#প্রাণেশ্বরী #Writer_Asfiya_Islam_Jannat #পর্ব-২৭+২৮

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৭+২৮

“প্রাণপাখি! প্রাণপাখি! লেভিউ।”

টিয়াটার কথা বোধগম্য হতেই প্রাণের চোখ দুটো গোলগাল হয়ে আসে, অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। অধরযুগলে সৃষ্টি হয় কিঞ্চিৎ দূরত্ব। তোতাপাখিটা একটু থেমে আবারও বলে উঠে, “প্রাণপাখি! লেভিউ!”

প্রাণের এবার বিষম খাওয়ার মত অবস্থা। সে কস্মিনকালেও ভাবেনি এমনভাবে কেউ এরকম কোন বার্তা পাঠাতে পারে। তাও আবার ছন্দের মত কেউ?বিষয়টা তার কোনভাবেই হজম হচ্ছে না। এটা কি আসলেই কোন প্রপোজাল ছিল নাকি প্র‍্যাঙ্ক? তার ভাবনার মাঝেই আশা বেগম এসে পাশে দাঁড়ান। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “ওমা! এটা তোকে আবার কে দিল?”

আশা বেগমের প্রশ্নের বিপরীতে প্রাণ কিছু বলার পূর্বেই তোতাপাখিটা পুনরায় নিজের বাণী বলে উঠে৷ আশা বেগম এবার আশ্চর্যান্বিত নয়নে তাকান, “পাখিটা কি তোকে আই লাভ ইউ বললো?”

ক্ষণেই প্রাণের গাল দুটো আ’র’ক্ত হয়ে উঠে। থতমত খেয়ে বলে, “তাই তো লাগে।”

আশা বেগম ঈষৎ হেসে কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন, “তোকে এত সুন্দর করে প্রস্তাব দিল কে?”

প্রাণ কথা বলে না। বাহির দিয়ে তাকে শান্ত দেখালেও ভিতরে প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার। নেত্রযুগল কয়েকবার বিরতিহীন ঝাপটে শুষ্ক-রুক্ষ ঠোঁট দুটো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নেয়। হঠাৎ করেই গলা শুকিয়ে আসছে কেন এত? এমনটা তো হওয়ার কথার না। উপরন্তু ছন্দ বলেছিল, সে তার মায়া পড়বে না। তাহলে এসব কি? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না সে। তবে তার মধ্যকার অনুভূতি বেশ এলোমেলো। কখনো রাগ লাগছে আবার লাগছে না। কখনো আবার অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। যতবারই টিয়াটি তার নাম ধরে ডাকছে ততবারই হিম শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ জুড়ে। শান্ত মন হয়ে উঠছে অশান্ত৷ সে বুঝে উঠতে পারছে না হচ্ছেটা কি তার সাথে। এদিকে প্রাণকে কথা বলতে না দেখে আশা বেগম তার কাঁধে হাত রেখে বলেন, “মামনি, বললি না তো কে দিয়েছে।”

প্রাণ এবার বাধ্য হয় বলতে। মিনমিনে কন্ঠে বলে, “ছন্দ!”

আশা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকান। তবে ফের কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই প্রাণ উঠে পাখির খাঁচাটা নিয়ে রুমের দিক চলে যায়। আশা বেগম তার যাওয়ার পাণে তাকিয়ে মুচকি হাসেন। মেয়েটা তার পুনরায় নাজুক হচ্ছে বুঝি?
.
রুমে এসে প্রাণ ছন্দকে ফোন দেয়। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ছন্দ ফোন রিসিভ করে। প্রাণ কোন ভণিতা না করে জিজ্ঞেস করে, “এসব কি মি. তুরহান?”

ছন্দ হতবাক কন্ঠে বলে, “কিসব কি?”

প্রাণ অতি শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”পাখিটাকে কি শিখিয়েছেন আপনি?”

ছন্দ সংশয়িত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কোন পাখি?”

প্রাণের ভ্রু কুঁচকে আসে এবার, “একটু আগে যে টিয়াপাখি পাঠিয়েছেন সে-টা।”

ছন্দ হতাশাগ্রস্ত কন্ঠে বলে, “ওইটা আজ ডেলিভারি করে দিয়েছে তারা? আমি তাদের এতবার করে বললাম পরশুদিন যেন ডেলিভারিটা দেয়, তাও আগে কেন দিল? ”

“দিয়েছেন কেন?”

ছন্দ একটু থেমে বলে, “পরশু আপনার বার্থডে তাই, সেই উপলক্ষে দিয়েছিলাম। চেয়েছিলাম সারপ্রাইজ দিতে কিন্তু পারলাম না। যাই হোক, হ্যাপি বার্থডে ইন অ্যাডভানস মিস. ল্যাভেন্ডার।”

ছন্দের কথা শুনে প্রাণ থমকায়। পরশু তার জন্মদিন? তারিখ কি আজ? প্রশ্নটা মনের মাঝে আসতেই ফোনটা কান থেকে নামিয়ে তারিখে চোখ বুলায় সে। সত্যি তাই। পরশু তার জন্মদিন অথচ তারই মনে নেই। কি অদ্ভুত! যদিও এ নতুন কিছু না। কোন বারই তার নিজের জন্মদিন মনে থাকে না, বাকি আট-দশটা দিনের মতই ওইদিনও ব্যস্ততার মাঝে কাটিয়ে দেয় সে। অতঃপর যখন তারিখের দিকে নজর যায় তখন বোধ হয় আজ তার জন্মদিন। কখনো আবার হয়ও না। চলে যায় দিন। আর মনে থাকবেই বা কিভাবে? এইদিনটা সেভাবে কখনো উৎযাপনই করা হয়নি তার। এমনকি কেউ জানেও না তার জন্মদিন কবে। সোশ্যাল সাইটের কোথাও উল্লেখও নেই। জানায়নি কখনো। যদিও নয়ন,জেসিকা পর্যন্ত জানতো কিন্তু ব্যস্ততার মাঝে প্রায় ভুলে যেত। দুই-তিন গড়িয়ে যাওয়ার মনে পড়তো তাদের, তখন দু-চারটে গিফট নিয়ে এসে সরি বলে দিত। তবে ছন্দ কিভাবে জানলো, জানা নেই তার। কিন্তু জিনিসটা তার হৃদয়ের দুয়ারে কড়া নেড়ে গেল যেন। এভাবে কখনো কেউ তাকে সারপ্রাইজ করেনি বা করার কথা ভাবেনি তাই বলে হয়তো।
প্রাণ নিজেকে ধাতস্থ করার পথে পাখিটি কথা বলে উঠে। সেটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র কোমল তুলতুলে মনটায় পুনরায় ক্রোধের প্রদীপ ধপ করে জ্বলে উঠে। সে তী’ক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি শিখিয়েছেন পাখিটাকে?”

ছন্দ দ্বিধাজড়িত কন্ঠে বলে, “আপনার নাম কেন?”

প্রাণ থমথম মুখে স্পিকার বাড়িয়ে দিয়ে মোবাইলটা পাখির সামনে ধরে, কিয়ৎক্ষণ নীরবে কেটে যাওয়ার পর প্রাণ তী’র্য’ক দৃষ্টিতে তাকাতেই পাখিটি কথা বলে উঠে, “প্রাণপাখি! লেভিউ!”

টিয়া কথা বলা শেষ করতেই প্রাণ বলে উঠে, “তাহলে এটা কি? হাও উইল ইয়্যু এক্সপ্লেইন টু মি নাও?”

ছন্দের অভিব্যক্তি ক্ষণে বদলে যায়। বিস্মিত কন্ঠে বলে, “বিশ্বাস করুন আমি এটা শিখাইনি। আমি আপনার নাম আর ল্যাভেন্ডার বলা শিখাতে চেয়েছিলাম। তবে টিয়া আপনার নাম বলতে পারলেও ল্যাভেন্ডার বলতে পারিনি। অনেক কষ্টে শুধু ‘লেভে’ পর্যন্ত শিখাতে পেরেছিলা তবুও আধা-আধুরা। তাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। মাঝখান দিয়ে ও ‘লেভিউ’ বলা কিভাবে শিখলো জানি না। আই সোয়ের!”

ছন্দের কথাগুলো যুক্তিগ্রাহ্য ঠেকে প্রাণের নিকট। ‘ল্যাভেন্ডার’ উচ্চারণের সাথে পাখিটার বলার ধরণটা বেশ মিল আছে। পাখিটাই হয়তো নামটা উচ্চারণ করতে গিয়ে বি’কৃ’ত করে ফেলেছে। যার জন্য দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন আসে না মস্তিষ্কে। প্রাণ স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “আচ্ছা।”

“আই সোয়ের আমি ওই শব্দটা ওকে শিখাইনি।”

“বিশ্বাস করছি আমি আপনার কথা।”

ছন্দ কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু এর আগেই আশপাশ থেকে সুমধুর এক ধ্বনি ভেসে আসে। মেয়েলী কন্ঠে কেউ এনাউন্সমেন্ট দিচ্ছে। অকারণেই প্রাণ তা মনোযোগ দিয়ে শুনে, বুঝতে পারে ছন্দ এয়ারপোর্টে বসে। এনাউন্সমেন্ট শেষ হতেই ছন্দ বলে উঠে, “থ্যাংকস! বাট আমি আপনার সাথে পরে কথা বলছি। আমার ফ্লাইটের টাইম হয়ে যাচ্ছে।”

অকস্মাৎ প্রাণ জিজ্ঞেস করে উঠে, “কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”

প্রশ্নটা করে প্রাণ নিজেই আহাম্মক বনে যায়। অকারণে প্রশ্ন করা তার স্বভাববিরোধী। অথচ আজ সেই বিধি ভঙ্গ হয়ে গেল। ছন্দ মৃদু হেসে বলে, “নিউজিল্যান্ড! এবারের ম্যাচ ওখানে।”

প্রাণ ছোট করে ‘অহ’ বলে মৌন হয়ে গেল। ছন্দ নিজ থেকেই বলল, “বাংলাদেশে থাকবো না বলেই গিফটটা কুরিয়ার করা। সামনা-সামনি দিলে হয়তো এত গড়বড় হতো না। মাই ব্যাড!”

প্রাণ বলতে চাইলো কিছু, কিন্তু মৌনতারা কণ্ঠনালি আড়ষ্ট করে ফেলায় পারলো না। পিছন থেকে ছন্দের ডাক পড়তেই ছন্দ পুনরায় তাকে উইশ করে কল কেটে দেয়। প্রাণ কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে খাঁচার ভিতর বন্দী প্রাণীটার দিক তাকায়। কিছু একটা ভেবে উঠতেই তার ঠোঁটের কোণ আপনা-আপনি প্রসারিত হয়ে যায়।
.
ফ্লাইট ট্যাক অফ করতেই ছন্দ সিটের পিছনে মাথা হেলিয়ে দেয়। আঁখিপল্লব দুটো এক করে বিরবির করে বলে উঠে, “অবুঝ প্রাণীটাও আমার মনের কথা বুঝে গেল অথচ আপনি পারলেন না মিস. ল্যাভেন্ডার। আপনি শুধু আমার মিথ্যে শব্দগুলোই বিশ্বাস করে গেলেন।”

______

নয়ন নিখোঁজ আজ একমাস ধরে। রাতারাতি একটা মানুষ এভাবে উধাও কিভাবে হয়ে গেল জানা নেই কারো। প্রাণ নিজেও খোঁজ চালানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু তেমন একটা লাভ হয়নি। তবে সে আঁচ করতে পেরেছিল নয়নের নিখোঁজের কারণ, তাই বিষয়টা নিয়ে আর ঘাটেনি। নয়নকে নিয়ে সে আর দ্বিতীয় কোন ভাবনা ভাবতে চায় না। এদিকে নয়নের বাবা-মা পুলিশে জিডি করেছেন ঠিক কিন্তু কোন খোঁজ পাননি। উপরন্তু, খুব আশ্চর্যজনকভাবেই তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে এলো। দেউলিয়া হওয়ার পথে এমন। যার দরুণ টাকা দিয়ে বা পাওয়ার দিয়ে যে নিজের ছেলের খোঁজ চালাবেন তা আর সম্ভব হয়ে উঠলো না। যদিও এ নিয়ে বেশ কন্ট্রোভার্সি তৈরি হলো। প্রাণকে টানা হলো মাঝে। ধারণা করা হলো, প্রাণ হাত আছে এতে। কেন না, বর্তমানে নয়নের সবচেয়ে বড় শ’ত্রু সেই-ই। তবে এসব বেশিদিন চললো না। এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি থেকে এভাবেই প্রতিনিয়ত শতশত মানুষ হারিয়ে হয়ে যায়, আড়ালে-আবডালে। দুই-একদিন সবাই খোঁজ নিলেও সময়ের স্রোতে সাথে সাথে সবই ভুলে যায় মানুষ। এবারও তাই হলো। ঘটনা পুরোনো হতেই ভুলে গেল সবাই নয়নকে, মাতামাতি শুরু হলো অন্য কোন এক নিউজ নিয়ে। তাই হয়তো বলা হয়, “সময়ে সাথে মানুষও ফুরায়।”
.
.
আষাঢ়দিনের মত ঘন বাদল জমছে আসমানে। নিকষকৃষ্ণ আঁধার নেমেছে ধরিত্রীর বুকে। তীব্র বেগে বন্য হাওয়া ছুটছে। ফুল-লতাপাতা আঁচড়ে পড়ছে একে অপরের গায়ে, শুকনো পাতা সব ঝরঝর করে পড়ছে। পায়ের তলায় পিষতেই গুড়িয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ধারে, ল্যাম্পপোস্টের হরিদ্রাভ আলো প্রায় নিভু নিভু হয়ে এসেছে। যেকোন মূহুর্তে ই’ন্তে’কা’ল করতে পারে। নিচেই বে’ও’য়া’রি’শ কু’কু’র দুটো বিরতিহীন ঘেউ ঘেউ শব্দ করে চলেছে। ফাঁকে ফাঁকে প্রশ্রয় দিতে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠছে মেঘদূত। প্রাণ এমন পরিবেশ দেখে বিরক্তবোধ করলো। বৃষ্টি তার জীবনের চরম শ’ত্রু। সে সাথে এমন পরিবেশও। তার মতে, বৃষ্টি নামে সর্বদা অ’শু’ভ কিছু ঘটাতে। সুখকর এতে কিছুই নেই। তবে কে জানতো তার ধারণা পুনরায় সত্য হতে চলেছে?

কক্ষে বন্য হাওয়ারা হানা দিতেই প্রাণ বারান্দার দরজা ও জানালা লাগিয়ে দেয়। এসি ছেড়ে অরেঞ্জ ফ্রেগ্রেন্সে এয়ার ফ্রেশনার চারদিকে স্প্রে করে বিছানায় গিয়ে বসে। কোলে ল্যাপটপ নিয়ে কি-বোর্ডেে আঙ্গুল চাপতে থাকে, বহুদিন পর মুভি দেখার ইচ্ছে জেগেছে। তাই খুঁজছে। স্লাইডিং ডোরের পাশেই টিয়াপাখিটি ডানা ঝাপটাচ্ছে। মাঝে-সাঝে হুট করে সেই চিরচেনা বুলি আওড়ে উঠছে। সপ্তাহ খানেক লাগিয়ে প্রাণ কত চেষ্টা করলো তাকে এই কথা ভুলিয়ে নতুন কথা শিখাতে কিন্তু টিয়া মশাই বাধ্য হলে তো? সে কিছুতেই ‘লেভিউ’ শব্দটি ভুলতে রাজি না। কোন মধু মিশে আছে শব্দটিতে কে জানে? অবশেষে না পেরে প্রাণ হাল ছাড়লো।

মুভি দেখার এক ফাঁকে আশা বেগম এক কাপ কফি নিয়ে আসেন। তিনি প্রাণের পায়ের কাছে বসে কাপটা এগিয়ে দিতেই প্রাণ বলে, “তোমার না পায়ে ব্যথা? তাহলে এত দৌড়াদৌড়ি করছো কেন?”

“সার্ভেন্ট সবাই ছুটিতে, তো তোর কফি কে আনতো? হুম?”

প্রাণ ল্যাপটপের স্ক্রিন নামিয়ে বলে উঠে, “আমার দরকার পড়লে আমি নিজে করে নিতাম। তুমি কেন কষ্ট করতে যাও বল তো? রাতে খাবারের সময় মনে করে ঔষধ খেয়ে নিবে, নাহলে ব্যথায় সারারাত ঘুমাতে পারবে না।”

আশা বেগম প্রাণের মাথায় আদরমাখা হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, “তোর জন্য এইটুকু করতে আমার কোন কষ্ট হয় না মামনি। আমি, আমার ভালো লাগা থেকেই সব করি।”

প্রাণ কাপটা নিয়ে সাইড টেবিলে রেখে আশা বেগমকে পাশ দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে, “আই লাভ ইউ আশামা।”

আশা বেগমও প্রাণকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “আই লাভ ইউ টু।”

শীতল, তরল কিছু উপলব্ধি হতেই প্রাণ আশা বেগমের দিক তাকিয়ে বলে, “এসি রুমে এভাবে ঘামছো কেন তুমি?”

আশা বেগম নিজের অস্বাচ্ছন্দ্য ভাব লুকাতে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলেন। আঁচল টেনে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেন, “রান্নাঘর থেকে আসলাম না মাত্র? ওইটার জন্যই হয়তো।”

প্রাণ দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করার আগেই আশা বেগম অস্ফুটস্বরে বলেন, “তাড়াতাড়ি কফিটা খেয়ে নে, ঠান্ডা হয়ে যাবে নাইলে। আমি একটু আসছি।”

প্রাণ মাথা দুলিয়ে সড়ে আসলো। আশা বেগমও কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো ঠিক তখনই। অকস্মাৎ তার মাথা ঘুরে উঠলো, চোখের সামনে ছেঁয়ে গেল অন্ধকার। এতক্ষণ তার ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি লাগলেও এবার বুকের বা-পাশটা ব্যথা করে উঠলো। দুঃসহ সেই ব্যথা। কিছু বুঝে উঠার আগাই জ্ঞান হারালেন তিনি, লুটিয়ে পড়লেন মার্বেল টাইস করা মেঝেতে। শব্দ হলো। নিস্তব্ধ রুমে শোনা গেল তীব্রভাবে। প্রাণ চমকে উঠলো, পাশ ফিরে আশা বেগমকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে তার পুরো দুনিয়া ঘুরে গেল যেন। হাতে থাকা কাপটা পড়ে গেল মেঝেতে, শত খ’ণ্ড’বি’খ’ণ্ড হয়ে। প্রাণ কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে “আশামা” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। লাফিয়ে নামলো বিছানা থেকে, যার দরুণ বড় এক কাঁচের টুকরো আড়াআড়িভাবে বিঁধে গেল তার পায়ে। মুহূর্তে এক ফিনকি র’ক্ত বেরিয়ে আসলো পা গড়িয়ে। সাদা পাপোশটি ভিজে গেল লহু কণিকায়। পরক্ষণেই আ’র’ক্তি’ম দেখালো। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠার বদলে সে একটানে পা থেকে কাঁচটা বের করে ছুটে গেল আশা বেগমের দিকে। তার কাছে গিয়ে তার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে প্রাণ অনবরত “আশামা” বলে ডাকতে থাকলো। দিগ্বিদিক ভুলে বদ্ধ উ’ন্মা’দে’র ন্যায় আচরণ করতে থাকলো। কাজলবিহীন টানা টানা চোখ দুটো হতে টুপ টুপ করে গড়িয়ে পড়লো অজস্র অশ্রুকণা, ভিজে গেল আশা বেগমের মুখশ্রী। তবুও কোন পাঠপ্রতিক্রিয়া দেখালেন তিনি। প্রাণের চি’ৎ’কা’র, আ’র্ত’না’দ সব ভাসতে থাকলো শূন্য রুম,বাড়ি জুড়ে। কিন্তু কোথাও যে কেউ নেই, শুনবে কে এই আ’র্ত’না’দ? ঘুরে-ফিরে যে ফিরবে সব তার সান্নিধ্যেই।

#চলবে

[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]

[আগেই জানিয়েছিলাম আজও গল্প দিতে পারবো না। তবে কিছু পাঠকের অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখে তাদের অপেক্ষায় রাখতে ইচ্ছে হলো না। কষ্ট হলেও লিখে ফেললাম। এবার মন্তব্য করার পালা আপনাদের। ভালোবাসা অফুরন্ত রইলো❤️]
#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৮

ঘড়ির কাটা তখন একের ঘরে পদার্পণ করেছে। বাহিরে নেমেছে ধ্বং’স’লী’লা ঝড়, বায়ুমন্ডলের চাপ ঊর্ধ্বশ্বাসে। রাস্তার ধারে পানি জমেছে গোড়ালি সমান। কয়েকটি গাছ-পালা ইতোমধ্যে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। প্র’ল’য়’ঙ্কা’রী পরিবেশ অথচ কেমন নিস্তব্ধ, নির্জীব, অসাড় লাগছে। তিমির ঘনিয়ে এসেছে, জনমানবশূন্য চারদিক। কেবিনের ভিতর রাখা ছোট সোফায় বসে আছে ছন্দ। তার কাধেই নিষ্প্রাণ অবস্থায় শুয়ে আছে প্রাণ। ডান পায়ে মোটা ব্যান্ডেজ, নিচে দিকে হালকা ভিজে। শুভ্র কাপড়ের ওপর র’ক্ত রেণুর গাঢ় ছাপ। রুমের বাতি নিভানো। দরজার মধ্যস্থলে চতুর্ভুজ আকৃতির ছোট কাঁচ, সেখান হতে মিছে মিছে আলো এসে ঠিকড়ে পড়ছে মেঝেতে। দৃষ্টির সামনে হসপিটাল বেডে শুয়ে আছেন আশা বেগম। মুখে অক্সিজেন মাক্স ঝুলানো, হাতে কেনোলা পড়ানো। ছন্দ এক হাত দিয়ে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিল। অর্ধনিদ্রিত নয়নে তাকালো প্রাণের ক্লান্তি ভরা মুখের দিকে। মসৃণ গালে ক্রন্দনের দাগ স্পষ্ট। দীর্ঘ সময় ধরে কান্না করার ফলে আঁখিপল্লবের কোণে ছোট ছোট অশ্রুকণা জমে আছে। ধূসর আলোয় চিকচিক করছে। ছন্দ হাতের তর্জনী উঁচিয়ে খুব সন্তর্পণে তা মুছে দিল। একহাতে প্রাণকে আগলে সোফার পিছে মাথা হেলিয়ে আঁখিপল্লব দুটো এক করে নিল। আকস্মিক মনের মাঝে হানা দেয় ঘন্টাখানেক আগের ঘটনা।

ছন্দ তখন টিভিতে তার বিগত ম্যাচগুলো অবজার্ভ করছিল। কোথায় কে কোন ভুল করেছে, তার এবং সকলের মধ্যে কি কি ইম্প্রুভমেন্ট দরকার এসব দেখার জন্য৷ তিনদিন আগেই নিউজিল্যান্ডে টেস্ট ম্যাচ খেলে দেশে ফিরেছে সে, কয়েকটা ম্যাচে পারফর্মেন্স তাদের একবারেই খারাপ ছিল। যার জন্য ছন্দ ভুল সব পরিলক্ষিত করতেই বসেছিল, যাতে পরবর্তীতে সেগুলো আর না হয়। ঠিক সেসময় প্রাণের কল আসে তার ফোনে। ছন্দ খানিকটা ভড়কায়, কেন না প্রাণ বিনাকারণে তাকে কখনোই কল করে না। তাদের পরিচয়ের এতদিনে প্রাণ নিজ থেকে শুধু একবারই ফোন করেছিল। তাই তার ভয় হলো, খারাপ কিছু ঘটেনি তো? সে ফোন রিসিভ করতেই প্রাণ তাকে সব খুলে বলে এবং সাহায্য চায়। কথা বলার সময় তার কন্ঠ বারবার জড়িয়ে আসছিল। প্রাণের কথা শুনে সে কোনপ্রকার দ্বিরুক্তি না করে কোনরকম গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে বিশ মিনিটের মধ্যেই তার বাসায় গিয়ে হাজির হলো। ছন্দ পুরো রুমে রক্ত জানতে চাইলো অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়নি কেন? তখন প্রাণ জানায়, ঝড় বৃষ্টির জন্য তারা এখন আসতে পারবে না, দেরি হবে। ছন্দ একবার প্রাণের মুখপানে তাকায়। কতটা করুণ দেখাচ্ছে তাকে। কাঁদার ফলে চোখ দুটো ফুলে আ’র’ক্ত দেখাচ্ছে। সে আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত আশা বেগমকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পরে। তার পিছে পিছে প্রাণও ছুটে। অতঃপর দুইজনে মিলে আশা বেগমকে সবচেয়ে নিকটবর্তী যে প্রাইভেট হসপিটাল পায় সেটাতেই এডমিট করে ফেলে। এরপর সম্পূর্ণ চেকাপ করা শেষে ডাক্তার জানায়, আশা বেগম মেজর হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি হার্টের সমস্যায় ভুগছিলেন। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের অভাব ও সময়মতো ঔষধ সেবন না করায় অবস্থা আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। আপাতত তিনি বিপদমুক্ত, বিশ্রাম নিচ্ছেন। তবে আজ তাকে আনতে আরেকটু দেরি করলে হয়তো বিষয়টা হাতের বাহিরে চলে যেত।
কথাটা শোনার পর ছন্দ একটু শান্ত হয়। প্রাণও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মাত্রাতিরিক্ত ব্লিডিং-এর কারণে মাথা চক্কর দিয়ে উঠে তার, দূর্বল হয়ে পড়ে শরীর। সে বেসামাল হাত ছন্দের হাত শক্ত করে ধরে, নিজেকে সামলে উঠার পূর্বেই ঢলে পড়ে ছন্দের বুকে। ছন্দ দ্রুত তাকে সামলে নেয়, বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় প্রাণের দিকে। হঠাৎ নিচের দিকে নজর যেতেই সরু র’ক্তে’র ধারা দেখতে পায় সে। ক্ষণেই চমকে উঠে। বক্ষপট দুমড়ে মুচড়ে উঠে যেন। গলা শুকিয়ে আসে বারংবার। প্রাণ যে এতটা সময় ধরে আ’হ’ত অবস্থায় ছিল খেয়ালই করেনি সে। মুহূর্তেই অপ্রীতিকর ভাবনা ভর করে মস্তিষ্ক জুড়ে। তৎক্ষনাৎ বিমর্ষচিত্তে নার্সকে ডেকে উঠে সে, যথাক্রমে তার চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থাও করে। অতঃপর প্রাণের জ্ঞান ফিরার পর সে স্থির থাকতে চাইলো না, আশা বেগমের নিকট যাওয়ার জন্য পাগলামি করতে থাকলো। ছন্দ তখন বাধ্য হয়েই তাকে ধরে কেবিনে নিয়ে আসে। প্রাণ আশা বেগমকে পলক ভরে দেখে ক্ষান্ত হয় যেন। ছন্দ এরপর তাকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়ে। এদিকে প্রাণ অপেক্ষা করে কখন তার আশামায়ের ঘুম ভাঙবে। কিন্তু তার শরীর প্রচন্ড দূর্বল থাকায় সে ছন্দেত কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে। ছন্দ প্রথমে ইতস্তত করলেও পরবর্তীতে প্রাণকে আগলে নেয়। তার মধ্যকার ঝড় ততক্ষণে শান্ত হলো যেন।

হঠাৎ কিছু শব্দ পেয়ে ছন্দ চোখ খুলে তাকালো। আশা বেগমকে নড়াচড়া করতে দেখে ছন্দ প্রাণকে নিজের কাছ থেকে আলতো করে সরিয়ে নিল। আলগোছে শুয়ে দিল সোফাতে, খেয়াল রাখলো তার ঘুমে যাতে সামান্যটুকু ব্যাঘাত না ঘটে। প্রাণকে ঠিকমতো শুয়ে দিয়ে ছুটে যায় নার্স ডাকতে। আবছা দৃষ্টিতে আশা বেগম সম্পূর্ণ বিষয়টাই খেয়াল করলেন। অকারণেই শান্তি অনুভব করলেন বক্ষে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন নার্স এসে চেকাপ করতে, সব নরমাল আছে দেখে নার্সটি ছন্দকে চিন্তামুক্ত থাকতে বলে বেরিয়ে গেল। ছন্দ পাশেে পড়েে থাকাা টুলটাা টেনেে আশাা বেগমেরর সামনেে বসেে বলল, “এখন ভালো লাগছে আন্টি?”

আশা বেগম মাথা দুলালেন। ছন্দ বলল, “যাক আলহামদুলিল্লাহ! আচ্ছা, আমি প্রাণকে ডেকে দিচ্ছি৷ তিনি অনেকক্ষণ ধরে আপনার জাগার অপেক্ষায় ছিলেন।”

আশা বেগম ধীরগতিতে হাত উঁচিয়ে ছন্দকে থামালেন। অক্সিজেন মাস্কটা খুলে বললেন, “জাগিও না। ঘুমাক ও।”

ছন্দ চিন্তিত কন্ঠে বলল, “আপনি মাস্ক খুলবেন না। এতে সমস্যা হতে পারে।”

আশা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “কিছু হবে না। এমনেও আমার কিছু জানানোর আছে তোমায়।”

ছন্দ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি আন্টি?”

আশা বেগম একটু থেমে জিগ্যেস করলেন, “প্রাণকে পছন্দ কর তুমি?”

আশা বেগমের প্রশ্ন শুনে ছন্দ কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। বাক্যহারা হলো যেন। নিজের দৃষ্টি লুকাতে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকলো। গ্রীবাদেশে হাত গলিয়ে ইতস্তত কন্ঠে বলল, “না মানে আন্টি……হ্যাঁ।”

এনিয়ে-বিনিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলো ছন্দ। আশা বেগম কিঞ্চিৎ হেসে বললেন, “আগলে রাখতে পারবে ওকে আজীবন?”

ছন্দ মাথা নত করে বলল, “চেষ্টা করবো।”

আশা বেগম নিদ্রাবিষ্ট প্রাণকে একবার পরোক্ষ করে বললেন, “প্রাণকে আগলে রাখা কোন মুখের কথা না। ওকে দেখতে স্বাভাবিক লাগলেও আদৌ কিন্তু ও স্বাভাবিক না।”

ছন্দের কপালে ভাঁজ পড়লো এবার, “মানে?”

“বলছি। তবে তার আগে তোমায় ওর সম্পর্কে জানতে হবে। হয়তো এর মাঝেই তুমি তোমার মনের সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।”

“আমি শুনছি আপনি বলুন।”

আশা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, “একটা ফুল কিন্তু এভাবেই ম’রে যায় না। দীর্ঘদিন অযত্ন,অবজ্ঞা,অবহেলা করার ফলেই কিন্তু সে একসময় ঝরে পড়ে৷ ত্যাগ করে দেয় জীবনের মায়া। প্রাণের জীবনটাও ঠিক তেমনই। ছোট ফুল ছিল সে, যার সুবাসে ঘর-বাড়ি মুখরিত থাকতো। তবে অনাদর, উপেক্ষার সাগরে তলিয়ে সেও হয়ে যায় মৃ’ত।”

ছন্দ ভ্রু কুঁচকে তাকালো, “একটু পরিষ্কার করে বলবেন বিষয়টা?”

“হুম! গল্পটা শুরু হয় আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে। বড় সাহেব মানে নিহাল শিকদার তখন টগবগে যুবক। ডিরেক্টর হওয়ার তার স্বপ্ন ছিল ছোট থেকেই, তাই সে সময়টা তিনি রাত-দিন জেগে নিজের স্বপ্নের পিছনেই ছুটছিলেন। তার বাবা শিমুল শিকদার ছিলেন তখনকার আমলের প্রভাবশালী লোক। যার জন্য নিজের বাবার পরিচয় ব্যবহার করেই বড় সাহেব সফলতার সিড়ি চড়ছিলেন। এমন সময় শিমুল শিকদার মানে বড় কর্তা হুমায়রা নামের একটা মেয়ে পুত্রবধূ হিসাবে খুব পছন্দ হয়। তার বন্ধুর মেয়ে ছিল সে। যাওয়ার-আসার সময় দেখেছিলেন কয়েকবার তিনি। হুমায়রা আপা ছিলেন রূপে-গুণে অনন্যা, সে সাথে তাদের অবস্থাও বড় কর্তাদের মতই ছিল। তাই বড় কর্তা দেরি না করে কথা পাকাপাকি করে ফেলেন। বড় সাহেবকে এ বিষয়ে জানালে তিনি প্রথমে নাকচ করে দেন কিন্তু হুমায়রা আপার ছবি দেখার পর মন বদলে যায় তার। তিনি রাজি হয়ে যান বিয়েতে। তবে শর্ত দেন যে, বিয়ের কথা বাহিরের মানুষ যাতে না জানে। বিয়ের কথা জানাজানি হলে নাকি তার ক্যারিয়ারে প্রভাব পড়বে। সময় হলে তিনি নিজ থেকেই সবাইকে সবটা জানিয়ে দিবেন। বড় কর্তা প্রথমে রাজি হন না, একমাত্র ছেলের বিয়ে তিনি বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষে বড় সাহেবের জেদ দেখে তিনি তার কথায় রাজি হয়ে যান। হাতেগণা কয়েকজন আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে ঘরোয়াভাবেই বিয়ে হয় বড় সাহেব আর হুমায়রা আপার। বিয়ের কয়েকমাস পর বড় সাহেব কাজের জন্য হুমায়রা আপাকে নিয়ে অন্য জায়গায় বাড়ি নেন। এরপর সেখানেই তারা থাকতে শুরু করেন। তাদের বিয়ের তিন বছরের মাথায় প্রাণের জন্ম হয়। এই পর্যন্ত সব ভালোই যাচ্ছিল। বড় সাহেব প্রচন্ড ভালোবাসতেন নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে। জা’ন দিয়ে দেন এমন। কিন্তু প্রাণের যখন চার বছর তখন চিত্রটা বদলে যায়। কোন এক কারণে বড় সাহেব ও হুমায়রা আপার মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। নিত্যদিনই ঝগড়া লেগে থাকতো তাদের মাঝখানে। মাঝে মধ্যে বড় সাহেব হাত তুলতেন হুমায়রা আপার উপর। এসবই প্রাণ পর্দার আড়ালে দেখতো। প্রাণ ছোট থেকেই প্রচন্ড চঞ্চল ছিল, এদিক-সেদিক ঘুরে বেরানো ওর অভ্যাস ছিল। তবে বাবা-মায়ের মাঝে মনোমালিন্য তাকে গুটিয়ে যেতে বাধ্য করে। হুমায়রা আপা তখন একটু শান্তি পেতে প্রাণকে নিয়ে ঢাকার বাহিরে চলে যেতেন। ঘুরে ফিরে আবার চলে আসতেন। যদিও মেয়েরা বাবার ভক্ত বেশি হয়ে থাকে তবে প্রাণ ছিল মা ভক্ত। মায়ের আঁচল সে কোনভাবেই ছাড়তে চাইতো না। সবসময় তার পিছু পিছুই ঘুরতো। তাই হুমায়রা আপাও কখনো ওকে একা ফেলে যেতেন না।
এর মাঝে প্রাণের যখন পাঁচ বছর তখন হুমায়রা আপার ক্যান্সার ধরা পড়ে। থার্ড স্টেজে ছিলেন তিনি তখন। ব্যাপারটা জানাজানি হতেই বড় সাহেব সকল ব্যবস্থা করেন তার চিকিৎসার। এমনকি ইন্ডিয়াও নিয়ে যান চিকিৎসার জন্য। কিন্তু লাভ হয় না। এদিকে প্রাণ সবই নীরবদর্শকের ন্যায় দেখছিল। ওর তখনও বোধ হয়নি আসলে হচ্ছিলটা কি? সে ভেবেছিল তার মা সাময়িকভাবে অসুস্থ, দ্রুত ঠিক হয়ে যাবেন। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে হুমায়রা আপার শরীর আরও খারাপ করতে থাকে। দেখতেই দেখতে তিনি চলে যান লাস্ট স্টেজে৷ একদম বিছানায় পড়ে যান। তার দেখা শোনার জন্যই বড় সাহেব একটি নার্স রাখেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বড় সাহেব হুমায়রা আপার খোঁজ নেওয়া বন্ধ করে দেন। বাসায় খুব কম থাকতে শুরু করেন। প্রাণকেও কাছে টানতেন না আর তেমন। তাই প্রাণও সবসময় মায়ের পাশে বসে খেলা করতো আর কথা বলতো। তো এমনই একদিন প্রাণ হুমায়রা আপার পাশেই বসে কথা বলছিল, খেলছিল। ঠিক সময়টাতেই হুমায়রা আপা ই’ন্তে’কা’ল করেন। হুমায়রা আপার চোখ তখন উল্টে ছিল, মুখ খোলা, ঠোঁট দুটো জী’র্ণ’শী’র্ণ। মায়ের এমন অবস্থা দেখে প্রাণ ভয় পেয়ে যায়, তাকে অনেক ডাকে কিন্তু সাড়া পায় না। নার্সটাও সেদিন ছুটিতে ছিল তাই প্রাণ বাধ্য হয়ে ছুটে যায় বাবার কাছে সাহায্য চাইতে। বড়সাহেব সচরাচর বাসায় থাকলে স্টাডিরুমে থাকতেন তাই প্রাণও সেদিকেই যায়। তবে সেখানে গিয়ে বড় সাহেবকে অন্য এক নারীর সাথে দেখে ও থমকে যায়। কোনরকম নিজেকে সামলে নিম্নস্বরে ডাকে তাকে, বড় সাহেব সেই আওয়াজ শুনে দ্রুত সরে আসেন সেই নারীটির কাছ থেকে। ধমকে উঠেন প্রাণের উপর, সে কেন এসেছে এখানে? প্রাণ তখন কেঁদে সবটা বলতে চায় ঠিক কিন্তু বড় সাহেব শুনেন না। তাকে জোর করেই বের করে দেন রুম থেকে। প্রাণ কোন উপায়ন্তর না পেয়ে পুনরায় চলে যায় হুমায়রা বেগমের রুমে। তাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। কখন তার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে জানা নেই। কিন্তু যখন ঘুম থেকে উঠে তখন আর কোথাও নিজের মাকে খুঁজে পায় না সে।”

#চলবে
[দু’দিন ধরেই শরীর প্রচন্ড খারাপ আমার। বমি করছি ঘন ঘন, যার জন্য শরীর দূর্বল হয়ে পড়েছে। গল্প লিখতে কষ্ট হচ্ছে। কাল আর আজ লেগেছে ছোট এই পর্ব লিখতে। জানি না কি লিখেছি। তবে ভুল-ত্রুটি থাকলে পাঠকরা ধরিয়ে দিয়েন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here