#নিশুতি_তিথি,পর্ব ৬,৭
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৬
১১.
‘বিয়ে’ নামক শব্দে কী এমন থাকে যা প্রতিটি নারী মনের ভীত নাড়িয়ে দেয়। হয় কেউ উজানে ভাসে নাহয় কেউ স্বামী নামক পুরুষটাকে আঁকড়ে বাঁচে। কিন্তু আঞ্জুমানের ক্ষেত্রে কোনটি হলো? তা কেবল আঞ্জুমান’ই জানে। মনের কথা যদি মুখ ফুটে বলার মতো তার স্বভাব হতো, তাহলে তো আর বেচারিকে এ-দুয়োর ও-দুয়োর করে ফিরতে হতো না। মা মারা যাওয়ার বছরখানেক পরই বাবা নামক ছায়াও হারায়। ততক্ষণে অলক্ষুণে মেয়ে নামক সিলগালা হয়ে যায়। যেহেতু বাবা-মা’য়ের মতো আপন যাঁরা পৃথিবীতে নেই, সেহেতু অপরের কাছে ভালো কিছু প্রত্যাশা করার মতো অবকাশও নেই আঞ্জুমানের। যার দরুন বিচার কার্যের ফল হিসেবে আলীকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে ‘কবুল’ উচ্চারণে বিয়ে করতে হয়। বিয়ের প্রস্তাবটা আলীর পক্ষ থেকেই রাখা হয়। ময়মুরুব্বি’দের প্রস্তাবিত বিষয়টাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝিয়ে তাদের দু’জনকে বিয়ের মতো বাঁধনে বাঁধার সুপারিশ করে আলী। যেহেতু দু’জনের দ্বারা ভুল হয়েছে সকলে বলছে, তাহলে তাদের দু’হাত একত্রে করে দেওয়াই ভালো নাকি মেয়েটাকে অপদস্ত করে গ্রাম ঘুরানো। আরো নানা যুক্তি আলী পেশ করলে, সবাই তাদের বিয়ে দেওয়ার সিধান্ত নেয়। সেখানে এই মূখ্য সিধান্ত নেয় গ্রামের মাস্টার আর ইমাম সাহেব। এদিকে এতকিছুর মাঝে আলী নিজের পদটাকেও হারায়। তার বিরুদ্ধে থাকা বিপক্ষীয় দলের লোকেরা সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে তাকে পদচ্যুত করতে আবেদন করলে, গ্রামবাসীরাও সেখানে সায় দেয়। যেহেতু তার-ও দোষ রয়েছে। এসবে আলীকে অতটা মাথা ঘামাতে দেখা যায় না৷ সে নির্বিকার থাকে, সকল ধ্যান তার অন্যকিছুতেই। অতঃপর সকলের বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে নির্বিঘ্নে বিয়েটা হয়ে যায়। আঞ্জুমান সেখানে কেবল কাঠের পুতুলের মতো ‘কবুল’ উচ্চারণ করে। অবশেষে দেখা যায়, এমন ঝামেলা শেষে সকলেই চলে যায়। আলী-ও চলে যায় বাড়ির ভেতরে। শুধু রয়ে যায় আঞ্জুমান একটা গাছের নিচে। মনে হয়, কারো লাশ কবর দিতে এসেছিল মানুষজন। কবর দেওয়া শেষ কবরস্থান শূন্য করে চলে যায় লাশটাকে মাটির ভেতরে রেখে। এখানে লাশের ভূমিকায় আঞ্জুমানকে দেখা যায়। বিস্ময়ে বিমূঢ় চিত্তে স্পন্দনহীন, অসাড়ে।
‘রাহিমা খালা!’
আলীর চিৎকারে রান্না করার কাজের মহিলা রাহিমা রান্নাঘর ছেড়ে ছুটে আসেন। এতক্ষণ ছিলেন জনসম্মুখের বিচারে আড়ালে।
‘জি, ছোটো সাহেব।’
সোফায় বসে ক্লান্তিকর দেহ ছেড়ে দেয় আলী। মনে হয় কত জানি পরিশ্রমের কাজ করে এসেছে বেচারা!
‘বাইরে আঞ্জুমানকে নিয়ে আসো।’
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে যান রাহিমা। মিনিট কয়েক বাদে দু’হাতে আগলে ধরে নিয়ে আসেন আঞ্জুমানকে। পাথুরে শরীর হয়ে আছে আঞ্জুমানের। এই বুঝি ভর ছেড়ে দিবে। এতটুকু আনতেই হাঁপিয়ে উঠেছেন রাহিমা। আঞ্জুমানকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলী বলল,
‘ওপরের গেস্ট রুমে রেখে আসো।’
বলেই সোফায় হেলে পড়ে চক্ষুদ্বয় মুদিত করে ফেলে আলী। এদিকে আলীর কথা শুনে ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়েন রাহিমা। বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব, তাই গায়ে অত শক্তি নেই যে সিঁড়ি বেয়ে ওঠবেন আরেকজনকে নিয়ে। একা উঠলে কথা ছিল একটা। এরইমধ্যে আঞ্জুমান ভর ছেড়ে দেয় জ্ঞান হারিয়ে। যার ফলে আচমকা রাহিমার হাত ফসকে পড়ে যায়। সোফার সম্মুখে ছিল কাচের টেবিল। পড়ে তো পড়ে গিয়ে কাচের ওপরই পড়ে আঞ্জুমানের হালকা-পাতলা গড়নের শরীর। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়। কাচ ভেঙে বুকে-পেটে-হাতে গিয়ে বিদ্ধ হয়। এসব দেখে রাহিমার মুখে হাত আর সোফার নরম গদিতে মুদিত আলীর চক্ষুদ্বয় বিস্ময়ে বিমূর্ত। কিছু পল স্তব্ধ, অনড় থাকা অবস্থায় অনুধাবন করার চেষ্টা করে মস্তিষ্ক যে তার সম্মুখীন ঘটনা কী ঘটল। অতঃপর কম্পিত হওয়া আঙুলে আঞ্জুমানের গায়ে আলতো করে ধাক্কা দিতে দিতে বলল,
‘এ্যাই আঞ্জুমান ওঠ, ওঠ বলছি। মাত্রই না আমাদের বিয়ে হইল। এখনই তুই চলে যাবি? দোষ নাহয় করছি একটু তাই বলে এত বড়ো শাস্তি দিবি? আঞ্জুরে তোরে আমি খুব ভালোবাসি রে। ওঠ না জানপাখি।’
আলীর চিৎকারে করিম মিয়া বাইরে গেট থেকে দৌড়ে আসে। কাচ ভাঙার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা আঞ্জুমানকে দেখে ভড়কে যায়। অপরপাশে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কাঁপতে থাকা রাহিমার দিকে একনজর তাকিয়ে ফের আলীর দিকে তাকায়। এই প্রথম আলীকে এমন কম্পমান, হারানোর ভয়ে ত্রস্ত হয়ে শঙ্কিত হতে দেখল। এটা কি সত্যিই ভালোবাসা? আলীর পক্ষে সবকিছু সম্ভব হলেও এটা তো হওয়ার কথা নয়।
‘আঞ্জু, ওঠ বলছি। নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।’
আলীর চিৎকারে ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে দেখে মেয়েটার শরীরে কাচ বিঁধে রক্তের ছড়াছড়ি। আঞ্জুমানের নিশ্বাস পড়ছে কি না দেখে নেয়। অতঃপর দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন মনে করে আলীকে বলল,
‘বেঁচে আছে, তাড়াতাড়ি চিকিৎসার দরকার।’
হতবুদ্ধি হওয়া আলীর কথাটা মাত্রই খেয়াল আসে। সে-ও মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দারোয়ানকে বলে গাড়ির ব্যবস্তা করতে বলে।
১২.
‘বাবা, আমি আজ গ্রামে যাব ভাবছি।’
সকালের নাস্তার টেবিলে মেয়ে রিমার কথা শুনে খাবার মুখে দেওয়া থামিয়ে দেন আফজাল সাহেব। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন,
‘এই তো দু’দিন হলো এলে। এরইমধ্যে আবার যাওয়ার তাড়া কেন?’
কী বলবে আলী যে তার ফোন ধরছে না? এটা বলবে? এমনিই কাল এটা নিয়ে যা হাসিঠাট্টা করেছে ছোটো ভাবি। এখন বাবা নামক গুরুজনকে তো আর এটা বলা সাজে না। এদিকে মেয়েকে আফজাল সাহেব কোনো উত্তর দিতে না দেখে বললেন,
‘কী হয়েছে? আলীর সাথে তোর কি ঝগড়া হয়েছে?’
বিশালাকার খাওয়ার টেবিল ভর্তি খাবার-দাবার। তিন-ভাই’ই বিবাহিত। বড়ো ভাবির দুই ছেলে, এক মেয়ে। মেজো ভাবির এক ছেলে, এক মেয়ে। ছোটো ভাবির কোল আপাতত খালি কারণ স্বামী তার প্রবাসী। এই বিশালাকৃতির ডাইনিং টেবিলে বাবা-মা, দু’ভাই তাঁদের স্ত্রী-সন্তানসহ বসেছেন। তন্মধ্যে আফজাল সাহেবের কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই খাওয়া থামিয়ে দেয় সবাই। তবে এরমধ্যে বাচ্চারা নিজেদের মতো খাবার গ্রহণে ব্যস্ত৷
‘সত্যিই কি ওই ছেলেটার সাথে তোর ঝগড়া হয়েছে?’
মেজো ভাইয়ের গলার স্বরে রোষানলের আভাস। রিমা তখন গমগমে শব্দে বলল,
‘ওই ছেলেটা কী, হ্যাঁ? নাম আছে তার। কিছু তো সম্পর্কের মান করো। তোমাদের বোনের জামাই সে।’
রিমাকে রাগান্বিত হয়ে কথা বলতে দেখে আফজাল সাহেব তাদের থামানোর জন্য কথা ঘুরিয়ে বললেন,
‘তুই এবার না গিয়ে আলীকে ডেকে পাঠা। মাসখানেক হতে চলল গ্রামে গিয়েছে আর আসার খবর দেখছি না তার।’
বোঝা হয়ে গেল রিমার যে, তার বাবা এবার তাকে জার্নি করে গ্রামে যেতে দিবেন না। কয়েকদিন আগে জার্নি করার কারণে বাড়িতে এসে বিছানায় পড়েছিল। যার ফল হিসেবে সামনে থেকে গ্রামে যাওয়া তার জন্য নিষিদ্ধ। মন খারাপ করে খাওয়ায় মন দিলো রিমা। তার মলিন হওয়া মুখ সকলের দৃষ্টিগোচর হলেও সবাই চুপ করে রইল। কারণ তাঁরা সকলে রিমার ভালো চায়। কিন্তু মেয়েটা যা স্বামী পাগল। না জানি কোনো কষ্টের কারণ হয় তার অতি ভালোবাসার স্বামী।
রিমা তার নিজের রুমে উপুড় হয়ে শুয়ে ফোনে আলীর ছবি দেখতে মশগুল। এমন সময় তার বড়ে ভাইয়ের ছোটো মেয়ে নিনি এসে ফুপিমনির পিঠে চড়ে। রিমা ঘুরে নিনিকে সামনে এনে বলল,
‘কী ব্যাপার আম্মুজান ফুপিমনির ঘরে যে?’
এমন সময় হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে আসে তার বড়ো ভাবি। নিনি তার মা’কে দেখে রিমাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ লুকায়। যার অর্থ বুঝে রিমা হাসতে থাকে। হাসতে হাসতেই বড়ো ভাবিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘রেখে যাও আমিই খাইয়ে দেই।’
ফোঁস করে দম ছেড়ে বড়ো ভাবি তখন বললেন,
‘ও’র পিঠের চামড়া তুলতে মন চাচ্ছে। এত জ্বালা তাদের ভাই-বোনদের। খেতেই চায় না। খাওয়ার সাথে যেন তাদের জন্মের দুশমনি।’
রিমা তার ভাবির কথা শুনে বুঝিয়ে বলল,
‘ছাড়ো না, ছোটো মানুষ’ই তো। স্বাভাবিকই খাবারের প্রতি এখন যত সব অনিহা থাকবে তাদের। আমাদের মতো বুঝদার হলে তো আর কথাই ছিল না।’
তবুও বিরক্তি ছেয়ে বড়ো ভাবির মুখাবয়বে। সেই বিরক্তিকর মুখ ফসকে বললেন,
‘ছোটো-বড়ো কথা না গো। বাচ্চা সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। তোমার তো হয়নি তাই বুঝো না, হলে বুঝতে বাচ্চ…..’
‘বড়ো বউ মা!’
কারো ধমকে বড়ো ভাবি চুপ হয়ে গেলেন। অতঃপর পিছু ফিরে সেই ধমক দেওয়া কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন। রিমার রুমের দরজার সামনে শ্বাশুড়ি জয়তুন বেগম দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে রাগত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা দেখে বড়ো ভাবি শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু নাহ, মরুভূমির মতো গলা শুকিয়ে আছে। আর না জানি তার কপালে কোন শনি নাচবে এবার। এদিকে রিমার মাথায় কেবল বড়ো ভাবির কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে। মনের মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার ইচ্ছেগুলোর ব্যাপকতা হলেও পূরণে ক্ষেত্রে সেগুলো সংকুচিত। হয়তোবা না পাওয়ার মতোই। কিছু কিছু ইচ্ছে যা স্বপ্নেই সুন্দর বাস্তবে তারা ধরা দেয় না, অধরাই রয়ে যায়। রিমার স্বপ্নটাও এমনই জায়গায় এসে বিলীন হয়ে গেছে।
চলবে…
#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৭
___________
১৩.
হসপিটালের ফিনাইলের ভরপুর গন্ধে আলীর নাজেহাল অবস্থা। তার হসপিটালের এই গন্ধে শ্বাসনালি আঁটকে যাওয়ার মতো। এসবে সে বেশ একটা অভ্যস্ত নয়, বড়োজোর অতিব প্রয়োজন ছাড়া কখনো এ-মুখো হয়নি সে। সরকারি হসপিটালে দ্রুত আঞ্জুমানের চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য আসা। কিন্তু ডাক্তার’রা সেখান থেকে ফিরিয়ে দেয়। দিক-বেদিক হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ডাক্তাদের কলার ধরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে তাঁদের ওপর রাগ ঝাড়ে আলী। তখন করিম মিয়া এগিয়ে এসে মাথা ঠান্ডা করে অন্যত্র নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়। সেই আবার গাড়ি ঘুরিয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয় আঞ্জুমানকে। সেখানে দ্রুত চিকিৎসা শুরু হয়। দোতলা ক্লিনিকের দ্বিতীয় তলার ওটির রুমের সামনে পাতানো চেয়ারে বসে আলী। দু’হাত জড়ো করে কপালে ঠেকানো। করিম বারবার লক্ষ করছে, খুব গভীরভাবে। তার কাছে বিষয়টা বপশ অদ্ভুত ঠেকছে। কখনো আলীকে কারো জন্য এত চিন্তিত হতে দেখা যায়নি। এই যে চিন্তা সেটা কীসের? আঞ্জুমানকে পেয়েও হারিয়ে ফেলার? সে তো জানে সেখানে অন্য কোনো অভিপ্রায় নিহিত। আরকিছু ভাবতে পারছে না করিম মিয়া। এমন নিষ্পাপ, পবিত্র মেয়েটার ভাগ্য জুড়ে এই নিষ্ঠুর, নির্মম, পাষাণ, জঘন্যতম পুরুষটাই এলো! এলো না কি আনা হলো তা শুধু সময়ের ব্যবধানে জানা যাবে।
‘রক্ত লাগবে পেশেন্টের।’
নার্সের কথা শুনে অবনত হওয়া মুখ তুলে ওপরে তাকালো আলী। অতঃপর করিম মিয়াকে ডেকে রক্ত জোগাড়ের আদেশ দিলো। মনে মনে করিম মিয়া ভেবে নিলো, আর যাই হোক আলী কখনো কাউকে ভালোবাসতে জানে না। নাহলে প্রিয়জনের জন্য রক্ত জোগাড়ের কাজটা তার মতো কাজের লোকের হাতে ন্যস্ত করত না।
বিকেলের গোধূলি আলোয় হলদেটে আভা ছড়ানো আকাশের মধ্যমনি সূর্যটাকে দেখে একপ্রকার প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে আলীর। এটা কি সত্যি আলোর দিশারীর শান্তি না কি আঞ্জুমানের সুস্থতার ইঙ্গিতে মনের কোণে স্বানুভাব দেখাল।
‘বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত।’
ডাক্তারের কথায় জানালার কাচ দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য নিক্ষিপ্ত করা দৃষ্টি এবার ফিরিয়ে নিয়ে মনোযোগী হলো আলী সম্মুখের চেয়ারে অবস্থান করা মানুষটার কথা শুনতে।
‘জি, সমস্যা নেই।’
‘আঞ্জুমান আপনার কী হয়?’
খানিকটা চুপ থেকে ওপাশ থেকে উত্তর আসে গম্ভীর গলার,
‘আমার বউ।’
‘ওহ, আই সি। তা এমন ঘটনা ঘটল কী করে?’
আলীর মেজাজের পারদ এবার তুঙ্গে। এত বিষয়-বিশ্লেষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করার কী আছে বুঝে আসে না তার। প্রয়োজনীয় কথা বলবে তা না ব্যক্তিগত বিষয়াদি জানার আগ্রহ তাঁর। ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে আলী প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করে,
‘আঞ্জুমান এখন ঠিক আছে?’
জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন ডাক্তার সাহেব বুঝে যান তাঁর করা প্রসঙ্গ পালটাতে চাচ্ছে আলী। তাই তিনিও আলীকে বিব্রত না করে বললেন,
‘হুম, আপাতত তো সুস্থ বাকিটা সেরে ওঠবে প্রোপার দেখাশোনার মাধ্যমে। তার প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল হতে হবে। মেয়েটার শরীরে রক্তশূন্যতা রয়েছে, সাথে ওজনটাও কম। রক্তের ঘাটতি কমাতে ভালো-মন্দ, পুষ্টিকর খাবার খাওয়াবেন। অল্প বয়সের মেয়ে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করা ঠিক হয়নি। আবার আপনাদের মধ্যে এইজ ডিফারেন্ট মাচ।’
শেষোক্তিটা বেশ আফসোসের সুর টেনে বললেন ডাক্তার। কিন্তু পুরো কথার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মস্তিষ্কে ধরলেও শেষের উক্তি দু’টো আলীর তুঙ্গে ওঠা মেজাজে গেঁথেছে। যার ফলে সম্মুখের টেবিলে বলশালী হাতের থাবায় শব্দ করে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘আপনার মাথা শুধু ডাক্তারি করার কাজে মন দেন না কি অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে। নাহলে ফল হিসেবে ডাক্তারি করার জন্য মাথা আর মাথার জায়গায় থাকবে না।’
ডাক্তার-ও বেশ ঘাবড়ে যান। চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে আলীর প্রস্থান লক্ষ করে আটকে রাখা দম ছাড়েন।
১৪.
‘বাবা, থাক কিছু বলো না আর।’
‘বলব না মানে। সাহস কত বড়ো এ মেয়ের! আমার মেয়েকে কষ্ট দিয়ে কথা বলে।’
থমথমে বিরাজমান ড্রয়িংরুমের শোভাবর্ধক স্থানটা। যেন আর ক্ষণকালের মধ্যে দূর আকাশের বাজ এই রুমেই পড়বে। কিন্তু তার আগেই রিমা তার বাবাকে বারবার অনুরোধ করে বুঝাচ্ছে কথা আর না বাড়াতে। কিন্তু আফজাল সাহেবের এক কথা।
‘আমার মেয়ের চোখে অশ্রু ঝরানোর কারণ যে তাকে আমি দু-চোখে সইতে পারব না। তার বিচার হবে, কঠিন বিচার।’
‘প্লিজ বাবা, ক্লাম ডাউন প্লিজ। বড়ো ভাবি তো মিথ্যে কিছু বলেনি। সত্যিটাই তো বলল। সন্তানের মুখ যে দেখেনি, সে কীভাবে উপলব্ধি করবে একজন সন্তানের অস্তিত্বকে?’
বলেই বাঁধভাঙা জোয়ার এলো রিমার দু’চোখের পাতা জুড়ে। এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন আফজাল সাহেব। ব্যবসায়ী, শক্ত-পোক্ত মনের মানুষ তিনি। তবুও আজ মেয়ের কষ্টে ব্যথিত হৃদয় নিংড়ানো অশ্রুরাও বইছে তাঁর চোখের কোলে। অনেক মানত করে পাওয়া মেয়েটার কেন একটু কষ্টে সারাজীবনের দুঃখ বয়ে বেড়াতে হবে? সন্তান জন্মদানে অক্ষমতার স্বীকার হওয়া একমাত্র মেয়েটার কষ্ট যে তিনি সহ্য করতে পারছেন না। এরইমধ্যে বড়ো বউ সেটা খুঁচিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে রক্তাত্ত করল। রিমাকে বুক থেকে সরিয়ে বড়ো বউ নাবিলার উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘আজই বাড়ি থেকে চলে যাবে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেও। রাকিব রেখে আসবে তোমাকে।’
বাবার দেওয়া আদেশ শুনে নিজের কান্না থামিয়ে দিয়ে বড়ো ভাবির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, মেয়েটাও কাঁদছে অঝোর ধারায় তবে সেই কান্নার কারণ ভিন্ন। তার সন্তানরা তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। এই দৃশ্য এক ঝলক তাকিয়ে দেখে ফের বড়ো ভাই রাকিবের দিকে নজর ফিরালো। সে জানে বাবা যে আদেশ করবে, সেটা ন্যায়-অন্যায় যাই হোক না কেন ভাইয়েরা তা মাথা পেতে নেবে। সেজন্যই তো বড়ো ভাই নিচু মস্তকে বসে আছে সোফায়, কোনো তর্কে জড়াননি। ছোটো ভাবি তার মা’য়ের সাথে বসে আছে সোফাতে। মেজো ভাই, ভাবি এখানে বিদ্যমান নেই। তিনি গিয়েছেন শ্বশুর বাড়িতে মেজো ভাবির মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে, তাঁকেই দেখতে গিয়েছেন। এত সুন্দর পরিবার হঠাৎই কেমন ছিন্নভিন্ন হয়ে বিদীর্ণ রূপ ধারণ করল, তা কেবল তার জন্য? নাহ, সে তো তার পরিবারকে হাসিখুশি ফ্যামিলি রূপে দেখতে চায় না কি আকাশের মেঘলা কালো রঙের মতোন। তাই দ্রুততর উত্তেজিত কণ্ঠে রিমা তার বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
‘বড়ো ভাবি যদি চলে যায়, তাহলে কিন্তু আমি-ও চলে যাব গ্রামে। তখন দেখবে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকব তবুও তোমাদের কাছে ফিরব না।’
১৫.
আঞ্জুমানকে নিয়ে সেই সকাল থেকে দৌড়াদৌড়ি করে আলীর খেয়াল ছিল না রিমার কথা। সারাদিনে পার করে নিশীথে আঞ্জুমানের মাথার কাছে বসে খেয়াল এলো রিমার কথা। মেয়েটার সাথে সেই যে, কোন একবেলা কথা হয়েছে ভুলেই বসেছে। এত এত ঝামেলায় কি মনে থাকার কথা না কি। না জানি তাকে ফোনে না পেয়ে কী কী পাগলামি শুরু করেছে। ভাগ্য ভালো যে, তাকে না পেয়ে গ্রামে চলে আসেনি। যদি আসতো তখন কী হতো? ভাবতেই রিমাকে ফোন দিয়ে কথা বলা জরুরি মনে করল। নিজের ফোন তো বাড়িতে রেখে এসেছে তাই ক্লিনিকের থেকে ফোন করল। এদিকে রিমা জাগ্রত অবস্থাতেই ছিল বিধায় অচেনা নম্বরে রিসিভ করে আলীর কণ্ঠ শুনে অস্থিরচিত্তে বলে উঠল,
‘এই তুমি ঠিক আছ তো? কী হইছে তোমার ফোন বন্ধ ছিল কেন? আর এটাই বা কার নম্বর?’
তার উদ্বিগ্নতার স্বর বেশ ক্রদনরত শোনাল। মনে মনে হাসল আলী। মেয়েটা তার জন্য পাগলপ্রায়। এই যে তাদের সন্তান হয় না, তবুও চায় না তার স্বামীকে ভাগ করতে। সন্তানের জন্য কাঁদবে তবুও স্বামীকে হারানোর কথা উঠলে, সন্তান চাওয়ার আশা ছেড়ে দেয়। বিয়ের বছর দুয়েক বাদে যখন তাদের সন্তান হবে না জানল, সমস্যাটা রিমার ছিল। তখন মেয়েটার কান্না থামানোর মতো জো ছিল না। সারাক্ষণ দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াত, ঘুম যেত না, চুপচাপ যেন সর্বহারা হয়ে বসে থাকত। তখন ভালোবাসার চাদরে এনে খুব আদরে আদরে আলী তাকে আয়ত্তে আনে। অবশ্য বেশি একটা সময়ও লাগেনি কাজটা করতে। মেয়েটা যে তাকে খুব করে চায়। কন্ট্রোল করার অর্ধেক কাজ তো আফজাল সাহেব’ই তো করে দিয়েছিলেন। তাও আবার অজান্তেই। মেয়ে যখন তাঁর বাচ্চার জন্য আধপাগল, তখন তিনি আলীকে আরেকটা বিয়ে করার প্রস্তাব করেন। ব্যস! কাজ হয়ে গেল, স্বামীকে অন্য মেয়ের সাথে বোধহয় কোনো বাঙালি মেয়েই সহ্য করতে পারে না। যতোই সে মর্ডান হোক না কেন। রিমাও সন্তানের চিন্তা বাদ দিয়ে তখন স্বামী নামক অত্যধিক ভালোবাসার ব্যক্তি আলীকে আকাড়ে ধরে এত বছর পার করল। কিন্তু আফসোস! সেই তো অন্য ফুলের গন্ধ পেয়ে মৌমাছি ছুটল সে ফুলের গন্ধ নিতে। আটকে রাখতে পারল কি আর? পৈশাচিক হাসি খেলে গেল আলী আকবরের কালচে পুরু ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে।
চলবে…