তরঙ্গিনী পর্ব-১৮ #আরশিয়া জান্নাত

#তরঙ্গিনী পর্ব-১৮

#আরশিয়া জান্নাত

মানুষ যখন বাস্তবতার তীব্রাঘাতে যন্ত্রণাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তখন সে ভাবে ওর সাথেই কেন এমন ঘটছে? বাকি সবাই তো ভালো আছে, সুখে আছে। সে কেন নেই?
তাই মানুষের জীবনে সঠিক মানুষটা আসা খুব জরুরী। সঠিক মানুষটাই পারে আমাদের জীবনের খারাপ ভালো উভয় পরিস্থিতিতে আমাদের পাশে শক্ত ঢাল হয়ে থাকতে। আমাদের হতাশা কমাতে। পুরো পৃথিবী যখন বিপরীতে, সেই মানুষটা পরম আপনজন হয়ে পক্ষে থাকে। তার কাছে ম্যাচিওর হতে হয় না, বয়স মেপে আচারণ করতে হয়না। সে বলবেনা এই বয়সে এমন ন্যাকামো কেন? যার সামনে গুছিয়ে থাকতে যেমন মানা নেই অগোছানো থাকতেও দ্বিধা নেই।এমন একজন মানুষ থাকা আবশ্যক যার সামনে পাগলামি করা যাবে, হাসা যাবে, কান্না করা যাবে।
এমন সঠিক মানুষ কয়জনে পায়? যারা পায় তারাও কি ঠিক কদর করতে জানে?

রেবার বয়স ২৫ পেরিয়ে ২৬ এ পড়েছে। এই বয়সের মেয়েরা এক অদ্ভুত সংকটে ভুগে। হুট করে যেন ভুলে যায় সে কোন ক্যাটাগরীতে আছে। তাকে তরুণী বলাটা কি কটাক্ষ? নাকি ঠিকই আছে? সাধারণত এদেশে বিয়ে বাচ্চা হলেই সকল নারী গণ-আন্টিতে পরিণত হয়ে যায়। তাকে আপু ডাকতেও অনেকের বিধে। রেবার যদি ১৮ তে বিয়ে হতো এতোদিনে সেও ২বাচ্চার মা হয়ে নিশ্চয়ই আন্টি উপাধী পেত।
বিয়ের আগে রেবা নিজেকে মেয়াদোত্তীর্ণ পাত্রী বলেই ভাবতে শুরু করেছিল। চারপাশের মানুষদের তাকে নিয়ে অত্যন্ত দুঃশ্চিন্তাই এর জন্য অনেকটা দায়ী। সবাই ধরেই নিয়েছিল ওর কপালে ভালো কেউ জুটবেনা। বয়স পেরিয়ে গেলে কেই বা বৌ করতে চায়?

অথচ আল্লাহর ইচ্ছায় সে এমন একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে যে তাকে রাণীর মতোই ট্রিট করে। তার মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে রেবা ভুলেই যায় সে ষোড়শীর সদ্য ফোটা ফুল নেই। বয়সটা যেন নিছকই সংখ্যা। যা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। পরম অনুরাগে যার পানে চেয়ে সহস্র বছর পার করা যায় অনায়েসে। তাই দেরী হলেও ভুল মানুষটা না আসুক জীবনে।

মানুষকে আল্লাহ একদম ফেলনা করে সৃষ্টি করেননি। প্রত্যেকের মাঝে এমন এক গুণ বা বৈশিষ্ট্য দিয়ে রেখেছেন যেটা তাকে অনন্য করে তোলে, সেটা আর কেউ না দেখলেও যার সাথে ডোর বাধা তার চোখে ঠিকই পড়ে। এমন হয় বলেই তো অন্যদের চোখে যে অগ্রহণযোগ্য কোনো একজনের কাছে সেই সেরা।

রেবা খুব সাধারণ একটা মেয়ে, অথচ আরাফের চোখে সে সকল সৌন্দর্যের আধার! তার রূপের কাছে কারোই তুলনা হয় না। হয়তো সেজন্যই শরৎচন্দ্র বলেছিলেন,
“কপালের যেখানটায় বসন্তের দাগ ছিল; সবাই চোখ ফিরিয়ে নিত ঘেন্নায়! সেখানটায় চুমো খেয়ে বুঝিয়ে দিতে হয় ভালোবাসা জিনিসটা সবার জন্য আসেনি।”

সত্যিকারের ভালোবাসার চরম দূর্ভিক্ষের এই যুগে এমন একটা মানুষ পাওয়ার ভাগ্য যার হয়েছে সে নিশ্চয়ই ভাগ্যবতী/ভাগ্যবান।
এমন দূর্লভ মানুষটার উপর বিপদ আসলে কারো পক্ষেই স্থির থাকা সম্ভব না। আরাফের এমন মুমূর্ষ অবস্থায় দেখে রেবার মনের মাঝে কি কষ্ট হচ্ছে তা কি কেউ টের পাবে?

আরাফের এক্সিডেন্টের খবর শুনে তার বাবা-মা ছুটে আসেন পরদিন সকালেই। ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখা কোনো মা-ই সহ্য করতে পারেনা।
রেহানা চৌধুরীও পারেননি। আরাফ মায়ের কান্না থামাতে বললেও তিনি থামলেন না। আক্ষেপের স্বরে বললেন, তোকে কত করে বলি সাবধানে থাকবি, দোআ পড়ে বের হবি। ড্রাইভারকে বলবি শান্ত হয়ে ড্রাইভ করতে, তাড়াহুড়ো না করতে। আমার কথা তোর মনেই থাকেনা।

মা এতো কাঁদছো কেন বলোতো? আমি ঠিক আছি তো।

একদম ঢং করবিনা, বৌমা আমাকে সব বলেছে। তুই কেমন আরাফ? এমন সিচুয়েশনেও আমাদের কাউকে খবর দিলিনা, এমনকি রেবাকেও না! আল্লাহ না করুন আজ যদি বড় কিছু হয়ে যেত? এমন আর কখনো করবিনা বাবা।

মা তুমি গিয়ে ওকে সামলাও। কাল রাত থেকে যে কাঁদতে শুরু করেছে, একটু পর পর থেমে আবার শুরু করে। ওকে কেউ বুঝাও আমি বেঁচে আছি তো।

ওর অভিমান তুই বুঝে উঠতে পারিস নি। আমার মেয়ের কান্না শুনেই তো ছুটে এসেছি আমি। নাহয় তোর মতো নিষ্ঠুর ছেলেকে দেখতে আসতো কে?

আমায় তুমি কত বকা দিচ্ছ মা? এমন অসুস্থ ছেলেকে কেউ এতো ঝাড়ে? কোথায় এসে আদর করবা তা না।

আদর করার মতো কি করেছিস?

আরাফের বাবা বললেন, আরাফ তোমার অন্যায়টা কিন্তু ছোট নয়। পরিবারের থেকে কোনোকিছু লুকানোর পরিণাম ভালো হয় না বাবা। তোমরা এখানে একা আছ, একে অপরের ভালোমন্দের দায়িত্বে নিয়োজিত আছ। এখন তুমি যদি তাকেই জানাতে নিষেধ করো কেমন হয় ব্যাপারটা বলো?

আমার ভুল হয়েছে বাবা। আমি এর জন্য সত্যিই লজ্জিত।

যাক যা হবার হয়েছে, এখন ভালোমতো রেস্ট করো। চিন্তার কিছু নেই।

রেবা দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, মা আপনারা এতো জার্নি করে এসেছেন খেয়ে একটু রেস্ট নিন। আমি খাবার রেডি করেছি।

চলো রেহানা। আমার আসলেই অনেক খিদে পেয়েছে।

তুই আরাম কর বাবা। বৌমা তুই এখানে বস।

কিন্তু মা,,

কোনো কিন্তু না, ছেলে আমার হাড় ভাঙার চেয়ে বৌয়ের মান ভাঙানোর চিন্তায় অস্থির। আর রাগ করে থাকিস না মা।

রেবা মাথা নীচু করে ঝাপসা চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। এখন পলক ফেললেই টুপ করে পানি বেরিয়ে পড়বে যেন। উনারা দুজন চলে গেলে রেবা আলগোছে চোখ মুছে বেডের কিনারায় গিয়ে বসে।

আরাফ সোজা হয়ে বসতে গেলেই ব্যথায় কুকড়ে উঠে। রেবা দ্রুত তার কাছে গিয়ে বলে, উঠতে চাইছেন‌ কেন? শুয়ে থাকুন‌না।

আরাফ রেবাকে কাছে টেনে বলে, এমন দূরে সরে আছেন কেন? আমার ভালো লাগছে না রেবা! আমি সরি তো,

রেবা আরাফের দু’হাতে কপাল ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগলো। আরাফ ওর চোখের পানি আজলায় তুলে বললো, ওহহো চোখের পানির সাগর করে ফেলবেন দেখছি! আমি মরে যাইনি তো,,

রেবা রেগে বলল, আপনি অনেক খারাপ। যা তা মুখে আসে আপনার। এসব কি ধরনের কথা?

আরাফ রেবার গালে হাত রেখে বলল, রেবা আপনি এই প্রথমবার আমার কাছে বেড়াতে যাওয়ার আবদার করেছিলেন। আমি নিতে পারিনি। সেজন্য সরি।

আপনি সুস্থ হয়ে আমার পাশে থাকুন, ওতেই আমার চলবে। আর কোনো চাহিদা নেই আমার এই জীবন থেকে।

আরাফ মৃদু হেসে বলল, আপনি অল্পতেই তুষ্ট আমি জানি। তাই বলে আমি যে কিছুই করবো না তা তো হয় না।

রেবা আরাফের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল, আপনাকে হারানোর ক্ষমতা আমার নেই আরাফ। আল্লাহ যেন আমাকে আপনার আগেই নিয়ে যান। আমি আপনাকে ছাড়া আর একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে পারিনা।

রেবা! আপনার কি ধারণা আমি পারবো? আমায় বিরহের বোঝা দিতে এই নিয়্যত রাখেন!

রেবা আরাফের বুকে আলতো করে মাথা রেখে বলল, এতোকিছু আমি জানিনা, এতো কিছু ভাবতেও চাই না। আমি শুধু জানি আপনি আমার জন্য খুব মূল্যবান। আমি আমরণ আপনার বুকেই থাকতে চাই। এখানেই যেন আমার মরণ আসে।

রেবা প্লিজ এসব বলবেন না। মৃত্যু একটা চরম সত্যি। এটা থেকে পালানোর উপায় নেই। আসার সময় যে সিরিয়ালে আসি, যাওয়ার সময় যে সেই সিরিয়ালেই যাবো এমন নয়। এখানে যে কেউ আগে পরে যেতে পারে। তবে মনে রাখবেন এটা আমাদের স্বল্প সময়ের বিচ্ছেদ। আল্লাহ চাইলে মৃত্যুর পর আমরা ফের এক হবো।

রেবার চোখের উষ্ণ জলে আরাফের বুক ভিজে যায়। আরাফ আর থামায় না। তার বৌটা এতো কান্না করতে পারে!!!


আরাফের প্রতি রেবার যত্নের অন্ত নেই। সবসময় তার আশেপাশেই থাকে কখন কি লাগে। আরাফকে একদম চোখের আড়াল করেনা। দেড়মাস বেডরেস্টে থেকে আরাফ এখন অনেকটাই সুস্থ। রাজশাহীর কাজও প্রায় শেষ‌ হয়ে এসেছে। আর কিছুদিন পরই তারা ঢাকায় ব্যাক করবে। ওদিকে পিহুর বিয়ের কথা মোটামুটি ফাইনাল। ওরা গেলেই আংটিবদল করে বিয়ের ডেট ফিক্সড করবে।

রেবা আজকাল এই জায়গাটা নিয়ে ভাবে। ৫/৬ মাসের জন্য আসা এই শহরটার সৌন্দর্যের মায়ায় সে আটকে গেছে যেন। কটা দিন পর এখানে আর থাকা হবেনা। একদিকে আপনজনদের মাঝে ফিরে যাওয়ার যেমন উচ্ছাস, অপরদিকে এদিকের অজানা মায়ার টান। মনকে বুঝ দেয় ফের আসবে তো। এখানে আসতে তো আর মানা নেই। লতা, তাহেরা, রহিম চাচা-সবার জন্য কিছু জিনিস কিনে রেখেছে। যাওয়ার দিন সবাইকে দিবে বলে। আরাফ রেবার এসব দেখে খুশী হয়। মেয়েটার মনে সবার জন্য মমতা আছে, এই ব্যাপারটা তার ভীষণ ভালো লাগে।
আরাফ রেবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, রেবা তখন কাপড় ভাঁজ করছিল। আরাফকে দেখে বলল কিছু বলবেন?

হুম

বলুন?

ভালোবাসি!

রেবা হেসে বলল, জানিতো।

আপনি বলবেন না?

এখন বললে তো মনে হবে ভালোবাসার পিঠে ভালোবাসি বলেছি!

তাহলে?

তাহলে আর কি?

বলবেন না?

বলবো তো।

বলুন?

রেবা আরাফের গলা জড়িয়ে বলল, আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি।

আরাফ ওর কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে বলল, আমি আপনায় যত দেখি ততোই প্রেমে পড়ি। এই কঠিন অসুখ সারানোর উপায় কি বলুন তো?

সারাতে চান কেন? বয়ে চলুন। কিছু অসুখ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

তাই বুঝি?

জ্বি ঠিক তাই।

একটা কথা বলি?

হুম?

আমরা কি পরবর্তী প্ল্যান করতে পারি?

কোন প্ল্যান?

আই মিন ফ্যামিলি প্ল্যানিং,,,

৭টা?

নাহ নাহ। বলেছি না ২টা হলেই চলবে!

ভেবে বলছেন তো? পরে আবার বলবেন না আমার জন্য ইচ্ছে পূরণ হয় নি।

আরাফ রেবার গালে চুমু খেয়ে বলল,না বলবো না। রাজী আছেন?

রেবা চিন্তার ভঙ্গি করে গালে আঙুল দিয়ে বলল, সময় দিন ভেবে জানাচ্ছি।

আচ্ছা। সমস্যা নেই, ভেবে জানান।

আরাফ ল্যাপটপটা নিতে টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই রেবা তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, আপনি এতো ভালো কেন আরাফ? আপনাকে আমি কোথায় রাখি বলুন তো?

আরাফ হেসে বলল, যেখানে রাখলে আর কেউ থাকার জায়গা পাবেনা সেখানে রাখুন।

রেবা নিজের বুকের বা’পাশে তাক করে বলল এদিকটায়?

হুমম

আচ্ছা,,,

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here