তরঙ্গিনী পর্ব-৩০ #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী পর্ব-৩০

#আরশিয়া_জান্নাত

আমি আপনাকে কতবার বলেছিলাম আরাফ, আপনি যেন না বদলান। তখন যেমন করে আমার যত্ন করতেন, আগলে রাখতেন সেভাবেই সবসময় রাখবেন। কিন্তু আপনি আমার কথা রাখেন নি। আপনি বদলে যাচ্ছেন,, আমি এজন্যই ভালোবাসতে ভয় পেতাম। আমি জানতাম আমি ভালোবাসতে শুরু করলেই সব বদলে যায়। তৌকিরও আমায় অনেক ভালোবাসতো, কত পাগলামী করতো। কিন্তু দিনশেষে অবহেলা ব্যতীত কিছুই দেয়নি। কিন্তু আপনি তো ওর মতো নন, তবে কেন আপনিও সেই পথেই এগোচ্ছেন?আমি মায়ায় পড়লেই কেন সবকিছু নির্মম হতে শুরু করবে? আমি আপনাকে নিজের স্বামী বলে মানতে শুরু করেছি, নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছি। এর সম্পূর্ণ ক্রেডিট আপনার। তবে এখন কেন এতো অবহেলা? আমিতো আপনাকে অবহেলা করিনি কখনো?মানছি শুরুতে ভালোবাসিনি কিন্তু ঘৃণাও তো করিনি আরাফ! আপনি আজকে আমায় এমনভাবে আলাদা করলেন যেন আমার স্পর্শ আপনার সহ্য হয়না,,আপনি স্মোকার এটা আমি জানতাম না। আপনি বললেন আপনি দেখাননি বলে জানিনি। তবে কি যা দেখিয়েছেন সব মিথ্যে ছিল? কোনটা সত্যি আরাফ? আগেরটা নাকি এখনের টা? আমায় কেন গোলকধাঁধায় ফেলছেন? আমি এসবে ভীষণ দূর্বল আরাফ, আমার কঠিন পরীক্ষা নেবেন না।
ছাদের রেলিং ঘেষে বসে রেবা কাঁদতে কাঁদতে এসব কথাই বলছিল। আজ বহুদিন পর তার এমন বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে। শেষবার যেদিন কেঁদেছিল আরাফ তাকে বুকে আগলে রেখেছিল, অথচ আজ!
রেবা হাঁটুর ভাজে মাথা রেখেই অবিরাম কাঁদতে লাগলো।
ভালোবাসা মানেই যন্ত্রণা। যেখানে ভালোবাসা আছে সেখানে যন্ত্রণা আসবেই। তবে আমি এই যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হতে দিবো না। আপনার মান আমি ভাঙাবোই,,,

আরাফ সিঁড়িঘরে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে রেবাকে দেখে। রেবার কান্নায় ওর মন নরম হয়ে যায়। তবুও কাঠিন্য ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা করে।

আরাফ অফিসের জন্য রেডি হয়ে চুপচাপ বেড়িয়ে যাচ্ছিলো, রেবা ওর পথ আটকে দাঁড়ায়।
আরাফ ভ্রু উঁচিয়ে বলে, কি?
রেবা ওর ঘাড় ধরে টেনে নিজের কপালে জোর করে চুমু নেয়। তারপর জড়িয়ে ধরে বলে, সাবধানে যাবেন, সাবধানে ফিরবেন। আর দুপুরে ঠিক টাইমে লাঞ্চ করবেন।
আরাফ ওর আচারণে খুশি হলেও প্রকাশ করেনা। বরং এমন ভাব করে যেন সে ভীষণ বিরক্ত হয়েছে।
রেবা সেসব তোয়াক্কা না করেই আরাফের দুহাত টেনে নিজের পিঠে রাখলো। কিন্তু আরাফ সেটা সরিয়ে নিলো।
যতক্ষণ আরাফ বাসায় থাকে, রেবা ওর আশেপাশেই থাকে। আরাফ ওকে এড়িয়ে যেতে চাইলে ও জোর করে আরাফের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। রাতে ঘুমানোর সময় ইচ্ছে করে কাঁথা ফেলে দেয় যাতে আরাফ ওর গায়ে কাঁথা টেনে দেয়। আরাফের হাত টেনে‌ নিজের গালের নীচে রেখে ঘুমায়। যখন সে ল্যাপটপে ডুবে থাকে কতবার যে সামনে ঘুরঘুর করে, প্রশ্ন‌করে কথা বলতে চায়। কিন্তু আরাফের হু হা উত্তরে রেবা দমে যায়। একা একা আর কতক্ষণ কথা আগানো যায়? রেবার ভীষণ কষ্ট হয় আরাফের নির্লিপ্ততায়। যে মানুষটার যত্ন‌ আর মনোযোগ পেয়ে সে অভ্যস্ত, তার এড়িয়ে যাওয়া তাকে কতটা পীড়া দেয় বলা বাহুল্য। কবে যে এই মান অভিমান পর্বের সমাপ্তি ঘটবে!


দুপুরে সে আরাফের পছন্দমতো রান্না করে অফিসে নিয়ে গেল একসঙ্গে লাঞ্চ করবে ভেবে। আরাফ রেবা আসার খবর পেয়ে ইচ্ছে করে লাঞ্চ আওয়ারে মিটিং এ গেল। রেবা চুপচাপ ওর কেবিনে বসে রইলো দুই ঘন্টা। কিন্তু আরাফের কোনো খবর নেই। পরে অফিস সহকারী হানিফ বললো, ম্যাডাম স্যার ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ করে ফিল্ডে গেছেন ফিরতে দেরী হবে।

রেবা হেসে বলল, আপনি লাঞ্চ করেছেন?

না ম্যাডাম, সবার লাঞ্চ শেষে করি।

এইগুলো তাহলে আপনি খেয়ে নিন। আর আমার জন্য গাড়ি বের করতে বলুন।

ধন্যবাদ ম্যাডাম। কিন্তু ম্যাডাম আপনি লাঞ্চ করবেন না?

রেবা ঈষৎ হেসে বলল, আমি খেয়েই এসেছি।

রেবা বাসায় ফিরে নিজের ঘরে ঘুমাতে গেল।মনের কষ্টের সামনে ক্ষুধার তীব্রতা স্থান পেল না

আরাফ অফিসে ফিরে হানিফকে জিজ্ঞাসা করলো, রেবা লাঞ্চ করেছিলেন?

হানিফ বলল, না স্যার। উনি সব খাবার আমাকে দিয়ে চলে গেছেন আর বলেছেন উনি খেয়ে এসেছেন।

আচ্ছা যাও।

তারপর রুহিকে ফোন করে বলল, দুপুরে বাসায় কে কে ছিল আজ?

কেন আমি মা,চাচীরা! ভাবী তো তোমার সাথে লাঞ্চ করবে বলে চলে গিয়েছিল।

ওহ।

হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে?

নাহ রাজীব দুপুরে ফিরেছিল কি না জানতে জিজ্ঞাসা করছি।

আচ্ছা।

হুম রাখছি।

আরাফের নিজের উপর অনেক রাগ হলো। সে বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। রেবাকে কষ্ট দিয়ে না নিজে ভালো আছে, না রেবাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে। লাগবেনা এই ঘোড়ারডিমের দূরত্ব মান অভিমান। তার কাছে রেবার ভালো থাকাই মুখ্য। এই যে মেয়েটা অসহায়ের মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বারবার আশপাশ ঘেষছে, কাছে আসতে চাইছে, ওর এটেনশন পেতে কত কি করছে। এসব উপেক্ষা করা কি আরাফের জন্য সহজ? আরাফ উপরে যতোই ডোন্ট কেয়ার মুডে থাকুক ভেতরে ভেতরে রেবার সাথের দূরত্বতা ওকেই বেশি পোড়াচ্ছে। আজকাল রেবা আনমনেই আকাশের দিকে চেয়ে থাকে, আড়ালে কান্নাকাটি করে অথচ সবার সামনে মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে রাখে। কাউকে বুঝতে দেয়না ওদের মাঝে ঘটা সমস্যার খবর। আরাফ মনে মনে ভাবে ভালোবাসা তো গিভ এন্ড টেইক নিয়ম মানেনা। ভালোবাসা দিলেই ভালোবাসা পেতে হবে এমন কোথাও লেখা আছে? রেবা ওকে যদি ভালো নাও বাসে তাতেও কি, ও তো ভালোবাসে। আর ও ভালোবাসে মানেই রেবার দোষগুণ মিলেই ভালোবাসে। রেবার যত্নে ত্রুটি রাখা ও কখনোই বরদাশত করবে না। ওকে হ্যাপি রাখার যে পণ ও নিজেকে করেছে তা নষ্ট করবেনা।
আরাফ ফেরার পথে রেবার জন্য ওর ফেভারিট কাচ্চি বিরিয়ানি কিনে নেয়। মেয়েটা দুপুরে খায়নি, কি জানি অভিমান করে আবার না খেয়ে বসে আছে কি না!
রুমে এসে আরাফ যা দেখে তা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না,

রেবা! এ আপনি কি করছেন?

আরাফ চিৎকার করে দৌড়ে এসে রেবার হাত থেকে চাকু কেড়ে নেয়। ওকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করেই কান্না করে ফেলে।
আমি আপনাকে অনেক হার্ট করেছি তাই না?, সেজন্য আপনি সুইসাইড করতে যাচ্ছিলেন! আপনি একটাবারও ভাবলেন না আপনার কিছু হলে আমার কি হতো? আমি কি নিয়ে বাঁচতাম?আমার ভুল হয়ে গেছে রেবা আমি আর কখনো রাগ দেখিয়ে আপনাকে কষ্ট দিবো না। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ আমি আরেকটু দেরী করলে কি হয়ে যেত আজ!

রেবা হতভম্ব হয়ে আরাফের কান্ড দেখছে। রেবার হঠাৎ মনে হলো, এই আরাফটাই আসল আরাফ, যে তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। তার উপর রাগ করে থাকতেই পারেনা।
রেবা আরাফের চোখ মুছে দিয়ে বলল, এমন মরা কান্না জুড়ে দিলেন কেন বলুন তো? ভালোমতো তাকিয়ে দেখুন আমিতো চাকু দিয়ে আপেল কাটতে যাচ্ছিলাম।

আরাফ ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু দেখে তো মনে হয়েছে আপনি হাত কাটতে,,,,,

আপনিও না! কিসব যে ভাবেন! আমি সুইসাইড করতে যাবো কেন?

আমি এতোকিছু জানিনা, আমার বুকটা ধড়ফড় করছে, আপনি এখানে চুপটি করে থাকুন তো। আমার বুক শান্ত হোক!

রেবা হেসে আরাফের বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। যেন কত যুগ পর আরাফ ওকে আবার কাছে টানলো?
আরাফ ওর কপালে মাথায় এলোপাথারি চুমু খেয়ে বলল, আপনি এমন কেন রেবা? আমাকে কেন এতো কষ্ট দেন, আমি পারি না এতো কিছু সহ্য করতে। আপনি কি একজায়গায় স্থির থাকতে পারেন না?

আমি স্থিরই আছি আরাফ। আপনিই অস্থির হয়ে আছেন।

মোটেই না। আপনি একটুও স্থির নেই। না আপনি নিজে স্থির আছেন,না আমায় থাকতে দিচ্ছেন।

হুহ! সব দোষ এখন আমার?

জ্বি আপনারই।

আমি কি এতোই খারাপ? অনেক অপরাধী?

রেবা!

জ্বি

আপনি আমাকে ভালোবাসেন না তাই না?

ব্যাপারটা তেমন নয় আরাফ! আমি সত্যি বলছি আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।

তবে অতীত নিয়ে পড়ে আছেন কেন?

আরাফ আমি সেদিনের জন্য খুব দুঃখিত। আমার আপনার সঙ্গে ওমন বিহেভ করা ঠিক হয়নি। আসলে হুট করে এমন একটা নিউজ পেয়ে মন খারাপ এড়াতে পারিনি। আর আপনিও তখন এসে প্রশ্ন করেছেন পুরো ঝাঁজটা আপনার উপর গেছে। আমি সত্যিই মন থেকে সরি। তবে বিশ্বাস করুন আমি নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করছি। ভুল মানুষের জন্য মায়া জমানো বন্ধ করে দিয়েছি। আমার সব অনুভূতি, মায়া আপনাকে ঘিরেই। আমায় আপনি দূরে ঠেলে দেবেন না প্লিজ। আমি জানি আপনার জায়গা থেকে আপনি ঠিক আছেন। আপনার জায়গায় আমি হলেও হয়তো সেইম রিয়েক্ট করতাম। তবুও বলছি আমায় ক্ষমা করুন,,,আপনার অবজ্ঞা মুখ ফিরিয়ে নেওয়া আমার জন্য মৃত্যু সমতুল্য

স্যরি রেবা। আমি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি তাই না! কি করবো বলুন আমি মেনে নিতে পারছিলাম না ব্যাপারটা। যাই হোক যা হবার হয়েছে সেসব বাদ দিন। ঐসব ধরে রেখে আর লাভ নেই। আপনার জন্য আপনার ফেভারিট বিরিয়ানি এনেছি, খেয়ে নিন।

রেবা মুখ ভার করে বলল, আমি খেতে পারবো না।

ওমা কেন?

১ সপ্তাহ ধরে আপনি আমায় খাইয়ে দেন‌নি। এখন সেটার শোধ দিন।

আরাফ বেসিনে হাত ধুয়ে বললো, সব হিসেব নিকেশ খাতায় তুলে রেখেছেন বুঝি?

জ্বি, একদম পাই পাই হিসেব তুলে রেখেছি। সব শোধ‌ নিবো। একটা কিছুও বাদ যাবেনা।

আচ্ছা সব শুনবো এবং শোধ করবো আগে খেয়ে নিন, দেখি হা করুন।

রেবা বেডের উপর পা তুলে আয়েস করে বসে আরাফের হাতে খেতে লাগলো। আরাফও রাজ্যের ফিরিস্তি খুলে এটা ওটা বলতে বলতে যত্নসহকারে তার প্রেয়সীকে খাইয়ে দিতে লাগলো। যেন কত কথা জমা পড়েছে এ কয়দিনে। রেবা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আরাফের দিকে,,,,

আসলে স্বামী স্ত্রীর ব্যাপারটাই অন্য রকম। এখানে যতো সমস্যাই থাকুক না কেন দিনশেষে একটা বিশেষ‌ রহমতে সব ঠিক হয়ে যায়। এখানে ইগো জিইয়ে রেখে বা অপরের প্রতি ক্ষোভ পুষে রাখা ঠিক না। একে অপরের প্রতি দয়াশীল হতে হয়,সুযোগ দিতে হয় শুধরে নেওয়ার। কোনো মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। একসঙ্গে থাকতে গেলে অনেককিছুই ঘটবে, তাই অভিমানের পাহাড় জমবার আগেই ভালোবেসে সব ঠিকঠাক করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
একটা কথা সবসময় মাথায় রাখা উচিত স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরলে শয়তান সবচেয়ে বেশি খুশী হয় আর আল্লাহ দুঃখ পান।

🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸
রুহি বুঝের হবার পর থেকেই কারিয়ানকে পছন্দ করে। কিন্তু কারিয়ানের মনের খবর জানার কোনো উপায় নেই। কারিয়ান বরাবর শান্ত প্রকৃতির ছেলে, আর প্রয়োজনের বাইরে বিশেষ কথাও বলেনা। তাই রুহি আগ বাড়িয়ে কিছু বলার সাহসও পায়না। পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ের কথা আকারে ইঙ্গিতে বহুবার উঠলেও নানান কারণে পরিষ্কার করে বলা হয়নি। তবে এবার কারিয়ানের বাবা কবির সাহেব যখন বলেছেন দেশে ফেরার পর একটা চূড়ান্ত ফয়সালা হবে তাই রুহির মনের অবস্থা ভীষণ উড়ু উড়ু। তবে কারিয়ানের মনের ভাব না জেনে রুহি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারছেনা। দেখা গেল সবাই রাজী হলেও কারিয়ান বেঁকে বসলো। তখন রুহির কি হবে? তাই রুহি খুশিতে নাচতেও পারছেনা, আবার দুঃখীও হতে পারছেনা। সে মিশ্র অনুভূতির জোয়ারে ভেসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণছে।

কবে যে ওরা আসবে??

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here