তরঙ্গিনী পর্ব-২৫ #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী পর্ব-২৫

#আরশিয়া_জান্নাত

আমরা মেয়েরা এক বিশেষ মাটিতে গড়া। আমাদের মনে যেমন সাগরসম মমতা থাকে, তেমনি নিষ্ঠুরভাবে ছুঁড়ে ফেলার মতো মনোবলও থাকে। আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে যেমন মাথায় তুলে যত্নে রাখতে পারি, তেমনি ঘৃণায় মাথা থেকে ফেলে চূর্ণবিচূর্ণ করতে পারি। আমাদের মন প্রয়োজন অনুসারে বদলাতে পারে। অল্পতে কেঁদে বুক ভাসানো এই জাতিটাকে অনেকেই দূর্বল ভেবে ভ্রমে থাকে। সৃষ্টিকর্তা চোখের পানির মাধ্যমে এমন এক নির্যাস বের করে দেন, যা মনের অশান্তি লাঘব করে মনকে প্রশান্তি দেয়। হয়তো এজন্যই পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের হার্ট বেশিদিন সুস্থ থাকে! তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে কান্নাকে শক্তির আধার ভাবি।
রেবা তার প্রেম মুছেছে চোখের উষ্ণ জলে। প্রতিটা অশ্রুবর্জনে তার ভেতরের সবটা ধুয়েমুছে গেছে। এই মনে তৌকিরের জন্য যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও নিষিদ্ধতার বেড়িতে ধুলোবালিতে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। রেবা ওদিকে পা মাড়ায় না, এখন সেই মানুষটার একটা বিশেষ বৃত্ত গড়ে উঠেছে, তার স্ত্রী সন্তান তাকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছে।সেই বৃত্তকে দূর থেকে দেখার ইচ্ছে পোষণ করাও রেবার জন্য পাপ। এতে মানুষ ওকে গিরগিটি বললেও কিচ্ছু যায় আসেনা। তার স্নিগ্ধ অনুভূতি যদি কারো কাছে অযাচিত যন্ত্রণা হিসেবে পরিগনিত হয়, তবে সেই অনুভূতি মুছে ফেলতে দোষ নেই। বরং জিইয়ে রাখা নির্লজ্জতা, চরিত্রহীনতার পরিচয় বহন করে যা সে চায় না।
তাছাড়া এখন সে আরাফকে নিয়েই ভাবতে চায়। সঠিক মানুষের কদর দিতে চায়। ওর সাথেই যখন ভাগ্যের ডোর লেখা, তবে ওকে নিয়েই মগ্ন থাকাই শ্রেয়।

সানজেনা আরাফকে পছন্দ করে, হয়তো ভালোবাসে। তবে তার বোঝা উচিত আরাফ আর একা নেই। সে এখন অন্য একজনের স্বামী। সে এখনো যদি আরাফকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে কিংবা তার মনের প্রতিফলন দেখিয়ে আকর্ষণ টানার চেষ্টা করে এটাকে আর যাই হোক শুদ্ধতম ভালোবাসা বলা যায় না। যে ভালোবাসা অন্যকে দুঃখ দেয়, অন্যের জীবন অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয় সে এবং তাকে যারা বৈধতা দিতে চায় কেউই সঠিক পথের পথিক নয়। তাই প্রতিটা সম্পর্কের একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা আবশ্যক। সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের তেমনটাই শিক্ষা দেয়।
সময়ের সাথে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমান মানুষের কাজ। মনের সব সাধ পূরণ করতে নেই! সব অনুভূতি পুষে রাখতে নেই, কিছু সাধ আহ্লাদ উড়িয়ে দিতে হয় হাওয়ায়। এইসব অপূর্ণতার জন্যই জীবন সুন্দর বৈচিত্র্যময়!

ঘুম ভাঙতেই রেবা দেখে আরাফ ওর দিকে চেয়ে আছে, ওর দিনটা শুরু হয় এমন একটা মানুষকে দেখে যে তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। মহানুভব রব তাকে যেন প্রতিটা ব্যথার প্রশমনকারী হিসেবে পাঠিয়েছেন। তার ভালোবাসার শীতল পরশে রেবা বেঁচে থাকার তীব্র বাসনা পায়। এই মানুষটা না এলে রেবা কি পারতো অতীত ভুলে এগিয়ে যেতে?

সুপ্রভাত

রেবা আড়মোড়া ভেঙে বলল, আপনি এতো ভোরে উঠে বসে আছেন যে? ভালোমতো ঘুম হয়নি?

ঘুম যা হয়েছে আমার জন্য এনাফ। তাছাড়া এমন সুন্দর দৃশ্য ফেলে দুচোখ বন্ধ করে রাখা আমার কাছে অহেতুক মনে হয়েছে।

তাই না? এতো কথা শিখেছেন কোথায় বলুন তো?

শিখিনি ম্যাম। আপনার সামনে এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে আসে।

ইশ কি লজিক জনাবের!

এই রেবা,,

জ্বি?

আপনি এতো সুন্দর কেন?

হুমায়ুন আহমেদ কি বলেছেন জানেন?
সুন্দর বলে কিছু হয় না,আপনি যাকে যত বেশি ভালোবাসবেন,তাকে তত বেশি সুন্দর মনে হবে।

আপনিও না,,, একটুও আবেগ নেই না?

আমি আবেগহীন?

অবশ্যই। এই শান্ত নিবিড় ক্ষণে বরের মুখে এই লাইনটা শুনলে যে মেয়ে এভাবে উক্তি বলে সে আবেগহীনই বটে। আমার কাছে তো সে নির্মম!!

আমি যে নির্মম আজ বুঝলেন? এ তো বহু আগের জানা কথা!

আরাফ রেবাকে বুকের মাঝে চেপে বলল,নির্মম মনে প্রেম জাগলে বেশি ভালোবাসা পাওয়া যায়। সেটা বুঝি বলেই আরো বেশি ভালোবাসি।

রেবা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, ছাড়ুন তো। নির্মম আবেগহীন আরো কত কি আমি না? ছাড়ুন আমাকে।

এই রেবা। এইই

কি হয়েছে?

হবার সুযোগ পেলে তো হতো,

মানে?

আরাফ রেবার গলায় নাক ঘষে বললো, আপনার মন গলেনি রেবা? সবাইকে বলার সুযোগ দিন না আরাফের মেয়ে হয়েছে!

রেবা আরাফের চুলে হাত গলিয়ে বলল, নাম কিন্তু আমি রাখবো, মেয়ে হলে আয়াত আর ছেলে হলে আরহাম।

আরাফ প্রফুল্ল স্বরে চোখ বড় বড় করে বলল, নামও ভেবে ফেলেছেন, তার মানে আপনি সম্মতি দিচ্ছেন!

রেবা চোখ নামিয়ে মাথা নাড়লো।

আরাফ ওর চোখের পাতায় চুমু দিয়ে বলল, থ্যাঙ্কস এ লট!

🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸

মা তোমরা একটা বড় ভুল করেছ। তোমাদের আরো ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।

রুহির কথায় ওর মা চাচীরা সবাই হাতের কাজ ফেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

কোন সিদ্ধান্তের কথা বলছিস?

রুহি কিচেনের কেবিনেটের উপর বসে আপেলে কামড় দিয়ে বলল, তোমাদের উচিত ছিল একই বাড়ির দুই ছেলে দেখে একই দিনে দুই মেয়ে কে বিয়ে দেওয়া। মানিক জোড়কে আলাদা করে দুই প্রান্তে ফেলা ঠিক হয় নি। তোমাদের আরো ভাবা উচিত ছিল,,

ছোট চাচী বলল, এখনো বেশি দেরি হয়নি, তুই বললে ফাহিমের ছোট ভাইকে দেখি?

মেঝ চাচী বলল, হ্যাঁ এটা করা যায়, কি বলো বড় ভাবী? আমাদের আসলেই আরেকটু ভাবা উচিত ছিল। একবারেই দুটোকে দিতাম খরচাও বাঁচতো তুই আর ক’টা দিন আগে বলতে পারলি না?

রুহি নাক তুলে বলল, নাহ ঐ ছেলে কে আমি বিয়ে করবো না।

সেজ চাচী– কেন কি সমস্যা? ছেলে তো ভালোই আইটি সেক্টরে জব করে।

রুহি অসহায় ভঙ্গিতে বলল, তোমরাও না এসেছিলাম তোমাদের আটকাতে উল্টো তোমরাই আটকে দিলে। ধুরর ভাল্লাগেনা।

এই রুহি শোন, পালাচ্ছিস কেন? ভাইজান কে কি বলবো কথাটা এগোতে?

রুহি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। সবাই একযোগে হাসতে লাগলো।

রেহানা বলল, মেয়েটা আসলেই একা হয়ে গেছে, সারাক্ষণ দুটো একসঙ্গে থাকতো তো। মায়া পড়ছে না।

সেজ চাচি–পিঠোপিঠি বোন হলে এই এক কষ্ট।

মেঝ চাচি– কবির ভাই আসবে কবে?

রেহানা—শুনেছি তো এ বছরের শেষদিকে আসবে, তোদের ভাইজান তো বলছে এবার আসলেই রুহির ব্যাপারে কথা বলবে।

ছোট চাচী– কবির ভাই তো বলতে গেলে আমাদের পরিবারের মানুষ। ভাইজানের পরাণের দোস্ত। আশা করি ওখানে রুহি সুখেই থাকবে।

রেহানা– হুম কারিয়ানের জন্য রুহিকে ওরাই তো পছন্দ করেছে। বন্ধুত্বকে আত্মীয়তায় রুপান্তর করার সুযোগ তোদের ভাইজান হাতছাড়া করতে চায় না। আগে দেখি ছেলেমেয়ে কি বলে। ওদের পছন্দই আসল।

মেঝ চাচী– এটা ঠিক বলেছ ভাবী। কারিয়ানকে রুহির পছন্দ হয় কিনা সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাকিসব পরে দেখা যাবে।

রেবাকে সিলেট রেখে দু’দিন পরে আরাফ ব্যাক করলো ঢাকায়। রেবাকে ছাড়া বাসায় তার একদম মন বসছেনা, রাতে রুমে বসে টিভিতে এটাসেটা দেখে সময় পার করার বৃথা চেষ্টা করা তার রোজকার রুটিন হয়ে গেছে। চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ রেবার কল পেয়েই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে তার। আরাফ কল রিসিভ করে বলল, আলহামদুলিল্লাহ লম্বা হায়াৎ আপনার! আপনার কথাই ভাবছিলাম

কেমন আছেন? কি করছিলেন?

ভালো নেই একটুও, আপনাকে অনেক মিস করছি। আপনি ভালো আছেন?

হু

রেবা?

জ্বি!

কিছু হয়েছে? কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে যে?

না, এমনি মন খারাপ লাগছে,,

কেন?

জানিনা

এই বলবেন না আমাকে?

আপনার জন্য খারাপ লাগছে,,,

হায়ইইইই আমিতো উড়ে যাচ্ছি!

জানতাম এমন কিছুই বলবেন, তাই বলতে চাই না।

এটা আপনার অন্যায়। খুশি হলে প্রকাশ করতে পারবোনা?

আপনি কি রুমে আছেন?

হুম কেন?

ক্যামেরা অন করুন আপনাকে দেখবো।

আরাফ হেসে বলল, আমায় দেখতে ইচ্ছে করছে বুঝি?

রেবা আড়ষ্ট কন্ঠে বলল, আপনি না চাইলে থাক।

আরাফ ক্যামেরা অন করে রেবার দিকে তাকালো। রেবা ভিডিও কলে অস্বস্তিবোধ করলেও আজ আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো।

রেবা?

হুম

এভাবে চেয়েই থাকবেন। কিছু বলবেন না?

আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি,,,

আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি। এই রেবা আমি কি আপনাকে নিতে আসবো? বেড়ানো শেষ‌ হয়েছে আপনার?

চলে আসুন, আপনাকে ছাড়া ভালো লাগছেনা। ঘুমও হচ্ছেনা ঠিকঠাক। কোথায় ভেবেছিলাম ক’টা দিন ঘুমিয়ে উঠবো। কি জাদু করেছেন বলুন তো?

আরাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আমি কিছুদিনের মধ্যেই আসছি। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন কেমন? মন খারাপ করবেন না,, সবার সঙ্গে সময়টা উপভোগ করুন।

আচ্ছা। রাতে ঠিকমতো খেয়ে ঘুমাবেন। টেনশন করবেন না। রাখছি।

নিজের যত্ন নিবেন।

আরাফ ফোন‌ রেখেই ব্যাগ গোছালো। তখনই রওয়ানা দিলো সিলেটের উদ্দেশ্যে।

রেহানা হেসে বলল, তোমার ছেলে তোমার মতোই হয়েছে। বৌ’টা একটু বাপের বাড়ি গিয়ে শান্তি পেলো না। যাচ্ছে নিয়ে আসতে।

এমনভাবে বলছো যেন তুমি এমন নও? চিঠি লিখে কে বলতো এসে নিয়ে যাও, ও বাড়িতে মন টিকছে না? ঐ চিঠি পেয়েই তো ছুটতাম তোমায় আনতে,,,

তো কি করবো তোমার যত্নাদি করতে করতে এমন অভ্যাস হয়েছে বাপের বাড়ি গেলেও মন পড়ে থাকতো এদিকে, তুমি খেয়েছ কি না, ঠিকঠাক ঘুমাচ্ছ কি না। চিন্তাতেই তো আধসের হয়ে যেতাম।

এখন ভিন্নভাবে প্রকাশ করলেও অর্থ কিন্তু ঐ একটাই!

রেহানা হেসে বলল, ওদের সংসার সবসময় এমনি করে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকুক।

আমিন।


রেবা ঘুমের মাঝেই টের পেলো কেউ একজন ওকে পেছন‌ থেকে জড়িয়ে রেখেছে। প্রথমে ভাবলো তার মা হয়তো। ঘুমের চোখেই কোমড়ে জড়ানো হাত ধরে বুঝলো আরাফের হাত এটা। ও কি স্বপ্নে এতোটাই বিভোর যে আরাফের স্পর্শ স্পষ্ট টের পাচ্ছে?

আরাফ ওকে আরো গভীর করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, এটা স্বপ্ন নয় সত্যি।

রেবা চমকে লাফিয়ে উঠে, তাকিয়ে দেখে সত্যিই আরাফ এসেছে!

আপনি এখানে? কখন এলেন?

আরাফ হেসে বলল, আপনার কি মনে হয় আমার বৌটার মনমরা গলা শোনার পরও আমি ওখানে চুপচাপ বসে থাকতে পারতাম?

তাই বলে নাইটে জার্নি করে এলেন?

হু!

আপনিও না!

আমিও না কি?

বড্ড উন্মাদ!

আপনারই,,

জানিতো।

সারপ্রাইজ টা কেমন লাগলো?

আবেগে কাঁপুনী ধরানো,

তাই বুঝি?

রেবা ওকে জড়িয়ে গালে কপালে চুমু খেয়ে বলল, কত্ত মিস করেছি আপনাকে জানেন? উফফ এতোক্ষণে দেহতে প্রাণ ফিরল যেন।

আপনি আরো আগে বললেই পারতেন আমি চলে আসতাম।

ভেবেছিলাম সবসময় তো আসবো না। ক’টা দিন বেড়িয়ে নেই।

আচ্ছা। তা ৫দিনেই বেড়ানো শেষ?

হুম।

আমি ভাবতাম আমিই বৌ পাগল। এখন দেখছি আপনিও দারুণ বরপাগল।

রেবা কোনো‌ জবাব দিলোনা, আরাফের বুকে মুখ গুজে নিরব হয়ে রইলো।

আরাফ মুচকি হেসে রেবাকে জড়িয়ে রাখলো। ভালোবাসা এতো প্রশান্তিময় কেন??

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here