তরঙ্গিনী (পর্ব-৩) #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী (পর্ব-৩)

#আরশিয়া_জান্নাত

তৌকির সবসময় বলতো আমার চুপচাপ থাকাটাই তাকে অনেক টানতো। তার মনে হতো আমি রহস্যময়ী। আমার প্রতি তীব্র কৌতুহল থেকে তার মনে প্রেম আসে, তারপর রোজ নিয়ম করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো আমায় এক পলক দেখতে। আমি স্কুলে আসা যাওয়ার টাইমে সে স্কুলের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো সবসময়। তারপর একদিন সাহস করে বলেই দেয় মনের অভিব্যক্তি। বাবাকে আমি ভীষণ ভয় পেতাম, তার রাগের যে নমুনা ছিল। বড় ভাইয়া আপুদের দেখে তার অদ্যপন্ত জেনেছিলাম বলেই এগোনোর দুঃসাহস করিনি। কিন্তু আবেগের ঘন উচ্ছাসের ঢেউয়ে প্রেম কি দমে থাকে? বাবা ভাইয়ের অগোচরেই চলতে থাকে আমার জীবনের প্রথম মধুরতম প্রেম। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী, জেএসসি পরীক্ষা শেষ। তাই স্কুল প্রাইভেট কিছু নেই। ওদিকে তৌকির পড়াশোনার জন্য ঢাকায় পাড়ি জমায়। তার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম নেই বললেই চলে। তবুও ফাকেঝোকে বান্ধবীর মোবাইল থেকে কল করে কয়েকমিনিট কথা হতো। ছুটিতে এলে দেখা হতো, এভাবেই চলছিল আমাদের লং ডিস্টেন্স রিলেশনশীপ। কলেজে উঠার পর থেকেই আমার বিয়ের জন্য প্রপোজাল আসতে শুরু করে, কিন্তু নানা কারণে সেসব তেমন জোর পায় না। ততদিনে আমিও ৫২বাটনের একটা নোকিয়া সেটের মালিক হই। সুযোগ পেলেই তার সঙ্গে কলে কথা বলা, কত গল্প কত কি! আমি এতো কথা বলতে পারতাম কিভাবে জানিনা। তৌকির বলতো, প্রেমে পড়ে তোমার মুখে কথার খই ফুটেছে। আমি হাসতাম তার কথা শুনে।
মাঝেমধ্যে ভাবি সেই মানুষটা কিভাবে এতো বদলে গেল? আমার সাথে কথা না বললে যার শান্তি লাগতো না সে এখন কিভাবে শান্তিতে থাকে? কত রাত আমি জেগে কাটিয়েছি তার ফোনকলের আশায়, আমার ফোন করা নিষিদ্ধ ছিল বলে কল করিনি ভয়ে। ওর যা মেজাজ! একবার নিষেধাজ্ঞা ভুলে কল করছিলাম বলে কি জঘন্যভাবেই না গালাগাল করেছিল মা-বাবা তুলে! আমি লজ্জায় পুরো রাত কেঁদেছিলাম। অথচ সে নিজে ফোন করতে ভুলে যেত। আমি টের পেতাম মানুষটা বদলে যাচ্ছে। কিন্তু ততদিনে আমার যে আর পথ রইলো না। সে আমার অভ্যাসে এতোটাই মিশেছিল যে আমি তাকে ছাড়া একটা দিনও পার করার চিন্তা করতে পারতাম না।
মেমসাহেব” বইটা পড়ে সবসময় মনে হয়েছে প্রতিষ্ঠিত ছেলের বৌ হবার চেয়ে পাশে থেকে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছেলের বৌ হওয়া ঢের ভালো। আমিতো তার দূর্দিনে পাশে থেকে সুদিনের ভাগীদার হতে চেয়েছিলাম। তবে সে কেন রাখলো না?
আমায় কতশত অপবাদ দিয়ে গেল, অযোগ্যতার লম্বা লিস্ট ধরিয়ে বলেছিল, আমি তার পরিবারের সাথে এডজাস্ট করতে পারবোনা। আমার মতো ইন্ট্রোভার্ট মেয়েরা নাকি সবাইকে নিয়ে সংসার করতে পারে না,,,,

এমন কথা যে মেয়েটা প্রাক্তনের কাছে শুনেছে সে কি এমন ভরা সংসারে টিকে থাকার মনোবল পাবে? সত্যি বলতে আমি মনে মনে ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম।

হঠাৎ কোলের উপর রাখা হাতে কারো স্পর্শ পেতেই আমার ধ্যান ভাঙলো।
তাকিয়ে দেখিয়ে আরাফ আমার মনোযোগ নিতেই এমনটা করেছে। সে মৃদু স্বরে বললো, খাওয়া বাদ দিয়ে কোন সাগরে ডুব দিয়েছেন হুম? সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো,,

আমি পরোটা ছিড়ে একটু একটু খেতে শুরু করলাম। ওরা সবাই অনেক কথা বলছিল। আমি ছাড়া কেউই চুপচাপ খাচ্ছেনা। আমি মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এই কোলাহল মেনে নেওয়ার।


রুহি আর পিহু সবসময় আমার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকে। পিহু তাদের ফ্যামিলি অ্যালবাম এনে বললো ভাবী তোমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই, আমরা হচ্ছি মোট ১১জন ভাই আর ৬জন বোন। এর মধ্যে ৪আপু তোমার ননাস। ননদ কেবল আমরা দুজন। আর ভাইয়াদের তো দেখলেই, আরাফ ভাইয়া সবার বড়। তাই তোমার প্রতি আমাদের সবার এতো আগ্রহ। একে একে সবার ছবি দেখলাম আর মজার মজার স্মৃতি শুনে হাসলাম। সত্যি বলতে রুহি আর পিহু আমাকে এতোটাই আপন করে নিয়েছিল আমার একবারো মনে হয়নি ওরা আমার ননদ।
এই পরিবারের সবাই অনেক ভালো, একে অপরকে ভালোবেসে, সম্মান করে একসঙ্গে বাস করে। আমার শাশুড়ি তথা এই বাড়ির বড় বৌ। তাকে সবাই অনেক মান্য করে চলে। তিনিও প্রয়োজনে কঠোর আবার কোমল রূপ ধারণ করেন। খাওয়ার সময় বাদে এ বাড়ীতে সবাই মহাব্যস্ত। আসলে সবাই যত ব্যস্তই হোক খাবারের সময় এখানে উপস্থিত থাকতেই হতো। কেউ কারো ঘরে গিয়ে অযথা বিরক্ত করেনা। আড্ডার সময় ব্যতীত কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই প্রাইভেসী মেইনটেইন করে অন্যকে স্পেস দেয়। সত্যি বলতে এই নিয়মনীতিগুলো আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। চাচীরা যখন রান্না করতে আসে আমি তাদের সাথে টুকটাক কাজ করি। মাঝেমধ্যে এটা ওটা জিজ্ঞাসাও করি। উনারা একেকজন গল্পের আসর খুলে বসেন, আমি নিরব শ্রোতা হয়ে শুনতে থাকি।
আরাফ রোজ অফিস থেকে ফেরার পর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে, মা তখন শত কাজ থাকলেও আমায় রুমে পাঠিয়ে দেন। বলেন, শোন মা স্বামী বাইরে থেকে ফিরলে পরিপাটি হয়ে সামনে থাকতে হয়, এতে তার ক্লান্তি অর্ধেক দূর হয়ে যায়। নে ওর জন্য কফিটা নিয়ে যা।

আমি কফি নিয়ে রুমে এসে দেখি জনাব চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন, আমি নক করার পরো হোলদোল নেই। উনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন?

কফিটা ঢেকে রেখে আমি বেডের একসাইডে বসে রইলাম। বহুক্ষণ পর আরাফ চোখ মেলে চাইলো, আমায় দেখে মুচকি হেসে বলল, অসময়ে চোখ লেগে এসেছে! ডাকেননি যে?

আপনি ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন তাই আর ডাকিনি।

রেবা,,

জ্বি

আপনি এখানে ভালো আছেন তো?

হুম।

কোনো অসুবিধা হচ্ছে?

নাহ।

আমি ভাবছিলাম কিছুদিনের জন্য কোথাও বেড়াতে যাবো। আপনার কোনো পছন্দ আছে এই বিষয়ে? আই মিন হানিমুনে কোথায় যাবেন ভেবে রেখেছেন কি না,,,

আপনি যেখানে যেতে ইচ্ছুক, এসব নিয়ে ভাবিনি আসলে।

আচ্ছা তবে বলুন পাহাড় না সমুদ্র?

পাহাড়,,

আচ্ছা

আরাফ আমার অনেক খেয়াল রাখতো, আমার সুবিধা অসুবিধার প্রতি সতর্ক থাকতো। এই পরিবারের সবার পজিটিভ কার্যকলাপ আমার মনে শান্তি দিতে পারেনি। আমার বারবার মনে হতো সবে তো বিয়ে হয়েছে তাই সবাই এতো কনসার্ন। কিংবা আরাফের প্রতি মনে হতো তৌকিরো তো শুরুর বছরগুলোয় কত কৌতুহল ছিল, যত্নশীল ছিল। ছেলেরা প্রথম প্রথম ভালোবাসলেও ধীরে ধীরে তাদের ভালোবাসা বদলে যায়, এরা স্থির থাকেনা। আমি এখন তার প্রেমে পড়লেই সব ভালোবাসা উড়ে যাবে,,,, আমি জানি এ আমার ছোট মনের পরিচয় বহন করে। কিন্তু আমার ভাঙা মনের অবস্থা তেমনি ছিল। বিয়ে করে নতুন ঘরে এলেই মনের ক্ষত মিশে যায় না। আমার অতীতের দগদগে ক্ষত এখনো তাজা হয়ে বুকে বিধে আছে। আমার অবাধ্য মন এখনো তৌকিরের স্মৃতিতেই ডুবে থাকে। আমিতো আর রোবট নই সবকিছু ডিলেট করে ফেলব। অপরপাশের মানুষটা সব ভুলে গেছে, আমিতো ভুলিনি। আমার মাঝেমধ্যে মনে হতো আমি মরেগেলেই ভালো হয়। এই এক জীবনে মানুষ তো বারবার প্রেমে পড়েনা? নাকি পড়ে? সেসব আমি জানিনা জানতেও চাই না।
আমি তার প্রতি অসম্ভব দূর্বল বলেই তো বারবার তার পায়ে পড়েছিলাম। কত আকুতি মিনতি করেছিলাম এভাবে ফেলে না যেতে। একটা বছর আমি কুকুরের মতো তার পিছে ঘুরেছি। পদে পদে অবজ্ঞা অপমান ছাড়া কিছুই পাই নি। সে পরিহাস করে বলেছিল, এখন ভালো চাকরী পেয়েছি তো তাই লোভ পড়ছেনা তাই না? আগে তো খুব ব্যক্তিত্ব দেখাতে। এখন কোথায় গেল তোমার আত্মমর্যাদা? শোনো আমি বলেই তোমার মতো মেয়ের সঙ্গে এতোবছর প্রেম করেছিলাম। নাহয় যেমন রসকষহীন সুচিত্রা সেন টাইপ মেয়ে তুমি, কেউই তোমার কাছে দুদিনের বেশি টিকত না!

আসলেই কি তাই? আমি এতোই নগন্য? আমায় কেউ ভালোবিসতে পারেনা? প্রেম মানেই অনাকাঙ্খিত স্পর্শ? যখন তখন শরীর হাতড়ে বেড়ানো? ঐসব যারা করতে দেয় না তারাই রসকষহীন; প্রেমিকা হিসেবে অযোগ্য?
তৌকির বলে আমি দীর্ঘদিন তার প্রেমিকার রোল নামমাত্র প্লে করেছি, প্রকৃত অর্থে তার মনে দূর্বলতা সৃষ্টির (তথা শারীরিকভাবে আকর্ষণ তৈরির) কিছুই করিনি। সে আমার যা দেখে আকৃষ্ট হয়েছিল তা নাকি অন্তঃসারশূন্য!
তার শব্দগুলো আমি মার্জিতভাবে লিখে প্রকাশ করলেও এর ভেতরে থাকতো জঘন্য মুখভঙ্গি আর অশ্লীল শব্দগুচ্ছ।
এই যে এসব বলতো এগুলো আমি মনে রাখিনা, তার ক্ষেত্রে আমার মাইন্ড চাইলেও নেগেটিভ হয় না। আমি পজিটিভলিই ভাবতাম এসব সে আমার পিছু ছাড়ানোর জন্য ব্যবহার করছে, আমায় ইচ্ছে করে কষ্ট দিচ্ছে। রাগ পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে। সে ফের আবেগঘন স্বরে বলবে, আহা রেবা সোনাটা! আমি তোমায় এত্তোগুলা ভালোবাসি,এসব কেবল তোমায় রাগানোর জন্য বলছি। কোনোটাই সত্যি না,,,

আমার মনে ঘুরতে থাকে ভালো সময়গুলো। যখন আমার জ্বরের খবর শুনলেই সে কত টেক্সট করতো, অস্থির হয়ে যেত আমার চিন্তায়। আমরা অনাগত দিনে কিভাবে সংসার সাজাবো। একটা ভালো চাকরি পেলেই সে বাবার কাছে আসবে, চিলেকোঠায় বাসা ভাড়া নিবো, যেন মধ্যরাতে বৃষ্টিবিলাস কিংবা চন্দ্রবিলাস করতে বাঁধা না থাকে,,,এমনি কত লাল নীল স্বপ্ন! সেই স্বপ্নগুলো তখন রঙিন প্রজাপতি হয়ে আমার মনে রংধনু ছড়াতো। আমি বিভোর হয়ে থাকতাম তৌকিরের মাঝে।

এখন আমি অন্যকারো স্ত্রী আর সে অন্যকারো স্বামী। এই তিক্ত বাস্তবতা আমায় প্রতিমুহুর্তে দংশন করে। আমি ব্যথায় নীল হয়ে পড়ে থাকি। আমার এই যন্ত্রণার সমাপ্তি কি আদৌ ঘটবে?
আরাফ আজ নাহয় কাল ঠিকই আর অধিকার চাইবে। আমি মনের মাঝে অন্য কাউকে রেখে শরীরটা কিভাবে তাকে দেই? আমি কেন পারিনা তৌকিরকে ঘৃণা করতে? আমি কেন এতো বেহায়া? আচ্ছা আমার কি আরাফ কে সব জানানো উচিত? সে যদি জানে তার স্ত্রীর প্রাক্তন ছিল আমাকে নষ্টা ভাববে? এখন যেমন যত্ন করে, সম্মান করে তেমনটা আর করবে না, তাই না? এখনকার প্রেম মানেই তো অনেককিছু, সেও আমাকে সেই তালিকাভুক্ত করে অসতী ভাববে? ঘেন্নায় ছুড়ে ফেলবে?
নাহ আর পারি না ভাবতে,, আমার মন প্রাণ বিষিয়ে উঠে। একটু শান্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। তখনই আরাফ আসে, মৃদুস্বরে ডাকে রেবা?

তার এই ডাকে অদ্ভুত মায়ামেশানো থাকে। আমি আমার সকল ক্লেশ লুকিয়ে মুখে নকল হাসিরেখা টেনে তার দিকে ফিরে তাকাই। নিজেকে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী প্রমাণ করার অলিখিত প্রতিযোগীতায় নামি !!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here