তরঙ্গিনী পর্ব-২৪ #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী পর্ব-২৪

#আরশিয়া_জান্নাত

মানুষের মাঝে একটা অদ্ভুদ পশুত্ব বিদ্যমান। সে সবসময় অন্যের সুখে সুখী হতে পারেনা। হয়তো উদারমনা মানুষ মুখে বলে ও সুখে থাকলেই আমিও সুখি। কিন্তু তিক্ত বাস্তবতা হলো, আপনি যাকে একসময় ভালোবাসতেন বা যে আপনাকে একসময় খুব ভালোবাসতো, তার দুঃখী চেহারা কিংবা আপনার অনুপস্থিতির ছাপ তার মাঝে স্পষ্টত দেখাই মনের অজান্তে কল্পনা করেন। যখন সেটা হয়না না চাইতেই মন খারাপ হয়। আমরা যাকে ভালোবাসি, যে আমাদের প্রাক্তন, তাকে সুখে থেকো বলাটা সহজ হলেও- সে আমাদের ছাড়া ভালো আছে কিছু ক্ষেত্রে দিব্যি সুখেও আছে এটা আমাদের মেনে নেওয়া সহজ হয়না। বুকের মাঝে একটা তীব্র হাহাকার ঠিকই জানান দেয় ও কেন ভালো আছে? আমায় ছাড়াও কেন এতো ভালো আছে?

এই কঠিন সময়টা রেবা পর করেছে। তৌকির ওকে ভুলে গেছে, একটা মিষ্টি মেয়েকে নিয়ে সংসার পেতেছে, তার জমানো দীর্ঘ বছরের প্রেমকে পায়ে পিষে কি অনায়াসেই না চলে গিয়েছিল সে? মানুষের মন এত পাষন্ড হতে পারে, এতো বছরের স্মৃতি যাকে একটুও কষ্ট দেয় না,ভাবায় না, সেই মানুষটার জন্য কত রাত রেবা চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়েছে। সময়ের সাথে আরাফের প্রচেষ্টায় রেবা ঐ কঠিন মায়া ভুলে এগিয়েছে ঠিকই। কিন্তু বুকের মাঝে রয়ে যাওয়া দগদগে ক্ষতটা কি এতো সহজে নিশ্চিহ্ন হয়?
তৌকিরের ধারণা ছিল রেবার অতো সহজে বিয়ে হবেনা, বা হলেও মধ্যবয়স্ক কারো সাথেই হবে। রেবা হয়তো এখনো ওকে ভেবেই। কান্নাকাটি করে, মুভ অন করা রেবার পক্ষে অসম্ভব। এমনই এক আত্মঅহং এ ডুবেছিল সে। নিজেকে দামী মানুষ বলেই মনে হতো, বাবাহ ওর জন্য একটা মেয়ে এখনো কাঁদে এটা কি কম গর্বের? এতে যে পৈশাচিক আনন্দ মেলে তার কি সংজ্ঞা দেওয়া যায়? রাইসা যখন তাকে মাঝেমধ্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলে, তৌকির তখন এই ভেবে শান্তি পায় এই পৃথিবীতে একজন আছে যে ওকে মাথায় তুলে রাখে। দূরে হলেও ঠিকই তার জন্য দোআ করে।
অথচ তৌকির ভুলে যায় অনাদরে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে কিছুই টিকে থাকেনা। আর এ তো রক্তেমাংসে গড়া মানুষের পরিবর্তনশীল মন! এই পৃথিবীতে কারো অনুভূতিকে অবজ্ঞা করা কত নির্মম!

আরাফের সঙ্গে রেবাকে দেখে তৌকিরের বহু বছরের দাম্ভিকতায় আঘাত হানে। রেবাকে কেউ একজন রাণীর মতো আগলে রাখতে পারে এ যেন তার কাছে আকাশ কুসুম কল্পনা।

তৌকিরের হঠাৎ করেই মনে হতে থাকে রেবার সেইসব বৈশিষ্ট্য যার আকর্ষণে সে কতদিন উন্মাদ ছিল। রেবা! হ্যাঁ রেবা, সেই সদ্য অঙ্কুরিত হওয়া পুষ্পের ন্যায় কোমল কিশোরী মেয়েটা। তারুণ্যের দোরে পা রাখার আগ মুহূর্তে মেয়েদের সৌন্দর্যের যে আভা ছড়ায় তার সামনে পৃথিবীর কোনোকিছুর তুলনা হয়না। রেবার হাসি, চোখের লাজুক চাহনী, কথার বলার সময় মাথা নীচু করে উড়নার কোণে আঙুলে প্যাঁচানো, ভয়মিশ্রিত কন্ঠে রাতের ফোনালাপ, সবকিছু যেন ক্রমান্বয়ে প্রতিফলিত হতে থাকে মানসপটে। তৌকিরের মনে তীব্রভাবে জেগে উঠে কয়েকবছর আগের অতীত হওয়া ধুলোবালিতে জমা প্রেম! নিজেকে মনে হয় অনেক বিভৎস কীট। কিভাবে পেরেছিল সে রেবার সকল ত্যাগ তিতিক্ষাকে ভুলে যেতে? মেয়েটা কত কিই না করেছিল ওর জন্য, অথচ ও বিনিময়ে কি দিয়েছিল? নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে তার। কিন্তু সেই ভাবনা স্থায়ী হবার সময় পায়না। রাইসার ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে সে,

চলো বরকনের সঙ্গে ছবি তুলি।

এখন তুলতেই হবে?

ওমা বিয়েতে আসছি যে ছবি আপলোড করবো না? তাছাড়া সাফিনকে দেখাবা না ওর বন্ধুর বিয়ে কেমন হলো!

ওহ হ্যাঁ। চলো।

তৌকিরকে দেখে ফাহিম হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করে জড়িয়ে ধরলো।

ভাইয়া আপনি এসেছেন! অসংখ্য ধন্যবাদ। আস্সালামু আলাইকুম ভাবী। ভালো আছেন তো? খাওয়া হয়েছে আপনাদের?

হ্যাঁ, তোমার কথা কত শুনি তোমার ভাইয়ার কাছে। এসে অনেক ভালো লেগেছে। অনেক অনেক শুভ কামনা তোমাদের জন্য

থ্যাঙ্কস।

এই সেলফি তুলো না,

তৌকির ফোন বের করে হাসিমুখে সেলফি তুলল।

রেবা তখন আশেপাশে না থাকায় তাকে দেখল‌ না।

আরাফ চেয়ারে সোজা হয়ে বসে রইলো, রেবা তাঁর কাধে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। সারাদিন এতো দৌড়ঝাপের মধ্যে ছিল এক দন্ড রেস্ট করার সময় পায়নি। এখন ঘাড়মাথা ধরে এসেছে যেন।
রেবা মোলায়েম স্বরে বলল, এখন কেমন লাগছে?

অনেকটা ভালো লাগছে, থ্যাঙ্কস।

রেবা মাথার পেছনে আঙুল দিয়ে আলতো করে ম্যাসাজ করে বলল, একটু পরেই তো পিহুকে নিয়ে যাবে, সেই পর্যন্ত একটু কষ্ট করুন। বাসায় গিয়ে হট শাওয়ার নিবেন, আরাম লাগবে।

আরাফ রেবা পেটে হেলান দেয়ে মাথা উঁচু করে বলল, আপনি যে ম্যাসাজটা করছেন না ওতে আমি আরো ২৪ঘন্টা খাটতে পারবো। ডোন্ট ওরি!

দেখি আপনি আমার সামনে বসুন তো। আপনার উপরও কম ধকল যায় নি। জিরোন একটু,,

জিরোবো তবে এখন না। আপনার ভালো লাগলে চলুন ওখানের কি হাল দেখি।

হুম চলুন।

রেবা শাড়ির আচল ঠিকঠাক করে কুচি সামলে এগোতে লাগলো। তখনই তৌকির আর রাইসা ওদের সামনে দিয়ে আসছিল। রেবা তৌকিরকে দেখে ভীষণ চমকে গেলেও প্রকাশ করলো না, শান্তদৃষ্টিতে তার বৌবাচ্চাকে দেখে তৌকিরের চোখে চোখ রাখলো,
তৌকির ও রেবার দিকে চেয়ে রইলো, আরাফ ওর হাত ধরে কি সুন্দর কথা বলে বলে যাচ্ছে, এই মুহূর্তে আরাফকে ভাগ্যবান বলেই মনে হচ্ছে তার।
রেবা আর তৌকির পাশাপাশি বিপরীত দিকে পথ অতিক্রম করলো। চারপাশের কোনোকিছু প্রভাবিত না হলেও দুটো মানুষের আত্মা একটু হলেও কেঁপে উঠেছিল
রেবা চোখের কোণ ভরে আসার আগেই হাসিমুখে আরাফের বাহু ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। একটিবারও পেছনে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করলোনা অতীত হয়ে যাওয়া সুখী মানুষটাকে,,, পিছু ফিরলেই দেখতো একজোড়া চোখ নিবদ্ধ হয়েছিল তার দিকে যতদূর পর্যন্ত তাকে দেখা যায়।


ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পিহুকে বিদায় দিয়ে সকলেই অশ্রুসিক্ত হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। আরাফ গাড়ি থামিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। বোনকে বিদায় দেওয়ার পর প্রতিটা ভাইয়ের মন খারাপ থাকে, আরাফও তার ব্যতিক্রম নয়। রেবার ওর পাশে এসে বললো, মন খারাপ করবেন না। দোআ করুন ওরা যেন সুখী হয়।

জানেন রেবা বড় আপুর বিয়ের সময় আমি অনেক কান্না করেছিলাম। আপু চলে যাচ্ছে এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য তখন কঠিন ব্যাপার ছিল। আপু কত করে বুঝালো আবার চলে আসবে, আমরা সবাই গিয়ে তাকে নিয়ে আসবো। কিন্তু আমি তাকে ছাড়িনি। পরে আমায় সাথে নিয়েই আপু শ্বশুড়বাড়ি গেল। আজ দেখুন আমি বড় ভাই হওয়ায় তেমনটা করতে পারিনি। আমি এখন বড় হয়ে গেছি না? আমি কিভাবে সবার সামনে কান্না করে বলতাম আমার বোনকে নিও না? সময় বদলেছে কিন্তু অনুভূতি তো বদলায় নি।
আমিতো বদলাই নি!

রেবা আরাফকে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনি মন ভরে কাঁদুন আমি কিচ্ছু মনে করবোনা। কেঁদে আপনার মন শান্ত করুন।

আরাফ রেবাকে শক্ত করে ধরে কাঁদতে লাগলো। রেবা মনে মনে বলল,আল্লাহ আপনি এই নরম দিলের মানুষটাকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করুন।

রেবা বেলকনীতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো, তৌকিরের ছেলেটা অনেক কিউট হয়েছে দেখতে। তৌকির ভালোই আছে, কি সুন্দর পারফেক্ট ফ্যামিলি ওর। স্ত্রীকে নিয়ে অনেক ভালোই আছে হয়তো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, আমাদের গল্পের সূচনা একসঙ্গে হলেও সমাপ্তি ঘটেছে ভিন্ন দুটি চরিত্রের সাথে। তোমার গল্পের নায়িকা রাইসা, আর আমার গল্পের নায়ক আরাফ! তুমি ভালো আছ তৌকির, অন্য কারো সঙ্গে ঘর বেঁধেই ভালো আছ,,,অবশ্য আমিও অনেক ভালো আছি। হয়তো এটাই ছিল উপরওয়ালার লেখা। আমাদের আর কখনো দেখা না হোক,,,

রেবা!

জ্বি?

ঘুমাবেন না?

হ্যাঁ আসছি,
🥀🥀🥀🥀🥀🥀🥀🥀🥀

আরাফের মনমেজাজ একদম খারাপ হয়ে গেছে। নাহ সানজেনাকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছেনা। মেয়েটার সমস্যা কি? এতোদিন বাসায় তাও মানা গেছে আজকাল অফিসে এসেও বিরক্ত করছে। এসবের মানে কি? আগে তো এমন ছিল না, এখন এমন হয়েছে কেন? বড় বোনের ননদ বলে চুপচাপ সহ্য করলেও এখন তার কার্যকলাপ মোটেই সহনশীল রইছেনা। রেবা এই পর্যন্ত অফিসে না আসলেও সানজেনা অনেকবার এসে গেছে। তাইতো সেদিন ও বলেছিল রেবা যেন অফিসে আসে। ওর সঙ্গে সময় কাটায়। এই সমস্যা দূর করতে কি করা যায়?

হঠাৎ রেবাকে আসতে দেখে ওর সব বিরক্তি নিমিষেই মিশে যায়। ওর ম্যানেজার রেবাকে আরাফের কেবিনে এনে বলে, ম্যাম এটা আরাফ স্যারের কেবিন, আপনি ভেতরে যান।

ধন্যবাদ ম্যানেজার সাহেব।

আরাফ উঠে এসে বলল, হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! আপনি সত্যিই এসেছেন?

রেবার ওর চেয়ারে বসে চারদিকে তাকিয়ে বলল, এতো অবাক হবার কি আছে? আপনি যখন বলেছেন আমি আসবোনা?

নাহ সেটা না, তবে এমন সময় এসেছেন যখন আমার ভীষণ দরকার ছিল।

আপনার জন্য লাঞ্চ নিয়ে এসেছি। কোথায় খেতে বসেন, এখানেই?

হুম।

একজন এসে লাঞ্চবক্স দিয়ে গেল, রেবা বক্স খুলে আরাফের জন্য খাবার পরিবেশন করলো। নিন শুরু করুন।

আপনি খেয়েছেন?

হুম।

রেবা টেবিলের উপর রাখা ফটোফ্রেমে তাদের বিয়ের ছবি দেখে বলল, আপনি এই ছবিটা এখানে রেখেছেন, সুন্দর তো ছবিটা!

আপনার পাশে তোলা সব ছবিই সুন্দর। তবে এটা একটু বেশিই সুন্দর।

আমি জানতাম ছেলেরা নিজেদের ম্যারিড বোঝাতে পছন্দ করেনা, আপনি দেখি উল্টো! বিয়ের ছবি এটে বসে আছেন, দেখো সবাই আমার বৌ আছে! হাহাহা

শুনুন সবাই এক না, যাদের মনে অন্যকিছু আছে তারাই বিয়ের মতো সুন্দর ব্যাপারটা হাইড রাখে। আমিতো পারলে ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে বলতাম।

রেবা ওর পাতে আরেকটু তরকারি দিয়ে বলল, বলুন না বাধা দিয়েছে কে?
একটু থেমে ফের বলল, আরাফ! যা আপনাকে অনাকাঙ্খিত চিন্তায় ফেলেছে তা নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দিন। কিছু জিনিসকে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলতে হয়। মেন্টালি প্রেশার নিয়ে না।

আরাফ চমকে তাকালো রেবার দিকে। রেবা রহস্যময়ী ভঙ্গিতে হাসলো।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here