‘মনসায়রী’
৮.
বিরক্তিতে মুখ তেঁতো হয়ে এলো দুপুরের। ছেলে মেয়ে গুলোর দৈহিক গড়ন দেখে দুপুরের চেয়ে বড় মনে হলেও, দুপুর দুই একজনের হাতে অনার্সের বই দেখেই বুঝে গেলো এরা সবাই তার জুনিয়র। মাঝারি উচ্চতার ছেলেটা এখনো দুপুরের সামনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর একটু পরপরই বলছে গান গাইতে। যেনো দুপুর তার নিজের বানানো রোবট। যাকে সে যা ইচ্ছে করতে বলবে, আর রোবোটও বিনাবাক্য ব্যয়ে কাজ শুরু করবে।
বয়সে বড় হলেও কোনো দিক থেকেই নিজেকে বড় না লাগায় অস্বস্তি নিয়ে গাট হয়ে মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে রইলো দুপুর। একবার ভাবলো, চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। সেইমতেই ডান দিকে ফিরে ওড়না খামচে চলে যাচ্ছিলো দুপুর। পথ আঁটকে আবারো দাঁড়ালো ফাহাদ নামের ছেলেটা। পেছনে নিপা সহ সব বাকি তিনজনও হাসছে। শুধু একটা চশমা পড়া মেয়ে ওদের থামিয়ে বলল এসব না করতে। কিন্তু, ওরা কেউই ওকে পাত্তা দিলো না। দুপুর এবার প্রচুর বিরক্ত হলো সঙ্গে রেগেও গেলো।
মুখ উঁচু করে বলল,
‘এসব কী ধরনের অসভ্যতামো! সরে দাঁড়ান বলছি। ‘
ফাহাদের পাশে নিপা এসে বলল,
‘তুমি তো দেখছি ভারী বেয়াদব। এতক্ষণ ধরে আমরা ভালো মতো বলছি গান গাইতে, গাইছো না কেন?’
দুপুর ভ্রু কুচকে বলল,
‘কেউ গান গাইতে না পারলে, সে কী জোর করে গাওয়া শুরু করবে এখন?’
‘এই মেয়ে, আবার মুখে মুখে তর্ক করো। এতো সাহস কী করে হয়!’
‘তর্ক করছিনা। ভালো মতোই বলছি। আমাকে যেতে না দিলে খুব খারাপ হবে এখন। ‘
চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে দুপুরের। সে-ও তো এখানেরই স্টুডেন্ট।কই কখনো তো কোনো জুনিয়রকে এভাবে দাঁড় করিয়ে র্যাগ করেনি। ভার্সিটির এসব নিয়ম খুব বিরক্ত লাগতো তখনও। আকাশ বা ফ্রেন্ডদের মধ্যে কেউ করলে ওদেরকেও মানা করে দিতো। আর আজ কিনা নিজের চেয়ে জুনিয়রের কাছে লজ্জায় পড়তে হচ্ছে। তারমানে এরা সব ফ্রেশারদের সাথেই এমন ব্যবহার করে। একটা উচিত শিক্ষা দেয়া দরকার এদেরকে। এখন এখান থেকে গেলে পরে একটা ব্যবস্থা নিবে। কঠিন চোখে তাকিয়ে কয়েকটা বকা দেয়ার প্রস্তুতি নিলো। চেঁচিয়ে উঠার আগেই নিপা উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘দাঁড়াও এবার তোমার বিচার করছি। এই সায়ু এদিকে আয়!’
সবার দৃষ্টিতেই ঝলক দেখা গেলো। কোঁকড়ানো চুলের ফর্মাল ড্রেসআপে চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা পড়া একটা ছেলে বই হাতে এদিকেই এগিয়ে আসছে ৷ নজর বইয়ের পাতায়। গোল হয়ে সবার দাঁড়িয়ে থাকার জায়গাটায় এসে বই বন্ধ করে পকেট থেকে একটা চাবির রিং নিয়ে অনামিকা আঙুলে ঝুলিয়ে ভ্রু কুঞ্চন করে প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে তাকালো। নিপা যেনো এই ইশারার অপেক্ষাতেই ছিলো। ছেলেটার তাকানো মাত্রই নিপা গড়গড় করে বলল,
‘নতুন মেয়ে সায়ু,আমরা সবাই মিলে মেয়েটাকে কাজ দিলাম। আর মেয়েটা আমাদের সাথে তর্ক করে বলে পারবেনা। ‘
ছেলেটা চোখ তুলে চশমার ভেতর থেকে দুপুরের দিকে তাকাতেই বিস্মিত হলো দুপুর। এই তো সেই ছেলেটা যে গতকাল সবার সামনে হেনস্তা করলো। রাগে গা রি রি করছে। হাবভাবে বোঝা যায় ইনিই এই গ্যাঙ লিডার। যেমন লিডার তেমন তার সদস্য।
ফাতরামি করতেই এরা এখানে আসে। কিন্তু, অবাক হলো এই ভেবে গতকালকে যেমন পোশাকে ছিলো। তার ছিটেফোঁটাও এখন অবশিষ্ট নেই। কালকের ইনফরমাল আর আজকের ফরমাল শার্ট-প্যান্ট সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুপুর অবাক কন্ঠে খানিকটা জোরে বলে উঠলো,
‘আপনি! না সরি তুমি! তুমি এখানেও আমার পিছে লাগতে এসেছো তাই না?’
সায়র বাইকের হেলমেট হাতে নিতে নিতে গমগমে গলায় বলল,
‘জ্বি না, আমার সময় আমি কোনো ফালতু কাজে নষ্ট করতে পছন্দ করিনা। ‘
ঠোঁট উল্টে গাল দুটো ফুলে উঠলো দুপুরের। কী বলল ছেলেটা!
সে ফালতু! মূর্তির মতো শক্ত হয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো দুপুর। সায়র বাইকের মিরর দেখে নিপার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কতবার বলবো যা ইচ্ছে হয় তখনই তা না করতে তোদের! আক্কেল বুদ্ধি নেই কোনো? ‘
তারপর দুপুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি যান। ‘
দুপুর আগ বাড়িয়ে আর কথা বলল না। ছেলেটা যে তাকে চিনেও না চেনার ভান করে আছে। মুখ কালো করে ভারী গালে সামনে চলে গেলো সে। করুক যা মন চায়। জাহা’ন্নামে যাক সায়র না ফায়র। দুপুরের কী আসে যায়! বাচ্চা ছেলের এত্ত ভাব। বিড়বিড় করে বকতে থাকলো দুপুর।
সায়রের দিকে নিপা, ফাহাদ, রোহান,ইশিকা সবাই গোলগোল চোখে তাকিয়ে আছে। রোহান হা করে বলল,
‘এইডা কী হইলো সায়ু!’
সায়র ভাবলেশহীন বাইকে হেলান দিয়ে ফোন চালাচ্ছে। যদিও তার আচার-আচরণ পৃথিবীর মানুষের সাথে মিলেনা বলে দাবি করে বন্ধুরা এমনিতেই। আগে থেকেই এলিয়েন বলে ডাকে। যেখান থেকে সবার চিন্তা শেষ হয়, সেখান থেকে সায়রের শুরু হয়। রাগারাগি চেঁচামেচি করা সায়রের রক্তে নেই। সারা বছর যেখানে নাক-মুখ ডুবিয়ে পড়াশোনা করেও ওরা সবাই এভারেজ নম্বর পায়। সেখানে পরীক্ষার আগের রাতে হেডফোন লাগিয়ে গুণগুণ করে বেশ ভালো রেজাল্ট করে ফেলে। তা নিয়ে বন্ধুদের মাঝেও কৌতূহলের উদ্রেক হয়। এই যে এখন যে বইটা নিয়ে আসলো। এটাও পাঠ্যবই ছিলো না। সাইন্স ফিকশন ছিলো ওটা।
সাইন্স ফিকশনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ সায়রের। জাফর ইকবাল স্যারের সবগুলো সাইন্স ফিকশনই সায়রের লাইন বাই লাইন মুখস্থ। রোহান আবারও সায়রের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘নিউটনের নাতি, এখন কী চরিত্রে অভিনয় করতাসস? তোর তো আবার একেক সময় একেক রূপ। বড়লোক বাপের ইনোসেন্ট পোলা? মাইয়াডার সামনে ভালা সাজলি? ‘
সায়র বিরক্ত হয়ে রোহানের হাত সরিয়ে বলল,
‘মুখ খারাপ করিস না। ‘
‘তুই এতো রাগ করতাসস ক্যান? কী করসি আমরা? ‘
নিপা তেড়ে এসে কোমরে হাত রেখে বলল,
‘আসলেই, এই সায়ু মেয়েটাকে যেতে বললি কেন? ‘
সায়রের ভাবলেশহীন উত্তর,
‘কারণ, তিনি আমাদের সিনিয়র। ‘
ভূমিকম্প হলো যেনো। নিপা কোমর থেকে হাত ফেলে মুখে চেপে আতঙ্কিত হয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠলো। ফাহাদ আর রোহান ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। ইশিকা হো হো করে হেঁসে উঠলো,
‘বেশ হয়েছে। এবার তোরা বুঝবি। আমার কথা না শোনার ফল। ‘
বলে আরেক দফা হাসিঠাট্টায় মেতে উঠলো। ইশিকাকে রোজকার মতো মাথায় ঠাস করে বাড়ি মেরে নিপা ধমক দিয়ে বলল,
‘চুপ থাক তুই! তখন বললি না কেনো ঐ মেয়ে মানে আপুটা সিনিয়র! ‘
ইশিকা বোকাসোকা মেয়ে। সহজসরলও বলা চলে। কেউ এসে গুলি মেরে দিয়ে গেলেও ইশিকা হো হো করে হেঁসে বলবে,’ওওহ ইটস ওকে’। এজন্য নিপার হাতের কেলানি খেয়েও খিলখিল করে হাসছে সে। হাসতে হাসতেই বলল,
‘আমি কী জানতাম নাকি!’
ফাহাদের এতক্ষণের সাহসী মুখটা চুপসে গেলো। আমতা আমতা করে বলল,
‘এবার কী হবে! মেয়েটার চেহারা দেখে তো বুঝতেই পারিনি আমাদের বড় হতে পারে। ‘
সায়র কাটখোট্টা কন্ঠে বলল,
‘কী আর হবে, একটু পরই হয়তো তার সাথে সিনিয়র ভাইরা আসবে। আর তোদের নাকমুখ ফাটিয়ে দিয়ে যাবে। ‘
এহেন কথায় আহত হয়ে তাকালো সবাই। নিপা একটু নরম কন্ঠে বলল,
‘প্লিজ সায়ু, কিছু কর না! ‘
হাতঘড়ি দেখতে দেখতে সায়র বাইকে উঠে বসলো। এখন তার যেতে হবে। বাইক চালু করে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘তার সাথে দেখা হলে হাত পায়ে ধরে সরি বলে নিবি, আর কী!’
সবার চোখেমুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো। যাকে জুনিয়র ভেবে র্যাগ দিলো। কে জানতো, তারই কাছে মাথা নুইয়ে ক্ষমা চাইতে হবে! দুনিয়া বড়ই আজব জায়গা। কখন কী ঘটে বলা যায়না।
–
ক্লাসে লেট করে আসায় সবার পেছনের বেঞ্চে গিয়ে গুটিসুটি হয়ে বসলো দুপুর। চোখ মুখের কালো ভাব আরো খানিকটা বেড়েছে। ফজিলাতুন্নেছা ম্যাডাম কয়েকটা কটুবাক্যে খোঁচা মেরে দুপুরের অর্ধকালো মন খারাপের ডিব্বা পূরণ করলেন। দাঁতে দাঁত চেপে সেটাও সহ্য করে পেছনের বেঞ্চে বসে যখন দেখলো পাশের সিটেই বসে আছে চিরশত্রু মারুফ। আসলে, মারুফের সাথে কোনো শত্রুতা নেই। শত্রু হলো মারুফের মুখটা। যা সবসময়ই সিগারেটের গন্ধে ভরপুর থাকে। যা বাকি ছিলো এবার সেটাও ষোলোকলা পূর্ণ হলো। ঠাস করে বসতেই মারুফ দাঁত কেলিয়ে হেসে হেলো বলল। জোরপূর্বক হেঁসে খাতাপত্র খুলল দুপুর। প্রথম ক্লাসের প্রথম দিনটাই বাজে কাটলো। কে জানে পরের দিনগুলোর কী হয়। সামনের দিক থেকে কাজল আর মিহা ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো, লেট হওয়ার কারণ কী। কিন্তু তেঁতো মুখে কোনো কথাই বলতে হচ্ছে করলো না দুপুরের। সারা ক্লাস মনোযোগ দিতে না পেরে শেষমেষ জানালার বাহিরে শিমুল গাছটার মগডালে তাকিয়ে রইলো। গালে হাত দিয়ে আনমনে ভাবলো,
‘ইশ! কেউ যদি এই আগুন ধরানো সৌন্দর্যের শিমুল ফুলটা এনে খোঁপায় বেঁধে দিতো!’
জানালার ওপার থেকে কেউ তা দেখে চমৎকার হাসলো। তারপরই ছুটে চললো কারো মনোপ্রার্থনা পূরণের উদ্দেশ্যে..
চলবে-
লেখায় -নাঈমা হোসেন রোদসী।
(গতকাল গ্রাম থেকে ব্যস্ত যানজট পেরিয়ে ঢাকায় আসায় আর এনার্জি ছিলো না লেখার। আজকে এতটুকুই থাক। কালকে গল্প আসবে।)