##ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১৫
কুসুম রাঙা আলোয় খুব ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে ধরিত্রী। অসীমে নীলের মাঝে মাতাল মেঘেরা তুলার ন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছে। মানুষের ভেতরের চাপা কষ্ট গ্লাণিকে হরদমে উপেক্ষা করে প্রকৃতি প্রাণোচ্ছল ভাবে হরিদ্বর্ণ দিগন্তে মন বনান্তপ্রাণ খুলে অধর ছড়িয়েছে।
ফোনের বিপ বিপ ভাইব্রেশনের বিভৎস শব্দে চোখ কুচকে এলো মোহরের। বার কয়েক বিরতিহীন গুমগুমে শব্দে চোখ খুললো মোহর৷
আশেপাশে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বুঝে আড়মোড়া ভেঙে উঠলো। ঘুমে ঢুলুঢুলু আধবোজা চোখে সামনে তাকালে চোখ দু’টো স্থির হয়ে যায়। চুম্বকীয় টানের ন্যায় অভিভূত হয়ে স্থবিরত্ব নিয়ে তাকিয়ে রইলো নিজের চেয়ে কয়েক ফিট্ সামনে।
কুচকুচে মেরুন রঙের ডিভানটা পুরোপুরি দখল করে শুয়ে আছে দীর্ঘদেহী সৌষ্ঠব ব্যক্তিটা। বারান্দায় যাওয়ার স্লাইডিং ডোরে কিঞ্চিৎ ফাঁক পেয়ে অবাধ্য রোশনাই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরে। তারই একাংশ মেহরাজের গায়ে উপচে পরেছে। সমুদ্রের ন্যায় গভীর নীল রঙের টি-শার্ট এর রঙকে তুচ্ছ করে মেহরাজের ফর্সা বাহু দুটোতে চোখ বিঁধে গেল মোহরের।
ঘুমুরে চোখের ঘোর লাগা দৃষ্টিতে দেখলো সম্পূর্ণ মেহরাজকে। এই লোকটা এমন কেন? মানুষটাকে দেখলে মোহরের ছোট্ট মনটা জুড়ে খরস্রোতা নদীর আকস্মিক প্লাবনের ন্যায় ওঠাপড়া অদ্ভুত অনুভূতি গুলো উপচে পড়ে।
ভীষণ মন্থর গতিতে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো, দ্বিধাদ্বন্দ্বিত মনে এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো মেহরাজের একদম সামনে। ঘুমন্ত অবস্থায় ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে শুভ্র নির্মল চেহারাটা। ঘন চওড়া ভ্রুযুগলের নিচের বন্ধ চোখ দু’টো কত শান্ত, চিত্তগ্রাহীই না লাগছে, ইচ্ছে করছে প্রাণ ভরে শুধু এই চোখ দুটোই অবলোকন করতে।
কেমন মোহাচ্ছন্নের মতো লাগলো মোহরের। নিজের অজান্তেই মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে কিঞ্চিৎ ঝুকে আসলো, দুই হাত হাঁটুতে ভর করে মেহরাজের উপর উবু হয়ে তাকালো, দৃষ্টি ভরা কেমন সকৌতুকতা। এক পর্যায়ে ভ্রু কুচকে এলো মোহরের।
কিছু একটা নিয়ে ভাবনাগ্রস্ত হয়ে ঘাড় কাত করে তাকালে মোহরকে চূড়ান্ত বিড়ম্বনায় ফেলে বেহায়া ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠলো, তৎক্ষনাৎ মেহরাজ চোখ খুললেই মুখের উপর এমন মোহরকে উবু হয়ে থাকতে দেখে হকচকিয়ে উঠলো। মোহর প্রচণ্ড ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সরে আসতে নিলে ডিভানের সামনে রাখা ছোট একটা টি-টেবিলের মতো কিছু একটায় হাঁটুতে সজোরে ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে পরলো একেবারে মেহরাজের বুকের উপর।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় মোহর আকস্মিক ঘটনায় অপ্রস্তুত হয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেললো। বুকের ভেতর প্রচণ্ডরকম দ্রিমদ্রিম শব্দে টাইফুন তুলেছে। ঘুমের প্রকপে ফোলা ফোলা চোখ দুটিতে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।
মেহরাজ ভ্রুকুটি করে কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে আছে। সকাল বেলাই ঘুম ভেঙে এহেন কাণ্ড ওর ধারণার বাইরে ছিল। মোহর নড়েচড়ে সরে আসার চেষ্টা করলে পিছলে গেলেই মেহরাজ ওর সুডৌল কোমর আঁকড়ে ধরলো দু’হাতে, বিদ্যুতের ঝলকানির ন্যায় কম্পে উঠলো মোহরের সমস্ত চিত্ত। চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিল। সরে আসতে গেলেও প্রচণ্ড শক্ত থাবার ন্যায় হাত দুটো সরাতে পারলো নাহ। বরং ওর অস্বস্থিকে থার্মোমিটারের পারদের মতো তরতর করে বাড়িয়ে দিল মেহরাজের ভারী গালার ঘুমঘুম স্বর
-এতো কষ্ট করে চুরি করে দেখবার কি দরকার ছিল। আপনার যদি আমাকে এতই দেখতে ইচ্ছে করে তাহলে আমাকেই বলতেন, আমিই নাহয় বসে থাকতাম আপনার সামনে, আপনার মন না ভরলে সারাদিনই বসে থাকতাম মোহমায়া।
উত্তাপধারী কণ্ঠের এমন মাদকতা মিশ্রিত শব্দে মোহরের শিরা উপশিরায় শীতল রক্ত স্রোত বয়ে গেল। মস্তিষ্কের নিউরনের প্রচণ্ড উদ্দীপনার দাপটে দূর্বল হয়ে এলো মেরুদণ্ড। প্রকাণ্ড ভার এসে ভর করলো কণ্ঠনালীতে। জিহ্ব ঠেলে কোনো রকমে জড়তা ভরা গলায় বলল
-দে্ দেখুন
-এতো ছটফট করলে কিভাবে দেখব আপনাকে
মোহর গরম ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করার প্রয়াস করে মেহরাজের বুকের উপর হাত রেখে উঠে আসার চেষ্টা করলো। হাতের করপুট নিমিষেই ঢিলে করে দিল মেহরাজ। ছাড়া পেয়ে এক ঝটকায় সরে এসে দাঁড়ালো, বিব্রতচিত্তে অবিন্যস্ত ভাবে বলল
-আ আপনার ফোন বাজছিল অনেক্ষণ ধরে, তাই ডাকতে এসেছিলাম, আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমন না
মেহরাজ শোয়া থেকে উঠে বসলো। স্বচ্ছ টলটলে দীঘির ন্যায় আঁখিদুটির স্থবির দৃষ্টিতে তাকালো মোহরের দিকে।
-আমি তো কিছুই ভাবছি নাহ
মেহরাজের সে চাহনি মোহরকে তড়বড় করে অস্বস্তিকে বাড়িয়ে দিল। অপ্রকৃতস্থ হয়ে বলল
-আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে ধপ করে দরজা লাগিয়ে দিল। মোহরের পালিয়ে যাওয়া দেখে মেহরাজ ঠোঁট কামড়া হাসলো, একেবারেই ক্ষীণ হাসি দিয়ে নিজের হাতটা তুলে রাখলো বুকের ঠিক সেইখানে মোহর হাত রেখেছিল যেখানে।
•
গেট পেরিয়ে ঢুকে নিজ ক্লাসরুমের দিকে এগোতে লাগলো মোহর। খানিক এগোতেই সিড়ির দিকে শ্রীতমা কে দেখলো। কারো সাথে ফোনে কথা বলছে হয়তো। মোহর এগিয়ে যেতে যেতে ফোনে কথা শেষ হলে মোহরকে দেখেই অধর ছড়িয়ে হাসলো।
-মোহ, আই আই তোর জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি
মোহর এগিয়ে গিয়ে, ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল
-তুই কি করে জানলি আমি এখনই আসবো। আজ তো তাড়াতাড়ি এসেছি অনেক
-ওমা আমি জানবো না তো আর কে জানবে।
বলে ফিক করে হেসে দিল। মোহরও ক্ষীণ হেসে এগোতে লাগলো সিড়ি বেয়ে। কিন্তু মোহরের স্বাভাবিক চেহারাকে তব্দা মেরে দিয়ে তমা বলল
-মোহ আমি না প্রেমে পরেছি
চোখ ছোট করে মোহর তাকালো তমার দিকে।
ওর বিশ্বাস হচ্ছে না, কারণ এর আগেও তমা এহেন মজা করেছে মিথ্যা বলে। ও তনুর কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল
-আবারও মজা করছিস।
-আরে নাহ। শোন না আমি সত্যিই বলছি। আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি উনাকে।
মোহর ওর কথায় তবুও গা করলো নাহ। তাই ওর বলা শব্দসমষ্টিকে নিরবে মিথ্যে আখ্যা দিয়ে চুপ করে রইলো। তনু ওর বিশ্বাসকে ভুল প্রমানিত করে দিয়ে ফোন বের করে ধরলো মোহরের সামনে।
স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ফরমাল স্যুট পরিহিত হাস্যজ্বল একটা শ্যামবর্ণ চেহারা। বেশ সুদর্শন পুরুষ। তমা মুচকি হেসে বলল
-অরুনাভ মুখার্জী। বিজনেসম্যান, উনাকেই ভালোবেসে ফেলেছি আমি।
মোহর চোখ বড় বড় করে তাকালো শ্রীতমার দিকে। ওর মুখে লাজুক হাসি। এই প্রথমবার ওকে কোনো ছেলে নিয়ে কথা বলতে দেখলো। লজ্জায় মাথা নামিয়ে রেখেছে। চিরচেনা প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর এমন অচেনা চেহারাটা মুহুর্তেই মোহরকে অভিভূত করলো। হৃদয়ের কোনো এক কোণে অনাদরে পরে থাকা ভালোবাসা শব্দটার সুপ্ত মৃদু মুগ্ধতা গুলো উঠকেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইলো যেন,চোখের সামনে অজান্তেই একটা সুদর্শন চেহারা ভেসে উঠলো। পরমুহূর্তেই ওর জীবনের বাস্তবতা গুলো স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায় প্রতিফলন হয়ে উঠলো। মৃদু হাসি দিয়ে মাথা থেকে অযাচিত চিন্তা গুলো গা ঝারা দিয়ে তমার হাত ধরে বলল
-আসলে কি কি হয়েছে বল তো?
•
পুরু কাঁচের দেয়ালে আবদ্ধ বৃহৎ কেবিনটা। দক্ষিণ পাশটা দিয়ে পুরো শহরের একত্রিত চিত্র দেখা যায়। সাদা নীলের মিশ্রণে দারুণ রঙ আকাশের বুকে। যেন রম্য ক্যানভাস স্বচ্ছ রহস্যময়ী নির্মল রূপ, মেঘের উপরে মেঘ উড়ছে জগলুর চিত্ত বিহ্বলের ন্যায়।
ধোয়া ওঠা কফির মগটা পাশের টেবিলে রাখলো।
দু’হাত পকেটে গুঁজে গাঢ় মণির অপলক দৃষ্টিতে তাকালো নীলে সবুজের অপরূপ আকাশ আর মাটির রেখায়।
-স্যার আসবো?
নিজ স্থানের নড়চড় করলো নাহ। ক্ষীণ গতিতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। ভেতরে ঢুকে আবারও দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে এসে দাঁড়ালো অভিমন্যু। নিজ স্যারের নিরব সম্মতিকে তার খুব ভালো ভাবেই চেনা আছে। ওর চাঞ্চল্য ভরা গলায় শ্রদ্ধা বিনয় মিশিয়ে বলল
-স্যার এই লোকেশন গুলো রিকমেন্ড করেছে সবাই। এখন শুধু আপনার ভ্যারিফাই করে সিলেক্ট করার অপেক্ষা। তার পরেই কাজ শুরু হবে
বলে ফাইল টা এগিয়ে দিল। মেহরাজ স্থির নিমিত্তে তাকিয়ে আছে সুদূর দিগন্তে। আকাশের বুকেও যেন ভীত-সন্ত্রস্ত সেই কৃষ্ণাভ আঁখিদুটি ভেসে উঠছে। বুকের উপরে রাখা সেই হাতের স্পর্শ এখনো তাজা হয়ে আছে।
-স্যার?
অভিমন্যুর ডাকে ধ্যান ভাংলো মেহরাজের। স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ঘুরে দাঁড়ালো। অভিমন্যুর জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টি পরখ করে এগিয়ে গিয়ে নিজের চেয়ার টাতে বসলো। অভিমন্যু এগিয়ে এসে কিছুক্ষণ আগে বলা কথা গুলো আবারও সম্পূর্ণ আগ্রহের সাথে পুনরায় বলল
-সাইট গুলো সব চেক-আউট করা হয়েছে?
কালো রঙের চকচকে ফাইলটার কাগজ ওলটাতে ওলটাতে বলল মেহরাজ। অভিমন্যু ঘাড় নাড়িয়ে বলল
-ম্যানেজার সব দেখে এসেছে স্যার
-ফরগেট দ্যাট। তুমি নিজে।গিয়ে দেখে আসো একবার।
-জ্বি স্যার, আমি আজ রাতেই যাচ্ছি। টিকিট বুক করাও হয়ে গেছে।
মেহরাজ অভিমন্যুর এরূপ বুদ্ধিমত্তায় নতুন খুশি হলো নাহ। কারণ ও এমনই, স্যার আর তার সব কাজের ঠিক রাখায় অভিমন্যুর স্বভাব। মেহরাজের মতো খুতখুতে স্বভাবের মানুষের সব কাজ একমাত্র অভিমন্যুই পারফেকশনের সাথে কমপ্লিট করতে পারে।
মেহরাজ ফাইলটা ওর হাত্র ধরিয়ে দিয়ে বলল
-এদিকের সব ডান?
-ইয়েস স্যার, এখন আপনি বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। আর একটা প্রজেক্ট ভ্যারিফাই করা বাদ আছে আমি ওটা সামলে নিতে পারবো।
বলে দরজার দিকে যেতে নিলে মেহরাজ পেছন থেকে ডেকে বলল
-অভি, শীপ ম্যানেজমেন্টের ফাইলটা ইবনাত দেখে নিবে। তুমি বাড়ি যাও
-ইটস ওকে স্যার, আমি সামলে নিতে পারবো
-তোমাকে যা বলেছি তাই করো। এসব কাজ ওরাই সামলে নিবে। তুমি বাড়ি ফিরে যাও, ওভারটাইম তোমার কাজ নয়
অভিমন্যু নীরবে সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে গেলে মেহরাজ ফোনটা হাতে নিলো। ওখানে স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে ডিম লাইটের মৃদু আলোতে মোহরের ঘুমন্ত চেহারাটা
……………………..
-ছোট ম্যাডাম সর্বনাশ হয়ে গেছে, আমি না গেলে তো তাথই আপা এখনি বাচ্চাডারে মাইরা ফেলতো।
মালা চিৎকার করতে করতে এলো বসার ঘরে, কাকলি বসে ফোনে কথা বলছিলেন। আর আম্বি টিভি দেখছিলেন। মালার কথায় সব কাজ রেখে উঠে দাঁড়ালে মালা এগিয়ে এসে বলল
-বাচ্চাটা কখন থেকে কাঁদতেছিল খিদায়। আমি দুধ গরম করতে আইছিলাম নিয়ে যেতেই দেখি তাথই আপা ফ্ল্যাক্স থেকে গরম পানি বের করে বাচ্চারে খাওয়াইতে লাগছে। ওমা ম্যাডাম আমি সময় মতো না গেলে তো বাচ্চাডারে আজ মাইরা ফালাইতো গো
কাকলি আতঙ্কিত হয়ে গিয়ে মালার হাত থেকে বাচ্চাটাকে কোলে নিতে নিতে বলল
-ওকে খাওয়াইনি তো গরম পানি?
-না ম্যাডাম তার আগেই আমি পৌঁছাই গেছিলাম
মোহর সবেমাত্র ফিরেছে, বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে এসব শুনেই ভ্রু কুচকে এলো। কাকলি বেগম বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ক্ষিপ্ত ভাবে বলল
-অনেক দেখেছি ওর এসব উদ্ভট কাজ, আজ ওকে এর জবাব দিতেই হবে
বলেই ছুটে গেল তাথই এর ঘরের দিকে। আম্বি বেগম আর মালাও ছুটলো পেছনে। ঘরে ঢুকেই কাকলি ছুটে তাথই এর গালের উপর সপাটে ঠাস করে চ’ড় বসিয়ে দিল। অকস্মাৎ চ’ড়ে তাল সামলাতে না পেরে ধপ করে পরে গেল তাথই। কাকলি বেগম চিৎকার করে বলল
-কি পেয়েছিস টা কি তুই। যা নয় তাই করবি? তুই কি মে’রে ফেলতে চাস মেয়েটাকে? এটাকে তুই আদও পেটে ধরেছিস
তাথই উঠে দাঁড়ালো। কথার পৃষ্ঠে সজোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল
-না ধরিনি আমি, ওকে আমি পেটে ধরিনি। ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।না তো সত্যিই ওকে মে’রে ফেলবো আমি।
কাকলি বেগম আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। আবারও হাত উঠালেন আ’ঘাত করার জন্যে। কিন্তু এবার চ’ড় দিতে গেলে কেও খপ করে পেছন থেকে হাত চেপে ধরলো। উনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে মোহরকে দেখে বলল
-মার’বেন না উনাকে
-আমার হাত ধরেছ কোন সাহসে তুমি? আমার মেয়েকে আমি মা’রবো তোমাকে হাত ধরতে কে বলেছে
মোহর সকপটে বলল
-উনাকে মার’লেই তো এসবের সমাধান হবে নাহ। সবটা বুঝুন তারপরে শাসন করবেন
কাকলি বেগম উত্তরে কিছু বলবে তার আগেই মোহর তাথইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি দিদার ঘরে যান
কেমন আদেশের স্বরে বলল। আর অদ্ভুত ভাবে তাথই প্রত্যুত্তর করা দূর আজ্ঞামত চুপচাপ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আম্বি বেগম বলে উঠলেন
-তুমি ওকে চলে যেতে কেন বললে। ওর সাথে কথা বলাটা কত দরকার যানো তুমি। দিনদিন ওর পাগলামি বেড়েই চলেছে
-আসলে আপনারা সবাই খুব বেশি খামখেয়ালি, সবসময় নিজেদের মতামত টাকেই শ্রেয় মনে করেন।
আম্বি বেগম ভ্রু জড়ো করে বললেন
-কি বলতে চাইছো টা কি তুমি?
-এই যে একটা বাচ্চা এসেছে ঘরে, আপনারা সবসময় ওকে নিয়েই ব্যস্ত একবার আপার কথাটা ভেবেছেন? উনার প্রতিও কি যত্নশীল হওয়ার দরকার ছিল না?
-কিসব বলছো তুমি?
মোহর ঘুরে দাঁড়ালো ওদের দিকে। জড়তা হীনায় বলল
-আমি যতটুকু শুনেছি তাথই আপার প্রেগন্যান্সিতে ডিফিকাল্টি ছিল। ডেলিভারির সময়েও অবস্থা ক্রিটিকাল ছিল। আর ডেলিভারির পরে মায়েদের শরীরে হরমোনাল ইমব্যালেন্স হয়। এর ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে মায়েদের আচরনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে। যেমন অকারণে মেজাজ খিটখিটে, কান্না করা, বাচ্চার প্রতি অনীহা ছাড়াও সুই’সাইডাল টেনডেন্সি ক্রিয়েট করে। অনেক সময় ডিপ্রেশন এত মারাত্মক আকার ধারণ করে যার ফলে বাচ্চাকে মে’রে ফেলার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে। মেডিকেলের ভাষায় আমরা এই সমস্যাটাকে বলি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন! আপুর ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই হয়েছে। নতুন সদস্য পেয়ে সবাই তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরেছে যে আপুর দিকে ততটাও খেয়াল করেনি। যার কারণে বাচ্চাটার উপরেও সকল ক্ষোভ এসে পরেছে। আর মেন্টালি, ফিসিক্যালি প্রবলেম মিলিয়ে ফ্রাসট্রেশন থেকে এমন আচরণ করে৷ এক্ষেত্রে উনার সাথে এমন রূঢ় আচরণ করলে শাসন করতে গেলে সমস্যা বাড়বে নাইবা কমবে।
একদমে কথাগুলো বলে দম নিল মোহর। কাকলি বেগম আর আম্বি বেগম কোনো উত্তর করলো নাহ। মোহর আবারও বলল
-বাচ্চাটাকে সবাই সামলাতে পারবে। আপনি নাহয় তাথই আপুর দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। মেয়েরা দুঃসময়ে আপন মানুষগুলোর কাছেই ঠাঁই পেতে চাই,তাছাড়া কিছু না।
বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে বেড়িয়ে এলো। ঘরে এসে ব্যাগটা রেখেই ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।
আধ ঘন্টা সময় নিয়ে একবারে গোসল করেই বেরোলো। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ালে পেছনে হুট করে লম্বাকৃতির প্রতিবিম্ব দেখে চমকে ঘুরে তাকালো
-রিল্যাক্স, আমি
মেহরাজ অভয় দিয়ে বলল মোহরকে। মোহর বিব্রতকর চেহারায় তাকালো তার দিকে। এই লোকটা কখন এলো? ঘরে ঢুকে তো দেখেনি? আর আসলেও এতক্ষণ কোথায় ছিল?
-আমি আপনার আসার কিছুক্ষণ আগেই এসেছি, ব্যালকনিতে ছিলাম তাই খেয়াল করেনি
মোহর ঠোঁট গোল করে ও বলল শুধু। পরক্ষণেই ভাবলো সে তো মুখে প্রশ্ন করেনি তাইলে বুঝলো কি করে মেহরাজ? এমন অদ্ভুত কেন লোকটা?
-আপনি খুব অল্পতেই ভয় পেয়ে যান মোহমায়া।
-আমি মোটেও ভয় পাইনি?
মোহর সকপটে উত্তর করলো। পুনরায় নিজেই বলল
-আমি চমকে গিয়েছিলাম হুম করে পেছনে আপনাকে দেখে।
-চমকে যাওয়া আর ভয় পাওয়া আলাদা,বলছেন?
-অবশ্যই, ভয় মনের অবচেতন স্তরের একটি বিশেষ মানসিক অবস্থা বা মানুষ যখন কোনো কিছু নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে নিজের ক্ষতির আশঙ্কা করে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়। আর চমকে যাওয়ার অর্থ অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কিছু দেখে হুট করেই ভড়কে যাওয়া বা ইতস্তত বোধ করা।
মেহরাজ মোহরের শিক্ষকের ভঙ্গিমায় বলা কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো। অবশেষে বলল
-তাহলে আমার ঘরেই আমার থাকাটাকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হয়েছে আপনার,তাই তো?
আবার তব্দা মে’রে গেল মোহর। এই লোকটা কি করে প্রত্যেকটা কথার উল্টো জবাব বলে ফেলে? ইতস্তত হয়ে বলল
-মানে?
-কফি খাবেন?
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
©Humu_❤️
কুসুম রাঙা আলোয় খুব ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে ধরিত্রী। অসীমে নীলের মাঝে মাতাল মেঘেরা তুলার ন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছে। মানুষের ভেতরের চাপা কষ্ট গ্লাণিকে হরদমে উপেক্ষা করে প্রকৃতি প্রাণোচ্ছল ভাবে হরিদ্বর্ণ দিগন্তে মন বনান্তপ্রাণ খুলে অধর ছড়িয়েছে।
ফোনের বিপ বিপ ভাইব্রেশনের বিভৎস শব্দে চোখ কুচকে এলো মোহরের। বার কয়েক বিরতিহীন গুমগুমে শব্দে চোখ খুললো মোহর৷
আশেপাশে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বুঝে আড়মোড়া ভেঙে উঠলো। ঘুমে ঢুলুঢুলু আধবোজা চোখে সামনে তাকালে চোখ দু’টো স্থির হয়ে যায়। চুম্বকীয় টানের ন্যায় অভিভূত হয়ে স্থবিরত্ব নিয়ে তাকিয়ে রইলো নিজের চেয়ে কয়েক ফিট্ সামনে।
কুচকুচে মেরুন রঙের ডিভানটা পুরোপুরি দখল করে শুয়ে আছে দীর্ঘদেহী সৌষ্ঠব ব্যক্তিটা। বারান্দায় যাওয়ার স্লাইডিং ডোরে কিঞ্চিৎ ফাঁক পেয়ে অবাধ্য রোশনাই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরে। তারই একাংশ মেহরাজের গায়ে উপচে পরেছে। সমুদ্রের ন্যায় গভীর নীল রঙের টি-শার্ট এর রঙকে তুচ্ছ করে মেহরাজের ফর্সা বাহু দুটোতে চোখ বিঁধে গেল মোহরের।
ঘুমুরে চোখের ঘোর লাগা দৃষ্টিতে দেখলো সম্পূর্ণ মেহরাজকে। এই লোকটা এমন কেন? মানুষটাকে দেখলে মোহরের ছোট্ট মনটা জুড়ে খরস্রোতা নদীর আকস্মিক প্লাবনের ন্যায় ওঠাপড়া অদ্ভুত অনুভূতি গুলো উপচে পড়ে।
ভীষণ মন্থর গতিতে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো, দ্বিধাদ্বন্দ্বিত মনে এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো মেহরাজের একদম সামনে। ঘুমন্ত অবস্থায় ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে শুভ্র নির্মল চেহারাটা। ঘন চওড়া ভ্রুযুগলের নিচের বন্ধ চোখ দু’টো কত শান্ত, চিত্তগ্রাহীই না লাগছে, ইচ্ছে করছে প্রাণ ভরে শুধু এই চোখ দুটোই অবলোকন করতে।
কেমন মোহাচ্ছন্নের মতো লাগলো মোহরের। নিজের অজান্তেই মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে কিঞ্চিৎ ঝুকে আসলো, দুই হাত হাঁটুতে ভর করে মেহরাজের উপর উবু হয়ে তাকালো, দৃষ্টি ভরা কেমন সকৌতুকতা। এক পর্যায়ে ভ্রু কুচকে এলো মোহরের।
কিছু একটা নিয়ে ভাবনাগ্রস্ত হয়ে ঘাড় কাত করে তাকালে মোহরকে চূড়ান্ত বিড়ম্বনায় ফেলে বেহায়া ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠলো, তৎক্ষনাৎ মেহরাজ চোখ খুললেই মুখের উপর এমন মোহরকে উবু হয়ে থাকতে দেখে হকচকিয়ে উঠলো। মোহর প্রচণ্ড ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সরে আসতে নিলে ডিভানের সামনে রাখা ছোট একটা টি-টেবিলের মতো কিছু একটায় হাঁটুতে সজোরে ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে পরলো একেবারে মেহরাজের বুকের উপর।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় মোহর আকস্মিক ঘটনায় অপ্রস্তুত হয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেললো। বুকের ভেতর প্রচণ্ডরকম দ্রিমদ্রিম শব্দে টাইফুন তুলেছে। ঘুমের প্রকপে ফোলা ফোলা চোখ দুটিতে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।
মেহরাজ ভ্রুকুটি করে কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে আছে। সকাল বেলাই ঘুম ভেঙে এহেন কাণ্ড ওর ধারণার বাইরে ছিল। মোহর নড়েচড়ে সরে আসার চেষ্টা করলে পিছলে গেলেই মেহরাজ ওর সুডৌল কোমর আঁকড়ে ধরলো দু’হাতে, বিদ্যুতের ঝলকানির ন্যায় কম্পে উঠলো মোহরের সমস্ত চিত্ত। চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিল। সরে আসতে গেলেও প্রচণ্ড শক্ত থাবার ন্যায় হাত দুটো সরাতে পারলো নাহ। বরং ওর অস্বস্থিকে থার্মোমিটারের পারদের মতো তরতর করে বাড়িয়ে দিল মেহরাজের ভারী গালার ঘুমঘুম স্বর
-এতো কষ্ট করে চুরি করে দেখবার কি দরকার ছিল। আপনার যদি আমাকে এতই দেখতে ইচ্ছে করে তাহলে আমাকেই বলতেন, আমিই নাহয় বসে থাকতাম আপনার সামনে, আপনার মন না ভরলে সারাদিনই বসে থাকতাম মোহমায়া।
উত্তাপধারী কণ্ঠের এমন মাদকতা মিশ্রিত শব্দে মোহরের শিরা উপশিরায় শীতল রক্ত স্রোত বয়ে গেল। মস্তিষ্কের নিউরনের প্রচণ্ড উদ্দীপনার দাপটে দূর্বল হয়ে এলো মেরুদণ্ড। প্রকাণ্ড ভার এসে ভর করলো কণ্ঠনালীতে। জিহ্ব ঠেলে কোনো রকমে জড়তা ভরা গলায় বলল
-দে্ দেখুন
-এতো ছটফট করলে কিভাবে দেখব আপনাকে
মোহর গরম ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করার প্রয়াস করে মেহরাজের বুকের উপর হাত রেখে উঠে আসার চেষ্টা করলো। হাতের করপুট নিমিষেই ঢিলে করে দিল মেহরাজ। ছাড়া পেয়ে এক ঝটকায় সরে এসে দাঁড়ালো, বিব্রতচিত্তে অবিন্যস্ত ভাবে বলল
-আ আপনার ফোন বাজছিল অনেক্ষণ ধরে, তাই ডাকতে এসেছিলাম, আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমন না
মেহরাজ শোয়া থেকে উঠে বসলো। স্বচ্ছ টলটলে দীঘির ন্যায় আঁখিদুটির স্থবির দৃষ্টিতে তাকালো মোহরের দিকে।
-আমি তো কিছুই ভাবছি নাহ
মেহরাজের সে চাহনি মোহরকে তড়বড় করে অস্বস্তিকে বাড়িয়ে দিল। অপ্রকৃতস্থ হয়ে বলল
-আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে ধপ করে দরজা লাগিয়ে দিল। মোহরের পালিয়ে যাওয়া দেখে মেহরাজ ঠোঁট কামড়া হাসলো, একেবারেই ক্ষীণ হাসি দিয়ে নিজের হাতটা তুলে রাখলো বুকের ঠিক সেইখানে মোহর হাত রেখেছিল যেখানে।
•
গেট পেরিয়ে ঢুকে নিজ ক্লাসরুমের দিকে এগোতে লাগলো মোহর। খানিক এগোতেই সিড়ির দিকে শ্রীতমা কে দেখলো। কারো সাথে ফোনে কথা বলছে হয়তো। মোহর এগিয়ে যেতে যেতে ফোনে কথা শেষ হলে মোহরকে দেখেই অধর ছড়িয়ে হাসলো।
-মোহ, আই আই তোর জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি
মোহর এগিয়ে গিয়ে, ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল
-তুই কি করে জানলি আমি এখনই আসবো। আজ তো তাড়াতাড়ি এসেছি অনেক
-ওমা আমি জানবো না তো আর কে জানবে।
বলে ফিক করে হেসে দিল। মোহরও ক্ষীণ হেসে এগোতে লাগলো সিড়ি বেয়ে। কিন্তু মোহরের স্বাভাবিক চেহারাকে তব্দা মেরে দিয়ে তমা বলল
-মোহ আমি না প্রেমে পরেছি
চোখ ছোট করে মোহর তাকালো তমার দিকে।
ওর বিশ্বাস হচ্ছে না, কারণ এর আগেও তমা এহেন মজা করেছে মিথ্যা বলে। ও তনুর কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল
-আবারও মজা করছিস।
-আরে নাহ। শোন না আমি সত্যিই বলছি। আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি উনাকে।
মোহর ওর কথায় তবুও গা করলো নাহ। তাই ওর বলা শব্দসমষ্টিকে নিরবে মিথ্যে আখ্যা দিয়ে চুপ করে রইলো। তনু ওর বিশ্বাসকে ভুল প্রমানিত করে দিয়ে ফোন বের করে ধরলো মোহরের সামনে।
স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ফরমাল স্যুট পরিহিত হাস্যজ্বল একটা শ্যামবর্ণ চেহারা। বেশ সুদর্শন পুরুষ। তমা মুচকি হেসে বলল
-অরুনাভ মুখার্জী। বিজনেসম্যান, উনাকেই ভালোবেসে ফেলেছি আমি।
মোহর চোখ বড় বড় করে তাকালো শ্রীতমার দিকে। ওর মুখে লাজুক হাসি। এই প্রথমবার ওকে কোনো ছেলে নিয়ে কথা বলতে দেখলো। লজ্জায় মাথা নামিয়ে রেখেছে। চিরচেনা প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর এমন অচেনা চেহারাটা মুহুর্তেই মোহরকে অভিভূত করলো। হৃদয়ের কোনো এক কোণে অনাদরে পরে থাকা ভালোবাসা শব্দটার সুপ্ত মৃদু মুগ্ধতা গুলো উঠকেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইলো যেন,চোখের সামনে অজান্তেই একটা সুদর্শন চেহারা ভেসে উঠলো। পরমুহূর্তেই ওর জীবনের বাস্তবতা গুলো স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায় প্রতিফলন হয়ে উঠলো। মৃদু হাসি দিয়ে মাথা থেকে অযাচিত চিন্তা গুলো গা ঝারা দিয়ে তমার হাত ধরে বলল
-আসলে কি কি হয়েছে বল তো?
•
পুরু কাঁচের দেয়ালে আবদ্ধ বৃহৎ কেবিনটা। দক্ষিণ পাশটা দিয়ে পুরো শহরের একত্রিত চিত্র দেখা যায়। সাদা নীলের মিশ্রণে দারুণ রঙ আকাশের বুকে। যেন রম্য ক্যানভাস স্বচ্ছ রহস্যময়ী নির্মল রূপ, মেঘের উপরে মেঘ উড়ছে জগলুর চিত্ত বিহ্বলের ন্যায়।
ধোয়া ওঠা কফির মগটা পাশের টেবিলে রাখলো।
দু’হাত পকেটে গুঁজে গাঢ় মণির অপলক দৃষ্টিতে তাকালো নীলে সবুজের অপরূপ আকাশ আর মাটির রেখায়।
-স্যার আসবো?
নিজ স্থানের নড়চড় করলো নাহ। ক্ষীণ গতিতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। ভেতরে ঢুকে আবারও দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে এসে দাঁড়ালো অভিমন্যু। নিজ স্যারের নিরব সম্মতিকে তার খুব ভালো ভাবেই চেনা আছে। ওর চাঞ্চল্য ভরা গলায় শ্রদ্ধা বিনয় মিশিয়ে বলল
-স্যার এই লোকেশন গুলো রিকমেন্ড করেছে সবাই। এখন শুধু আপনার ভ্যারিফাই করে সিলেক্ট করার অপেক্ষা। তার পরেই কাজ শুরু হবে
বলে ফাইল টা এগিয়ে দিল। মেহরাজ স্থির নিমিত্তে তাকিয়ে আছে সুদূর দিগন্তে। আকাশের বুকেও যেন ভীত-সন্ত্রস্ত সেই কৃষ্ণাভ আঁখিদুটি ভেসে উঠছে। বুকের উপরে রাখা সেই হাতের স্পর্শ এখনো তাজা হয়ে আছে।
-স্যার?
অভিমন্যুর ডাকে ধ্যান ভাংলো মেহরাজের। স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ঘুরে দাঁড়ালো। অভিমন্যুর জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টি পরখ করে এগিয়ে গিয়ে নিজের চেয়ার টাতে বসলো। অভিমন্যু এগিয়ে এসে কিছুক্ষণ আগে বলা কথা গুলো আবারও সম্পূর্ণ আগ্রহের সাথে পুনরায় বলল
-সাইট গুলো সব চেক-আউট করা হয়েছে?
কালো রঙের চকচকে ফাইলটার কাগজ ওলটাতে ওলটাতে বলল মেহরাজ। অভিমন্যু ঘাড় নাড়িয়ে বলল
-ম্যানেজার সব দেখে এসেছে স্যার
-ফরগেট দ্যাট। তুমি নিজে।গিয়ে দেখে আসো একবার।
-জ্বি স্যার, আমি আজ রাতেই যাচ্ছি। টিকিট বুক করাও হয়ে গেছে।
মেহরাজ অভিমন্যুর এরূপ বুদ্ধিমত্তায় নতুন খুশি হলো নাহ। কারণ ও এমনই, স্যার আর তার সব কাজের ঠিক রাখায় অভিমন্যুর স্বভাব। মেহরাজের মতো খুতখুতে স্বভাবের মানুষের সব কাজ একমাত্র অভিমন্যুই পারফেকশনের সাথে কমপ্লিট করতে পারে।
মেহরাজ ফাইলটা ওর হাত্র ধরিয়ে দিয়ে বলল
-এদিকের সব ডান?
-ইয়েস স্যার, এখন আপনি বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। আর একটা প্রজেক্ট ভ্যারিফাই করা বাদ আছে আমি ওটা সামলে নিতে পারবো।
বলে দরজার দিকে যেতে নিলে মেহরাজ পেছন থেকে ডেকে বলল
-অভি, শীপ ম্যানেজমেন্টের ফাইলটা ইবনাত দেখে নিবে। তুমি বাড়ি যাও
-ইটস ওকে স্যার, আমি সামলে নিতে পারবো
-তোমাকে যা বলেছি তাই করো। এসব কাজ ওরাই সামলে নিবে। তুমি বাড়ি ফিরে যাও, ওভারটাইম তোমার কাজ নয়
অভিমন্যু নীরবে সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে গেলে মেহরাজ ফোনটা হাতে নিলো। ওখানে স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে ডিম লাইটের মৃদু আলোতে মোহরের ঘুমন্ত চেহারাটা
……………………..
-ছোট ম্যাডাম সর্বনাশ হয়ে গেছে, আমি না গেলে তো তাথই আপা এখনি বাচ্চাডারে মাইরা ফেলতো।
মালা চিৎকার করতে করতে এলো বসার ঘরে, কাকলি বসে ফোনে কথা বলছিলেন। আর আম্বি টিভি দেখছিলেন। মালার কথায় সব কাজ রেখে উঠে দাঁড়ালে মালা এগিয়ে এসে বলল
-বাচ্চাটা কখন থেকে কাঁদতেছিল খিদায়। আমি দুধ গরম করতে আইছিলাম নিয়ে যেতেই দেখি তাথই আপা ফ্ল্যাক্স থেকে গরম পানি বের করে বাচ্চারে খাওয়াইতে লাগছে। ওমা ম্যাডাম আমি সময় মতো না গেলে তো বাচ্চাডারে আজ মাইরা ফালাইতো গো
কাকলি আতঙ্কিত হয়ে গিয়ে মালার হাত থেকে বাচ্চাটাকে কোলে নিতে নিতে বলল
-ওকে খাওয়াইনি তো গরম পানি?
-না ম্যাডাম তার আগেই আমি পৌঁছাই গেছিলাম
মোহর সবেমাত্র ফিরেছে, বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে এসব শুনেই ভ্রু কুচকে এলো। কাকলি বেগম বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ক্ষিপ্ত ভাবে বলল
-অনেক দেখেছি ওর এসব উদ্ভট কাজ, আজ ওকে এর জবাব দিতেই হবে
বলেই ছুটে গেল তাথই এর ঘরের দিকে। আম্বি বেগম আর মালাও ছুটলো পেছনে। ঘরে ঢুকেই কাকলি ছুটে তাথই এর গালের উপর সপাটে ঠাস করে চ’ড় বসিয়ে দিল। অকস্মাৎ চ’ড়ে তাল সামলাতে না পেরে ধপ করে পরে গেল তাথই। কাকলি বেগম চিৎকার করে বলল
-কি পেয়েছিস টা কি তুই। যা নয় তাই করবি? তুই কি মে’রে ফেলতে চাস মেয়েটাকে? এটাকে তুই আদও পেটে ধরেছিস
তাথই উঠে দাঁড়ালো। কথার পৃষ্ঠে সজোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল
-না ধরিনি আমি, ওকে আমি পেটে ধরিনি। ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।না তো সত্যিই ওকে মে’রে ফেলবো আমি।
কাকলি বেগম আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। আবারও হাত উঠালেন আ’ঘাত করার জন্যে। কিন্তু এবার চ’ড় দিতে গেলে কেও খপ করে পেছন থেকে হাত চেপে ধরলো। উনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে মোহরকে দেখে বলল
-মার’বেন না উনাকে
-আমার হাত ধরেছ কোন সাহসে তুমি? আমার মেয়েকে আমি মা’রবো তোমাকে হাত ধরতে কে বলেছে
মোহর সকপটে বলল
-উনাকে মার’লেই তো এসবের সমাধান হবে নাহ। সবটা বুঝুন তারপরে শাসন করবেন
কাকলি বেগম উত্তরে কিছু বলবে তার আগেই মোহর তাথইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি দিদার ঘরে যান
কেমন আদেশের স্বরে বলল। আর অদ্ভুত ভাবে তাথই প্রত্যুত্তর করা দূর আজ্ঞামত চুপচাপ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আম্বি বেগম বলে উঠলেন
-তুমি ওকে চলে যেতে কেন বললে। ওর সাথে কথা বলাটা কত দরকার যানো তুমি। দিনদিন ওর পাগলামি বেড়েই চলেছে
-আসলে আপনারা সবাই খুব বেশি খামখেয়ালি, সবসময় নিজেদের মতামত টাকেই শ্রেয় মনে করেন।
আম্বি বেগম ভ্রু জড়ো করে বললেন
-কি বলতে চাইছো টা কি তুমি?
-এই যে একটা বাচ্চা এসেছে ঘরে, আপনারা সবসময় ওকে নিয়েই ব্যস্ত একবার আপার কথাটা ভেবেছেন? উনার প্রতিও কি যত্নশীল হওয়ার দরকার ছিল না?
-কিসব বলছো তুমি?
মোহর ঘুরে দাঁড়ালো ওদের দিকে। জড়তা হীনায় বলল
-আমি যতটুকু শুনেছি তাথই আপার প্রেগন্যান্সিতে ডিফিকাল্টি ছিল। ডেলিভারির সময়েও অবস্থা ক্রিটিকাল ছিল। আর ডেলিভারির পরে মায়েদের শরীরে হরমোনাল ইমব্যালেন্স হয়। এর ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে মায়েদের আচরনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে। যেমন অকারণে মেজাজ খিটখিটে, কান্না করা, বাচ্চার প্রতি অনীহা ছাড়াও সুই’সাইডাল টেনডেন্সি ক্রিয়েট করে। অনেক সময় ডিপ্রেশন এত মারাত্মক আকার ধারণ করে যার ফলে বাচ্চাকে মে’রে ফেলার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে। মেডিকেলের ভাষায় আমরা এই সমস্যাটাকে বলি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন! আপুর ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই হয়েছে। নতুন সদস্য পেয়ে সবাই তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরেছে যে আপুর দিকে ততটাও খেয়াল করেনি। যার কারণে বাচ্চাটার উপরেও সকল ক্ষোভ এসে পরেছে। আর মেন্টালি, ফিসিক্যালি প্রবলেম মিলিয়ে ফ্রাসট্রেশন থেকে এমন আচরণ করে৷ এক্ষেত্রে উনার সাথে এমন রূঢ় আচরণ করলে শাসন করতে গেলে সমস্যা বাড়বে নাইবা কমবে।
একদমে কথাগুলো বলে দম নিল মোহর। কাকলি বেগম আর আম্বি বেগম কোনো উত্তর করলো নাহ। মোহর আবারও বলল
-বাচ্চাটাকে সবাই সামলাতে পারবে। আপনি নাহয় তাথই আপুর দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। মেয়েরা দুঃসময়ে আপন মানুষগুলোর কাছেই ঠাঁই পেতে চাই,তাছাড়া কিছু না।
বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে বেড়িয়ে এলো। ঘরে এসে ব্যাগটা রেখেই ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।
আধ ঘন্টা সময় নিয়ে একবারে গোসল করেই বেরোলো। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ালে পেছনে হুট করে লম্বাকৃতির প্রতিবিম্ব দেখে চমকে ঘুরে তাকালো
-রিল্যাক্স, আমি
মেহরাজ অভয় দিয়ে বলল মোহরকে। মোহর বিব্রতকর চেহারায় তাকালো তার দিকে। এই লোকটা কখন এলো? ঘরে ঢুকে তো দেখেনি? আর আসলেও এতক্ষণ কোথায় ছিল?
-আমি আপনার আসার কিছুক্ষণ আগেই এসেছি, ব্যালকনিতে ছিলাম তাই খেয়াল করেনি
মোহর ঠোঁট গোল করে ও বলল শুধু। পরক্ষণেই ভাবলো সে তো মুখে প্রশ্ন করেনি তাইলে বুঝলো কি করে মেহরাজ? এমন অদ্ভুত কেন লোকটা?
-আপনি খুব অল্পতেই ভয় পেয়ে যান মোহমায়া।
-আমি মোটেও ভয় পাইনি?
মোহর সকপটে উত্তর করলো। পুনরায় নিজেই বলল
-আমি চমকে গিয়েছিলাম হুম করে পেছনে আপনাকে দেখে।
-চমকে যাওয়া আর ভয় পাওয়া আলাদা,বলছেন?
-অবশ্যই, ভয় মনের অবচেতন স্তরের একটি বিশেষ মানসিক অবস্থা বা মানুষ যখন কোনো কিছু নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে নিজের ক্ষতির আশঙ্কা করে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়। আর চমকে যাওয়ার অর্থ অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কিছু দেখে হুট করেই ভড়কে যাওয়া বা ইতস্তত বোধ করা।
মেহরাজ মোহরের শিক্ষকের ভঙ্গিমায় বলা কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো। অবশেষে বলল
-তাহলে আমার ঘরেই আমার থাকাটাকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হয়েছে আপনার,তাই তো?
আবার তব্দা মে’রে গেল মোহর। এই লোকটা কি করে প্রত্যেকটা কথার উল্টো জবাব বলে ফেলে? ইতস্তত হয়ে বলল
-মানে?
-কফি খাবেন?
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
©Humu_❤️