“মনসায়রী” পর্ব-৩৭

“মনসায়রী”
পর্ব-৩৭

বাহিরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসময় চা খেতে খেতে বৃষ্টি দেখলে মন্দ হয়না। সাথে একজন চা খাওয়ার সঙ্গী। ঠান্ডা পরিবেশ। কিন্তু দরদরিয়ে ঘেমে যাচ্ছে দুপুর। গায়ে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। চুলগুলো খোঁপা করে বাঁধা। শিহাব বারান্দায় বসে আছে হুইলচেয়ারে। পাশের চেয়ারটায় দুপুর। দুপুরের বসতে ইচ্ছে করছেনা। সে বুঝতে পারছেনা কেনো শিহাব তাকে গত বিশ মিনিট ধরে বসিয়ে রেখেছে। কিছু বলছেওনা। অধৈর্য হয়ে গেছে দুপুর ভেতরে ভেতরে। শিহাব গ্রিলের ফাঁক দিয়ে গাড়ির চলাচল দেখছে। স্পষ্ট বোঝা যায় সে ওটা দেখলেও মনোযোগ অন্য কোথাও। শিহাবের বিয়ের পর দুপুর কখনো শিহাবের সাথে একা বসেনি। একই বাসায় থেকেও দু’টো অপরিচিত মানুষের মতো থেকেছে। অথচ একসময় এরাই সবচেয়ে পরিচিত ছিলো। সময়ের ব্যবধান সবকিছু পাল্টে দেয়। দুপুর ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। সে চায় শিহাবও এগিয়ে যাক। সায়রকে সে ভালোবাসে কিনা বলতে পারেনা। তবে চায়, বিয়ের পর সায়রকে ভালোবাসতে। দুপুর এতোদিন বিয়ে করতে রাজি হয়নি, কখনো মনে হয়নি যে নতুন করে কাউকে ভালোবাসতে পারবে। কিন্তু সায়র জীবনে আসার পর থেকে কী যেনো বারবার বুকের মধ্যে ধাক্কা খায়। মনে হয় এমন কারো অপেক্ষাতেই ছিলো হৃদয়। সায়রের ঐ ভালোবাসা ভরা চোখ দুটোর দিকে তাকালে সবকিছু ভালো লাগে। শিহাব দুপুরের দিকে একবার তাকালো। কী একটা ভেবে আবার নজর সরিয়ে নিলো।

নীরবতা ভেঙে বলল,

‘তুই কী ঐ ছেলেটাকে ভালোবাসিস দুপুর?’

খানিকটা নড়েচড়ে বসলো দুপুর। এমন একটা প্রশ্ন যে শিহাব করতে পারে তা আগেই বুঝতে পারছিলো দুপুর। শিহাব কখনো দুপুরের পুরো নাম ধরে ডাকেনা। আজ ডাকছে মানে সে খুব সিরিয়াস। দুপুর মুখ নিচু করে ফেললো।

‘ভালোবাসা কী খুব সহজ জিনিস শিপুদা?’

‘ওটা আমার প্রশ্নের উত্তর না। ‘

‘তুমি সত্যি জানতে চাও? ‘

‘আমি সত্যিটাই জানতে চাই দুপুর! আমি চাইনা তুই জোরপূর্বক একটা ভালোবাসাহীন সম্পর্কে জড়িয়ে যাস। আমি তো এমন একটা বিয়ের ভুক্তভোগী! ‘

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো যেনো। যে ব্যাথাটা এতোদিন বুকে চেপে ছিলো শিহাব তা-ই যেনো বেরিয়ে আসতে চাইলো। দুপুর জানে শিহাব খুব মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আছে। এই যন্ত্রণাটা হয়তো একটু হলেও কমবে যেদিন শিহাব নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। দুপুর চায় সেই দিনটা শীঘ্রই আসুক। এজন্য হলেও বিয়েটা করবে সে। সায়র তো বলেছে, সে চিকিৎসা করাবে শিহাবকে দেশের বাহিরে। খুব আড়ালে চোখের জলটুকু মুছে নিলো দুপুর। আজ একটা মিথ্যা কথা বলবে দুপুর। এই মিথ্যাটা শিহাবকে সাহায্য করবে জীবনে এগিয়ে যেতে।

‘আমি সায়রকে ভালোবাসি। ওকে বিয়ে করতে চাই। ‘

শিহাব চমকে উঠলো। দুপুর এতো নিষ্ঠুর ভাবে কথাটা বলে ফেললো! শিহাব ভাঙা গলায় বলল,

‘তুই কী বললি দুপুর!’

দুপুর খানিকটা বিরক্তির সাথে বলল,

‘আশ্চর্য হওয়ার কী আছে শিপুদা!তুমি যদি বিয়ে করতে পারো, এক ছাদের নিচে একটা মেয়ের সাথে থাকতে পারো তো, আমি কাউকে বিয়ে করতে পারবো না! ভালোবাসতে পারবোনা! তুমি এতোদিন হয়েছে বিয়ে করেছো, তুমি কী বলতে চাও? তনয়া ভাবিকে ভালোবাসোনা? এতোদিনেও তাকে স্পর্শ করো নাই?’

শিহাব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে দুপুরের দিকে। দুপুর যেনো আর বসে থাকতে পারলো না। শিহাব কী বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা। দুপুর উঠে দাঁড়িয়েছে। শাড়ি ঠিক করার ভঙ্গিতে ব্যস্ত হয়ে বলল,

‘বাহিরে সবাই অপেক্ষা করছে। আমি আর বিলম্ব করতে চাইনা। আমার মনে হয় না তুমি এই বিয়েতে কোনো আপত্তি করবে। ‘

আর কোনো দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো দুপুর। শিহাব নিজের হাতটা বুকে চেপে ধরলো। এতো ব্যাথা আগে কখনো করেনি! দুপুর এই চিনলো তাঁকে! নিজেকে শেষ করে দিতে পারলে মনে হয় খুব ভালো হতো। কিন্তু তা করতে পারবেনা শিহাব। কষ্ট যেনো বুকটা ভেঙে আসলো শিহাবের। অস্ফুটস্বরে বললো,

‘তুই আমাকে এই চিনলি দুপুর! তোর ধারণা ভুল। তোকে ছাড়া আমি কাউকে ভালোবাসিনি, কাউকে স্পর্শ করিনি! ‘

চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here