তরঙ্গিনী (পর্ব-২১) #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী (পর্ব-২১)

#আরশিয়া_জান্নাত

পিহু ফোনে তার হবু বর ফাহিমের সঙ্গে কথা বলছে, আর রুহি অনলাইনে স্ক্রল করছে। যবে থেকে পিহুর বিয়ে ঠিক হয়েছে রুহির সাথে কথা বলার টাইম ই পায় না। রুহিও বিরক্ত হয়ে ফোন নিয়েই বিজি থাকে। পিহুর কথা বলা শেষ হলে রুহি বলে, আচ্ছা পিহু ক’দিন পর তো চলেই যাচ্ছিস তার কাছে, এখন এতো কথা বলতে হয় কেন? কোথায় আমার সঙ্গে বেশি করে কথা বলবি তা না,,,

তোর সাথে আমি ২২ বছর ধরে আছি। কম কথা বলেছি?

বিয়ের পর ওখানে কত বছর থাকবি বল? আর ২২ বছর তো কথা বলিসনি, কথা শিখে বুঝের হয়েছিস ধরলাম ১০ বছরের। তো হিসেব করলে ১২ বছর কথা বলেছিস। পুরো জীবনে মাত্র ১২ বছর বোনকে দিলি। আর সবটাই তো বরকে দিবি। তো এখন তুই বল কাকে সময় দেওয়া উচিত?

পিহু ভেবে বলল, আসলেই তো!

হুম এখন তোর মেরিডিয়ানকে বল বিয়ের আগে কোনো কথা নাই, এই সময়টা আমি আমার বোনকে দিবো।

ধুরর এভাবে বললে রাগ করে যদি?

করলে করবে।

রুহি বিয়ের ক’দিন আগে সবাই তো এমন কথা বলে, তুইও বলবি। তাহলে আমার বেলা নিষেধাজ্ঞা কেন?

আমি বোর হচ্ছি বুঝোস না?

বাইরে যা না, কত মানুষ আছে আড্ডা দে গিয়ে।

হু এখন তো আমারে ভালো‌ লাগবেনা। বিয়ে না হতেই জোড় ভেঙে দিলি।

রুহি গাল ফুলিয়ে বের হয়ে গেল। পিহু ওকে আটকাতে যাবে তখনি ফাহিম আবার কল দিলো। সে সব ভুলে কথায় মগ্ন হয়ে গেল।

আরাফ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হতে রুমে যায়। রেবা সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে বলল, কখন ফিরবেন?

বিকেলেই ফিরবো। কেন কিছু লাগবে?

নাহ।

রেবা ওর টাই বেধে দিতে হাত বাড়ালো, আরাফ ওর কোমড় জড়িয়ে বললো, আপনার আশেপাশে থেকে থেকে এমন অভ্যেস হয়েছে, অফিস যেতে মন চায় না।

তাই বুঝি?

জ্বি ম্যাম!

আচ্ছা শুনুন না। আমি ভাবছিলাম কি আপু আমায় এতো সুন্দর গিফট দিলো, আমারো কিছু দেওয়া উচিত না?

আপনার ইচ্ছে হলে দিবেন।

কি দেওয়া যায়? আপুর কি পছন্দ?

এমন একটা গিফট দিন যা ওকে একদম সারপ্রাইজড করে দিবে,

কি সেটা?

দেখুন, ও তো একবারো ফুপী হলো না, আপনি বরং ওকে ভাইপো বা ভাইঝি গিফট করুন। বেচারী খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবে।

ধুরর আপনিও না সবসময় ইয়ার্কি করেন ভাল্লাগেনা।

ভালো মানুষের দাম নেই আসলে। কি দারুণ আইডিয়া দিলাম পাত্তাই দিলেন না।

আপনার সব আইডিয়া ঐ বাচ্চা ঘিরেই!

নাহ তেমন না,,

হয়েছে থাক, আমিই বের করবো কি দেওয়া যায়। আপনি সাবধানে যাবেন। দুপুরে লাঞ্চ সময়মতো করবেন। কাজের বাহানায় দেরি করবেন না কিন্তু।

রেবা আপনি মাঝেমধ্যে অফিসে আসতে পারেন কিন্তু,,

নাহ, আমার অপেক্ষা করতে ভালো লাগে। আপনাকে সারাদিন না দেখার বিরহটা উপভোগ কর।

ওয়াহ! থিংকিং জাস্ট অওসাম!

ধন্যবাদ।

আচ্ছা আসছি,

রেবা ওর যাওয়ার দিকে অবাক হয়ে চাইলো, আরাফ ফের পিছে এসে ওর কপালে চুমু দিতেই ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো।


রেবা ওর মায়ের রুমে গিয়ে বলল, মা কি করছো?

এমনিই বসে আছি। আয় আমার কাছে বস।

আপা কোথায়?

ওরা তোর ননাসের সাথে।

তুমি একা বসে আছ যে?

এমনিই।

মা তেল নিয়ে আসি মাথায় লাগিয়ে দাও,,

আয়

রেবা তেলের বোতল এনে তার মায়ের পায়ের কাছে বসলো,
তোকে এমন হাসিখুশি দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।

উনি আমার যত্ন করে, আমাকে রাণীর মতো রাখে। জানো মা আমি রাতে ভাত খেতে না চাইলে বাবা যেমন নানান বাহানা দিয়ে খাওয়াতোই উনিও তেমন করে। আমার ভাগ্য এতো ভালো হবে আমি ভাবিনি।

মাশাআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ শুনে মনটা জুড়িয়ে গেল রে মা। তোকে নিয়ে আমার কত চিন্তা হতো জানিস, আল্লাহর কাছে সবসময় বলেছি তিনি এমন একজনকে পাঠাক যে তোর সব দুঃখ মুছে দিবে। তিনি আমার দোআ কবুল করেছেন। জামাইয়ের যত্ন করিস মা, কখনো অবহেলা করবি, অভদ্রতা করবিনা। সে তোকে যেমন ভালোবাসে তুইও বাসবি। তার পরিবারের সবাইকে যত্ন করবি।

দোআ করিও আমার জন্য, তোমার দোআই সব আমার জন্য।।

দেখেছিস খুকি আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। ঐ বদ তোর জীবন থেকে গেছে বলেই এমন ভালো ছেলে পেয়েছিস।

রেবা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, তোমার এই মালিশ যা মিস করছিলাম। মাথা একদম ঠান্ডা হয়ে গেল।

কতদিন বাড়ি আসিস না। আমার বুকটা কত পোড়ে তোর জন্য,,

এসবকিছু মিটমাট হোক তারপর যাবো সিলেট।

তুই বললে এবার আমাদের সাথে চল?

আচ্ছা উনাকে জিজ্ঞাসা করে বলবো।

রুহি লনে বসে চকলেট খাচ্ছে, এমন সময় সানজেনা বলল, হেই রুহি একা বসে কি করছো? পিহু নেই যে?

কেন একা বসতে পারিনা?

তা নয়, আমি সবসময় তোমাকে ওর সাথেই দেখি তো তাই আর কি। তুমি কি আপসেট?

কি বলবো বলো! ওর হবু বরের খেয়েদেয়ে কাজ নেই সারাদিন কল দেয়।

হুম ৬মাস তো তাদের কাজ থাকেনা। তাই এমন।
তা তুমি বিয়ে করছো কবে? পছন্দের কেউ আছে নাকি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করবে?

দেখি মা বাবা কি বলে, আমি আর একা পড়ে থাকবো কেন? তবে মনে হয় না ছোট ভাইয়ার বিয়ের আগে আমাকে দিবে।

আমার তো মনে হচ্ছে না তোমার ছোট ভাইয়া এখুনি বিয়ে করবে।

কেন?

ভাবীর কাছে শুনেছি সে নাকি বিয়ে ভয় পায়। মানে রেসপন্সিবিলিটি নিতে চায়না। আরো কয়েকবছর ট্যুরেই কাটাবে হয়তো।

হুম তা ঠিক। ছোটভাইয়া ভ্রমণবিলাসী। এই পর্যন্ত ৩৪টা জেলা ভ্রমণ করেছে। ওর প্ল্যান নিজের দেশের ৬৪টা জেলা শেষ করে অন্য দেশে যাবে।

ওর এই প্যাশনটা আমার জোস লাগে।

তুমি বিয়ে করবেনা? তোমার বফ আছে?

নাহ,, ডেট করেছি অনেকের সাথে, বাট মনমতো পাচ্ছিনা আসলে, আর দেশের সবাই তো বিয়ে করে ফেলেছে,,,

কি যে বলো। ছেলের কি অভাব আছে নাকি? তুমি দেশী চাইলে বলতে পারো, ভাইয়াদের অনেক সিঙ্গেল ফ্রেন্ড আছে।

আরেহ না না। আমি আর দেশে বিয়ে করবোনা। ওখানের কাউকেই করবো। দেশে আসা আর সম্ভব না।

কেন?

এমনি,আচ্ছা আরাফ ভাইয়া উনার ওয়াইফকে অনেক পছন্দ করে তাই না?

হুম।

আমি ভাবতাম উনি খুব রাগী, উনার বৌয়ের এডজাস্ট করতে অনেক সমস্যা হবে। কিন্তু এবার এসে দেখি উনি টোট্যালি চেইঞ্জড!

রাগ কমেছে কি না জানিনা, তবে ভাইয়া অনেকটাই ঠান্ডা হয়ে গেছে।
এখন আর হুটহাট রেগে যায় না।

দ্যাটস গ্রেট!

পিহু এসে বলল, তুই এখানে আর আমি তোকে পুরো বাড়ি খুঁজছি।

পুরো বাড়ি না খুঁজে কল দিলেই পারতি।

পিহু মাথা চুলকে বলল এই বুদ্ধিটা মাথায় আসেনি। যাই হোক চল আমরা শপিং এ যাবো।

এখন কিসের শপিং?

পিহু সানজেনাকে বলল,আচ্ছা আপু পরে দেখা হচ্ছে। টাটা।

রুহিকে টেনে পিহু গাড়ির সামনে নিয়ে গেল।

রুহি ওর হাত ঝাড়া দিয়ে বললো, এতো টানছিস কেন ? রহস্য কি খুলে বল। নয়তো আমি এককদমও এগোবো না।

পিহু ওর গলা জড়িয়ে বলল, চল না টুকটাক শপিং করবো, তোকে তোর ফেভারিট স্টেইক খাওয়াবো তবুও চল।

এবার আমি কনফার্ম সামথিং ইজ ফিশি!
ঐ মেরিডিয়ান বের হতে বলছে তোকে না? হালা ছ্যাঁচড়া পান্ডা!

তুই এসব কি বলিস ও তোর দুলাভাই না?

এহহ দুলাভাই না কচু।

এতো রেগে থাকিস কেন বল তো? চল না

রুহি না চাইতেও পিহুর সঙ্গে গেল।


আরাফ অফিস থেকে ফিরে শুয়ে রইলো, রেবা ওর মাথার কাছে বসে বলল, জনাব কি জেগে আছেন?

আরাফ কোনো শব্দ করলো না।

রেবা আরাফের নাকে চুমু দিয়ে বলল, ঘুমানোর অভিনয়টা ভালো ছিল!

আরাফ ওকে টেনে বুকে উপর ফেলে বলল, কোথায় থাকেন হু? আমি যে এসেছি খবর পাননি?

রেবা ওর বুকে নাক ঘষে বলল, হাতের কাজটা সেরে এসেছি, আপনি তো জানেন আমার অর্ধেক কাজ ফেলে রাখা পছন্দ না।

রেবা

জ্বি?

আপনি ভালো আছেন?

হুম। এখন তো অনেক ভালো আছি

তাই বুঝি?

জ্বি বাবুজি!

আরাফ গড়িয়ে ওকে বেডে রেখে ওর ওপর ঝুকে তাকালো, আরাফের গরম নিঃশ্বাস মুখের উপর পড়তেই রেবা চোখ বন্ধ করে ফেলল।
আরাফ মুচকি হেসে রেবার মুখের উপর ছড়িয়ে থাকা এলোচুল আলতোভাবে সরিয়ে বলল,
শোনো,
কাজল চোখের মেয়ে
আমার দিবস কাটে, বিবশ হয়ে
তোমার চোখে চেয়ে।
এই যে মেয়ে কাজল চোখ
তোমার বুকে আমায় চেয়ে
তীব্র দাবির মিছিল হোক।
(সাদাত হোসাইন)

রেবা ওর গলা জড়িয়ে বলল, কবিতাও মুখস্ত করা হচ্ছে বুঝি?

হুম, কি করবো বলুন। বৌ যখন পড়ুয়া হয় তাকে কবির কথা শুনিয়েই ইম্প্রেস করতে হয়।

আরাফ গাঢ় দৃষ্টিতে রেবার চোখের দিকে চেয়ে রইলো।

রেবাও ওর চোখে চেয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে,

হঠাৎ দরজায় নক শুনে আরাফ বিরক্ত স্বরে বললো, এই বাড়িতে একটু রোমান্স করার জো নেই। হাহ!

রেবা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখে সানজেনা,
কিছু বলবেন?

আরাফ ভাইয়া এসেছেন দেখলাম তাই এসেছি।

রেবা খানিকটা অবাকই হলো, কেননা এই বাড়িতে কেউই প্রয়োজন ব্যতীত কারো বেডরুমে যায় না। সানজেনা নিজেই ভেতরে ঢুকে গেল রেবার বলার আগেই। আরাফ বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি এখানে?

ডিস্টার্ব করলাম নাকি?

নাহ ঠিকাছে, বসো।

রেবা ভেতরে এসে বসলো। সানজেনা চারপাশ ঘুরে বলল, আপনার রুমের ইন্টেরিয়র ডিজাইন দারুণ। এই বইগুলি কে পড়ে?

আরাফ বললো, তোমার ভাবী বই পড়তে পছন্দ করে তো, এসব উনার বই।

ওহ আচ্ছা।

সানজেনা ঘুরেঘুরে সব দেখল আর টুকটাক কথা বলল। কিন্তু রেবার সঙ্গে একটা কথাও বলল না, রেবা যে এই ঘরে আছে এ যেন সে দেখলোই না।

আরাফ ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারলো না,তবে রেবার মুখের রংবদল ঘটেছে এটা বেশ ভালোভাবেই টের পেলো। বুদ্ধি করে রুহিকে টেক্সট করলো রুমে আসতে।

কিছুক্ষণ পর রুহি এসে বলল, সানজেনা আপু তুমি এখানে? তাড়াতাড়ি চলো মা তোমায় ডাকছেন।

আন্টি আমাকে ডাকছেন কেন?

আমি কি জানি? আমায় বললো তোমাকে নিয়ে যেতে। জলদি এসো তো।

সানজেনা না চাইতে স্থান ত্যাগ করলো।

রেবা বিড়বিড় করে বলল, কেমন গায়ে পড়া মেয়েরে বাবা! এরকম করে কেউ কারো বেডরুমে ঢুকে? ওকে দেখলেই আমার এতো রাগ লাগে কেন?

আরাফ রেবার মাথায় হাত রেখে বলল, শান্ত শান্ত। এতো হাইপার হবার কিছু নেই রিল্যাক্স।

রেবা দ্রুত আঁচলের কোণ প্যাঁচাতে লাগলো।

আমি যে এই ঘরে আছি পাত্তাই দিলো না। আমার সঙ্গে কথা বলতে ফোস্কা পড়ে? অথচ আরাফ ভাইয়া আরাফ ভাইয়া বলে বলে ফেনা তুলতে সমস্যা হয় না।

কি জানি ও কেন এমন করলো স্ট্রেইঞ্জ!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here