তরঙ্গিনী পর্ব-২৬ #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী পর্ব-২৬

#আরশিয়া_জান্নাত

ব্রেকফাস্ট খেতে বসে রেবার মা বলল, তোর জ্বর কমেছে? কেমন লাগছে এখন?

আরাফ অবাক হয়ে বলল, রেবা আপনার জ্বর ছিল নাকি? বলেন নি তো!

রেবা অপ্রস্তুত গলায় বলল, সামান্য জ্বর ছিল বলে আপনাকে চিন্তায় ফেলতে চাই নি।

রেবার ভাবী বলল, ভাইয়া আসল ঘটনা হলো রেবা আপনাকে চোখে হারায়, আপনি না থাকায় জ্বরে পড়ে গেছে। এখন আপনি এসেছেন ওর জ্বরও গায়েব।

রেবা লাজে রক্তিম হয়ে বলল, ভাবী তুমিও না কি যে বলো!

আরাফ কৃত্রিম হাসি দিলেও মনে মনে ভীষণ রাগ করলো। রেবা তাকে জানালো না কিভাবে!

খাওয়া শেষে রেবা তার ভাবীকে বলল, ভাবী ভাইয়ার বাইকের চাবিটা দাও তো।

রুমা হেসে বলল, নে ধর, তোর জন্যই রেখে গেছে।

থ্যাঙ্কস

রেবা আগে থেকেই রুমাকে বলেছিল এবার আরাফ আসলে ওরা বাইকে করে বেড়াতে যাবে। রেবা প্রফুল্ল মনে রুমে গিয়ে দেখে আরাফ ফোনে কার সঙ্গে কলে কথা বলছে। কথা বলা শেষেই আরাফ বলল, তৈরী হয়ে নিন।

আমিও এটাই বলতে এসেছিলাম তৈরী হয়ে নিন। কিন্তু আপনি বললেন কেন? কোথায় যাবেন?

আরাফ রেবার দিকে না তাকিয়ে বলল, ডাক্তারের কাছে। ২মিনিটে রেডি হন। আমি অপেক্ষা করছি।

রেবা হাতে থাকা বাইকে চাবি আড়াল করে বলল, আচ্ছা।

রেবা চুপচাপ রেডি হয়ে আরাফের পেছনে গেল।

রুমা হেলমেট নিয়ে এসে বলল, রেবা এটা নিতেই ভুলে যাচ্ছিস যে!

আরাফ পিছু ফিরে দেখলো রুমার হাতে হেলমেট। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রেবার দিকে তাকাতেই রুমা বলল, রেবার শখ হয়েছে আপনার সঙ্গে বাইকে চড়ার, তাই ওর ভাইয়া বাইক রেখে গেছে। নিন ওকে নিয়ে বেড়িয়ে আসুন।

আরাফ হেলমেট নিয়ে বলল, থ্যাঙ্কস ভাবী।

বাইকের সামনে এসে আরাফ রেবার দিকে তাকালো, রেবা চাবি বাড়িয়ে দিলো। আরাফ বাইকে বসে রেবাকে বলল, ভালোমতো ধরে বসুন। রেবা আরাফের থমথমে মুখ দেখে মিইয়ে পড়েছে যেন। উনি এতো রেগে গেলেন কেন?

আরাফ প্রথমে ডাক্তারের চেম্বারে গেল, ওখান থেকে বের হয়ে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করলো।

আরাফ আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?

আপনি কি করেছেন যে আমি রাগ করবো?

রেবা মাথা নীচু করে বলল, আপনি সবসময় অনেক প্রেশারে থাকেন, আর সত্যি বলছি বেশি জ্বর ছিল না। এসব মাঝেমধ্য হয়,,

আরাফ জাস্ট চোখ মেলে ওর দিকে তাকালো, ঐ দৃষ্টি স্বাভাবিক ছিল না। রাগ নাকি অভিমান রেবা বুঝেনি, সে শুধু বুঝেছে এটা ভীষণ আলাদা। এরচেয়ে আরাফ যদি ওকে বকাও দিতো ওর এতো খারাপ লাগতো না। আরাফ দুহাত ভাঁজ করে বুকের উপর রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আচ্ছা জ্বরটা স্বাভাবিক ছিল। এতোই স্বাভাবিক আপনি পুরো ২টা দিন বিছানায় পড়েছিলেন, খাবারটাও মুখে নিতে পারেন নি। একা উঠে দাঁড়াতেও পারেন নি। এটা এতোটাই সাধারণ জ্বর ছিল যে আমাকে বলার প্রয়োজনবোধ হয় নি!
রেবা আপনি জানেন এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে, তারপরও জ্বরকে তোয়াক্কা না করে বসেছিলেন? আপনি হয়তো ভুলে গেছেন বা জানেন না আপনার প্রতিটা বিষয় আমার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। নাকি জানেন বলেই এই অবহেলা?

আপনি ভুল বুঝছেন,,

আচ্ছা ভুল বুঝেছি! মানলাম। আমরা কি এখনো এতোটা আপন হতে পারিনি যাতে আপনি বলতে পারেন চলুন বাইকে করে বেড়াতে যাই? আমাকে সব কিছু অন্যদের থেকে জানতে হয় কেন?

আমি বলতেই এসেছিলাম, কিন্তু আপনার মুড দেখে সাহস হয় নি বলার। আর আপনিও তো শুনতে চান নি,,

আরাফ নিজের চুল ঠেলে পেছনে ব্রাশ করলো। দু’হাতে মুখ মুছে পানির গ্লাস থেকে পানি খেয়ে গলা ভেজালো। মাথা ঠান্ডা করতে রেবার দিকে মন দিয়ে তাকালো। রেবা তখনো মাথা নীচু করে রেখেছে। অপরাধী বাচ্চা মেয়ের মতো মুখ করে বসে আছে যেন। এতো কিউট লাগছিল দেখতে,,
আরাফের রাগ পড়ে গেল মুহূর্তেই। নাহ এই মেয়ের উপর রাগ করে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব না। ও যদি এখন কেঁদে ফেলে ওর চেয়ে বেশি কষ্ট আরাফের হবে। আরাফ মৃদুস্বরে ডাকলো, রেবা!

রেবা মাথা তুলে বলল, জ্বি?

আমার ভীষণ কষ্ট হয় আপনি আমার থেকে কিছু লুকালে। আর কখনো এমন করবেন না প্লিজ।

স্যরি আরাফ। আর কখনো এই ভুল হবে না।

কোথায় যাওয়ার ইচ্ছে?

আজকে আর কিভাবে? বেলা তো ফুরিয়ে এলো,

কোথায় যাবেন শুনি?

আপনি জানেন আমাদের এখানে সব স্পটই পানি কেন্দ্রীয়। আর আমার পানিতেই যত আকর্ষণ। এই ভরা বর্ষায় ঘোরার জায়গার অভাব আছে এখানে?

আচ্ছা তাহলে কাল প্রিপারেশন নিয়ে আসবো কেমন? আজ চলুন এমনিই ঘুরি।

বেশ তবে চলুন আপনাকে দেখাই আমাদের সিলেট শহরটা।

আরাফ রেবার উচ্ছাস দেখে পুলকিত হলো। দুই কপোত-কপোতী মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় ঘুরে বেড়ালো উদ্দেশ্যহীনভাবে শহরের অলিতে গলিতে। সাথে স্ট্রিট ফুড তো আছেই,,,


রাতে রেবার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। রেবা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে থাকে, আরাফ আমি মরে গেলে আপনি ভালো দেখে আরেকটা বিয়ে করে ফেলবেন। একা থাকার চিন্তা করবেন না। আমি আপনার জন্য ওপারে অপেক্ষা করবো,আপনি অনেক ভালো আরাফ। আমার অনেক যত্ন করেন।

রেবা আপনি এসব কথা বলা বন্ধ করবেন?

রেবা উঠে বসে বলল, একটু ভেজা কাপড়টা দিন তো।

আমাকে বলুন কি করতে হবে?

রেবা ওর হাত থেকে কাপড় নিয়ে বলল, মানুষের জ্বর হলে কপাল পুড়ে যায়, কিন্তু আমার পায়ের পাতা জ্বালাপোড়া করে।
রেবা বেশি করে পানি দিয়ে পায়ের পাতা মুছলো।

আরাফ দেখে বলল, দিন আমি করে দিচ্ছি।

নাহ! আপনি আমার পা ছুঁবেন কেন? পাপী বানাবেন না,,

কে বলেছে পা ছুলে পাপী হয়?

আপনি আমার স্বামী, পরম শ্রদ্ধাভাজন মানুষ। গুরুজনও বটে। আপনি এ কাজ করতে হবেনা।

আরাফ রেবার কথা শুনে হেসে ফেলল বলল, বোকা মেয়ে অসুস্থ মানুষের সেবায় কোনো পাপ নেই। আমি বুঝেছি কি করতে হবে,

রেবা মাথার যন্ত্রণায় বালিশে মাথা চেপে শুয়ে পড়লো। এই বিছানা পর্যন্ত তার অসহ্য লাগছে, বালিশটাও মনে হচ্ছে পাথর। জ্বর মানেই এতো অসহনীয় উষ্ণতা কেন? এতো গরম লাগছে,,,

আরাফ ওয়াশ রুম থেকে বোলে করে পানি আনলো, টাওয়েল ভিজিয়ে রেবার পা মুছে দিলো। মেয়েটার পা থেকে আসলেই অনেক গরম হাওয়া বের হচ্ছে। অন্য ভেজা কাপড় দিয়ে মুখ, গলা, হাত পা মুছে দিলো। রেবার কাছে মনে হলো এর মতো শান্তি আর কিছুতেই নেই। এতো আরাম লাগছিল ওর, ও ঘুমের রেশে চোখ বন্ধ করেই বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমার ভীষণ আরাম লাগছে।

এসব না বলে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। মেডিসিনটা কাজ দিবে।

যতক্ষণ না শরীরের উষ্ণতা কমলো আরাফ এভাবেই স্পঞ্জ করে গেল।
মাঝরাতে জ্বর পড়তেই আরাফ ওর মাথার কাছে আধশোয়া হয়ে বসে রইলো। রেবাকে মুমূর্ষ দেখতে ওর একদম ভালো লাগছেনা। জ্বরে মুখটা এইটুকুন হয়ে গেছে যেন, এতো মায়া লাগছে!! আরাফ রেবার হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল, হে আল্লাহ আপনি ওকে সুস্থ করে দিন। ওর কষ্ট লাঘব করে দিন, ওকে শেফা দান করুন!

ভোরের দিকে যখন রেবার ঘুম ভাঙে দেখে আরাফ ওর পাশেই আধশোয়া হয়ে ঘুমাচ্ছে। মানুষটাও না পারে বটে! একটু ঠিক করে শান্তিতে শুবে না? নিশ্চয়ই সারারাত এভাবেই শিয়রে বসে ছিল।

রেবা উঠে বালিশ ঠিক করে তাকে ঠিক করে শুইয়ে দিলো। আরাফ তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। রেবা ওর গালে কপালে চুমু খেয়ে বুকে মাথা রেখে বলল, আপনি এতো ভালো কেন আরাফ? আপনাকে যত দেখি, যত জানি ততোই কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নুইয়ে আসে। আমার জন্য দোআ করবেন প্লিজ। আমি যেন আপনাকে আপনার মতোই যত্ন করতে পারি।

আরাফ ওকে জড়িয়ে বলল, আপনি আমাকে একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দিবেন না? কান্নাকাটি করে আমার বুক ভাসাচ্ছেন কেন?

রেবা ওর বুকে আঙুল ঘুরিয়ে বলল, এটা আমার প্রপার্টি, এখানে আমি যা খুশি করবো আপনার কি?

ওহ তাই না? তাহলে জ্বরের ঘোরে এর মালিকানা বদল করার কথা বললেন কেন? আপনার কি ধারণা আপনি না থাকলেই এখানে অন্য কেউ চলে আসবে, এতো সহজ?

কঠিন বুঝি?

উল্টো প্রশ্ন না।

শুনুন, ওটা জ্বরের তীব্রতায় বলেছি। আমি জ্বরে পড়লে কত কি বলি। তবে একটা কথা কি আমি না থাকলে আপনি ছন্নছাড়া হবেন না, ভালোভাবে বেঁচে থাকবেন। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন। কেমন?

রেবা! তখন কিছু বলিনি, কিন্তু এখন এসব বলে মাথা গরম করলে খবর আছে। আমার রাগ দেখেননি কিন্তু,,

রেগে গেলে কি করেন? গায়ে হাত তুলেন নাকি গালি দেন?

গায়ে হাত তুললে বা গালি দিলেই বুঝি রাগ প্রকাশ পায়? আর কোনো উপায় নেই?

রেবা গতকালকের কথা মনে পড়তেই বলল, আপনার রাগ প্রকাশের ছিটেফোঁটা দেখেই তো আমি শেষ, আসল ডোজ পেলে বোধহয় ফুড়ুৎ।

এই তো বুদ্ধিমতি! তাই আমার রাগ উঠানোর চেষ্টা করবেন না। এসব বলা আমার পছন্দ না। ভবিষ্যত আমরা কেউ দেখিনি। যা হবে ভালোর জন্যই হবে। ওটাকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে বর্তমানে বাঁচুন, উপভোগ করুন। মনে রাখবেন নিয়্যত আরমানে বরকত। মনে যা নিয়্যত থাকবে তাই ঘটবে। সো বি পজিটিভ।

আচ্ছা।

আরাফ রেবার গায়ে মাথায় হাত দিয়ে চেক করে বলল, জ্বরতো নেই, এখন কেমন লাগছে? মাথা ব্যথা সেরেছে?

হুম। এতো যত্ন পেলে এসব আর থাকে?

তাই নাকি?

হুম ঠিক তাই। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আর কতবার বলবো এমন ধন্যবাদ আমার লাগবেনা? অন্যভাবে শোধ করবেন।

করবোনা শোধ। সব জমা থাকুক, ঋণ থাকুক আপনার কাছে। কিছু ঋণ পরিশোধ করতে নেই।

এটা চিটিং

এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়্যার!

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here