে থাকো বাবা। আর এভাবেই অবহেলিত বাবা-মায়েদের সেবা করে জান্নাত কুড়িয়ে নাও। আল্লাহ তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকামে নসীব করুক।”

আমি দেখলাম দাদুকে বিদায় জানানোর সময় যুবকের চোখ ছলছল করছিলো। সে মেইন রোড পর্যন্ত দাদুকে এগিয়ে দিতে এলো।

দাদুকে প্রথমে আমরা বাড়িতে নিয়ে আসি। দুদিন লেগে যায় দাদুর স্বাভাবিক হতে। পরে আমাদেরকে দাদু যা জানায় তার সারমর্ম হলো এই,
সেদিন বাবা ফুফিকে চিরতরে বেরিয়ে যেতে বলার পর ফুফি বাড়ি গিয়ে দাদুর উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়৷ ফুফির অপমান, জাফরের জেলে যাওয়া সব দায় দাদুর ওপর বর্তায়৷ সেদিন রাতেই জাফর পালিয়ে এলাকা ছাড়ে এবং বেশ অনেকদিন পর ফুফি ও ফুফাকে ফোনে জানায় যেন দাদুকে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। ফুফাও এরপর কোনো কারণে এলাকা ছাড়ে। এখন ঐ বাড়িতে ফুফি একাই থাকে। ও হ্যাঁ, জাফর পালিয়ে যাওয়ার পর ফুফিকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনোকিছু জানতে না পারায় ছেড়ে দেন। এরপরের আর কোনো খবর দাদু জানেন না।

আমরা আপাতত থানা, হাজত, জাফর, ফুফি সেসব ভুলে সপ্তাহখানেক পর দাদুকে শান্তি কুঠিরে নিয়ে গেলাম। দাদুকে পেয়ে বাচ্চারা যেন হাতে মোয়া পেল। সারাক্ষণ দাদুর কাছে গল্পের আবদার করে। আমিও বসে পড়ি তাদের সাথে। দাদু মন খুলে কথা বলেন আমাদের সাথে। এখন আর ফুফির ভয় নেই, নেই কোনো লুকোচুরি। যা খুশি তাই বলে বেড়ায় দাদু। ইচ্ছেমতো ইবাদত-বন্দেগি করে অবসরে আমাদের গল্প শোনান। নবীর গল্প। ভুল হলে আমি শুধরে দিই। আমি তো নতুন নতুন সব শিখছি তাই সব ঝরঝরে পরিষ্কার আমার কাছে। দাদুর তো বয়স হয়েছে অনেককিছু ভুলে যায়। তাছাড়া দাদু আগে যা কিছু শিখেছে তারমধ্যে কিছু কিছু বিদআতও রয়েছে। আমি সেগুলো শুধরে দিই সহীহ হাদীসের রেফারেন্স দেখে। আমি আবার রেফারেন্স ছাড়া কিচ্ছু বিশ্বাস করি না।

এরমধ্যে আমি বেশ কয়েকটা রান্নাও শিখে ফেলেছি মায়ের কাছে। বাবা তো বিশ্বাসই করতে চাননি আমি রান্না পারি। আমার রান্না করা প্রথম গরুর গোশত খেয়ে বাবা বলেছিলেন, “গোশত কেটেছিস না রান্নাও করেছিস?”

এর আগে একবার আমি গোশতের জন্য আলু ছিলে মাকে সাহায্য করেছিলাম৷ সেদিন বাবাকে বলেছি,
“বাবা, আলুগুলো মজা হয়েছে?”
বাবা খুশিমনে বললেন, “তুই রেঁধেছিস নাকি?”
আমি মুচকি হেসে জবাব দিয়েছিলাম, “না বাবা, আলুগুলো আমি ছিলেছি।”
বাবা হা হয়ে গিয়েছিলেন। তাই সত্যি রান্না করার পর প্রশ্নটা করলেন। আমি হেসে জবাব দিলাম,
“ না বাবা, এবার সত্যি রান্না করেছি।”
“আলহামদুলিল্লাহ!”

একদিকে অনলাইনে বিজনেস সামলাই অন্যদিকে শান্তি কুঠিরের সবার জন্য রান্না করি৷ বাকি সময় ইবাদত বন্দেগিতেই কাটে। সবাইকে নিয়ে বেশ ভালোই দিন কাটছে আমার৷ এরমধ্যে একদিন প্ল্যান করলাম সবাইকে কাশবন ঘুরিয়ে আনবো। নাকীব প্রথমে বেশ আপত্তি জানালো।
“আপু, কাশবন হলো তোমার স্মৃতির জায়গা। ওখানে অহরহ স্মৃতি তোমার। একবার গেলেই আবার জ্বর বাঁধাবে। দরকার নেই।”
আমি গাল বাঁকিয়ে বললাম,
“ধুর! আমি রাফিনকে ভুলে গেছি।” বলামাত্র বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। আসলেই কি রাফিনকে ভুলে গেছি?

”ওসব বলে লাভ নেই। তোমার যাওয়া হচ্ছে না।”
“একশোবার হচ্ছে। দেখিস, এবার কিছু হবে না।”
“অফকোর্স হবে। সেদিন বৃষ্টির মধ্যে ঐ ছেলেটাকে রাফিন ভাইয়া মনে হয়েছে তোমার তাই না? আপু শোনো না, ছেলেটা সত্যিই রাফিন ভাইয়ার মতোই ছিলো।”

আমি মুখ গোমড়া করে বললাম, “হুম এজন্যই তো…”
নাকীব চোখ রাঙ্গিয়ে বললো, “এই না বললে ভুলে গিয়েছো? এই তার নমুনা? তুমি যাচ্ছো না ব্যস!”

কথা কাটাকাটির শেষে আমি ঠিকই গেলাম সবার সাথে। যাওয়ার পথে হঠাৎ মাহফুজ এবং কুলসুম একসাথে চেঁচিয়ে বললো, “আপুউউ, ঐ যে ঐ যে আমাদের নেতা।”

আমি ও নাকীব দ্রুত তাকালাম। ঝিলি, আবিরসহ সবাই আমাদের পেছনে এসে লুকালো। এত ভয় কেন ওদের মনে কে জানে!
আমরা তাকিয়ে একজন লোককে দেখলাম। আঙ্গুল দেখিয়ে ইশারায় বললাম, “ওটা?”
ওরা দু’পাশে মাথা নাড়ালো, “উঁহু, ওটা, লাল শার্ট।”

আমরা অনেক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না। ওরা বারবার দেখিয়েই গেল। অনেকক্ষণ দেখার পর হঠাৎ মনে হলো ওখানে জাফর দাঁড়িয়ে আছে। নাকীবকে বলায় ও বললো,
“আমারও তো মনে হয়েছে।” বলে একছুটে সেদিকে গেল নাকীব।

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here