সংসারের_সাতকাহন পর্ব ১ ও ২ ©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ

0
800

– মুরাদ ভাই, এটা কেমন কথা বলুনতো? আপনারই সামনে আপনার স্ত্রীকে আপনার মা এতো অপমান করে গেল আপনি একটা শব্দও করলেন না? আপনার কি উচিৎ ছিলনা মিথ্যার প্রতিবাদ করা? একমাত্র ননদ তুলির বর ও হাসবেন্ড নাঈমের বন্ধু মুরাদকে অভিযোগের সুরে বলে ইতি।

– ভাবি, আগে আমি ভাবতাম আমার বউ যে হবে সে আসবে অন্য পরিবার ছেড়ে তাকে আমি মাথায় তুলে রাখব। কিন্তু আপনাদের বিয়ের পর থেকেই দেখছি নাঈম এইসব মুহুর্তে একদম চুপ থাকে। আমিও ওর দেখেই শিখলাম এইসব সময়ে চুপ থাকতে হয়। জানেনই তো সারাজীবন ওর খাতা দেখেই পাশ করেছি আমি। হেসে উত্তর দেয় মুরাদ।

মুরাদের উত্তর শুনে ক্ষণিকের জন্য থ হয়ে যায় ইতি ও তুলি দুজনেই। কিছুক্ষণ পড়ে মুরাদের ইংগিত ধরতে পেরে ওর উপর রেগে যায় তুলি – কি বলতে চাচ্ছ তুমি হ্যাঁ? আমরা ভাবির সাথে অন্যায় আচরণ করতাম? ভাবির ভুল ছিল বলেই তো মা আর আমি রাগারাগি করতাম। আর শুন আমার ভাই বেয়াদব না যে মায়ের সাথে ঝগড়া করবে বা মায়ের কথার প্রতিবাদ করবে।

এবার সত্যিই হা হা করে হেসে উঠে মুরাদ। বলে – তোমার ভাই আদবের পুরুষ সেজন্য মা বোনের অন্যায় দেখেও চুপ থাকে আর আমি তোমার পক্ষ নেইনা সেজন্য আমি কাপুরুষ? বাহ দারুন যুক্তি তো তোমার।

এবার দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলে উঠে ইতি – থাক মুরাদ ভাই। কে সুপুরুষ আর কে কাপুরুষ তার বিচার করতে নিশ্চয়ই আপনি আমাকে এখানে ডাকেননি? সেটা আল্লাহই বিচার করবেন। আপনি প্লিজ একটু মুখ খুলুন, তার মানে ঝগড়া না। যদি দেখেন তুলির অন্যায় তাহলে তুলিকে বুঝাবেন আর আন্টির অন্যায় হলে প্লিজ আন্টিকে বুঝাবেন। এটা আপনার কাছে অনুরোধ রইল ভাই। অন্য কেউ হলে হয়তো আমি এই অনুরোধটুকু করতে পারতাম না, কিন্তু আপনি নাঈমের ফ্রেন্ড। নিজেদের মানুষ, আপনাদের ভালোবাসার বিয়ে, এই কারণে এই অনুরোধ করছি।

ইতি বের হয়ে যেতে উদ্যত হতেই তুলি ওর হাত চেপে ধরে। – ভাবি আরেকটা সমাধান তো করলে না।

– কি সমাধান তুলি? জানতে চায় ইতি।

– আমি চাকুরি করতে চাই তোমার মতো। এই ব্যাপারে মুরাদকে রাজি করাও। নাকি তুমিও চাওনা আমি চাকুরি করি? ঝাঁঝের সাথে বলে তুলি।

– না, আমিও চাইনা তুমি চাকুরি কর। সত্যিই চাইনা। আমি নিজেও চাকুরি করতে চাইনা, কিন্তু বাধ্য হয়ে করছি। তোমার ভাইয়ের আয় আরেকটু বেশি হলেই আমি চাকুরি ছেড়ে দিতাম। কিন্তু তুমি হয়তো জানোনা তোমার ভাইয়ের পুরো বেতন ও মার হাতে তুলে দেয় সংসার খরচের জন্য। আর আমার বেতনের টাকায় আমরা দুজন চলি। একজন মেয়ে হিসেবে প্রতিদিন ঘরে বাইরে সামলে আমি হাঁপিয়ে যাই। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে নাই তাই বাধ্য হয়ে চাকুরি করছি। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে ইতি।

– দেখ তুলি, আমাদের অবস্থা ভালো তোমার ভাইয়ের তুলনায়। ভাবির বেতনের ডবল টাকা তোমাকে আমি দেই হাতখরচের জন্য। তারপরও তোমার এই চাকুরির জন্য জেদ করা আমি পছন্দ করিনা। মুরাদ বলে উঠে।

– হ্যাঁ কথায় কথায় তো খোঁটা দাও আমার ভাই গরীব। তা তো দিবাই। আর আরেকজন আমি চাকুরি করতে চাইলে হিংসায় মরে যায়, যদি তার চেয়ে বেশি আয় করি। যাও বের হও আমার বাড়ি থেকে। আর কখনই আসবে না। বলে ইতিকে একরকম ধাক্কা দিয়েই ঘর থেকে বের করে দেয় তুলি।

ধাক্কা খেয়ে ইতি গিয়ে পড়ে তুলির শাশুড়ির উপর। উনি তাকে ধরে সোফায় বসিয়ে বলে – শিক্ষা হয়েছে না? খুব তো এসেছিলে এই বেয়াদবের কথায়। কেন ওর কথায় নাচো মেয়ে? আগে থেকেই তো জানো সে কেমন?

উত্তরে ম্লান হাসে ইতি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা হব হব করছে। তুলির শাশুড়িকে সালাম দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে তুলির বিয়ের আগের কথা। তুলির বিয়ের তিন বছর আগে ইতির বিয়ে হয়। ইতি বিয়ের আগে শুনেছিল ননদ ভাবি নাকি বন্ধুত্ব হয়। সেই আশা নিয়েই এসেছিল শ্বশুর বাড়ি। ননদের বন্ধুত্বের ভান দেখে বন্ধুত্ব শব্দের উপরই ঘেন্না ধরে গেছে ইতির।

ইতির বিয়ের পর থেকে তুলির বিয়ে পর্যন্ত না ছিল ওর কোন ব্যক্তিগত জীবন, না ছিল কোন চাওয়া-পাওয়ার মূল্য। এমনকি ওরা রাতে ঘুমানোর সময়ও দরজায় ছিটকানি দিতে পারত না কারণ তুলির ছোট থেকেই অভ্যাস রাতে দুই একবার করে ভাইয়ের ঘরে এসে ভাইকে দেখে যাওয়া, নইলে তার ঘুম হয়না। ইতির ছোট থেকেই অভ্যাস দরজায় ছিটকানি না দিলে সে ঘুমাতে পারেনা। কতদিন নাঈমের সাথে এই কারণে রাগ করে গেস্ট রুমে গিয়ে ছিটকানি লাগিয়ে ঘুমিয়েছে তার ঠিক নাই।

নাঈম সারাদিন পরে অফিস থেকে ফিরে সাথে সাথে রুমে যেতে পারবেনা। আগে মায়ের ঘরে যেতে হবে। নাঈম যখন রুমে যাবে তখন ইতি রুমে থাকতে পারবেনা। শুধুমাত্র ঘুমানোর সময় ছাড়া ওরা একসাথে হতে পারবেনা, কথা বলতে পারবেনা। আর ঘুমাতে হবে দরজার ছিটকানি না লাগিয়ে। ইশ কি দিন গেছে একেকটা। ইতি মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছিল এসব দেখে। সেই সময় ওর জীবনের বদ্ধ ঘরে জানালা হয়ে এলো স্কুলের এই চাকুরিটা।

ইতি বিয়ের প্রথমদিকের চাকুরীজীবন মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ইতির স্কুলে যেতে হত সকাল ৭টার মধ্যে। ও বাসা থেকে বেরিয়ে পরত ৬.৪৫ এর মধ্যেই। নাঈম বাসায় ফিরত রাত ১১টার পরে। অফিস সেরে ৩টা টিউশনি করিয়ে এক দোকানের সারাদিনের হিসাব মিলিয়ে তারপর বাসায় আসত। টিউশনি ও এই বাড়তি কাজের টাকা পুরোটাই সে জমাতো তুলির বিয়ের জন্য। এটা পরিবারের সবাই জানে। ওরা সবাই ১০ টার মধ্যে যার যার মতো খেয়ে শুয়ে পরত। ইতি নাঈম না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করত। নাঈম ফিরে কিছুক্ষণ গল্প করে তারপর খেতে বসত রাত ১২টার পরে। খাওয়াদাওয়া শেষে সব গুছিয়ে দরজা জানালাগুলো ঠিকমতো লাগানো আছে কিনা চেক করে শুতে শুতে রাত একটা পার হয়ে যায় ইতির। তারপরও নতুন বিয়ের স্বামীর কিছু আবদার তো থাকতই। ঘুমাতে যত রাতই হোক সকাল ৬ টার মধ্যে বিছানা ছাড়তে হত ইতিকে, নইলে সময়মতো স্কুলে পৌঁছাতে পারত না।

বিয়ের পরে স্কুল থেকে ফিরে প্রথম তিনদিন শুধু দুপুরের খাবার পেয়েছে ইতি। তারপর থেকে প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় স্কুল থেকে ফিরে দেখত খাবার নাই। সব তার শাশুড়ির রুমে রাখা ফ্রিজে তুলে ফ্রিজ লক করা। অবাক হলেও ইতি কথা বাড়ায়না। নিজের রুমে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ে। যেহেতু রাতে ৮ ঘন্টা ঘুম পুরো হয়না সেহেতু দুপুরে ঘুমিয়ে নেয়। ঘুম পুরো না হলে ইতির মাইগ্রেনের পেইন হয়।

প্রথমদিন ইতি না খেয়েই দুপুরে ঘুমিয়ে যায়। সন্ধ্যায় উঠে নামাজ পড়ে কুরআন পড়ে সবাইকে চা নাস্তা দিয়ে রাতের রান্না করে ইতি। নাঈম অনেক রাতে ফিরে ঠান্ডা ভাত খেতে চায়না তাই ওদের দুজনের জন্য ভাত পরে রান্না করে ইতি। ও যে দুপুরে খাবার পায়নি, না খেয়ে ছিল সন্ধ্যায় সেটা কারো আচরণেই প্রকাশ পায়না। বাড়িতে সদস্য বলতে মাত্র ৫ জন। ইতি, নাঈম, তুলি ও ইতির শ্বশুর শাশুড়ী। রাতে নাঈম ফিরলে ইতি দুপুরের কথা কিছুই তুলেনা।

ইতি পরদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার সময় হালকা এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে আসে ব্যাগে করে। যদি আজও খাবার না থাকে তাহলে বিস্কুট খেয়ে পানি খেয়ে থাকবে। নইলে সন্ধ্যার নাস্তায় পরিবেশন করবে। যথারীতি বাসায় ফিরে দেখে খাবার নাই। কি মনে করে তুলিকে জিজ্ঞেস করে খাবারের কথা। তুলির উত্তর শুনে থ হয়ে যায়। তুলি বলে – আমার মা কি তোমার কেনা বান্দী? তুমি সারাদিন বাইরে ঢং করে আসবা আর মা তোমার জন্য ভাত রেঁধে বসে থাকবে? তোমার উচিৎ না সকালে যাওয়ার আগে দুপুরের রান্না করে রেখে যাওয়া?

উত্তরে ইতি বলে – দেখ তুলি, আমি চাকুরীজীবি জেনেই তোমার পরিবার আমাকে এই বাড়িতে এনেছিলে তোমরা। আমার স্কুল সকাল ৭টা থেকে। আমি কিভাবে দুপুরের রান্না করে রেখে যাব বল? আচ্ছা আমি রাতের রান্নার সময় দুপুরের জন্য বেশি করে রান্না করে রাখব এখন থেকে।

– আমার বাপ মাকে বাসী খাবার খাইয়ে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করতেছ তুমি? আমরা জীবনেও কেউ বাসী খাবার খাইনি। এখন মহারানী আসছেন আমাদের বাসী খাওয়াতে। চিৎকার করে বলতে থাকে তুলি। ওর চিৎকারে ছুটে আসে ইতির শাশুড়ী, নাজমা বেগম।

কোন কিছু না শুনে, না বুঝে ধমক দেন ইতিকে, কেন সে তুলির সাথে ঝগড়া করছে।
– শুন ইতি, তোমাকে ভদ্র পরিবারের ভালো মেয়ে বলেই জানতাম, সেজন্যই আমার ছেলের বউ করেছি কিন্তু তুমি বিয়ের দশদিনের মাথায় এভাবে ননদের সাথে পায়ে পা তুলে ঝগড়া করবে ভাবিনি। ছিঃ এই তোমার শিক্ষা? বলে মেয়েকে নিয়ে ঘরে চলে যান নাজমা বেগম।

ইতি ওর প্রতিদিনের কাজ সেরে রুমে যায়। রাত ১০ টা বেজে গেলেও তুলিদের খাওয়ার কোন সাড়া পায়না। রাত এগারোটায় নাঈম ফিরে দরজায় কলিং বেল দেয়ার সাথে সাথে তুলি হেঁচকি তুলে কান্না শুরু করে। নাঈম ভিতরে ঢুকে দেখে ওর বোন ড্রইংরুমে বসে কাঁদছে, ওর মা বাবা থমথমে মুখে পাশে বসে। সে বুঝতে পারেনা কি হয়েছে। ইতিকে জিজ্ঞেস করতেই তুলি বলে উঠে – ও কি বলবে? অপরাধী তো সেই। শুন ভাইয়া আজ তোমার বিয়ের মাত্র দশদিন, অথচ এর মধ্যেই তোমার পেয়ারের বউ আমার গায়ে হাত তুলেছে। এখনই সামলাও ভাইয়া, নইলে দেখবা মা বাবা কেও বাড়ি থেকে বের করে দিবে।

ইতি প্রতিবাদ করতে যাবে তার আগেই নাঈম ওর দিকে তাকিয়ে বলে – কি হইছে কিছুই শুনার এনার্জি নাই। তুমি তুলিকে সরি বল। আর তুলি ইতিকে তুই আর মাই পছন্দ করে এনেছিস, সুতরাং এখন আমার কাছে অভিযোগ দিয়ে কি হবে? সারাদিন পরে বাসায় ফিরে এইসব কাহিনি ভালো লাগেনা। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মিটা।

নাঈম ঘরে ঢুকেই ইতিকে বলে – তুলি আমার অনেক আদরের ছোট বোন। ওর গায়ে হাত তুলে তুমি ভালো করনাই। একটা কথা জেনে রাখ, আমাদের এই বাসায় তুলির কথাই আইন। ওর পছন্দে তোমাকে বিয়ে করেছি, ওর অপছন্দ হলে তোমাকে ছেড়ে দিতেও আমার বাঁধবেনা। আর এই দরজার এই পাশে এসে তুমি তুলিকে নিয়ে কিচ্ছু বলবানা। বলার থাকলে ওর সামনে বলবা, পিছনে না। ওরা যেমন তোমার পিছনে কিছু না বলে সামনেই বলল।

ইতির আর রুচি হয়না দুপুরের খাবার নিয়ে কিছু বলার। চুপচাপ নাঈমকে খাবার বেড়ে দিয়ে বসে ওর খাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। নাঈম একাই খেয়ে উঠে, একবারও ইতিকে বলে না খেতে বসার জন্য। অথচ গত কয়দিন ধরে দেখে আসছে ইতি প্রতিরাতে ওর ফেরার অপেক্ষায় না খেয়ে থাকে। নাঈমের খাওয়া হলে সব ধুয়ে উঠিয়ে রেখে দরজা জানালাগুলো ঠিকমতো লাগানো আছে কিনা চেক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ে। সকালে স্কুলে গিয়ে একটা পরোটা কিনে খেয়েছিল ক্যান্টিন থেকে তারপর থেকে পানি, দুইটা বিস্কুট আর এক কাপ চা ছাড়া সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষুধায় কান্না চলে আসে ইতির। মনে পড়ে বিয়ের আগে কখনো যদি না খেয়ে শুয়ে পড়ত তাহলে বাবা ভাত মাখিয়ে এনে খাইয়ে দিতেন জোর করেই।

সেই কথা মনে হওয়ায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ইতি। সাথে সাথেই শুনে….
#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ১ ও ২
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here