মনসায়রী” ২৮.

“মনসায়রী”

২৮.
জানালার ওপাশের আকাশে কমলা মেঘ দলবেঁধে দাঁড়িয়েছে। হলদেটে মাখনরঙা আলোয় টিমটিম করছে বাসের ভেতর। অলৌকিক সুন্দর একটা ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে দুপুরের। ঘ্রাণটা ঠিক কীসের তা ঠাওর করার মতো শারীরিক কিংবা মানসিক কোনো শক্তিই বিদ্যমান নেই। সদ্য কান্নামোছা উজ্জ্বল ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে আছে। এখন আর কান্নার দমক নেই। ক্লান্ত চোখ বুঁজে সায়েরর শক্ত বুকে মাথা রেখে হেলে বসেছে দুপুর। যাকে কিনা একপ্রকার শত্রু ভেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আসছিলো সে, আগাম ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করে যাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো, কোনো একদিন যে তার বুকেই মাথা রেখে এতো নিরাপদ অনুভব করবে তা আদৌও কী ভেবেছিলো দুপুর! ভাবেনি। সায়রের ডান হাতটা অনবরত দুপুরের মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে। ছোটো কোনো বাচ্চার আবদার পূরণ করতে না পারলে যেমন আদুরে ভঙ্গিতে মুখ করে স্বান্তনা দেয়া হয়, সায়রের মুখভঙ্গি ঠিক তেমন ৷ সায়র তো তখনো জানেনা, কান্না করা কাজল লেপ্টানো দুই আঁখি মুদে দুপুর তারই চিন্তা করছে।
কান্না করার দরুণ শরীর ক্লান্ত হয়, ক্লান্ত হয় চোখও৷ শুধু ক্লান্তি নেই অবাধ্য মনটার। নিজের অত্যন্ত প্রিয় ডায়েরিটা হারিয়ে, শোকে কাতর হওয়া মনে ডায়েরীর কোনো চিন্তা এখন আসছে না। দুপুরের ইচ্ছে করছে একবার সায়রের মুখ দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতে, আচ্ছা তুমি কী ভ্যানিলা এসেন্সের পারফিউম ইউজ করো নাকি এটা দারুচিনি এসেন্স? আচ্ছা দারুচিনি এসেন্সের পারফিউম কী আছে? ধুর, কী আবোলতাবোল চিন্তা ভাবনা। চোখ বোজা অথচ দুপুরের চোখে ঘুম নেই। ব্যাপারটা সায়র হয়তোবা জানেনা। দুপুরের যদিও লজ্জা লাগছে, তবুও লজ্জার থেকে এখন মনের শান্তি বড়। দুপুর নিজের মনের সাথে লুকোচুরি খেলছে। সে জানে আর যার সাথেই হোক নিজের মনের সাথে লুকোচুরি খেলা যায়না। নিজের মনটা তাঁকে বারবার অবাধ্য করে তুলছে ক্রমশই। যেদিন বাসে ঘুম ভেঙে সায়রকে নিজের পাশে অনুভব করেছিলো, সেদিন থেকেই একটু একটু করে সায়রের জন্য জায়গা তৈরি হচ্ছিলো। এরপর রাতের ডিনারে সায়র যখন দুপুরের মুখ মুছে দিয়েছিলো, সবার সামনেই ওর ছোটো ছোটো পছন্দেরও খেয়াল করছিলো। মিষ্টি ডেজার্ট আইটেম যে দুপুুরের পছন্দ তারও খেয়াল রাখা। আর সবচেয়ে বেশি যা বুকে এসে একটা আস্তো ভালোলাগার প্রাসাদ তৈরি করেছিলো, সেটা হচ্ছে সায়রের ফায়ারউডের সামনে হাঁটগেড়ে বসে বলা -‘আপনি আমার গ্যালাক্সি হবেন দুপুর? ‘
ভাবলেই গুজবাম্পস হয় দুপুরের। ভয়টা দুপুরের সায়রকে নিয়ে নয় মোটেও। নিজের মনে কিছু না থাকলে দশটা সায়রও কিছু করতে পারতো না দুপুরকে৷ কিন্তু যেখানে নিজের মনেই ভেজাল সেখানে তো পালানোর চেষ্টা করবেই। চোরের মনে তো পুলিশ পুলিশ হয়ই।

এড়িয়ে গিয়ে, পালিয়ে, বিরক্তি প্রকাশ করে, রাগ দেখিয়ে কোনো ভাবেই তো আর সায়র থেকে দূরে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আর সম্ভব যখন হচ্ছেই না তখন মিথ্যা ঘুমানোর নাটক করে সায়রের কাছে থেকে নিজের ভাঙাচোরা মনটাকে একটু সুস্থ করার চেষ্টা করলে আর ক্ষতি কী! মাঝে মাঝে নিজের মনটাকে সামলে রাখা অত্যন্ত দায় হয়ে পড়ে। তবে, দুপুর এটা মানতে বাধ্য, যে সায়র বয়সে তার চেয়ে ছোটো হলেও দায়িত্বজ্ঞান,মূল্যবোধ,আর নারীদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা। একটা মেয়ের চোখে সবার প্রথমে যা ধরা দেয় মুগ্ধতার পরশে, তা হলো অন্য সব মেয়ের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা। মেয়েদের প্রতি তাকানোর ধরণ ও সভ্যতা। একটা অকট সত্যি এই, যে সায়রকে যতটা না তাঁর রূপের জন্য দুপুরের ভালো লেগেছে তাঁর চেয়ে বেশি লেগেছে তাঁর চরিত্রগুণে। এই যে দুপুর সেই কখন থেকে সায়রের বুকে মাথা রেখে বসেছে। সায়র পারতো দুপুরকে খারাপ স্পর্শ করতে। তা করেনি সায়র৷ শুধু একটা হাতই আলতো করে দুপুরের মাথার উপর রেখেছে। দুপুরের মাথা ছাড়া কোনো অংশেই ইচ্ছাকৃত ভাবে স্পর্শ করেনি। সায়রের মাঝে কথা দিয়ে কথা রাখার চেষ্টা আছে প্রবল। একদিন সায়র বলেছিলোও,দুপুরের অনুমতি ব্যতিত সে স্পর্শ করবেনা। দুপুরের সুপ্ত অনুমতি আছে বলেই সায়র দুপুরের কান্না থামাতে মুখ স্পর্শ করেছে। এছাড়াও, দিনের পর দিন পৃথিলা সায়রকে বিরক্ত করেছে। সায়র চাইলেই পারতো পৃথিলার গায়ে পড়া স্বভাবের উসিলায় ফায়দা লুটে নিতে। সায়র তা করেনি৷ পৃথিলা যখনই সায়রের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে, তখন তখন সায়র নিজের দৃষ্টিকে সংযত করেছে। কিছু কিছু মানুষ থাকে, যাদের লজ্জা ব্যাক্তিত্ব একেবারে শূন্যের কোঠায়। তাদের যতো যাই বলো, এদের গায়ে লাগেনা। দুপুরের বুকে তখন তীব্র জ্বলুনি হতো, যখন পৃথিলা এসে সায়রের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতো তখন পৃথিলাকে কষে একটা থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করতো৷ নিজের মনের এহেন হিংস্র মনোভাবে নিজেই চমকে উঠতো দুপুর। পৃথিলার কারণেই একটু একটু করে মনের আসল আয়না পরিষ্কার হয়ে প্রকট হচ্ছিলো। ধীরে ধীরে নিজের মনে সায়রের আসল জায়গাটা ধরতে পারছিলো সে। নিজের মনের কাছে সে অনেক আগেই ধরা পড়ে গেছে। প্রথম প্রেম না পাওয়ার ব্যর্থতায় হৃদয়ে যে ভাঙন লেগেছিলো, সেই ভাঙনে সায়র যেনো একটু একটু করে নিজেই আধিপত্য স্থাপন করেছে। দুপুরের শত দূর্ব্যবহারও হাসিমুখে সয়ে নিয়েছে। তারই ফলস্বরূপ, দুপুরের মনের এই অবাধ্য অনুভূতির বিস্তার।

আচমকা একটা ঝাঁকুনি ধরানো বজ্রপাতে কেঁপে উঠলো ধরনী। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে দুই পাশের রাস্তার শুষ্ক গাছপালা। রাস্তার পাশ দিয়ে কয়েকটা বাচ্চা হৈ-হুল্লোড় করতে করতে বৃষ্টিতে উল্লাস করছে ৷ বজ্রপাতের আওয়াজে চমকে উঠলো দুপুর। অজান্তেই সোজা হয়ে উঠে বসলো। জানালার পাশে বসায় বৃষ্টির ছিটা এসে গায়ে লাগছে। উঠে বসলেও শরীর যথেষ্ট দূর্বল। কাঁপা হাতে জানালার কাঁচ বন্ধ করার চেষ্টা করলো। পারলো না।
কাঁচটা শক্ত করে লাগানো৷ সায়র দুপুরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

‘আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। ‘

দুপুর শান্ত মেয়ের মতো মাথা নাড়লো। সায়র এগিয়ে এসে জানালার কাঁচটা বন্ধ করে দিলো। দুপুর এতক্ষণে খেয়াল করলো, বাসে তারা দুজন ছাড়াও আরো অনেক মানুষ আছে। কান্নার পর এতোকিছু খেয়াল হয়নি৷ এতোটা সময় একটা ছেলের সঙ্গে লেপ্টে ছিলো, ছি ছি! লজ্জায় কান গরম আসছে দুপুরের। এজন্যই মনকে বেঁধে রাখে সে। একবার আস্কারা পেলে ছুটতে থাকে বহুদূর।

সায়র দুপুরের রক্তিম চোখমুখ দেখে বলল,
‘আপনি কী লজ্জা পাচ্ছেন দুপুর? ‘

দুপুর হকচকিয়ে না না বলে মাথা নাড়লো। এখন, কী সে বলবে, হ্যা হ্যা আমি লজ্জা পাচ্ছি, দেখো আমি লজ্জা পাচ্ছি! লজ্জা পেলে কী কেউ বলে সে লজ্জা পাচ্ছে! সায়র দুপুরের বিব্রত মুখ দেখে সামান্য হাসলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে টাইম দেখতে দেখতে বলল,

‘আপনার শরীর কেমন এখন? ‘

দুপুর ধীম স্বরে বলল,

‘ভালো। ‘

সায়র দুপুরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো ওর মনটা খারাপ। তবে, তা ডায়েরির জন্য নয় এটা বুঝতে পারলো। দুপুরের মন অন্য দিকে নেওয়ার জন্য কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

‘দুপুর, একটা কথা বলবো আপনি রাগ করবেন না তো?’

দুপুর ভ্রু কুচকে বলল,

‘কী কথা?’

‘আপনার কানের পিঠে যে সুপ্ত একটা তিল আছে তা আমি দেখে ফেলেছি! তিলটা আমার ভালো লেগেছে। দুঃখীত। ‘

লজ্জায় হতভম্বতায় নির্বাক হয়ে মাথা নত করে রইলো দুপুর। এই একটা কথাই ছিলো বলার মতো৷ আরো কথাই তো বলা যেতো! সে দুঃখীত কীসের জন্য! তিলটা দেখার জন্য নাকি অসভ্য কথাবার্তা বলার জন্য। ছেলেটা যে এতো দুষ্ট তা তো জানা ছিলো না! পুরো পথটা লজ্জায় লাল হয়ে রইলো দুপুর। মুখ খুলে স্বাভাবিক রাগও দেখাতে পারলো না৷

বাস এসে ঢাকায় পৌঁছাতেই দুপুরের মনটা আশ্চর্যজনকভাবে আবারো খারাপ হয়ে গেলো। সায়র বাস থেকে ব্যাগপত্র নামাচ্ছিলো৷ সেদিকে খানিকক্ষণ মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকলো সে৷ মুখ ফুটে সে কীভাবে বলবে৷ ডায়েরি হারানোর থেকেও বেশি খারাপ লাগছে যে ওই শীতল চোখদুটো এখন থেকে আর রোজ সে দেখতে পারবেনা। ওই মাতাল করা নিঃশব্দের হাসি আর রোজ শোনা হবেনা। সুন্দর সময়গুলো এতো তাড়াতাড়ি যায় কেনো! ডায়েরি হারিয়ে,হঠাৎ প্রিয় হয়ে ওঠা মানুষটাকে দেখতে না পাওয়ার অঘোষিত আন্দোলনে রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুপুর। সায়র বুঝি দুপুরের মন পড়ে ফেলে চট করে৷ কিছু মানুষ থাকে, এদের সবকিছু খুলে ভেঙে বলতে হয়না৷ এরা জীবনে এসে জীয়নকাঠির পরশে রূপকথার জগতে নিয়ে যায়। কোনো দুঃখের ছায়া নামতে দেয়না। সায়র বুঝি দুপুরের সেই অতি আকাঙ্ক্ষার জিয়নকাঠি।

সবেমাত্র বৃষ্টি থেমেছে। বৃষ্টি থামায় ঠান্ডা বাতাস বইছে। রাস্তা ভেজা৷ সায়র দুপুরের সেই মন খারাপকে নিমিষেই শেষ করে দিতে কোথা থেকে উড়ে এলো। হাতে দুই কাপ রং চা। ওয়েদারের সঙ্গে পারফেক্ট। দুপুরের দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে আরেকটা নিজের কাছে রেখে চুমুক দিতে দিতে বলল,

‘আচ্ছা দুপুর, আপনি কখনো কল্পনা করেন, যদি আপনি মানুষ না হতেন তাহলে এর পরিবর্তে কী হয়ে জন্ম নিতে চাইতেন?’

দুপুর মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো বোকাভঙ্গিতে। এরকম ভাবনা তো কখনো আসেনি তাঁর। কিছুক্ষণ পর বলে উঠলো,

‘সেরকম করে তো কখনো ভাবিনি, তবে হলে বৃষ্টিই হতাম। মন খারাপ হলে আর বুকে চেপে রাখতে হতোনা। অশ্রু জল দিয়ে পৃথিবীটাকে বিশুদ্ধ করে দিতাম। ‘

সায়র হাসছে দুপুরের কথা শুনে৷ দুপুর নিজের চায়ে চুমুক দেয়ার বলল,

‘তুমি কী হতে, যদি সুযোগ পেতে?’

সায়র দুপুরের দিকে তাকিয়ে কী যেনো ভাবলো। যেনো দুপুরের মুখে কিছু লেখা আছে। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল

‘সত্যি করে বলবো?’

দুপুর বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘তো কী মিথ্যা বলবে?’

সায়র আবারো কিঞ্চিৎ হেঁসে বলল,

‘পরেরবার আমি ফুল হয়ে জন্ম নেবো দুপুর। আপনি আমাকে আপনার কানের পিঠে গুঁজে রাখবেন। আমি লেপ্টে রইবো আপনার সঙ্গে। ‘

চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here