ভার্সিটির নিজ ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যারের থেকে বিয়ের প্রস্তাবে ভড়কে উঠল মীরা। শ্রদ্ধেয়, বয়োজ্যেষ্ঠ, পিতৃস্থানীয় কারও কাছ থেকে এমন প্রস্তাব সত্যি চমকে দেওয়ার মত। তাছাড়া স্যারের কাছ থেকে তো এমনটা মীরা স্বপ্নেও আশা করেনি। মীরা ঘামছে। কনকনে শীতল রুমেও মনে হচ্ছে সে অ*গ্নিকু*ণ্ডের পাশেই বসা! নাকি বাহিরের চৈত্রের তীব্র তাপ রুমের শীতলতাকে ছাঁপিয়ে যাচ্ছে! কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে তার। অপরপাশের চেয়ারে বসা চেয়ারম্যান স্যার মীরার জবাবের জন্য অধীর আগ্রহে আছেন।
কিছুক্ষণ আগে,,
প্রায় তিন বছর পর নিজের ভার্সিটিতে পা দিয়েছে মীরা। ভার্সিটির করিডোরে ঘুরে ঘুরে দেখছে। যেসব ফ্লোরে তাদের ডিপার্টমেন্টের ক্লাস হয় সেখানেও ঘুরে ঘুরে লুকিং গ্লাসে টিচারদের ক্লাস নেওয়া দেখছে। করিডোরে স্টুডেন্টদের বিচরণ। সবার মাঝে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে সে। তার অতীতের দূরন্তপনা, হাসি-আনন্দ সব। করিডোরের কেউ তাকে লক্ষ্য করছে না। যে যার মত মেতে আছে নিজ নিজ বন্ধুদের সাথে। সব দেখে মীরার চোখে জল ভর করল। আলতো হাতে তা মুছে নিয়ে পা বাড়াল ডিপার্টমেন্টের দিকে। টিচারদের সাথে দেখা করতে। পুরনো অনেক শিক্ষকরা চলে গেছেন। কেউ পিএইচডি করতে তো কেউ অন্য কোন ভালো অপশন পেয়ে সেখানে। শিক্ষকদের মাঝেও অনেক নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। যাদের সাথে মীরার পরিচয় নেই। সে সবচেয়ে প্রিয় ম্যামদের সাথে প্রথমে দেখা করল। সবাই খুশি। ক্যারিয়ার প্ল্যানিং জানার পর শেষে একটাই প্রশ্ন,
“বিয়ে কবে করছি?”
প্রশ্নকর্তার কাছে খুব সহজ একটা প্রশ্ন, কিন্তু জবাবটা উত্তরদাতার কাছে বেশ কঠিন। মীরা মুচকি হেসে বলে,
“সময় হলে করব ম্যাম।”
সবার শেষে দেখা করতে যায় ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যার প্রফেসর ডঃ আকবর রেহমান স্যারের সাথে। ডিপার্টমেন্টের সব স্টুডেন্টদের উনি অনেক স্নেহ করেন। সে অনুসারে ছেলে-মেয়েরাও উনাকে বেশ শ্রদ্ধা করে। স্যার বেশ আন্তরিক। স্যারের অফিস কক্ষে গিয়ে নিজের পরিচয় দেওয়ার আগেই স্যার বলে ওঠেন,
“আরে মীরা! কেমন আছো?”
মীরা মিষ্টি হেসে চেয়ার টেনে বসে জবাব দেয়।
“আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন স্যার?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। এই বয়সে আর কতটুকু ভালো থাকি বলো? তাও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমার কী খবর?”
“মাস্টার্স শেষ করে এক সপ্তাহ হলো দেশে এসেছি।”
“চাকরির জন্য এপ্লাই করেছ?”
“না স্যার এখনো করিনি। আসলে আমি ইন্ডিয়াতে একটা জব করছি। ছুটিতে এসেছি। বাবা-মা খুব করে জোর করলেন, তাই আসলাম। ”
প্রফেসর ডঃ আকবর রেহমান হালকা হাসলেন। তারপর বললেন,
“বিয়ের জন্য কি? বাবা-মায়েদের এই এক মহাচিন্তা। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে নিয়ে।”
“জি স্যার তেমনটাই।”
“তা কবে বিয়ে করছ?”
মীরা নম্র হেসে জবাব দিল,
“যখন সময় হবে তখন করব স্যার। আমার বিয়ে নিয়ে অত চিন্তা নেই।”
“বিয়ের জন্য কেমন ছেলে পছন্দ? কোন পছন্দ আছে নিজস্ব? যার জন্য দেরি করছো?”
স্যারের এই প্রশ্নে মীরা চুপসে যায়। মনে হচ্ছে স্যার তার মনের কথা ধরে ফেলেছেন। মলিন হয়ে যায় তার মুখশ্রী। নিচু স্বরে বলে,
“না স্যার। আমার তেমন পছন্দ নেই। ভালো মনের মানুষই যথেষ্ঠ।”
“ওয়েল। এটা ঠিক, ভালো মনের মানুষ হলে ধন-সম্পদ, প্রাচুর্য ও অন্য কোনো কমতি থাকলেও সব হার মেনে যায়। আবার অনেকের অঢেল থাকার পরেও খারাপ মনের মানুষের পাল্লায় পরে সব শেষ হয়ে যায়।”
মীরা কিঞ্চিত হাসল। মীরাও স্যারের সাথে একমত। স্যারের একটা মাত্র ছেলে তাও সুস্থ না। শারীরিক ও মানসিক প্র*তিব*ন্ধী। দেশ-বিদেশে ঘুরে স্যার তার ছেলের অনেক চিকিৎসা করিয়েছে কিন্তু সুফল পায়নি। স্যারের ছেলে এখন শয্যাশায়ী। মুখ দিয়ে খেতেও পারে না, নড়াচড়াও করতে পারে না। তার স্ত্রীর জড়ায়ুর টিউমারের চিৎসার পর আর সন্তান হবে না জেনেও তিনি আরেকবার বিয়ে করেননি।
মীরা বলে,
“জি স্যার। বলে না, দুষ্ট গো*রুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল ভালো।”
প্রফেসর ডঃ আকবর রেহমান বলেন,
“মীরা, তোমার জন্য আমার কাছে একটা প্রস্তাব আছে। বিয়ের প্রস্তাব। তুমি ভেবে দেখতে পারো। আমার বাড়ির বউ হবে? আমাদের অপূর্ণতা মিটাবে?”
থমকে গেল মীরা। চেয়ারম্যান স্যারের কথাগুলো তার অবিশ্বাস্য লাগছে। সে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। আকাশ-পাতাল চিন্তা-ধারা করে চলেছে।
-_-_-_-_-_-
“কী হলো মীরা? কী ভাবছ? রাজী তুমি?”
চেয়ারম্যান স্যারের ডাকে ঘোর ভাঙ্গে মীরার। হকচকিয়ে উঠে সে। মস্তিষ্কে সমস্ত কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। যেখানে সে গুছিয়ে কথা বলার জন্য স্টুডেন্ট লাইফে ও চাকরিক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ, সেই মীরা কথা গোছাতে পারছে না। অবশ্য এটা আজকে তার সাথে প্রথমবার হচ্ছে না! মীরা জিভ দিয়ে ঠোঁট হালকা ভিজিয়ে ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে,
“আসলে স্যার….!”
“সময় নাও। ভাবো। তোমার বাড়ির লোকদের সাথে কথা বল তারপর সিদ্ধান্ত নাও। যেহেতু জীবনের একটা বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে চলেছ।”
মীরা জোরপূর্বক হেসে এখান থেকে উঠতে চাইছে। কিন্তু কী বলে উঠবে সেটাই ভাবতে পারছে না। মাথা এতটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কী বলবে! তখনই কক্ষে পিয়নের আগমন ঘটে। মীরা তড়িঘড়ি করে বলে,
“স্যার, আজ তাহলে আমি উঠি। ভালো থাকবেন।”
“আচ্ছা। তুমিও ভালো থেকো। আর ভেবো কিন্তু কথাটা।”
মীরা ওষ্ঠকোণে কৃতিম হাসি রেখে বেরিয়ে যায়। স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এতক্ষণ আটকে রাখা অস্বস্তিকর নিঃশ্বাসটা মুক্ত করে। চেয়ারম্যান স্যারের প্রতি থাকা সম্মানের স্তরটা ধীরে ধীরে কেমন যেন ফিঁকে হতে শুরু করেছে। খানিক এলোমেলো পায়ে ডিপার্টমেন্টাল করিডোর থেকে বেরিয়েই যাচ্ছিল তখন হঠাৎই কারও সাথে বেখেয়ালিতে ধাক্কা লেগে পরে যেতে যেতে বেঁচে যায়। কেউ তাকে ধরেছে। পিটপিট করে মুদিত নয়নজোড়া খুলে নিজের সেভিয়রকে দেখার প্রয়াস করে। তৎক্ষণাৎ ভড়কে যায়। এ কি! ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে স্ট্রিক্ট, ফ্রেন্ডলি, মুডি, সমাজছাড়া স্যার তার হাত ধরে পরে যাওয়া রোধ করেছে। মীরা ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর তোঁতলানো স্বরে বলে,
“স..সরি স্যা..স্যার! অ্যাই ডিডেন্ট নোটিশ!”
“ইটস অকে। নেক্সট টাইম, ইউ মাস্ট নোটিশ।”
“অকে স্যার।”
মীরা দ্রুত ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে লিফ্টের বোতামে প্রেস করে অপেক্ষা করতে থাকে। তার হাত কাঁপছে। আজকে কী হচ্ছে এসব! এত অস্বস্তিতে কেন পরছে? তখনি আবারও সেই স্যারের কণ্ঠ কানে আসে। তিনি দূর থেকেই জিজ্ঞেসা করেন,
“হুইচ সেমিস্টার?”
মীরা ভয়ে ভয়ে পেছনে ঘুরে। অতঃপর ঢোক গিলে ভদ্রতা সূচক একটু এগিয়ে বলে,
“স্যার, আমি এক্স স্টুডেন্ট।”
“ওও! সো, দ্যাটস হোয়াই অ্যাই অ্যাম আনএবেল টু রিকল ইউর নেম। বাট ইউর ফেস ইজ সামহোয়াট ফেমিলিয়ার।”
স্যারের ঠোঁটে হাসির রেখা দেখে মীরার স্বস্থি মিলে। স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায়ও এই স্যারের সামনে খুব একটা পড়তে চাইতো না সে। স্যারের ভয়ংকর চোখের চাহনি তাকে অস্বস্তিতে ফেলত। যেন চোখ দিয়েই গি*লে ফেলবে। মীরা হালকা হেসে বলে,
“কেমন আছেন স্যার।”
“অ্যাম গুড। হাউ এবাউট ইউ? শেখরদের ব্যাচ? তুমি ভালো গান গাইতে পারো। রাইট?”
স্যারের নাম মনে নেই কিন্তু যতোটা মনে আছে তা দেখেও মীরা বলতে বাধ্য এই লোকের স্মৃতিশক্তি প্রখরের চেয়েও প্রখর। মীরা উত্তর দেয়,
“জি স্যার। আমি মীরা তারান্নুম।”
স্যার হাসলেন। অতঃপর বললেন,
“কী করছ এখন?”
“ইন্ডিয়াতে একটা বায়োটেক ল্যাবে আছি।”
“অনেকদিন পর ভার্সিটিতে আসলে তাই না? তোমাকে দেখেছিলাম, করিডোরে লুকিং গ্লাস দিয়ে ক্লাসরুমের ভেতরে উুঁকি দিচ্ছিলে।”
স্যারের কথা শুনে দাঁত দিয়ে জিভ কা*টে মীরা। সে যে এই লোকের ক্লাসেও লুকিং গ্লাসে নজর দিয়েছিল! মীরা লাজুক হেসে বলে,
“স্যার আসলে এখানে ক্লাস করা, আপনাদের লেকচার সব মিস করছিলাম। এটা তো ট্রু যে, স্টুডেন্টরা তাদের স্টুডেন্ট লাইফ তখনই মিস করে যখন তারা স্টুডেন্ট লাইফ ছেড়ে বেরিয়ে আসে।”
“ইয়াহ। ইভেন, মি অলসো। যখন আমেরিকায় যাই তখন ইউনিভার্সিটির এড়িয়াতেই ম্যাক্সিমাম থাকা হয়। তা তুমি কি দেশে জবের জন্য ট্রাই করছ?”
“না স্যার। এখনও না। ট্রাই করব। ভালো জব পেলে ভেবে দেখব।”
“অকেই। বেস্ট অফ লাক। ভালো থেকো। ”
“স্যার আপনিও ভালো থাকবেন। দোয়া করবেন স্যার। আসি।”
স্যার হালকা হেসে চলে যান। মীরা আবারও লিফ্টের বোতাম প্রেস করে। তারপর লিফ্ট আসলে গ্রাউন্ডে নেমে আসে। কিছুক্ষণ সেখানে বসে থাকে। না চাইতেও চেয়ারম্যান স্যারের কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মনের মধ্যে তিক্ত স্বাদ অনুভব করছে। তখনি ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে মা কল করেছে। ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই ফোনের অপর পাশ থেকে মীরার মা মিসেস মলি জাহান বলে ওঠেন,
“কোথায় তুই? কখন আসবি? ভুলে গেছিস? আজকে বিকেলে যে তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। এইবার কিন্তু আমি তোর কোন টালবাহানা শুনব না। তোর বাবাকে আর রাগাস না।”
মায়ের কথা শুনে মীরা পিলারের সাথে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। ক্লান্ত স্বরে বলে,
“আসছি মা।”
মীরার মা আরো কিছু বলতো, তার আগেই মীরা ফোন কে*টে উঠে দাঁড়ায়। এরপর ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে সিএনজি ডেকে উঠে বসে। এই এক সপ্তাহের মধ্যে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সে পাত্রপক্ষের সামনে বসবে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে এত তাড়া তার বাবা-মায়ের! অথচ মীরার পিঠাপিঠি কোন বোনও নেই। সিএনজি চলতে লাগলো তার আপন গতিতে। মীরা ক্লান্ত হয়ে বসে পেছনে ছুটে চলা রাস্তা দেখছে। বাহিরে সূর্যের তেজ প্রখর। মনে হচ্ছে সব ঝলসে যাবে। যা তার হৃদয়ের দ*গ্ধতাকে আরও কাঁচা করে তুলছে।
বাড়িতে ফিরে মায়ের বাণী শুনতে শুনতে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে শাওয়ার নিতে চলে যায়। মিসেস মলি জাহান একটু রুষ্ট হলেন। তিনিও নিজের ঘরে চলে গেলেন। শাওয়ারের নিচে বসে মীরা ভাবতে থাকে তার অতীত জীবন….
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#সূচনা_পর্ব
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠকমহল। কেমন আছেন সবাই। প্রায় অনেকদিন পর নতুন গল্প দিচ্ছি। সবার রেসপন্স কামনা করছি।
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/