তরঙ্গিনী পর্ব-৩৪ #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী পর্ব-৩৪

#আরশিয়া_জান্নাত

একটা মানুষের জন্য সন্তানের আগমনের খবর কতোটা আনন্দদায়ক ঘটনা তা লিখে প্রকাশ করার মতো শব্দ হয়তো কারোই জানা নেই। রেবা মা হতে চলেছে, এটা কনফার্ম হবার পর আরাফের উচ্ছাস ছিল দেখার মতো। তার ইচ্ছে করছিল পুরো পৃথিবীকে চিৎকার করে বলতে, তোমরা শুনছো আমি বাবা হতে চলেছি,,,

রেবা আরাফের আনন্দ দেখে কেঁদেই ফেলল। এই মানুষটাও না, এতো পাগলামি করতে পারে!

আরাফ রেবাকে খুব সাবধানে হসপিটাল থেকে বাড়িতে আনলো। রেবাকে বেডে বসিয়ে বলল, রেবা শুনুন আপনি এখন থেকে অনেক কেয়ারফুল থাকবেন, সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করবেন, প্রয়োজন ব্যতীত বেশি উপর নীচ করবেন না। আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয় আমরা নীচের গেস্টরুমে কয়েকমাসের জন্য শিফট হয়ে যাই? তাহলে আপনাকে আর সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবেনা। নাকি মা কে বলবো এ কয়েকমাস আপনি এখানেই খাওয়া দাওয়া করবেন। এই রেবা শুনুন ওয়াশরুমে গেলে দরজা লক করবেন না। আমি না থাকলে আরো বেশি কেয়ারফুল থাকবেন। আল্লাহ কত কি ঠিক করতে হবে। আমার তো টেনশনে মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উফ উফ!!

রেবা আরাফকে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনি চুপটি করে বসুন তো। এতো হড়বড় করছেন কেন হুম? আপনি না ভীষণ ঠান্ডা মাথার মানুষ। আপনার এতো প্যানিকড হওয়া মানায়?

রেবা! আমি আগে ভাবিনি এতো চিন্তা হবে। একটু আগ পর্যন্ত আমি আনন্দিত ছিলাম, কিন্তু এখন অনেক টেনশন হচ্ছে। আমার কাছে আপনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এখন আপনি একা নন,বুঝতে পারছেন কিছু! আমি দেখি বাবার সাথে কথা বলে, আমি বাসায় থেকে অফিসের কাজ করবো। আপনাকে বাড়িতে রেখে আমার পক্ষে বাইরে থাকা অসম্ভব

এই! হুসসস। বলেছিনা চুপ করে বসতে। আপনার হার্টবিট বেড়ে গেছে অনেক। শান্ত হন না!

আরাফ রেবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমার কলিজাটা! আমার লক্ষি সোনা বৌটা। আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।

বলুন তো কতখানি ভালোবাসেন?

অসংজ্ঞায়িত

আরাফ!

হুম?

আমার কপালে চুমু দিন তো।

আরাফ ওর কপালে মাথায় চোখে চুমু দিয়ে বলল, হঠাৎ চুমু চাইলেন কেন?

আপনি যখন আমার কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু দেন,আমার মনে হয় আপনি মন থেকে আমার জন্য দোয়া করছেন। আপনার প্রতিটা স্পর্শে দোআ থাকে। আমার ভীষণ শান্তি অনুভব হয়। আরাম লাগে,,

তাই নাকি! আগে বলেননি কেন, তাহলে আরো বেশি দিতাম।

মুখে বলতে হয়নি, আপনি এমনিই সবসময় পরম মমতায় আগলে রাখেন। আমি জানি আপনার প্রতিটি মোনাজাতে আমি থাকি। জানেন আমার আজকাল মনে হয় আল্লাহ আমায় অনেক ভালোবাসেন বলেই আমার জীবন থেকে ঐ মানুষটাকে সরিয়ে আপনাকে পাঠিয়েছেন। নয়তো আপনার মতো কাউকে জীবনসঙ্গী পাওয়া সম্ভব হতো না।

আল্লাহ আপনাকে ভালোবাসেন এতে সন্দেহ নেই ম্যাডাম। তবে আপনিও কম নন, আপনাকে পাওয়াও আমার পরম সৌভাগ্য। আচ্ছা রেবা আপনি একটু বসুন আমি আসছি।

কোথায় যাচ্ছেন?

মাকে খবরটা দিয়ে আসি,,

আমি কি আসবো?

নাহ আপনি বসুন। আমি নিশ্চিত ওরা সবাই ছুটে আসবে।

আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে,, ওনাদেরকে ফেইস করবো কিভাবে?

লজ্জা লাগলে লজ্জা পাবেন, আর আমি আরো বেশি প্রেমে পড়বো। সমস্যা কি? আপনার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? শুনুন যাই খেতে ইচ্ছে হবে বিনা সংকোচে বলবেন। কেমন? আমি আসছি ওয়েট।

আরাফ তার বাবা-মায়ের রুমে গিয়ে দেখলো উনারা দুজনই মন খারাপ করে বসে আছেন। আরাফকে দেখে তার বাবা বললেন, বৌমাকে নিয়ে বেরিয়েছিলি বলে? ওর কি হয়েছে ডাক্তার কি বলল?

আরাফ তার বাবার সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। রেহানা চমকে ছেলের দিকে তাকালেন। আরাফ ওর বাবার হাতের উপর মাথা নুইয়ে চোখের পানি ছেড়ে বলল, বাবা! জানো আমাদের সংসারে নতুন একজন আসতে চলেছে,,তুমি দাদা হতে চলেছ। আমি আজকে টের পাচ্ছি বাবা তুমি আমাদের কত ভালোবাসো। ও তো এখনো আসেইনি এখনি আমার যা হাল হচ্ছে,,

ইফতেখার সাহেব তার বড় ছেলের এমন আবেগ দেখে হেসে বললেন, রেহানা দেখো আমার পাগল ছেলে এতো বড় খুশির খবর বলে কিভাবে কাঁদছে। এই বোকা ছেলে ক’দিন পর বাবা হবি এখনো এতো নরম মনের হলে চলবে? বাবাদের হতে হয় বটবৃক্ষের মতো দৃঢ়, যেন কোনো ঝড় তাকে টলাতে না পারে। যতকিছুই হোক তাকে আশ্রয় করে যারা বেঁচে আছে তাদের শরীরে আঁচও যেন‌ না লাগে তেমন কঠিন হয়ে থাকতে হয়। দেখি উঠ চোখ মোছ।

আরাফ উঠে দাঁড়ালো। রেহানা আনন্দিত গলায় বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমার কত বছরের শখ পূরণ হতে যাচ্ছে। আমার আরাফের ঘর উজাড় করে একজন আসতে চলেছে। এতো আনন্দ আমি কোথায় রাখবো। আমার বৌমা কোথায়? এই শুনছো, তুমি আরাফের উপর কাজের প্রেশার কমানোর ব্যবস্থা করো। এই সময়ে ও বৌমার আশেপাশে থাকবে। তুমি তো কাজ কাজ করে আমার বেলা একটুও সময় দাওনি। আমার ছেলেকে ঐরকম করতে দিবোনা। আমি যাই গিয়ে ওকে দেখে আসি।

ইফতেখার হেসে বলল, তোর মায়ের মুড মুহূর্তেই চেইঞ্জ হয়ে গেছে। এতোক্ষণ মন খারাপ করে বসেছিল,,,

বাবা কবির আঙ্কেলরা কি তবে না করে দিয়েছেন?

হুম।

চিন্তা করোনা বাবা, রুহির জন্য আমরা আরো ভালো পাত্র দেখবো। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ভরসা রাখো,,

রেহানা রেবার হাতে স্বর্ণের বালাজোড়া পড়িয়ে বললেন,আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে বৌমা বলে বোঝাতে পারবোনা। তুই শুধু নিজের দিকে খেয়াল রাখবি, আর কোনো চিন্তা করবিনা। যখন যা খেতে ইচ্ছে করবে বলবি। তবে সবসময় শুয়ে বসে থাকবিনা, হালকা হাঁটাচলা করবি, টুকটাক এক্সারসাইজ করবি ইউটিউব দেখে। অনেকে ভাবে গর্ভধারণ করলেই সারাদিন শুয়ে বসে আরাম করতে হয়, এটা ভুল। তবে ভারী কাজ করা উচিত না, রেস্ট নিতে হয়। এই সময়ে অনেক পরিবর্তন আসবে, শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে। ভয় পাসনে, মনোবল রাখবি সবসময় কেমন? আমরা সবাই আছি তোর পাশে।

মা আপনারা আছেন তো আমার চিন্তা নেই।

কয় মাস হলো জানিস?

১১ সপ্তাহ!

৩/৪ মাস কেয়ারফুল থাক, আল্লাহ ভরসা।

ম্যাম আসবো?

হ্যাঁ এসো,

ম্যাম এগুলো কোথায় রাখবো?

বেডসাইডে সেট করো। আর সব এনেছো তো ঠিকঠাক?

জ্বি ম্যাম লিস্ট অনুযায়ী সব ফুড আনা হয়েছে। আপনি চাইলে চেক করে দেখতে পারেন

বেশ তবে, চেক করতে হবেনা। তোমরা সব গুছিয়ে রেখে যাও।

ওরা একটা মিনি আলমারি ভর্তি আচারের বয়াম, ড্রাই ফুড,চকোলেট, বিস্কুট সহ হরেক রকম আইটেম সাজিয়ে চলে গেল।

রেহানা বলল, কিছু বাদ পড়লো কিনা দেখিস।

রেবা হেসে বলল, মা আপনার ছেলে আপনার উপরেই গেছে! উনি আর আপনি সবসময় একদম সেইম কাজ করেন,,

রেহানা ওর চিবুক ছুঁয়ে আঙুলের ডগায় চুমু খেয়ে বলল, আল্লাহ তোকে সহীহ সালামত ভাবে সন্তানের জননী করুন। আমাদের বড় আদরের ছেলে আরাফ। ওর সন্তান আসতে চলেছে মানে বুঝিস? আমি যাই শোকরানার নামায আদায় করি। তুই আরাম কর।


রুহি শপিং শেষে পার্কিং লটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলতেই সেই ছেলেটা দৌড়ে এসে ওর গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো। রুহি চিৎকার করে বলল, স্ট্রেইঞ্জ! আপনি আমার গাড়িতে উঠেছেন কেন? নামুন বলছি!

ছেলেটা আকুতি মিনতি করে বলল, প্লিজ ম্যাম ডোন্ট বি প্যানিকড। আমি আপনাকে এক্সপ্লেইন করতে পারবো। প্লিজ এখানে না, একটু শান্ত হয়ে বসুন, ড্রাইভারকে বলুন এখান থেকে দ্রুত বের হতে।আমি অনেক বড় বিপদে পড়েই এখানে এসেছি। প্লিজ হেল্প করুন।

বাট আপনি যে হাইজ্যাকার না বা কোনো গ্রুপের সদস্য না গ্যারান্টি কি?আমি কেন অযথা বিপদ কাঁধে নিবো?

ছেলেটা হ্যাট সরিয়ে নিজের আইডি কার্ড দেখিয়ে বলল ,আমি সিবিআই অফিসার ইরফাজ আহমেদ। এখন তো ভরসা করতে পারেন নাকি?

রুহি চমকে বলল, আপনিই সেই অফিসার না যার নিউজ দুইদিন পরপর হেডলাইনে আসে ও মাই গড!!

প্লিজ ম্যাম ডোন্ট শাউট। এখান থেকে দ্রুত বের হবার ব্যবস্থা করুন।

রুহি গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বললো, গাড়ি চালাতে। ওদের গাড়ির গ্লাস কালো হওয়ায় বাইরে থেকে কেউই ভেতরের কাউকে দেখতে পারেনা। মূলত সেজন্যই ইরফাজ এই গাড়িকে টার্গেট করে।

রুহি খুব আগ্রহ নিয়ে ইরফাজের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইরফাজ বা’ হাতের শার্ট ফোল্ড করে টিস্যু দিয়ে চেপে ধরলো।

রুহি আৎকে বললো, ও মাই গড আপনার হাতে কি হয়েছে এতো রক্ত পড়ছে! ওয়েট গাড়িতে ফার্স্ট এইড বক্স আছে। আপনি কি এখানে কোনো মিশনে এসেছেন? আপনার উপর কেউ হামলা করেছে?

ইরফাজ ক্লান্ত গলায় বলল, আপনাকে বিড়ম্বনায় ফেলার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আসলে আমি খুব জঘন্যভাবে ইনজুরড হয়েছি।‌কষ্ট করে আমাকে হসপিটালে,,,

ইরফাজ আর কিছু বলতে পারলো না। অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো রুহির কাঁধে। রুহি চিৎকার করে বলল, ড্রাইভার সাহেব হসপিটালে চলেন, আয়হায়ই লোক কি মরে গেল নাকি? ইয়া আল্লাহ এজন্যই আমার ডিফেন্সে জব করা একদম পছন্দ না। জানের রিস্ক নিয়ে চলতে হয় এদের। এতো সুন্দর ছেলে কোথায় মডেলিং করবে নাহয় সিম্পল কোনো জব করবে তা না! কুখ্যাত সন্ত্রাসী আর চোর ডাকাতের পিছে ঘুরে মরতে বসেছে!

রুহি তার নাকের সামনে হাত নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো নিঃশ্বাস পড়ছে কি না। যাক বাবা মরেনাই, দম আছে।

রুহি ফোন‌ বের করে বেশ কিছু সেলফি তুলে‌ নিলো। এমন সাহসী অফিসারের সাথে সেলফী থাকার ব্যাপারই আলাদা,সবাইকে বলতে পারবে দেখো কার সঙ্গে আমার উঠাবসা!

কিন্তু লোকটার এই হাল হলো কি করে? সে কি খুব ডেঞ্জারাস সিচুয়েশনে পড়েছিল? কে জানে?

হসপিটালে ভর্তি করিয়ে রুহি চুপচাপ বেঞ্চিতে বসে রইলো, ফোন হাতে নিয়ে দেখে রাত প্রায় নয়টা বাজতে চলেছে। নাহ আর বসে থাকা যাবেনা। হসপিটাল থেকে বের হয়ে রুহি বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো। যদিও মনে খচখচানী রয়েই গেল, এমন আহত ব্যক্তির জ্ঞান না ফিরতেই হসপাটালে ফেলে যাওয়াটা কেমন যেন লাগছে। পরে ফেরত এসে নার্সকে নাম্বার দিয়ে বলল, উনার জ্ঞান ফিরলে প্লিজ আমাকে জানাবেন। আর উনার খেয়াল রাখবেন প্লিজ।

নার্স মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই রুহি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল। আজকের দিনটা বড্ড বেশিই ঘটনাবহুল, হাহ!!

চলবে,,,

(আমার প্রিয় পাঠকপাঠিকা, আপনাদের ভালোবাসায় আমি সিক্ত। ৩৪দিন আপনাদের কমেন্ট পড়ে অনেক মুখই চেনা আপনজন মনে হয় এখন। আপনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। আমি এখন সুস্থ আছি আলহামদুলিল্লাহ। আমার জন্য দোআ করবেন। সবার জন্য ভালোবাসা আর শুভ কামনা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here