#সুপ্ত_অনুরাগে-০২,০৩
#প্রভা_আফরিন
[২]
আনিসুল সাহেবের চোয়াল ওঠানামা করছে। তিনি বসে আছেন খাটে। হাতে ছেলের রেজাল্ট কার্ড। উনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শিমুল। তার পা কাঁপছে। রুমে আপাতত তারা দুজন ব্যতীত কেউ নেই। আনিসুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“বাংলায় কত পেয়েছিস?”
শিমুল নিরুত্তর। আনিসুল সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন। তৃতীয়বার গর্জে উঠলেন,
“কথা কানে যায় না? কত পেয়েছিস?”
শিমুল কাঁদোকাঁদো হয়ে কাঁপা গলায় বলল,
“চব্বিশ।”
“কততে পাশ?” একইরকম আত্মা কাঁপানো স্বর।
“তে…তেত্রিশ।”
সঙ্গে সঙ্গে সপাটে চ ড় বসালেন আনিসুল সাহেব। শিমুলের মাইনাস পাওয়ারের চশমা মেঝেতে ছিটকে পড়ে ভেঙে গেল। মনে হলো গালে কেউ আ গুন ছুঁইয়েছে। সে গাল চেপে ধরে কেঁদে উঠল। ঝাপসা চোখ আরো ঝাপসা হয়ে গেল। আনিসুল সাহেব দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
“কিসের কমতি রেখেছি তোদের? বলার আগে সবকিছু মুখের সামনে ধরা হয়। বিনিময়ে পড়াশোনাটা করতে পারিস না? পড়াশোনা করলে কি আমার লাভ নাকি তোর?”
শিমুলের কানে কোনো কথাই ঢুকছে না। সে থরথর করে কাঁপছে। আনিসুল সাহেব রেজাল্ট কার্ড ছুড়ে মে রে বললেন,
“দূর হ চোখের সামনে থেকে।”
শিমুল ছুটে বেরিয়ে গেল। আনিসুল সাহেব আবারো চ্যাঁচিয়ে উঠলেন,
“জাহেদা? জাহেদা?”
জাহেদা বেগম ছুটে এলেন ঘরে। আনিসুল সাহেব রেগে থাকলে বাড়ির সকলেই উনাকে একপ্রকার এড়িয়ে চলে। জাহেদাও স্বামীর রা’গকে ভয় পান। তাই বলা চলে সারা মাসই তিনি প্রেশারের রোগী হয়ে থাকেন। আনিসুল সাহেব স্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন,
“তোমার ছেলে যেন আজ রাতে খাবার না পায়। তাহলে তোমার ভাত বন্ধ। টাকা গাছে ধরে না। র ক্ত জল করে কামাই করি। আমার ক-ষ্ট না বুঝলে আরাম, আয়েশ ছাড়তে হবে।”
জাহেদা বেগম কোনো জবাব দিলেন না। আনিসুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার গুণধর ভাই কোথায়?”
“কাজু তো সন্ধ্যায় চলে গেছে।”
“ওকে বলে দেবে আমার সামনে যেন না পড়ে। নয়তো তোমাদের দুই ভাই-বোনকে জ বাই করে গাঙ্গে ভাসিয়ে দেব।”
জাহেদা স্বামীর সামনে থেকে সরে গেলেন। আনিসুল সাহেব তখনো রা’গে ফুঁসছেন। কাজু উনার নাম করে বিভিন্ন জায়গায় ধার-কর্জ করে আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়েছে। এদিকে দোকানিরা এসে উনার কর্মস্থলে গিয়ে টাকা দাবী করছে। কি লজ্জার বিষয়! কলিগদের সামনে কতটা ছোটো হতে হলো! ভাবতেই রা’গে ফেটে পড়ছেন তিনি।
শিমুল ছুটে নিজের রুমে ঢুকেছে। অপরাজিতা আগেই সেখানে উপস্থিত। শিমুলকে হেঁচকি তুলে কাঁদতে দেখে সে হাত বাড়িয়ে দিলো। শিমুল এক ছুটে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরল। কান্নার শব্দ বাড়ল। তার ছোটো ফরসা গালে মোটা আঙুলের চারটি দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তাতে হাত বুলিয়ে অপরাজিতার চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু নির্গত হয়। ছেলেটাকে নিজের হাতে বড়ো করেছে কিনা!
_______________
শরৎ শুভ্র সকালে এলার্মের শ্রুতিকটু শব্দে নিদ্রান্বিত সুপ্তের মসৃণ কপালে বিরক্তির ভাজ উদিত হলো। সে নিদ্রাতুর আঁখিতেই হাতড়ে বেডসাইড টেবিলের উপর কম্পমান ঘড়িটি বন্ধ করে দিলো। উল্টো ঘুরে আবারো মুখ ডোবালো পেলব বালিশে। কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে উঠল। চোখ ডলে ভালো করে সময় দেখল। আটটা বেজে গেছে! সুপ্ত ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল। গোসল সেড়ে একেবারে তৈরি হয়ে নিচে নামতেই দেখল রফিক সাহেব টেবিলে বসে নাশতা করছেন। পাশে বসে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে ফারিহা ফুপি। সে সুপ্তকে দেখা মাত্রই বিস্তর এক হাসি ফুটিয়ে ডাকল।
“তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। ভাইজানের দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে খাওয়া শুরু করে দিলেন।”
সুপ্ত চেয়ার টেনে বসল। তার আফটার শেভের গন্ধটা রফিক সাহেবের নাকে লাগতেই ছেলের দিকে তাকালেন। বললেন,
“বেরোচ্ছিস?”
“হ্যাঁ।” ছোটো করে উত্তর দিলো সুপ্ত।
ফারিহা অভিযোগের কণ্ঠে বলল,
“সুপ্ত সারাদিন বাইক নিয়ে টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। এতবড়ো একটা ইঞ্জুরি হওয়ার পরও শিক্ষা হয়নি।”
রফিক সাহেব খাওয়া থামালেন ক্ষণিকের জন্য। সুপ্তের কপালের কা’টা দাগটা স্পটতই সুন্দর মুখের মাঝে ফুটে আছে। দুইমাস আগে ছোটোখাটো একটা বাইক এ’ক্সি’ডে’ন্ট করে বেশ আহ ত হয়েছিল সে। মন্দের ভালো মেজর কিছু হয়নি। কা টা ছেঁ ড়া শুকাতেই বাইক নিয়ে আবারো ছোটাছুটি শুরু করেছে। বলা চলে আগের চেয়েও বেশি বাইরে থাকে। রফিক সাহেব শত চেষ্টা করেও সুপ্তের বাইকের প্রতি আকর্ষণে লাগাম দিতে পারছেন না। প্রতিবারের মতোই বললেন,
“মাস্টার্স পাশ করা এতবড়ো ছেলেকে তো ঘরে তালা দিয়ে রাখতে পারছি না। নিজের ভালোটা নিজে না বুঝলে জোর করেও বোঝানো যাবে না। বাইরে যাওয়া নিয়েই তো কথা? গাড়িটা নিয়ে যাবি।”
“গাড়ি আমি নেব না বাবা। একদিন চলো আমার সঙ্গে, একটা লং ড্রাইভে যাই দুজনে। বাইকের স্বাদ পেয়ে যাবে।”
“ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই নেই। দুজনে একসাথে হাত-পা ভাঙলে আমার জোড়াতালি দেওয়া সংসার ভেসে যাবে। তারচেয়ে দুই চাকাটাকে ভাঙ্গারির দোকানে ফেলে আয়।”
“দুরন্ত গতির সঙ্গে বাইকটা যখন বাতাস ভেদ করে এগোয়, নিজেকে উড়ন্ত পাখি মনে হয়। সেই বাইক কেড়ে নেওয়া পাখির ডানা ছেঁটে দেওয়ার সমান। ইচ্ছাকৃত দেশীয় পাখির ক্ষ’তি করলে প্রাণীসম্পদ আইনে মা’ম’লা করে দেব।”
রফিক সাহেব ছেলের কথা শুনে কিছুক্ষণ বোবা হয়ে রইলেন। সন্দেহি দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুই কি আজকাল মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করছিস?”
সুপ্ত খাওয়া থামিয়ে তাকালো, “এমন মনে হওয়ার কারণ?”
“কারণ এসব পাখি, ডানা, উড়াল দেওয়া টাইপ কথাবার্তা মেয়েদের মুখেই বেশি মানায়।”
“তোমার কথা শুনলে পুরুষ পাখিরা ক্ষে পে যাবে। পরে পালাতে আমার বাইকের সাহায্যই না নিতে হয়।”
দুষ্টুমি করে উত্তর দিয়ে সুপ্ত প্রসঙ্গ এড়াতে চাইলো। রফিক সাহেব ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন,
“এভাবে আর কতদিন? চাকরিতে কবে জয়েন করবি?”
“দেখি।”
“দেখি দেখি করে সময় বয়ে যাচ্ছে। আমার কথা না ভাবলেও তোর মায়ের কথাটাও চিন্তা কর।”
ফারিহা চুপচাপ খাচ্ছিলো ও বাবা-ছেলের কথাগুলো উপভোগ করছিল। সুপ্তের মায়ের কথা উঠতেই সে বলে উঠল,
“বৈশাখী ভাবী কবে আসবেন ভাইজান?”
সুপ্ত হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। গম্ভীর গলায় ঘোষণা দিলো,
“আমার খাওয়া শেষ। ফিরতে একটু দেরি হবে।”
ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রফিক সাহেব ছোটো করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলেটা বড্ড অভিমানী।
গ্যারেজে ঢুকে সুপ্তের মাথায় হাত। আবারো খুব যত্ন নিয়ে তার বাইকের চৌদ্দটা বাজানো হয়েছে। এমন কাজ কে করেছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সুপ্ত বাইকের চাবিটা ছুড়ে ফেলে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এলো। ফোন বের করে একটা টেক্সট সেন্ড করল অতি ব্যবহৃত নাম্বারে।
“ডিয়ার বাডি,
বাবা গেলে বাবা পাওয়া যায় না। কিন্তু বাইক গেলে অবশ্যই বাইক পাওয়া যায়। বিফল এফোর্টের জন্য ডিপ কন্ডোলেন্স।”
___________
তপ্ত দুপুরে অপরাজিতা ঘেমে-নেয়ে একাকার। শুভ্র মেঘচন্দর লেপা আকাশটা যেন সূর্যের তাপে গরম তাওয়ার মতো হয়ে আছে। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমে জনজীবন কাহিল। অপু আজ ছাতা আনতে ভুলে গেছে। ফলে ভার্সিটি থেকে শপিং মল অবধি হাঁটা পাঁচ মিনিটের গমগমে পথটা পাড়ি দিতে তার কপাল, কাঁধ, গলা ভিজে উঠেছে। সে শপিং মলে ঢুকে চশমার দোকানে গেল। শিমুলের জন্য চশমা বানালো। ছেলেটা কাল থেকে ঝাপসা দেখছে। চশমা ছাড়া একদমই চলতে পারে না। যার জন্য স্কুলেও যেতে পারেনি আজ। চশমা নিয়ে যখন অপু ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়েছে হুট করেই তার ওপর একটি ছায়া এসে পড়ল। চকিতে পাশ ফিরতেই অল্পের জন্য ধাক্কা লাগা থেকে বাঁচল অপু। লোকটা তার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে মেদুর হাসি।
“ভালো আছো অপরাজিতা?”
সুপ্তের খেই হারানো চোখ অপুর মুখশ্রীতে নিবদ্ধ। দেখা হলে কতকিছু বলার ছিল। তাকে উপেক্ষা করার জন্য কিছু কঠিন শব্দও শোনাতে চেয়েছিল। অথচ মুখ ফুটে বেরোলো তিনটি মাত্র শব্দ। যাতে ম্যাগনিফাইন গ্লাস দিয়েও সামান্যতম কঠিন সুরের সন্ধান মিলবে না।
অপু চোখ ছোটো করে তাকালো। দুই ভ্রুর সন্ধিক্ষণে অতি সুক্ষ্ম একটি ভাজের রেখা উদিত হয়েছে। সুপ্ত অতি নিকটে দাঁড়িয়েছে বলেই কিনা ঘন ভ্রুর মাঝে লুকায়িত রেখাটা দৃষ্টিগোচর করতে পেরেছে। অপু স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“আপনি পিছু নেওয়া ছাড়লে ভালো থাকব।”
অপু এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। হাক ছেড়ে রিক্সা ডেকে লাফিয়ে উঠে পড়ল। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে সুপ্ত আগের মতোই মোলায়েম স্বরে বলল,
“তোমার প্রতি এ হৃদয়ে তুলোয় চেয়েও কোমলরূপে সমর্পিত। কিন্তু মানুষটা আমি বড়োই অবাধ্য।”
সুপ্ত মিটিমিটি হাসে। ফরিদ মিয়ার কপালে আজ বখশিশ নাচছে।
চলবে…
#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[৩]
রফিক সাহেবের রুম লাগোয়া প্রশস্ত একটি বারান্দা আছে। বারান্দাটি দক্ষিণমুখী। সম্মুখে মাথা ছড়িয়ে আছে কিছু আম, কাঠাল ও কৃষ্ণচূড়া গাছ। সুপ্তের এই স্থানটি খুবই প্রিয়। বাড়ির পেছনের দিকে হওয়ায় স্থানটা তুলনামূলক নির্জন থাকে সর্বদা। ছোটোবেলা থেকে সে কম ছলচাতুরী করেনি এই রুমটার জন্য। কিন্তু বাবা তার চেয়েও বেশি ধ রি বাজ। রুমটা তিনি দেবেন না। বাড়ির অন্য বারান্দা সংলগ্ন রুমগুলো সুপ্তের পছন্দ না। দক্ষিণমুখী, নির্জন, ছায়াঘেরা বারান্দা নয় কিনা! তবে বারান্দার দখল না ছাড়লেও একক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারেননি রফিক সাহেব। সুপ্তের এখানে অবাধ বিচরণ। এ নিয়ে ত র্ক প্রায়শই হয়। পরিশেষে ছেলের কাছেই হার মানতে হয়।
রাত সবে দশটা বেজেছে। খাওয়া-দাওয়া সেড়ে সবাই যে যার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে। রফিক সাহেব বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন সবে। তিনি ভীষণ পানচুয়াল লাইফ লিড করতে চেষ্টা করেন। রাত নয়টায় খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে দেন। ঘুমান রাত এগারোটায়। মাঝের সময়টায় বিছানায় গড়াগড়ি করেন, ম্যাগাজিন কিংবা দিনের অসমাপ্ত পত্রিকাটা পড়ে নেন। ভার্চুয়াল জগতটা কাজের বাইরে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন। যত অনিয়ম সব ছেলেটার জন্য। এমন সময় দরজায় করাঘাত হলো। রফিক সাহেব দরজা খুলতেই সুপ্ত ভ্রু কুচকে বলল,
“কি ব্যাপার? বুড়ো বয়সে দরজা আটকে ঘুমাও কেন? বলেছি না লক করবে না।”
রফিক সাহেব চোয়াল শক্ত করে বললেন,
“হোয়াট ড্যু ইউ মিন বাই বুড়ো? এসব কি ধরনের ভাষা?”
“বুড়ো মিন’স বৃদ্ধ। কুচকানো চামড়া, পাকা চুল ওয়ালাদের বাংলার মানুষ তাই বলে সম্বোধন করে। সাহেবিয়ানা করতে করতে বাংলাটা ভুলে বসেছো মনে হচ্ছে! সে যাক গে, দরজা কেন লক করে রাখো?”
“কেন লক করব না? আমার কি কোনো প্রাইভেসি নেই?”
“ব্যাচেলরদের আবার কিসের প্রাইভেসি?”
বলতে বলতে সুপ্ত বাবাকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকল। রফিক সাহেব আকাশ থেকে পড়লেন,
“ব্যাচেলর হতে যাব কোন দুঃখে? বাড়ি, সংসার, সন্তান সব আছে আমার।”
“বউ তো নেই। সুতরাং তোমার কোনো প্রাইভেসি নেই।”
রফিক সাহেব কটমট করে তাকালেন। সুপ্ত এগিয়ে এসে বাবার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
“দুঃখ পেয়ো না। আমারও বউ নেই। আমাদের কারোই প্রাইভেসি নেই। উই আর সেইম সেইম বাডি।”
রফিক সাহেব সুপ্তের মুখের কাছে নাক এনে শুকলেন। সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“আজকাল কি বাজে ছেলেপেলেদের সঙ্গে মিশে নে শা-টেশা করা শুরু করেছিস?”
উত্তর দেওয়ার আগে সুপ্তের নজর গেল বিছানায় খোলা পড়ে থাকা ম্যাগাজিনের দিকে। মডেলদের সংক্ষিপ্ত পোশাকের সঙ্গে নানান ভঙ্গিমার চিত্র তাতে প্রদর্শিত। সুপ্ত ছো মেরে সেটা তুলে নিল। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে ঠোঁটের কোণা চোখা করে বলল,
“ওহহ! এই তোমার প্রাইভেসি!”
রফিক সাহেব আবারো ক্ষে পলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“এবার আমি নিশ্চিত তুই নে শা করিস। উ-ই-ড খাস নাকি? পয়সার অভাব পড়লে আমার থেকে চেয়ে নিস বাপ। তবুও মেয়াদ উত্তির্ন গা জা খাস না।”
সুপ্ত হা হা করে হেসে বারান্দায় চলে গেল। রাতের ডুবন্ত আঁধারে বারান্দায় একটি ছমছমে অথচ ফুরফুরে আবহ ঘিরে রয়েছে। সুপ্ত গিয়ে বসল তার বাবার পছন্দের সৌখিন বেতের মোড়ায়। রফিক সাহেব পাশে বসতেই দরজার সামনে এসে হাজির হলো ফারিহা। সে সম্পর্কে রফিক সাহেবের ফুপাতো বোন। স্বামী মা রা যাওয়ার পর মামাতো ভাইয়ের আশ্রয়ে আছে দশ বছর যাবত। বাড়ির দেখাশোনা করে। সংসারের খেয়াল রাখে। তার পয়ত্রিশ বছরের দেহটিতে সামান্যতম ধুলো বা মেদ জমেনি। কতবার পুনরায় বিয়ের জন্য জোড়াজুড়ি করা হয়েছে। ভাইজানের আর্থিক অবস্থা দেখে অনেক অবিবাহিত পুরুষও বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু বিধবা হওয়ায় অন্যের চোখে সহানুভূতি বা তাচ্ছিল্যের সুক্ষ্ম দৃষ্টি হজম করতে পারে না বলেই বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানো হয়নি। সে বলল,
“চা খাবেন ভাইজান?”
“এই রাত-বিরেতে চা?”
“দুজন একসঙ্গে বসেছেন মানেই ঘুম সহজে কাছ ঘেঁষবে না।”
“আচ্ছা, আনো দু-কাপ।”
সুপ্ত সঙ্গে সঙ্গে মানা করে বলল,
“আমি খাব না। সারাবিকেল চা খেয়েই কাটিয়েছি। দাঁত-জিভ সব হলুদ হয়ে গেছে।”
রফিক সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন,
“তোর এত চা খাওয়ার অভ্যাস হলো কবে থেকে? এ-ক্সি-ডেন্টের পর থেকে স্বভাবে একের পর এক বদল লক্ষ্য করছি!”
সুপ্ত হেসে বলল,
“সবই লক্ষ্য করছো শুধু ছেলে বড়ো হচ্ছে সে খেয়াল রাখছো না।”
ফারিহা মুচকি হেসে বাবা-ছেলের স্পেস থেকে সরে গেল। রফিক সাহেব কাঁধ ঝাকালেন,
“বড়ো হয়ে কাজ নেই। দায়িত্ববান না হওয়া অবধি বিয়ের নাম মুখেও আনা যাবে না।”
“তুমি তো দায়িত্ববান। তাহলে তোমার সংসার এমন ব্যাচেলর কোয়ার্টার কেন?”
গমগমে বারান্দায় নির্জনতা ছেয়ে গেল। পাশাপাশি বসা মানুষের চেয়েও দূরের আঁধার যেন বেশি মনোযোগ পাচ্ছে। যাতে মিশে আছে কিছু অভিমান, তি ক্ততা অথবা অসহায়ত্ব। নিরবতা ভেঙে সুপ্ত বলল,
“এমনিই বললাম। আমি যে দোকানে চা খাই সেখানে তোমাকে একবার নিয়ে যাব। স্পেশাল গুড়ের চা। খেলে ফ্যান হয়ে যাবে।”
সুপ্ত উঠে যেতে নিলে রফিক সাহেব থামালেন। বললেন,
“দিন দিন মেয়েদের মতো হয়ে যাচ্ছিস। অভিমান না করে পরিস্থিতি বুঝতে শেখ। তোর মায়ের ভিসা লেগেছে। শীঘ্রই আসবে।”
“আপাতত ঘুমের ভিসা লাগলে আমি বেশি খুশি হবো।”
সুপ্ত চলে গেল। ফারিহার আনা চা এক সময় নিঃশেষ হয়ে এলো। রফিক সাহেব সেখানেই বসে রইলেন ঘন্টাখানেক। রুমে ফিরে দেখলেন সুপ্ত উনার বিছানাতেই হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রফিক সাহেবের মনে তীব্র আফসোস চেপে ধরে।
________________
সকাল থেকে শিমুল ঘাপটি মে রে ছিল। বাবা যতক্ষণ বাড়িতে থাকে সে রুম থেকে বের হয় না। সামনে তো ভুলেও পড়তে চায় না। আনিসুল সাহেব অফিসে যেতেই সে স্বাভাবিক হলো। ছুটে গিয়ে টেবিলে বসে গাপুসগুপুস খেতে লাগল। অসতর্কতায় সাদা ইউনিফর্ম-এ খাবার লেগে হলুদ দাগ পড়ে গেল। তা দেখে জাহেদা বেগম খে কিয়ে উঠলেন,
“এতক্ষণ ডেকে ডেকে খাওয়ার লোক পাই না আর এখন তিনি নাকে-মুখে সমানে খাচ্ছে, জামাকাপড়কেও খাওয়াচ্ছে। এবার এটা পরে ক্লাস করতে পারবি।”
“আমাকে আজ স্কুলে যেতে হবে মা। কালকেও মিস দিয়েছি।”
অপু ভাইয়ের এহেন কথায় চোখ বড়ো করে তাকাল। স্কুল ফাঁকি দিতে হাজারটা বাহানা দেওয়া ছাত্র কিনা স্কুলে যেতে মড়িয়া! বলল,
“সূর্য কোন দিকে উঠলো আজ? স্কুলে যেতে এত তাড়া?”
শিমুল চোখ লুকায়৷ আমতা আমতা করে বলে,
“টিচার মা রবে।”
জাহেদা বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,
“এই জ্ঞানটা আরো আগে হলে বাবার হাতে মা’র খেতে হতো না। তোদের জন্য আমার সুস্থ হয়ে বাঁচা দায়। একটা ছেলে-মেয়েকেও মানুষ করতে পারলাম না।”
অপু অবাক হয়ে বলল,
“এখন আমি কী করলাম?”
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। অপু উত্তরের আশা ছেড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। কাজু বুকে দু-হাত গুজে আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখা মাত্রই জাহেদা বেগম হুংকার দিয়ে তেড়ে এলেন।
“ফ কি ন্নির বাচ্চা! তুই এ বাড়িতে এসেছিস কোন সাহসে?”
কাজু অবাক হয়ে বলল,
“বুবু, তুই আমার বাপকে ফ কি ন্নি বললি?”
কথাটা শুনে জাহেদা বেগম পায়ের স্যান্ডেল খুলে ছুড়ে মা রলেন। অপু লাফ দিয়ে সরে দাঁড়ালো। কাজু স্যান্ডেল ক্যাচ ধরে ফেলল। অপু ভেবেছিল মামা এখন পালাবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাজু দৌড়ে গিয়ে বোনের পা জড়িয়ে ধরল।
“বুবুরে, তুই আমার মা, আমার বাবা। এই পৃথিবীতে তুই ছাড়া আমার কেউ নেই। তুই মুখ ঘুরিয়ে নিলে আমি অনাথ হয়ে যাবরে বুবু।”
জাহেদা বেগম জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। শিমুল মুখে খাবার নিয়ে কান্ডকারখানা দেখে যাচ্ছে। অপু পরিস্থিতি সামলাতে মায়ের কাছে গেল। বলল,
“মা শান্ত হও। তোমার জন্য চিৎকার চেচামেচি করা ক্ষ তিকর। শান্ত হও প্লিজ!”
“এই আদেখলাকে আমার কাছ থেকে সরতে বল। এর জন্য তোর বাপের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না। আমার নাক-কান সব কা টিয়েছে।”
কাজু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“বুবু, আমি কাল থেকে খাইনি। পথে পথে ঘুরেছি। আমার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে তোর মায়া হয় না?”
জাহেদা ঝামটা মে রে কাজুকে সরিয়ে দিলো। কাজু ভাবল কাজ হয়েছে। বুবু তাকে যতই ব কা ব কি করুক, ভালোও বাসে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে জাহেদা বেগম নিজের ঘরে চলে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো। কাজু কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো। কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বলল,
“খেতে দে তো অপু। খিদেয় দাঁড়িয়ে থাকার জোর পাচ্ছি না।”
অপু হেসে গড়িয়ে পড়ল। হাসির দমকে চোখে পানি চলে এলো। কোনোমতে নিজেকে সামলে বলল,
“কীভাবে পারো এসব?”
“চুপ বে য়া দ ব! তোরা কিছু দেখিসনি, শুনিসনি। গুরুজনদের নিয়ে হাসি-তামাশা করবি না।”
অপু ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
“হয়েছে হয়েছে, খেতে বোসো। আর ভুলেও যেন বাবার সামনে পোড়ো না। তাহলে তোমার হা-ড্ডি মাং-স একসঙ্গে পাওয়া যাবে না।”
“বললেই হলো? ওই টাকমাথা, ভুড়িওয়ালা লোক আমার বা…”
কাজু নিজেকে সামলে নিল। ভাগ্নে-ভাগ্নী সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গলা ঝেড়ে বলল,
“আমার চুলও ছুঁতে পারবে না। এখন কথা না বলে খেতে দে।”
শিমুল মামার সঙ্গে কোনো কথা বলল না। কাজু বলল,
“কিরে ললিপপ, নতুন চশমা নিয়েছিস দেখি।”
“তুমি যেখানে, বিপদ সেখানে।”
শিমুল তড়িঘড়ি করে ব্যাগ কাঁধে তুলে চলে গেল।
কাজু খাওয়া শেষ করে বুবুর রুমের সামনে গিয়ে চ্যাচিয়ে বলে উঠল,
“তুই আমার বুবু না, নিশ্চয়ই বাপের প্রথম পক্ষের মেয়ে তুই। এ জন্যই সৎ বোনের মতো আচরণ করিস।”
সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। জাহেদা বেগম রান্নাঘরে গেলেন ব টি আনতে। কাজু বি পদ সংকেত পাওয়া মাত্রই ছুটে পালালো। দিন কয়েক আর এ মুখো হবে না।
_______________
অপু ভার্সিটি পৌঁছালো সকাল দশটায়। রিক্সা থামার আগেই তার নজর গেল বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে। অপু চোখ বুজে লম্বা শ্বাস নিল। রিক্সা ঝাকি দিয়ে থেমে গেল। রাস্তার পাশে কনস্ট্রাকশনের কাজ হচ্ছে বলে রাস্তার অবস্থা নাজেহাল। চারিদিকে খানাখন্দ। অপু নামতে নিলে সুপ্ত বলে উঠল,
“সাবধানে…”
অপু লাফিয়ে নেমে কড়া চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
“আমি বাচ্চা নই।”
“জানি, আমিও বাচ্চাদের দিকে নজর দেই না। অল্প বয়সে পেকে যাওয়া মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করার বিন্দুমাত্র শখ নেই আমার।”
চলবে…