#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৯+৩০
“ঘুম থেকে উঠার পর প্রাণ যখন তার মাকে খুঁজে পেল না তখন পাগলামো শুরু করে দিল। বড় সাহেব পাশের রুমেই ছিলেন, বড় কর্তা ও গিন্নিমার সাথে কথা বলছিলেন। প্রাণের চিল্লাপাল্লা শুনতে পেয়ে সবাই দৌড়ে আসলেন, বুঝানোর চেষ্টা করলেন তার মা আর জীবিত নেই। কিন্তু অবুঝ বাচ্চাটা কি আর সেসব বুঝে? কান্নাকাটি করতে থাকে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য। তখন গিন্নিমা মানে প্রাণের দাদিজান মিশু বিবি প্রাণকে আগলে নিলেন। শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন কিন্তু লাভ হলো না এতে। অবশেষে তিনি বাধ্য হয়েই হুমায়রা আপার কবরের কাছে নিয়ে গেলেন প্রাণকে, বুঝালেন তার মা চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গিয়েছে। আর কখনো তিনি ঘুম থেকে উঠবেন না। প্রাণ তখন হুমায়রা আপার কবরের সামনে বসেই কান্না শুরু করে দেয়৷ কাঁদতে কাঁদতে একসময় ওখানেই অ*জ্ঞা*ন হয়ে পড়ে যায়। ওই ঘটনার পর থেকেই প্রাণ একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। সবসময় ঘরের এক কোণে পড়ে থাকতো ও। মাঝে মধ্যে হুমায়রা আপার জিনিসপত্র কোলে নিয়ে বিরবির করতে থাকতো,কাঁদতো। খাওয়া-দাওয়া তো একদম ছেড়েই দিয়েছিল মেয়েটা। ছোট থেকেই প্রাণ দেখতে একদম পুতুলের মত ছিল, যে একবার দেখতো সহজে চোখ ফিরাতে পারতো না। অথচ তখন তার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না, এতটাই রোগা হয়ে গিয়েছিল ও। গিন্নিমা অনেক চিন্তায় ছিলেন প্রাণকে নিয়ে, তাই তিনি নিজ থেকেই প্রাণের পাশে থাকতে শুরু করলেন। সারাক্ষণ তার খেয়াল রাখতেন, কথা বলতেন। প্রাণও এতে কিছুটা স্বস্তি পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু পুরো জিনিসটাই ঘেটে যায় যখন বড় সাহেব দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে নতুন বউ তুললেন। তাও কি-না আবার হুমায়রা আপার মৃ*ত্যু*র ত্রিশ দিনের মাথায়। বড় সাহেবের নতুন বউ ছিলেন মেহরিমা হোসেন। সেই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। অভিনয়ের সূত্র ধরেই বড় সাহেবের সাথে তার পরিচয় এবং হুমায়রা আপা যখন একদম লাস্ট স্টেজে ছিলেন তখনই তাদের মধ্যে আপত্তিকর একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে৷ অতঃপর সেই সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটাতেই তিনি বিয়ে করে নেন মেহরিমাকে। বড় কর্তা আর গিন্নিমা এই নিয়ে বেশ ক্ষেপে যান বড় সাহেবের উপর। কথা-কা*টা*কা*টি হয় বেশ। কিন্তু বড় সাহেব এসব কানে তুলেন না। সোজা চলে যান প্রাণের কাছে। পরিচয় করে দেন তার নতুন মায়ের সাথে। তবে মেহরিমাকে দেখার সাথে সাথেই প্রাণের মনে পড়ে যায় হুমায়রা আপার মৃত্যুর দিন মেহরিমাই তার বাবার সাথে ছিল। যার জন্য তার বাবা তার কথা শুনতে চায়নি, বের করে দিয়েছিল তাকে রুম থেকে। তখন প্রাণের মাথায় কিভাবে যেন এটা ঢুকে যায়, মেহরিমার জন্যই তার বাবা তাকে আর তার মাকে ভালোবাসতো না। একমাত্র মেহরিমার জন্য তার মায়ের মৃ*ত্যু হয়েছে। যার জন্যে মেহরিমাকে দেখামাত্র সে জিনিসপত্র ছুঁড়ে মা*র*তে শুরু করে। ভারি কিছু ছুঁড়ে মারার ফলে মেহরিমার কপাল ফে*টে র*ক্ত বেরিয়ে আসে। যা দেখে বড় সাহেব রেগে যান ও প্রথমবারের মত প্রাণের গায়ে হাত তুলে বসেন। রাগের মাথায় তিনি হুমায়রা আপার শিক্ষা-দীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। অকথ্য ভাষায় কথা বলেন এবং সে সাথে জানান, তার প্রাণের মত অ*স*ভ্য,বে*য়া*দ*ব মেয়ে চাই না। সে সময় গিন্নিমা এসে বড় সাহেবকে থামান এবং প্রাণকে মা*রা*র জন্য তাকে মা*রে*ন। অতঃপর বড় সাহেবের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি প্রাণকে নিজের সাথে করে নিয়ে আসেন। যদিও পরবর্তীতে রাগ কমার পর বড় সাহেব গিয়েছিলেন সব ঠিক করে প্রাণকে ফিরিয়ে আনতে তবে গিন্নিমা তাকে ফিরিয়ে দেন। বড়কর্তাও ততদিনে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তাই বড় সাহেব উপায় না হাল ছেড়ে দেন এবং নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
আমি গিন্নিমার বাসায় অল্প বয়স থেকেই রান্নার কাজ করতাম। ষোল বছর বসয়ে বিধবা হতে হয় আমাকে, শ্বশুরবাড়ির মানুষ বের করে দেয়, বাবা-মাও নিজের কাছে রাখতে আপত্তি জানায়। এই সমাজে থাকার মত যখন ঠাই ছিল না তখন গিন্নিমাই আমাকে কাজের বদলে তাদের বাসায় থাকার জায়গা করে দেন। পড়ালেখার ব্যবস্থাও করে দেন। করে নেন আমায় তাদের পরিবারের ক্ষুদ্র একটি অংশ। যার ফলে তাদের কোনকিছুই আমার কাছ থেকে লুকায়িত ছিল না। প্রাণকে এই বাসায় নিয়ে আসার পর একদম চুপচাপ থাকতো। কথা বলতো না,হাসতো না,খেলতো না, কিছু না। নীরবে এককোণে বসে থাকতো। আমি, গিন্নিমা মিলে খুব কষ্টে ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনি। আমি তখন সংসার হারা, মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা ছিল মনে। ছোট প্রাণকে সামনে পেয়ে লোভ সামলাতে পারি না। ওকে আগলে রাখার দায়িত্ব চেয়ে বসি গিন্নিমার নিকট। গিন্নিমা তখন ফিরিয়ে দেননি আমায়, হাতে তুলে দেন প্রাণের সকল দায়িত্ব। সেখান থেকেই আমি প্রাণের আশামা। প্রাণকে আমি নিজের সন্তানের মত করেই বড় করতে থাকি। তবে চঞ্চল প্রাণটাকে আর ফেরত আনতে পারি না, সময়ের সাথে সাথে ও আরও চাপা স্বভাবের হয়ে যায়৷ বাসায় যাও কথা বলতো বাহিরে তার এক শতাংশও বলতো না। এর পিছনে অবশ্য কারণ ছিল, স্কুলে বা পারা মহল্লায় প্রায় সবাই ওকে ওর বাবা-মা নিয়ে প্রশ্ন করতো। স্কুলে বাচ্চারাও অনেকসময় হাসা-হাসি করতো ওকে নিয়ে। বাবা-মা না থাকায় কটুক্তি করতো তারা। কিন্তু প্রাণের কোনটারই উত্তর দিতে পারতো না। তাই ও সবসময় অদৃশ্য হয়ে থাকার চেষ্টা করতো, সময় কাটাতে বইয়ের মাঝে মুখ গুঁজে রাখতো।
প্রাণের কাছে পরিবার বলতেই আমি,গিন্নিমা ও বড় কর্তা ছিলেন। আমাদের নিয়েই ছিল ওর ছোট পৃথিবী। তবে এই পৃথিবীতে ফা*ট*ল ধরে যখন প্রাণ আয়ে পাশ করে বের হয়। সে সময়টায় বয়সের ভার নিতে না পেরে বড় কর্তা ই*ন্তে*কা*ল করেন। তারই শোকে থেকে গিন্নিমাও এক সপ্তাহের ব্যবধানে চলেন না ফেরার দেশে। বিপর্যয় নামে প্রাণের জীবন। একসাথে এতবড় ধা*ক্কা নিতে পারেনি ও। স্মৃতিচারণে ভেসে উঠে নিজের মায়ের মৃ*ত্যু। সব মিলিয়ে প্রাণ ডিপ্রেশনে পড়ে যায়। মেনে নিতে পারে না আপনজনের মৃ*ত্যু। এভাবেও হুমায়রা আপা মা*রা যাওয়ার পর ও কারো মৃ*ত্যু সহ্য করতে পারতো না। ফোবিয়া ছিল ওর এটায়। ফলে কর্তা ও গিন্নিমার চলে যাওয়ায় ওর অবস্থা করুণ হতে শুরু করে। প্রথম কয়েকদিন বদ্ধ উ*ন্মা*দে*র মত আচরণ করলেও পরবর্তীতে বন্দী করে ফেলে নিজেকে একটি রুমের ভিতর। আঁধারপুরী কক্ষটায় খাওয়া-পানি ছাড়া কাটিয়ে দেয় সপ্তাহের পর সপ্তাহ। ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে সে। আমি তখন কোনভাবেই প্রাণকে সামলাতে পারছিলাম না।আমার কথাই শুনতে চাইতো না কোন। তাই বাধ্য হয়ে তখন বড় সাহেবকে ফোন দেই ও পুরো ঘটনা খুলে বলি। সব শুনার পর তিনি এসে প্রাণকে নিয়ে যান সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা যায় যে, প্রাণ মেন্টালি ইল। ছোট থেকেই স্ট্রেস, ডিপ্রেশন ও ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগার কারণে তার মানসিক অবস্থা খানিকটা বি*কৃ*ত হয়ে গিয়েছে। এমনকি সে বিপলার ডিসর্ডার ও পোস্ট ট্রোমাটিক স্ট্রেস ডিসর্ডার (PTSD) এর মত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। যদি দ্রুত চিকিৎসা না করা হয়, প্রাণ ভবিষ্যতে হয়তো ভারসাম্য হারাতে পারে। বড় সাহেব এটা শোনার পর তৎক্ষনাৎ প্রাণের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসা ঠিকই চলছিল কিন্তু বিপত্তি ঘটে প্রাণকে ঔষধ খাওয়ানো নিয়ে। কোনভাবেই ওকে ঔষধ খাওয়ানো যেত না। ফেলে দিত ও সব। অথচ ওর নার্ভ ঠান্ডা ও স্বাভাবিক রাখার জন্য ঔষধগুলোর ভীষণ দরকার ছিল। নাহলে যত যাই করা হতো না কেন ওর অবস্থায় উন্নতি আসতো না। প্রাণকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু সে মানেনি। এর কারণ, ও ঠিক হতে চাইতো না। জীবনের সকল মায়া ত্যাগ করে ফেলেছিল ও। প্রতিনিয়ত নিজের মৃ*ত্যু কামনা করতো। তাই ওকে লুকিয়ে-চুড়িয়ে খাবার বা জুসের সাথে মিলিয়ে ঔষধ খাওয়াতে হতো আমাকে। খেয়াল রাখতাম প্রাণ যাতে কোনভাবে কিছু তেড় না পায়। অতঃপর দীর্ঘ আট মাস চিকিৎসার পর প্রাণ গিয়ে খানিকটা সুস্থ হয়। তবে পুরোপুআরিভাবে না। ওর মস্তিষ্কের কিছু নার্ভ অচল হয়ে গিয়েছিল, যার জন্য ওকে স্বাভাবিক রাখতে রেগুলার কয়েকটা মেডিসিন দিতে হতো। আমিও লুকিয়ে ওকে ঔষধগুলো খাওয়াতে থাকি।”
আশা বেগমের কথার এই পর্যায়ে ছন্দ বলে উঠলো, “তার মানে ওইদিন আপনি আমায় মিথ্যে বলেছিলেন?”
আশা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “হ্যাঁ! মিথ্যে বলেছিলাম আমি। প্রাণকে সেদিন ঘুমের ঔষধ না, ওর প্রেসক্রাইব করা ঔষধগুলাই খাওয়ানো হয়েছিল। জেসিকার আ*ত্ম*হ*ত্যা*র কথা শুনে প্রাণ নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। বললাম না, মৃ’ত্যু জিনিসটা থেকে ওর ফোবিয়া আছে। তাই ওমন আচরণ করছিল। বলতে পারো, ওকে স্বাভাবিক ও শান্ত রাখতে মেডিসিনগুলো ভীষণ প্রয়োজন।”
ছন্দ দৃষ্টি নত করে বলল, “প্রাণ এন্টারটেইনমেন্ট জগতে আসলো কিভাবে?”
“প্রাণ যাতে সর্বদা ব্যস্ত থাকে ও পুনরায় যাতে একাকিত্বে না ভুগে, তাই বড় সাহেব জোরপূর্বক প্রাণকে এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়ে আসেন। কিন্তু প্রাণ কখনোই এই জগতে আসতে চাইতো না,প্রবল ঘৃ*ণা করতো। ওর ইচ্ছা ছিল হাইয়ার স্টাডিজের জন্য বিদেশ যাওয়ার। তবে পরিস্থিতির খপ্পরে পড়ে সে-টা আর সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে শুধু আমার কথায় ও রাজি হয় এই ইন্ডাস্ট্রিতে আসতে। কারণ আমি ভেবেছিলাম ব্যস্ত থাকলে হয়তো প্রাণের সমস্যা আসলেই দূর হয়ে যাবে। তবে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। যেহেতু বড়সাহেবের প্রথম বিয়ের কথা কেউ জানতো না সেহেতু প্রাণের ব্যাপারেও কেউ অবগত ছিল না। প্রাণের ডেবিউ করার পর পরই সে সমালোচনার মুখে পড়ে যায়। তখন বড় সাহেব সব সামাল দেন ও প্রাণকে মেহরিমা শিকদারের সন্তান বলেই পরিচয় দেন। প্রাণের যদিও এতে ঘোর আপত্তি ছিল কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে না মেনে উপায়ও ছিল না। এরপর অপছন্দ হলেও পড়ালেখা ছেড়ে অভিনয়কেই নিজের পেশা হিসাবে নিয়ে নেয় ও, আর পিছন থেকে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেন বড় সাহেব। খেয়াল রাখেন প্রাণের উপর যাতে কোন বিপদ-আপদ না আসে। হয়তো বাবা হিসাবে কিছু করতে না পারলেও এইটুকুতেই তৃপ্তি খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। যদিও তিনি জানতেন তিনি প্রাণকে কখনো আপন করে নিতে পারবেন না আর, মেহরিমা দিবে না তাকে এমন করতে। তাই দূর থেকেই যা করার করছিলেন আর মিডিয়ার সামনে পার্ফেক্ট ফ্যামিলি হিসাবে নিজেদের উপস্থাপন করছিলেন। ধীরে ধীরে প্রাণ যাও নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল, জীবনটা উপভোগ করতে শিখছিল ঠিক সেসময় নয়ন ও জেসিকা মিলে ওর পিঠে ছুঁ*ড়ি মারে। পুনরায় চূ*র্ণ*বি*চূ*র্ণ করে দেয় ওকে। বিশ্বাস করতে ভুলে যায় মেয়েটা আমার। কথায় আছে, দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন মেরুদণ্ড শক্ত হয়ে যায়। প্রাণের বেলায়ও ঠিক তাই হয়।”
ছন্দ বলল না কিছু। নীরবে একবার তাকালো ঘুমন্ত প্রাণের পাণে। কতটা না নিষ্পাপ, আদুরে লাগছে তাকে দেখতে। কেই বা বলবে এই মেয়েটা শৈশব থেকে লাঞ্ছিত,উপেক্ষিত হয়ে এসেছে? রাজ্যসম কষ্ট পেয়ে এসেছে? বক্ষঃস্থলে ভার অনুভব হলো ছন্দের। আফসোস করলো, “কেন আগে প্রাণের সাথে তার পরিচয় হলো না? কেন প্রাণের প্রথম অনুভূতি হতে পারলো না? কেন? কেন?”
আশা বেগম ছন্দের দৃষ্টি অনুসরণ করেই প্রাণের দিক তাকালেন। বললেন, “এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি যে এতটা বি*ষা*ক্ত তা আমি আগে বুঝিনি, বুঝলে হয়তো প্রাণের জীবনটা আজ এমন হতো না। দোষ সব আমারই।”
ছন্দ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে তন্ময় কন্ঠে বলল, “নিজেকে দোষারোপ করবেন না, প্লিজ। এখানে আপনার দোষ ছিল না। আপনি তো ইচ্ছে করে প্রাণকে এসবে ঠেলে দেননি, তাই না?”
“জানি কিন্তু তবুও কোথাও যে একটা কিন্তু থেকেই যায়। ও বুঝবে না তুমি। তবে তোমার কাছে আমার একটা চাওয়া আছে।”
“জি বলুন।”
“কথা দিতে পারবে, প্রাণকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখবে? কখনো ওকে একা ছেড়ে যাবে না? যত-যাই হোক না কেন। সবসময় ছায়ার মত পাশে থাকবে?”
ছন্দ নিস্পন্দ রইলো। পুনরায় প্রাণের দিক তাকিয়ে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো, “সে কি পারবে মনোহারিণী কন্যাটাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখতে? পারবে কি রক্ষা করতে?” মন তার সাথে সাথে উত্তর দিল, “পারতে হবেই তাকে। অচিনপুরের এই রাজকন্যাকে নিজের করতে হলে তাকে যদি খলনায়কও হতে হয়, হবে সে। তবুও সামান্যটুকু আঁচ আসতে দিবে না তার গায়ে।”
নিজের মনোভাব পাকাপোক্তভাবে স্থির করে ছন্দ প্রত্যুত্তর করলো, “কথা দিচ্ছি, কখনো আশাহত করবো না আপনাকে।”
আশা বেগম মুচকি হেসে বললেন, “মনে থাকে যেন, ওর সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন শুধু তোমার। আমি বিশ্বাস করে ওকে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখো।”
“আপনার বিশ্বাস আমি কখনো ভাঙাবো না। নিশ্চিন্তে থাকুন আপনি। তবে এখন একটু বিশ্রাম করুন। বিশ্রামের দরকার আছে আপনার।”
ছন্দের কথার বিপরীতে আশা বেগম দূর্লভ হাসলেন। ছন্দ সেদিক খেয়াল না করে আশা বেগমকে অক্সিজেন মাক্স পড়িয়ে দিল। অতঃপর বেরিয়ে গেল কেবিনটা থেকে।
________
সূর্যের স্বর্ণবর্ণা আলোকরশ্মিতে ঝলমল করছে অম্বর। রৌদ্রস্নাত মেঘেরা হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে। দুর্দম বাতাসে নড়ছে জানালার পর্দাগুলো। একটু আগেই ফ্লোর মুছে দিয়ে গিয়েছে কেউ, ফেনাইলের কড়া গন্ধ নাকে এসে বারি খাচ্ছে। প্রাণের ঘুম ভেঙেছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই। উঠে সে ফ্রেশ হয়ে বসলো আশা বেগমের পাশে, একহাত তার শক্ত করে ধরে। আশা বেগম তখন ঘুমোচ্ছিলেন। তিনি উঠলেন আরও ঘন্টাখানেক পড়ে। প্রাণের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে পুনরায় শুয়ে পড়লেন। দূর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি অনেক, বিশ্রামের বেশ প্রয়োজন। প্রাণ তার পাশে বসলো আরও কিছুটা সময়। এরপর ছন্দের কথা মাথায় আসতে বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। বাহিরে এসে তার খোঁজ করলো কিন্তু পেল না। তাই ফোন লাগালো। ফোন রিং হচ্ছে তবে কেউ উঠাচ্ছে না। কয়েকবার ফোন দেওয়ার পরও যখন কেউ ধরলো না তখন প্রাণের কপালে ভাঁজ পড়লো। ছন্দ কখনো এখনো এমন করে না, প্রথম কলেই রিসিভ করে। যার জন্য প্রাণ কিছুটা হলেও চিন্তিত হলো। যৎসামান্য সময়ের পর ছন্দে দেখা পেল সে। চুল গুলো তার বেশ এলোমেলো, নির্ঘুম রাত কাটানোর ফলে ক্লান্তিরা সব উপচে পড়ছে চোখ-মুখ বেয়ে, ঠোঁট দুটো অমসৃণ, রুক্ষ। ফ্যাকাসে দেখাছে মুখশ্রী। পড়নে কুঁচকে যাওয়া টি-শার্ট, ট্রাউজার। তাকে এমতাবস্থায় দেখে প্রাণের বেশ মায়া হলো। সে সাথে, অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ইচ্ছে হানা দিল মস্তিষ্ক জুড়ে। প্রাণ সেসব দ্রুত ডাস্টবিনে ছুড়ে মেরে স্বাভাবিক করলো নিজেকে। আনমনে অবাক হলো নিজের মধ্যে এত পরিবর্তন দেখে। নিজের স্বভাবের বিপরীত স্রোতে সে কখনোই গা ভাসায় না, তবে আজ কেন? নিজেকে প্রশ্ন করার ফাঁকেই ছন্দ তার নিকটে চলে আসে। প্রাণ ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে উঠলো, “কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”
ছন্দ ঈষৎ হেসে বলল, “এইতো কাজ ছিল কিছু।”
প্রাণ অসন্তোষজনক দৃষ্টিতে তাকালো। ছন্দ সেদিক পাত্তা না দিয়ে প্রাণের পাশেই বসে পড়লো। হাতে থাকা খাম থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে বলল, “আপনি যে আমার কাছে এখনো ঋণী আছেন তা মনে আছে কি?”
প্রাণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে ছন্দের দিক তাকালো। বলল, “আছে।”
“তাহলে ধরে নিন আজ আপনার ঋণ পরিশোধ করার সময় চলে এসেছে।”
প্রাণ কিছু একটা ভেবে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “বলুন কি চাই আপনার।”
ছন্দ হাতে ধরে থাকা কাগজগুলা প্রাণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “বেশি কিছু না, শুধু এখানে সাইন লাগবে আপনার। তবে শর্ত এটাই পেপারগুলার লেখা আপনি পড়তে পারবেন না, আর না জিজ্ঞেস করতে পারবেন কিসের কাগজ এগুলা। ঠিক আছে?”
প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। টু শব্দ না করে টান দিয়ে ছন্দের কাছ থেকে কাগজগুলো নিয়ে সাইন করে দিল। অকারণেই তার ছন্দের রাগ হচ্ছিল বেশ। কেন জানি না, স্বার্থপর লাগছিল তাকে। এর কারণ হয়তো অবচেতন মন তার ছন্দকে একটু বেশিই ভালো মনে করে নিয়েছিল। যার জন্য তার এই রূপটা নিতে পারছে না সে। প্রাণ এক নিঃশ্বাসে সাইন করে ছন্দকে কাগজগুলো ধরিয়ে দিয়ে বললো, “আশা করি, আমাদের মধ্যকার সকল হিসাব-নিকাশ শেষ হয়ে গিয়েছে। হলে আপনি এখন আসতে পারেন।”
ছন্দ ফট করে সকল কাগজগুলো নিয়ে প্রাণের সাইন করা জায়গাগুলায় চোখ বুলায়। সব ঠিকঠাক দেখে বিস্তৃত হেসে বলে, “থ্যাংকস আ লট মিস. ল্যাভেন্ডার। ইয়্যু জাস্ট মেড মাই ডে।”
ছন্দের এসব আদিখ্যেতা প্রাণের সহ্য হলো না কেন যেন। রাগ তো তার বহুক্ষণ ধরেই জমেছিল এবার যেন তাতে বাতাস দেওয়া হলো। সে বজ্রগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো, “আসতে পারেন আপনি।”
ছন্দ কথা বাড়ালো না। নৈঃশব্দ্যে উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গেল দরজার কাছে। বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে পিছনে ঘুরে অমায়িক এক হাসি হেসে বললো, “শাদি মুবারক মিস. ল্যাভেন্ডার।”
কথাটা বলে ছন্দ দ্রুত কেটে পড়লো। প্রাণ দরজার দিকেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। বুঝে উঠতে পারলো না ছন্দ বলে গেলটা কি?
#চলবে
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]
[আজ সকলে রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন।]
#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩০
অপরাহ্ণের প্রথমভাগ। তেজস্বান সোনালী রোদ্দুর মিঠে হয়ে এসেছে। নীলাভ অন্তরিক্ষ জুড়ে রঙবেরঙের মেঘ খেলা করছে। আড়ম্বরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। নৈসর্গিক মায়ায় ডুবাতে অজানা এক পাখি কূজন তুলেছে। আবহাওয়া ঠান্ডা রাখতে দুর্দম হাওয়া বহমান। দোল খাচ্ছে নীলবর্ণা পর্দাগুলো। প্রাণ সোফায় পিঠ হেলিয়ে বসেছিল তখন। দৃষ্টি তার জানালার বাহিরে, বিস্তৃত আকাশের দুর্গমস্থানে। কিন্তু মন-মস্তিক নিমজ্জিত অতল ভাবনায়। সকালে হয়ে যাওয়া ঘটনাই পুনর্বিবেচনা করছিল। ছন্দের কাজকর্ম, শেষ উক্তি সব। অবচেতন মন উঠে পড়ে লেগেছে ‘শাদি মুবারক’-এর মানেটা খুঁজতে। সন্দেহের কাটা যদিও এক জায়গায় গিয়েই আটকাচ্ছে কিন্তু তা কতটুকু ঠিক জানা নেই তার। মস্তিষ্ক বলছিল, “ওইটা রেজিস্ট্রার পেপার ছিল।” কিন্তু মন বলছিল বিপরীত কথা। কেন যেন, মন বিশ্বাস করতে চাইছে না ছন্দ তার সাথে ছলচাতুরীও করতে পারে। মন ও মস্তিষ্কের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে বের হতে প্রাণ সকাল হতে অগণিতবার ফোন লাগালো ছন্দকে। কিন্তু ছন্দ মহাশয় না কল তুললেন, আর না কল ব্যাক করলেন। শেষে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে ফোন দিল না আর। থম মেরে বসে রইলো। সে ভেবে কূল পাচ্ছিল না, “যদি কাগজগুলো সত্যি সত্যিই রেজিস্ট্রার পেপার হয়ে থাকে তাহলে কি হবে?” চিন্তায় মাথা ব্যথা করতে শুরু করলো প্রাণের। সে জানে, তার সাথে আর যাই হোক ছন্দের নাম জুড়তে পারে না। তাদের মধ্যে কিছু হওয়া মানেই ভিত্তিহীন। তাই এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইলো না। কিন্তু চাইলেই কি আর হয়? সারাদিনে এক মুহূর্তের জন্যও এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলো না সে। উল্টো চোখের সামনে ভাসতে থাকলো ছন্দের কর্মকাণ্ড গুলো।
এদিকে, দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল হতে চললো অথচ ছন্দের দেখা দেওয়ার কোন নাম গন্ধ নেই। নিরুদ্দেশ কোথায় হলো কে জানে? প্রাণের এসব আকাশ-কুসুম ভাবনার মাঝে জানালার ধারে এসে বসলো একটি দাঁড় কাক। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার দিকেই। অকস্মাৎ দাঁড় কাকটি দেখে প্রাণ থমকালো। মনে পড়লো তার মায়ের কথা, ছোট থাকতে তিনি প্রায়শই বলতেন, “দাঁড় কাক অশুভ হয়। যে দুয়ারে যায় মৃত্যুর খবর বয়ে নিয়ে যায়।”
কথাটা টনক নাড়তেই ভয় হয় প্রাণের। একপলক তাকালো সামনেই শুয়ে থাকা আশা বেগমের দিকে। অতঃপর ত্বরিত গতিতে উঠে জানালার কাছে গেল, হাতের ইশারায় ভাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো৷ প্রাণকে নিকটে আসতে দেখে কাকটি অবিলম্বে কা কা শব্দ করে উড়াল দিল উদ্দেশ্যহীন পথে। প্রাণ এবার থাইগ্লাস লাগিয়ে দিয়ে পর্দা টেনে দিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক চি*রে৷ সকল ভাবনা ছুঁ*ড়ে ফেলে আশা বেগমের পাশে ছোট টুল টেনে বসলো সে। তার খালি হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সন্তপর্ণে ঠোঁট ছোঁয়ালো। এরপর হাতটা গালের সাথে লাগিয়ে রেখে বিরবির করে বলল, “তোমাকে আমি হারাতে পারবো না আশামা। কোনভাবেই না।”
.
সায়াহ্নের অরুণ পশ্চিমাকাশে মিইয়ে যাওয়ার পরমুহূর্তেই ছন্দ এসে হাজির হলো। কেবিনের ভিতর ঢুকতেই দেখতে পেল প্রাণ আশা বেগমের কোমরের পাশে মাথা নুয়ে শুয়ে আছে৷ টুলের উপর বসে থাকার কারণের তার অবস্থা কিছুটা নড়বড়ে। ছন্দ এগিয়ে গিয়ে প্রাণের সন্নিকটে হাঁটু গেড়ে বসলো। একটু ঠেস দিয়ে বসলো যাতে পড়ে না যায় সে। অতঃপর ঘুমন্ত প্রাণকে অনিমেষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো। খুব কাছ থেকে। গভীরভাবে। আদুরে ভাব তার মুখমণ্ডল জুড়ে। সামনের চুলগুলো ছোট থাকায়, ক্লিপ দিয়ে বাঁধার পরও একগাছি চুল হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নেত্রপল্লবের উপরিভাগে। বিরক্ত করছে কিঞ্চিৎ। ছন্দ তাদের সাথেই দুষ্টুমি করতে হালকা ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো তাদের। কিন্তু অবাধ্য চুলগুলো নড়ে উঠার বদলে প্রাণ নড়ে উঠলো। প্রায় সাথে সাথে টুল হতে ভারসাম্য হারালো, তবে পড়ার আগেই সময়মত ছন্দ আগলে নিল তাকে। ঝুঁকে আসলো মুখ বরাবর, মাঝে দূরত্ব বিদ্যমান রইলো এক ইঞ্চি। ঝাঁকুনি খেয়ে প্রাণের ঘুম ছুটে গেল, অর্ধনিভন্ত নয়নে তাকালো সামনে। অর্ধসচেতন মন প্রথমে কিছু উপলব্ধি করতে না পারলেও পরমুহূর্তে ছন্দকে নিজের এত কাছে অনুভব করতে পেরে পিলে চমকে উঠলো। প্রাণ তৎক্ষনাৎ সরে আসতে নিলে ঠুস করে বা*রি খেল ছন্দের মাথার সাথে। দুইজনই একসাথে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “উহ!”
প্রাণ কপালে হাত গিয়ে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলে মেরুদণ্ডে টান অনুভব করলো। সুক্ষ্ম ব্যথাটা নিতে না পেরে আঁখিপল্লব এক করে ঠোঁট কাঁমড়ে ধরলো। পড়ে থাকলো ছন্দের সান্নিধ্য, চেপে ধরলো তার এক বাহু। তখন ওভাবে শুয়ে থাকার কারণেই এমনটা হয়েছে। ছন্দ বিষয়টা বুঝতে না পেরে রসিক কন্ঠে বলে উঠে, “আমার থেকে দূরে যেতে ইচ্ছে করে না বললেই হয়। আমি তাহলে দূরে সরিয়ে রাখি নাকি?”
প্রাণ রূঢ়ভাবে বলে, “শাট আপ।”
ছন্দ প্রাণের খিঁচে থাকা মুখটা লক্ষ করে বলে বুঝলো কোথাও কোন সমস্যা হয়েছে। তাই চিন্তিত হয়ে বলল, “আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে?”
প্রাণ প্রত্যুত্তর করলো না। কিয়ৎক্ষণ লাগলো তার স্বাভাবিক হতে। ব্যথা কমে আসতেই প্রাণ সরে আসলো। এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পিছনে পিঠের মধ্যখানে নিয়ে আস্তে আস্তে বা*রি মারলো। ছন্দ তন্ময় নয়নে সবই পর্যবেক্ষণ করলো, তার আর বুঝতে বাকি রইলো না কি সমস্যা হয়েছে৷ প্রাণ ঘাড় ডান-বামদিক কাঁত করে সোজা হয়ে বসলো। ছন্দের দিকে তী*র্য*ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কি করছিলেন আপনি?”
প্রাণের প্রশ্নে ছন্দ বিচলিত হলো না। ভাবলেশহীনভাবেই উত্তর দিল, “কিছু না তো। আপনি তখন পড়ে যাচ্ছিলেন বলে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলাম।”
প্রাণ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মৌন রইলো। কথা ঘুরানোর জন্য বলল, “সারাদিন কোথায় ছিলেন? ফোন ধরছিলেন না কেন আমার?”
ছন্দ এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “আজব তো! বউয়ের মত তদারকি করছেন কেন? বাই এনি চান্স, আপনার কি আমার বউ হওয়ার ইচ্ছে জেগেছে?”
ছন্দের পাল্টা আ*ক্র*ম*ণে প্রাণ অপ্রতিভ হলো। গোলগাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন।”
ছন্দ ক্ষীণ হেসে বলল, “কথা আমি ঘুরাচ্ছি না-কি আপনি? বিষয়টা এমন হলো না, চোরের মন পুলিশ পুলিশ?”
ছন্দের কথায় প্রাণ যে দমে যাওয়ার পাত্রী তা একদমই না। সে নিজেকে ধাতস্থ করে জিজ্ঞেস করলো, “কে পুলিশ আর কে চোর তা একটু পরই জানা যাবে। তার আগে বলুন, সকালে আপনি আমাকে দিয়ে কোন পেপারে সিগনেচার করে নিয়েছিলেন?”
“আপনি কিন্তু শর্ত ভাঙ্গছেন মিস. ল্যাভেন্ডার। শর্ত অনুযায়ী, আপনি পেপার নিয়ে আমায় কোন প্রশ্ন করতে পারবেন না।”
“আমি কোন পেপারে সাইন করেছি তা জানার অধিকার নেই আমার?”
ছন্দ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপাতত নেই। সময় হলে এভাবেই জানতে পারবেন আপনি।”
প্রাণ কিছুক্ষণ মৌন থাকলো। মনের কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “ওইগুলা কি রেজিস্ট্রার পেপার ছিল? ইয়েস ওর নো।”
ছন্দ পকেটে হাত গুঁজে বলল, “আই ডোন্ট নো।”
প্রাণ নিজেও উঠে দাঁড়ালো, “বাট আই নিড এন্সার।”
ছন্দ প্রাণের দিক এককদম এগিয়ে এসে বাম হাতের তর্জনী উঁচিয়ে আলগোছে তার মুখে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের কাছে গুছিয়ে দিয়ে বলল, “আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, তারপর।”
ছন্দের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে প্রাণ শিউরে উঠলো। পা জমে গেল ওখানেই। গাল জুড়ে ছেঁয়ে গেল র*ক্ত*রে*ণু। কম্পিত কন্ঠে কোনরকম জিজ্ঞেস করলো, “কি প্রশ্ন?”
ছন্দ অপার্থিব হেসে জিজ্ঞেস করলো, “আমার প্রাণেশ্বরী হবেন?”
ছন্দের প্রশ্নে তব্দা খেয়ে গেল প্রাণ। নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কতক্ষণ। প্রশ্নটা তার বোধগম্য হয়েছে ঠিক কিন্তু সে চেয়েও প্রত্যুত্তর করতে পারছে না। কন্ঠলগ্নে মৌনতারা পথ রোধ করে রেখেছে যেন। সহজ প্রশ্নের দুই অক্ষরের উত্তর অথচ কোনভাবেই উচ্চারণ করতে পাচ্ছিল না। অদ্ভুত না?
ছন্দ পুনরায় জিজ্ঞেস করে উঠলো, “ইয়েস ওর নো?”
প্রাণের কিয়ৎকাল নিজের সাথে যুদ্ধ করে অনুভূতি সব নিয়ন্ত্রণ করলো। পা*ষা*ণ হৃদয়ের অধিকারী বুঝাতে ছন্দের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “নো!”
ছন্দ প্রাণের চোখে দৃষ্টি স্থাপন করেই বলল, “এবার আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো, যতদিন না আপনার উত্তর ইয়েস হচ্ছে ততদিন আমিও বলছি না পেপারগুলা কিসের ছিল।”
প্রাণ হতবুদ্ধি তাকালো। স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলল, “মানে কি?”
ছন্দ কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল, “মানে যা বুঝেছেন তাই-ই।”
প্রাণ আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু কেবিনে ডাক্তার ঢুকায় বলতে পারলো না। কথাগুলো কন্ঠবদ্ধ করে ফেললো। ছন্দও এর ফাঁকে বেরিয়ে পড়লো কেবিনটা থেকে৷ এদিকে আশা বেগম এতক্ষণ প্রাণ ও ছন্দের কথোপকথন শুনে হাসছিলেন। প্রশান্ত সেই হাসি।
#চলবে
[কপি করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ।]