মনসায়রী” ৩০.

“মনসায়রী”

৩০.
খাঁটি প্রেমিকরা যেমন প্রেমিকার জন্য ভীষণ দায়িত্ববান, কেয়ারিং হয় তেমনই কিছু ক্ষেত্রে অধৈর্য। প্রেমিকদের চোখে প্রেমিকার চোখের লেপ্টানো কাজল, কেঁপে ওঠা তিরতির করা ওষ্ঠাধর, ভয়ে কুঁচকে থাকা মসৃণ ললাট সবটাই বড্ড প্রিয়। সায়র শুকনো ঢোক গিললো। বুকের একটা কোণায় সত্যিই আজ উপলব্ধি হচ্ছে, প্রেমিকাকে এতো সুন্দর হতে নেই। এতে অঘটন ঘটার সম্ভবনা বাড়ে। সম্ভবনা আরো বেশি থাকে যখন, প্রেমটা হয় একতরফা। এই যেমন এখন সায়রের লাগছে। দুপুর আঁতকে উঠলো সায়রের আবদার শুনে৷ এতো সুন্দর মিষ্টি করে যে কেউ এতো অসভ্য কথাবার্তা বলতে পারে তা এই প্রথম জানলো সে। দুরুদুরু বুকে একরাশ ভয় চোখে তাকিয়ে আছে দুপুর। গাড়িতে দুপুর আর সায়র ছাড়া কেউ নেই৷ সায়র চাইলে শুধু চুমু নয়, আরো অনেক অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। তাহলে, অনুমতি চাইলো কেনো? এখন কী তাঁর উচিত জোরে একটা কষিয়ে থাপ্পড় মেরে দেয়া সায়রের ঐ গালে। নাকি ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করা! কোনটা করা উচিত হবে!

দুপুরকে আর কিছু ভাবতে হলো না। আচমকা সায়র দুপুরের কাছ থেকে দূরে সরে গেলো। চোখ বন্ধ করে বিরবির করে কী যেনো বলল। দুপুরের সাইডের দরজার লকটা খুলে গম্ভীর গলায় বলল,

‘দরজা খোলা আছে, বেরিয়ে যান। ‘

দুপুর হঠাৎই বেশ অপমানিত বোধ করলো। তিক্ততায় ভরে উঠলো অন্তকরণ। অনুভব করলো, সায়র যখন অত্যন্ত কাছে এসে অপলক তাকিয়েছিলো তখনও খারাপ লাগেনি। এমন কী হলো, যে তাঁকে এমন করে বের হতে বলছে। যেনো, দুপুর জোর করে তাঁর দামী গাড়িতে উঠেছিলো। আত্মসম্মানে লাগলো ব্যাপারটা। এতক্ষণ ভয়ে চুপ থাকলেও, এখন সেখানে গম্ভীরতা জায়গা করে নিলো। টু শব্দটিও না করে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো দুপুর। পেছনে আর কিছুতেই ফিরে তাকালো না। পেছনে তাকালো হয়তো জানতো সায়র তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে অপলক। পেছনের সিট থেকে নিজের ব্যাগটা বের করে নিঃশব্দে প্রস্থান করলো দুপুর। সায়র দুপুরের যাওয়ার পর গাড়ি স্টার্ট করতে করতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,

‘আমি তো আপনার প্রেমিক নই, আমি হলাম অপ্রেমিক। আর অপ্রেমিকদের সামনে এতো অসহ্য সুন্দর প্রেমিকার একান্ত উপস্থিতি অঘটনের আশঙ্কা বাড়ায়! দুঃখীত আমি।’


কয়েক দিন যাবৎ তাপদাহ চলছে। গরমে কাহিল হয়ে ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ঢুকলো সায়র। গ্যারাজে গাড়ি পার্ক করে ট্রলিটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। পেছনে থেকে বাড়ির দারোয়ান মজনু ট্রলিটা নিয়ে বলল,

‘ভাইজান, আমারে দেন। আপনারে এমনেই কেলান্ত হইয়া আসেন। ‘

সায়র মজনুর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘সমস্যা নেই মজনু ভাই, আমি পারবো। তুমি বলো, তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছে? নতুন বিয়ে করলে শুনলাম। ‘

মজনু একটু লজ্জা পেয়ে হেসে বলল,

‘বাড়ির সবাই ভালা আসে। নতুন বউ গেরামে মা’র কাসে থাকে। আমার মা তো বাপ মরার পর একাই । এখন একজন সঙ্গী পাইয়া অনেক খুশি৷ ‘

সায়র স্মিত হাসলো। মজনু সায়রের কথা শুনলো না। একাই ট্রলিটা টেনে উঠালো। সায়র বাড়ির ভেতর ঢোকার আগে পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিলো। বাসার লক আগে থেকেই খোলা ছিলো। একটু অবাকই হলো। দরজা সবসময় লক করা থাকে। হলরুমে কাউকে না দেখতে পেয়ে একবার ভাবলো, বাসার সবাই কী কোথাও গেছে নাকি! আবার মনে হলো, সবাই কোথাও গেলে মজনু নিশ্চয়ই তাঁকে জানাতো। ব্যাগটা ওখানে রেখে, দরজাটা আঁটকে দিলো। খেয়াল করলো জোবাইদার রুম থেকে হালকা কথার শব্দ ভেসে আসছে। দ্রুত পায়ে সেখানেই ছুটে গেলো। রুমে প্রবেশ করে অবাক হলো। জোবাইদা বিছানায় শুয়ে আছেন। পাশে পলাশ দেওয়ান দাঁড়িয়ে। সায়ন্তী মায়ের পাশে বসে কী যেনো বলছে। সায়র একছুটে জোবাইদার কাছে গেলো। জোবাইদা ওকে দেখে দূর্বল হেসে বললেন,

‘এই দেখ সায়ন্তী, আমার ছেলে এসে গেছে। এবার সুস্থ হয়ে উঠবো আমি জলদি। ‘

সায়রের মুখ অসহায় হয়ে আসলো। সায়র ছোটো থেকেই মায়ের নেওটা। আর সায়ন্তী বাবার। জোবাইদা যেমন ছেলের এক কাশিতে কেঁদে ফেলেন, তেমন সায়রও মাকে অসুস্থ দেখলে অস্থির হয়ে ওঠে। যখন সায়রের বয়স মাত্র চার বছর। তখনই সায়রের আপন মা শেলী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শেলীকে হারিয়ে পলাশ দেওয়ান একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। সে সময় পলাশ দেওয়ানের চাচাতো বোন জোবাইদা এগিয়ে আসেন ছোট্ট সায়রকে দেখাশোনার জন্য। কেউ যদিও জানতো না, জোবাইদার সঙ্গে একসময় পলাশ দেওয়ানের প্রণয়ের সম্পর্ক ছিলো। বোকা বোকা কথা বলা, টকটকে লাল লিপস্টিক দিয়ে টইটই করে ঘুরে বেরানো মেয়েটা তাঁর মনে জায়গা করলেও, তাঁর মায়ের মনে করতে পারেনি। বাবা মারা যাওয়ায়, মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে তাঁকে কষ্ট দিতে কোনো ভাবেই পেরে উঠছিলেন না, এজন্যই জোবাইদাকে ছেড়ে মায়ের পছন্দে গ্রামের মেয়ে শেলীকে বিয়ে করেছিলেন। তখন জোবাইদার বয়স ছিলো আঠারো বছর। পাঁচ বছর পর পলাশ দেওয়ানের এই অসহায় অবস্থার কথা শুনে ছুটে এসেছিলেন। তখনও পলাশকে ভুলতে পারেননি তিনি, তাই বিয়েও করেননি। এরপর সায়রের জন্যই জোবাইদাকে বিয়ে করেন পলাশ। পুরোনো প্রেম, যে কভু এভাবেও ফিরে আসতে পারে তিনি জানতেন না। তিন চার পর সায়ন্তীর জন্ম হয়। অনেকেরই ধারণা ছিলো, জোবাইদার সন্তান হলে সায়রকে আর পছন্দ করবেনা। অথচ, সায়রকে তিনি আগের থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়েছিলেন।

সায়রের মাথা নুয়ানো। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করার শিক্ষাটা সায়র নিজের মায়ের কাছে থেকে পেয়েছে। জোবাইদা এমন একজন মানুষ যাকে ভালো না বেসে থাকা যায়না। সায়র জানে, জোবাইদা তাঁর আপন মা নন৷ তবুও, প্রচন্ড ভালোবাসে সে। জোবাইদার মাতৃস্নেহ না পেলে সায়র হয়তো একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারতো না। যদি জোবাইদা তাঁর সৎ মা না হয়ে, অন্য কেউ হতো তাহলে সায়র হয়তো একজন বেপরোয়া মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতো। জোবাইদা ছিলো বলেই কখনো মায়ের অভাব বোধ হয়নি।

জোবাইদা হাসছেন ছেলের অসহায় মুখ দেখে। সায়র বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘আম্মুর এই অবস্থা হলো কী করে বাবা?’

পলাশ দেওয়ান খানিকটা রাগী কন্ঠে বললেন,

‘তোমার মায়ের শখ , জিরো ফিগার বানাবেন। কিটো ডায়েট করে একেবারে যা তা অবস্থা। সেই কবে থেকে বলছি, এসব ছাড়ো তোমার বয়স এখন এসবের নয়। শুনলোই না, কিছুক্ষণ আগে প্রেশার লো হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন মহারাণী। ‘

জোবাইদা নাক মুখ ফুলিয়ে বলে উঠলেন,

‘ওগো তুমি আমাকে কী বললে! আমার বয়স নেই এসব করার। আমাকে তুমি বুড়ো বললে! ‘

পলাশ দেওয়ান কপাল চাপড়ে বললেন,

‘সবই আমার কপাল!’

সায়র জোবাইদার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘আম্মু, তোমার এসব করার দরকার নেই তো। তুমি এমনিতেই সেরা সুন্দরী। এসব ডায়েট ফায়েট ছাড়ো। তোমাকে গুলুমুলু দেখতে বেশি ভালো লাগে। ‘

জোবাইদা ঘুমিয়ে পড়লেন মেডিসিনের সাইড ইফেক্টে। সায়র মায়ের পাশে বসে মেডিসিন গুলো চেক করছে। সায়ন্তীর পেছনেই নিতু দাঁড়িয়ে আছে। সায়র নিতুকে দেখেনি এখনো। অথচ, সারাটাক্ষণ নিতু মুগ্ধ চোখে সায়রের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এই যে ক্লান্ত চেহারা, উষ্কখুষ্ক চুল এমনকি মায়ের অসুস্থতায় মলিন হওয়া মুখ সবটাতেই দারুণ মুগ্ধতা কাজ করে নিতুর। বলতে নেই, নিতুর মন চাইছে সায়রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলে উঠতে, আপনি কোথায় ছিলেন এতদিন! জানেন, রোজ একবার আমি আপনার খোঁজে এই বাড়ি এসেছি। আপনার ঘরে গিয়ে বিছানাটা ছুঁয়ে দিয়েছি বহুবার।

একধ্যানে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলো নিতু ৷ সায়র মায়ের পাশ থেকে উঠে সায়ন্তীর সাথে কথা বললো। অনেকদিন বোনের সাথে কথা হয়নি। পাশে নিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্মিত হেসে বলল,

‘ভালো আছো নিতু?’

নিতু মনে মনে আপ্লূত হলো। সায়র কী সুন্দর করে তার নামটা নিলো। নিজের নামটাও এখন ভীষণ ভালো লাগছে। পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে উঠেছে। এতদিনের সকল তৃষ্ণা ওই একটা ডাকেই মিটে গেছে। নিতু একগাল হেঁসে বলল,

‘হ্যা ভালো, আপনার ট্যুর কেমন ছিলো?’

ট্যুরের কথা বলতেই সায়রের মনে পড়লো দুপুরের কথা। ফেরার সময় দুপুরকে ওভাবে বেরিয়ে যেতে বলায় নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে দুপুর। সায়রেরও খারাপ লাগছিলো। কিন্তু, তখন ওইভাবে না বললে নিজেকে আঁটকে রাখা মুশকিল হয়ে যেতো। দুপুরের কথা মনে পড়তেই মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘খুব ভালো ছিলো। ‘

সায়র নিজের রুমে চলে গেলো। নিতুর ইচ্ছে করলো খুশিতে নেচে-কুঁদে বেরাতে। কী সুন্দর করে হাসলো সায়র তাঁর দিকে তাকিয়ে। তাঁর মানে সায়রও তাঁকে মনে মনে পছন্দ করে। প্রতিটা কথায় কতো সুন্দর করে উত্তর দেয়! শীঘ্রই নিজের মনের কথা জানাবে নিতু। নিশ্চয়ই সায়র তাঁর ভালোবাসা গ্রহণ করবে। আর বিনিময়ে ফিরিয়ে দেবে একবুক ভালোবাসা!

চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here