বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২৩)

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২৩)

“এই শুনছেন?”

“হু শুনছি।”

“চলেন না।”

“কোথায়?”

“আমার শহরে।”

“কেন?”

“বৃষ্টিতে ভিজতে।”

“এখনি?”

“হু এখনি।”

“যদি বৃষ্টি থেমে যায়?”

“আমি বৃষ্টি হব তখন।”

“কেমন করে?”

“এমন করে।”

“ইসস..”

“কি হলো?”

“কিছু না।”

“আসেন না।”

“আসছি তো।”

“কোথায়?”

“এই তো।”

“দেখছি না তো!”

“হাত বাড়াও।”

“বাড়িয়েছি।”

“চোখ বন্ধ কর।”

“করেছি।”

“অনুভব করছ?”

“হুম।”

“কী?”

“আপনাকে।”

ঘুম ভেঙে গেল অভিরাজের। ছেলেটার পুরো শরীর হাল্কা সমীরণে কেমন আন্দোলিত হয়ে উঠল। সে কিছুটা ঘেমেছেও বটে। জানালা গুলো পুরোপুরি খুলে ফেলল। এখান থেকে বাগানটা খুব সুন্দর দেখা যায়। নানান রঙের ফুল বাহারি সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। বারান্দায় কিছু পাখি এসে বসেছে। অভিরাজ যেতেই উড়ে গেল। আকাশের চাঁদ যেন নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে। মেঘে ঢাকা আকাশ বলছে খানিক বাদেই বৃষ্টি হবে। এই বৃষ্টিতে কত মানুষের আলাপন তৈরি হবে। ভালোবাসায় সিক্ত হবে কত প্রহর। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। অভি’র দু চোখ কেমন জ্বলছে। খানিক আগে দেখা স্বপ্নটা যেন একদমই সত্য। উষশী তাকে নিজের কাছে ডাকছে। অভিও তাতে সাড়া দিয়েছে। শুরু হয়েছে তাদের বৃষ্টিভেজা আলাপন। মধুময় সুন্দর মুহূর্ত গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। পাঁচ বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে। উষশী এখন নিশ্চয়ই সেই কিশোরীটি নেই। মেয়েটি তো এখন অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছে। তার এখন পুরো পৃথিবীতে ডানা মেলার কথা। সে আর ভাবতে পারছে না। কিশোরী মেয়েটির যুবতী রূপ কল্পনাও করতে চাচ্ছে না। কিন্তু একটা অদৃশ্য শক্তি বার বার ভাসিয়ে নিচ্ছে।

ভোরের আলো তখনো পৃথিবীতে পৌছায় নি। অভিরাজের চোখে ঘুম নেই। সে বেরিয়ে এসে চারপাশ একবার দেখতে লাগল। গতদিন এ বাড়িতেই থেকেছে সে। ঝকঝকে তকতকে করা হয়েছে পুরো বাড়িটা। সেই প্রথম দিনের মতো লাগছে। তবে উষশী নেই এখানে। মেয়েটির অভাব বেশ ভালোই মলিন করেছে বাতাবরণ। মনে হচ্ছে আলোটাই হারিয়ে গেছে। ভোর হতেই বাড়ির কেয়ারটেকার আব্দুল্লাহ বেরিয়ে এলেন। ফুল গাছ গুলোতে আগে থেকেই পানি দেওয়া ছিল। অভি দাঁড়িয়ে পূর্ব আকাশে চোখ মেলে দিয়েছে। ভোরের সূর্য বিলাশ করছে সম্ভবত।
“বাবা,কাইল রাতে এখানেই আছিলেন?”

“জী আঙ্কেল।”

“বড়ো ভালো করছেন। কি খাইবেন কন।”

“কিছু খাব না আঙ্কেল। আজই ফিরে যাব।”

“এটা কোনো কথা। আইজ থাইকা যান।”

“দেখি।”

উষ্ণ শ্বাস ফেলল অভিরাজ। সে এখনো পূর্ব দিকে তাকিয়ে আছে। সূর্য পুরোপুরি না উঠা অবধি একই ভাবে তাকিয়ে রইল সে।

পুরনো ফটো এলবাম দেখার সময় উষশী’র বেশ কিছু ছবি পেল লাবণ্য। মেয়েটা একটু বেশিই সুন্দরী। তাকে দেখলে একদমই বিদেশীর মতো লাগে না। মনে হয় বাঙালির অন্যরূপ। সব গুলো ছবি দেখতে দেখতে একটা ছবি পেল যেখানে অভিরাজ উষশী’র কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। উষশী’র অধর জুড়ে লাজুক হাসি। অভি’র চোখে মুখে অন্য রকম সুখ। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল লাবণ্য’র বুক চিরে। একটা সময়ে মস্তিষ্কের বিরোধীতা করে উষশী’র সাথে ভয়ংকর অন্যায় করেছিল সে।

অতীত

গ্রামের বাড়িতে আসতেই একটা হৈ হুল্লোড় পড়ে গেল। এখানে অভিরাজের আরো কাজিন রয়েছে। তাদের সাথে সম্পর্ক নেহাত মন্দ নয়। রিয়াজুল সিনহার পাঁচ সন্তান। তিন মেয়ে আর দুই ছেলে। এখনো তারা যৌথ পরিবার। দুই সন্তানের মধ্যে বড়ো আবু সিনহা আর ছোট জাবেদ সিনহা। আবু সিনহার দুই সন্তানের মধ্যে জুনায়েদ বড়ো। সে এখন চাকরি সূত্রে বিদেশ রয়েছে। আর মেয়ে ইরার বয়সী। জাবেদ সিনহা’র তিন সন্তান। বড়ো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর দুই ছেলে স্কুলে পড়ছে। বয়সের ফারাক থাকলেও দুজনে একই ক্লাসে পড়ছে। জাবেদের ছোট দুই ছেলেই বেশ চঞ্চল প্রকৃতির। অভিকে পেয়েই এটা সেটা বায়না শুরু করে দিয়েছে। তাদের বায়নার শুরুতেই রয়েছে নদীর শীতল জলে সাঁতার প্রতিযোগিতা। গল্পের মাঝেই ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত দেওয়া হলো। এটা মূলত ঘোল। উষশী আগে কখনো খায় নি। তার বিশেষ পছন্দ হলো না এটা। সে একটু খেয়েই রেখে দিল। চারপাশের হৈ হুল্লোড়ে অভি আসতেই পারছে না। এদিকে সবাই গল্পে মেতে গেছে। উষশী হয়ে গেছে ভীষণ একা। তার বয়সী কেউ নেই। অনেক সময় পর উষশী’র কাছে আসতে পারল অভিরাজ। উঠানের এক কোণে বসে ছিল সে। মাথার উপর শিউলি গাছ। সেখান থেকে ফুল কুড়িয়ে কিশোরীর মুঠো ভরে দিল।
“বিরক্ত লাগছে?”

“কিছুটা।”

“ওরা সবাই মিশুক। ইরার সাথে যে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছ ওর নাম রত্না। পরিচয় হওয়ার পর দেখবে একদমই একা লাগে না।”

“হুম।”

মেয়েটির পাশে বসে রইল অভিরাজ। কিছু সময় পর লাবণ্য এল। উষশীকে সাথে নিয়ে গেল সে। অভিদের এই বাড়িটা বেশ পুরনো আমলের হলেও ভেতরে সব রকমের সুবিধাই রয়েছে। অন্দরে বাড়ির সব বউদের আড্ডা চলছে। পুরুষ মানুষ গুলো গ্রাম দর্শনে বের হয়েছে। সকলেই ব্যস্ত হয়ে আছে। লাবণ্য উষশী’র জামা কাপড় গুছিয়ে রাখল। তারপর গোসল করতে বলল। সাদা রঙের জামা পরল উষশী। সব রঙেই তাকে সুন্দর লাগে। ভেজা চুল গুলো মেলে দিয়ে বের হতেই অভিরাজের সাথে দেখা। মেয়েটির এই সৌন্দর্য অভিকে পাগল করে দিচ্ছে। সে চোখের ইশারায় কিছু বোঝাল। উষশী লজ্জায় চোখ তুলতে পারল না। তার ফর্সা ফুলকো গাল কমলা বর্ণ ধারণ করেছে। মেয়েটির সাথে ঘনিষ্ঠ হবে ওমন সময় আমিনা এলেন।
“খাবার খেতে আয় তোরা। লাবণ্য কোথায়?”

“গোসল করছে।”

উষশী অন্যদের সাথে খুব কম কথা বলে। এতদিনে আমিনার সাথে এই তার প্রথম বাক্য বিনিময়। তিনি মেয়েটিকে পূর্ণ নজরে দেখে বললেন,”এই জামাটায় তো ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়। অভি ভালো করেছিস বাবা। এই বয়সী মেয়ে হাঁটু অবধি জামা পরে ঘুরে বেড়ালে দৃষ্টিতে লাগে।”

কথা শেষে লাবণ্য’র রুমে গেলেন আমিনা। উষশী’র একটু খারাপ লেগেছে। জামার জন্য ফের কথা শুনতে হলো তাকে। অভি তার কষ্টটা বুঝতে পারল। নরম হাতে গালে স্পর্শ করে বলল,”পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে হয় উষশী। প্রথমদিকে তুমি বলেছিলে কেন নিজেকে পরিবর্তন করবে। সেই তুমিই কিন্তু পরিবর্তন হয়েছ। তোমার সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিল না। অথচ আমরা সম্পর্কে আছি। বুঝতে পারছ আমার কথা?”

কিশোরী মেয়েটি যেন সবটাই বুঝতে পারল। অভি তাকে অন্যরকম অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়েছে। মেয়েটির শুভ্র রঙা মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”চলো খাবার খেতে হবে। বিকেলে ঘুরিয়ে আনব। দেখবে ভালো লাগবে।”

এ বাড়িতে সবাই মেঝেতে বসে খাবার খায়। বাচ্চারা আলাদা বসেছে। তাদের আড্ডা চলছে। কথা বলতে বলতে সকলের সাথে উষশীর পরিচয় হলো। রত্না নামের মেয়েটি উষশী’র বিষয়ে বেশ আগ্রহ বোধ করছে।
“একজন বিদেশী এত সুন্দর বাংলায় কথা বলছে!”

“আমার মম বাংলাদেশী। পাপা ও দীর্ঘদিন এ দেশে ছিল বিধায় বাংলায় কথা বলতে পারতেন।”

“নাইস। আমার তো ভীষণ আনন্দ লাগছে।”

“ও কিন্তু খুব জেদি আর একরোখা।”

কথাটা বলেই হাসল অভিরাজ। উষশী একটু মন খারাপ করে বলল‍,”সবার সাথে জেদ করি না। প্রথম দিন আমার সাথে খুব বাজে আচরণ করেছিলেন বিধায় ওমন করেছি।”

দুজনেই এই বিষয়ে ছোট একটা তর্ক জুড়ে দিল। ওদের থামাতে লাবণ্য বলল,”এভাবে তর্ক না করে খাবার শেষ কর।”

অভিরাজ উষশীকে চোখের ইশারা করল। উষশী একটুও পাত্তা দিল না। ইরা বিষয়টা লক্ষ্য করে বলল,”তোমরা চোখে চোখে কি বললে?”

চমকে তাকাল লাবণ্য। উষশী আর অভিরাজ দুজনেই মৃদু হাসছে। তাদের এই হাসির অর্থ কি হতে পারে বেশ ভালোই জানে লাবণ্য।
“ভাইয়া কি বললে উষশীকে?”

“বললাম এমন দুষ্টু মেয়ে এ জীবনে দেখি নি।”

“উষশী তুমি কি বলেছ?”

“মিস্টার রাগির রাগ ছাড়া আর কি আছে!”

ইরা একটু আহাম্মক বনে গেল। উষশী পুনরায় খেতে লাগল। তাকে মাছ বেছে দিচ্ছে অভিরাজ। লাবণ্য নিজের প্লেটের দিকে তাকাল। সময়ের স্রোতে কত কিছু বদলে যায়।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here