#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৫
#Esrat_Ety
(১ম অংশ)
(যারা ফেসবুক লাইট থেকে পড়তে পারেননি। তাদের জন্য দিলাম। ২য় অংশের লিংক কমেন্ট বক্সে পেয়ে যাবেন।)
মানুষ টা যাওয়ার নয় ঘন্টা হয়ে গেছে। গিয়ে পৌঁছিয়েছে নাকি পৌঁছায়নি উর্বী জানে না। একটাবার ফোন দিয়ে বলতে হয়না বুঝি?
উর্বীকেই ফোন দিয়ে জানতে হবে? তার ফোনে কি উর্বীর নাম্বার নেই ? নাকি উর্বীকে জানানোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। উর্বী আজ দেখবে তার কখন সময় হয়। আজ উর্বী কোনোভাবেই ঐ লোকটাকে ফোন দেবে না।
উর্বী ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো বিকেলটা অলসতায় কেটেছে। হাতে কোনো কাজ নেই। বাড়ি ভর্তি মেহমান। উর্বীর ননদেরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে একদিনের জন্য এসেছে বেড়াতে।
রাওনাফ গিয়েছে রাজশাহী। খুব সম্ভবত রাত ফিরবে,নাও ফিরতে পারে।
বাড়ির সবাই উর্বীকে ধরেছিলো যাওয়ার জন্য। উর্বী যায়নি।
উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে দাঁড়ায়, একটু অন্তরাকে দেখে আসা যাক। বেচারী হাঁটাচলা করতে পারে না। হাত পা ফুলে গেছে।
***
রাওনাফ রাজশাহী এসে কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। ফোনের দিকে তাকানোর সময় নেই। তবু সে মাঝে মাঝে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে কেউ ফোন দিয়েছে কি না, বিশেষ করে উর্বী। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার উর্বীর থেকে একটি কলও আসেনি আজ।
শর্মী দুবার ফোন দিয়েছে, মা একবার, নাবিল একবার। উর্বী একবারও ফোন দেয়নি।
***
ফ্রাইং-প্যানে একটা বড় সাইজের রূপচাঁদা মাছ ছেড়ে দিয়ে উর্বী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সবাই মিলে হাতে হাতে রাতের রান্নাটা সেরে ফেলছে। রুমা আর আজমেরী আড়চোখে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বীর চোখে চোখ পরতেই উর্বী হেসে বলে,”এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?”
আজমেরী বলে,”দেখছি।”
_কি দেখছো?
_বলা যাবে না।
উর্বী রান্নায় মনোযোগী হয়। রুমা বলে,”ব্যস রান্না তো সব হয়েই গেলো। তুমিও খেতে চলে এসো ভাবী। একসাথে খাবো।”
উর্বী ফ্রিজ থেকে চিংড়ি মাছ নামাতে নামাতে বলে,”তোমরা বসো। আমি একটু পরে বসবো।”
আজমেরী বলে,”এখন আবার কি রাধছো? চিংড়ি তো কেউ খাবে না। চিংড়ি কেনো রাধছো?”
উর্বী মাথা নিচু করে বলে,”উনি খুব সম্ভবত রাতে ফিরবেন। যা রান্না করেছি, উনি তো খাবেন না সেসব। তাই চিংড়িটা করে রাখছি।”
আজমেরী আর রুমা মিটিমিটি হাসে। উর্বী তাকিয়ে বলে,”এভাবে হাসছো কেন?”
_তোমার পরিবর্তন দেখে হাসছি ভাবী।
_কি পরিবর্তন?
উর্বী জানতে চায়। আজমেরী বলে,”ধীরে ধীরে খান বাড়ির বড় বৌ থেকে রাওনাফ করীমের স্ত্রী হয়ে উঠেছো সেটাই চোখে পরছে।”
কথাটা বলে দুজনে চলে যায়। উর্বী ম্লান হেসে পাতিলে মশলা কষাতে থাকে।
****
নাবিল খাবার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। সে আশেপাশে তাকাচ্ছে। টেবিলে খাবার দেওয়া। কিন্তু কেউ নেই। আজ একটা ক্রিকেট ম্যাচ ছিলো তাই সে টেবিলে সবার সাথে খেতে পারেনি।
এখন হাত ধুয়ে সে খেতে বসে। একটা একটা করে ঢাকনা উঠায় আর নাবিল অবাক হয়। এতকিছু কেনো রান্না হয়েছে !
উর্বী মাথায় ঘোমটা তুলতে তুলতে আসে। নাবিল চুপচাপ খেতে বসে।
উর্বী নাবিলের প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়। তারপর নিজেও একটা প্লেট নিয়ে বসে পরে।
“আপনি এখনো খাননি?”
নাবিল অবাক হয়ে জানতে চায়।
_ নাহ।
_কেন?
_ভাবলাম তুমি একা খাও না। তাই।
নাবিল চুপচাপ খেতে থাকে, কিছুক্ষণ পরে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে,
“যদি আমি এখন আট নয় বছরের বালক হতাম তবে আপনার মহানুভবতা দেখে অবশ্যই সারাদিন ছোটো মা ছোটো মা বলে আপনার আঁচল ধরে ঘুরতাম। কিন্তু আমি ছোটো বালকটি নই।”
উর্বী হাসে।
“কি হলো। হাসছেন যে!”
_একটা সত্যি কথা বলবো নাবিল? আমার কাছে তোমাকে আট বছরের ছেলেটিই মনে হয়। যাকে দেখলে স্নেহ করতে ইচ্ছে করে। মাথায় গাট্টা মেরে কিংবা নাক টিপে দিয়ে। তুমি আমায় অপছন্দ করলেও আমি কিন্তু তোমায় ভীষণ পছন্দ করি। আমি শর্মী,শায়মী আর তোমাকে ভয়ংকর পছন্দ করে ফেলেছি।”
নাবিল খাওয়া রেখে উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী একমনে খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সে নাবিলের দিকে তাকিয়ে তার দিকে কালাভুনার প্লেট এগিয়ে দেয়। বলে,
“এটাও নাও। তোমার জন্য রেধেছি। শুনেছি তোমার পছন্দ। তোমার মায়ের মতো না রাঁধতে পারলেও খাওয়ার যোগ্য। আর এতে কিছু মেশাইনি। স্নেহ ছাড়া।”
নাবিল হাত বাড়িয়ে বাটিটা নেয়। তার অস্বস্তি হচ্ছে। আজ এই মহিলার অযাচিত স্নেহে তার বিরক্তি আসছে না কেন?
****
বাচ্চারা চেঁচিয়ে ওঠে।
“বড়মামা এসেছে।”
উর্বী শুনেছে। সে বই রেখে উঠে দাঁড়ায়।
নিচে তাকে ডাকা হচ্ছে। ডাকছে আজমেরী।
উর্বী ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে লিভিং রুমে উকি দেয়।
রাওনাফকে ঘিরে ছোটো খাটো জটলা।
রাজশাহী থেকে রাওনাফ বাড়ির মেয়েদের জন্য শাড়ি নিয়ে এসেছে। প্রত্যেকের জন্য একটি করে।
উর্বীকে দেখে রুমা এসে তাকে টেনে নিয়ে যায় নিচে।
রাওনাফের সুটকেস থেকে আজমেরী একটা একটা করে শাড়ি বের করছে। শর্মী এবং শায়মীর জন্যও শাড়ি এনেছে তাদের বাবা। দুজন কিশোরী প্রচন্ড উচ্ছসিত পাপার থেকে প্রথম শাড়ী উপহার পেয়ে। দু’জনে কখনোই শাড়ি পরেনি। তবুও তারা খুবই এক্সাইটেড। চোখে আনন্দ ঝলমল করছে।
রুমা অবাক হয়ে বলে,”বাপরে। আজ সূর্য কোনদিক থেকে উঠলো ভাইয়া? তুমি কিনেছো মেয়েদের শাড়ি? মানে সত্যি?”
রাওনাফ হাসে,”আরে,ওখানে ডক্টর কিশোর আর তার ওয়াইফ গিয়েছিলো। ওরা টেনে নিয়ে গেলো তাতীবাজার। জামদানি শাড়ি তৈরির সবথেকে বিশাল বাজার। আমি তো যেতেই চাইনি। জোর করে নিয়ে গেলো। কিশোরের ওয়াইফ শাড়ি কিনবে। শাড়ি গুলো সুন্দর। একেবারে অথেন্টিক ম্যাটেরিয়াল। ভাবলাম আমিও কটা নেই। বাড়িতে তো নারীদের অভাব নেই। বাড়িটাই তো নারী শাসিত।”
কথাটি বলে রাওনাফ তার মায়ের দিকে তাকায়।
রওশান আরা বলে,”সেজন্যই আমার বাড়িটা এতো শান্তিময়। তোর হাতে থাকলে সংসার টা এতদিনে উচ্ছন্নে যেতো। আমি মরার আগে সব দায়িত্ব আমি বড় বৌকে দিয়ে যাবো।”
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। তার চোখে পরে উর্বীর মুখটা শুকনো লাগছে বেশ!
সবাই শাড়ি পছন্দ করছে। শর্মী আর শায়মী খুবই আগ্রহের সাথে যে যার শাড়ী বেছে নিয়েছে। রাওনাফ বলে দিচ্ছে কোন শাড়িটা কার জন্য কেনা হয়েছে।
অন্তরার জন্য আনা শাড়িটা অন্তরা হাতে ধরে বসে থাকে। তার এত্তো খুশি লাগছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
আজমেরী শাড়ি নিয়ে বলে,”এই সবুজ শাড়ি টা কার? কচি কলাপাতা রঙের জামদানিটা। ভাইয়া?”
রাওনাফ ইতস্তত করে বলে,”এটা উর্বীর..”
রুমা অবাক হয়ে বলে,”কেনো? এটা পরলে ভাবিকে গাছের মতো লাগবে। কলাগাছের মতো। ভাবী কি গাছ? তুমি ভাবীর জন্য অন্য রঙ দেখতে পারলে না? দাঁড়াও আমি আমার শাড়িটা ভাবিকে দিচ্ছি। বৌ মানুষ,একটু লালচে রঙের শাড়ি পড়বে না?”
রাওনাফ সংকোচের সাথে ধীরে ধীরে বলে,”উর্বীর গায়ে এই রঙটা বেশ মানায়, গাছের মতো লাগে না….”
এ পর্যন্ত বলে থেমে যায় রাওনাফ।
তারপর বলে,”ওর পছন্দ না হলে অন্য রঙ দেখতে পারে। অনেকগুলো আছে তো শাড়ী।”
উর্বী সবার দিকে তাকায়। সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তার প্রতিক্রিয়া জানতে।
সে হাত দিয়ে শাড়ীটা নেয়,বলে,”আমি এটাই নেবো। অন্য রঙ লাগবে না।”
রওশান আরা তার পুত্রবধুর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বীর চোখ মুখ দিয়ে চাপা আনন্দ ছড়িয়ে পরেছে। রওশান আরা তা দেখতে পান।
***
উর্বী ঘরে ঢুকে শাড়ীটা আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে শাড়ীটায় হাত বুলিয়ে দেয়। মুখ তার প্রশ্বস্ত হয়ে আছে হাসিতে, খুশিতে।
রাওনাফের পদধ্বনি শুনে উর্বী তাড়াতাড়ি আলমারি বন্ধ করে বই হাতে বসে পরে।
রাওনাফের উপস্থিতি টের পেয়েও সে বই থেকে মুখ তুলছে না।
রাওনাফ কাশি দিয়ে উর্বীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। উর্বী মাথা তুলে রাওনাফের দিকে তাকায়।
রাওনাফকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব ক্লান্ত। পরিশ্রান্ত। উর্বীর বড্ড মায়া হয়।
রাওনাফ বিছানায় বসে পরে।
উর্বী বলে,”আপনার কি শরীর খারাপ?”
_বুঝতে পারছি না। একটু জ্বর জ্বর লাগছে।
_সেকি! হঠাৎ জ্বর কেনো?
_হতে পারে ওয়েদার চেঞ্জ তাই।
_দাড়ান মেপে দেখছি।
উর্বী দৌড়ে গিয়ে রাওনাফের টেবিল থেকে থার্মোমিটার নিয়ে আসে।
রাওনাফ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”তুমি জানো থার্মোমিটার প্রথম কবে আবিষ্কার হয়েছিল?”
উর্বী অবাক হয়ে বলে,”তা আমি কিভাবে জানবো? এটা তো আপনার জানার কথা!”
_যদিও বিভিন্ন সময়ে এর সংস্করণ হয়েছে। তবে খুব সম্ভবত ১৭১৪ সালের দিকে। অবশ্য একেবারে নিখুঁত সংস্করণ হয়েছে ১৯৬৬ সালে।
_হু। তো কি হয়েছে? এসব কেনো বলছেন?
উর্বী অবাক হয়ে জানতে চায়।
রাওনাফ উর্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”থার্মোমিটার আবিষ্কারের আগে স্ত্রীরা তাদের স্বামীর কপালে হাত দিয়ে ছুঁয়ে জ্বর দেখতো…”
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অত্যন্ত সরল একটি আহ্বান।
উর্বী লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখে। তার প্রজাপতি গুলো কি আস্কারা পেলো মানুষটার থেকে!
রাওনাফ স্বাভাবিক ভাবে বলে,”বসো এখানে।”
উর্বী বসে,লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”আপনার জ্বর নেই তাই না? ভান করছিলেন কেনো?”
_একটু সহানুভূতি পেতে চাচ্ছিলাম। আমি একজন ডাক্তার, সারাদিন
অন্যদের সেবা দেই। আমারো ইচ্ছা করলো,কেউ আমার সেবা করুক ।
উর্বী বলে,”এভাবে মিথ্যা সহানুভূতি পেতে চাইতে নেই।
রাখালের কাহিনীটা জানেন না?”
রাওনাফ উর্বীকে দেখে, উর্বীর চোখে মুখে সংকোচ,লজ্জা। রাওনাফ বলে,”কি হয়েছিলো? চোখ মুখ শুকনো ছিলো কেন?”
উর্বী তাকায়। বলে,”কই না তো। কি হবে! আপনার এমন টা কেনো মনে হলো!”
“তখন তোমাকে নোটিস করলাম!”
_আপনি আমায় নোটিস করেন?
খুবই নিচুস্বরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে উর্বী জানতে চায়। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”মনে তো হচ্ছে করি।”
উর্বী চুপ হয়ে যায়। রাওনাফ কিছু বলতে যাবে তখনই দরজায় টোকা পরে। আজমেরী ডাকছে। অন্তরা পা পিছলে ওয়াশরুমে পরে গিয়েছে। তাকে হসপিটালে নিতে হবে।
***
ওয়েটিং রুমে দাড়িয়ে রওশান আরা কাঁদছে। উর্বী সবার মুখের দিকে তাকায়। সবাই বিষন্ন মুখে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে। এমন পরিস্থিতি আসবে খান বাড়িতে কেউ কি ঘুনাক্ষরেও টের পেয়েছিলো?
অন্তরার মি’স’ক্যারেজ হয়ে গিয়েছে। চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেনি ডাক্তাররা।
উর্বী সবাইকে ঘুরে ঘুরে দেখে রওশান আরার দিকে এগিয়ে যায়। কাঁধে একটা হাত রাখতেই রওশান আরা মুখ তুলে তার দিকে তাকায়। উর্বী বলে,”কাঁদবেন না মা। এই সময়ে অন্তরার আমাদের প্রয়োজন। ও আমাদের থেকে ভরসা নেবে। আপনি কাঁদবেন না।”
রওশান আরা শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। তারপর ধরা গলায় বলে,”আমি খারাপ শাশুড়ি হতে পারি বৌমা তবে মোনাজাতে কখনো ওর খারাপ চাইনি। চেয়েছি যেন সুস্থভাবে আমার নাতী নাতনিকে দুনিয়ায় আনতে পারে আর নিজেও যেন সুস্থ থাকে।”
উর্বী বলে,”আপনি যান। ওর কাছে যান। ওর শারীরিক যন্ত্রনার ভাগ তো আমরা কেউ নিতে পারবো না। ওকে দু’টো কথা বলে ওর মানসিক যন্ত্রনা ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করুন। আপনি যান মা। মেয়েটা তো কখনও মায়ের আদরও পায়নি শুনেছি।”
রওশান আরা উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরপায়ে অন্তরার কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়।
সামিউলের শার্ট খামচে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অন্তরা। সামিউল শক্ত করে আগলে ধরে বসে আছে অন্তরাকে। অন্তরা কোনো কথা বলতে পারছে না। কেঁদেই যাচ্ছে। সামিউল অন্তরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”প্লিজ এভাবে ভে’ঙে পরো না অন্তু,প্লিজ।”
_আমি কি পাপ করেছিলাম সামিউল। কেনো আমার সাথে এমন হলো। বলো না!
_আল্লাহর ইচ্ছে অন্তু। তুমি একদম ভেঙে পরো না। আমাকেও ভেঙে দিও না। ডক্টর বলেছে,আমরা ছয় মাস পরেই আবার বেবীর জন্য চেষ্টা করতে পারবো।
_তাতে কি হবে সামিউল? অন্য কাউকে পাবো আমরা। আর যে চলে গিয়েছে তাকে? নাই বা চোখে দেখলাম তাকে, তবে সে তো আমার ছিলো সামিউল। আমার সন্তান!
কাঁদতে থাকে অন্তরা। রওশান আরা কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকে। সে ভেতরে ঢোকে না। সামিউলের মতো করে সে নিশ্চয়ই সান্ত্বনা দিতে পারবে না।
অন্তরা কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,”আচ্ছা সামিউল। মা কি আবার আমাকে দূরে ঠেলে দেবেন? বলো না। আমার সাথে কেন হলো এসব।”
রওশান আরা শুনছে সেসব কথা। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
***
অন্তরাকে দুদিন হয় বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। শরীরটা অনেকটাই সুস্থ তবে মানসিক ভাবে পুরোটাই বিধ্বস্ত। উর্বী সবসময় চেষ্টা করেছে তাকে আগলে রাখার, মানসিক ভাবে সাপোর্ট দেওয়ার।
বিষাদের সময় কাটতে না কাটতেই রওশান মঞ্জিলে একটা খুশির সংবাদ এসেছে। শায়মী নাবিলের মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। শায়মী গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেলেও নাবিলের গোল্ডেন মিস গিয়েছে।
ডক্টর রাওনাফ করীম খান ছেলে মেয়ের রেজাল্টে ভীষণ খুশি। পুরো হসপিটালে,শায়মী-নাবিলের স্কুলে মিষ্টি বিলি করেছে। নিজে গিয়ে নাবিল শায়মীর নানা বাড়ি, দাদা বাড়িতে মিষ্টি দিয়ে এসেছে। এরপর সুমনা আর ঝুমুরদের বাড়ি হয়ে সোজা রওশান মঞ্জিলে ঢুকেছে।
পাপাকে দেখে শায়মী ছুটে যায়। রাওনাফ মেয়েকে আগলে নেয়। দোতলা থেকে বাবা মেয়ের এই সুন্দর মুহূর্ত উপভোগ করতে থাকে উর্বী।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রাওনাফ বলে,”ভীষণ খুশি হয়েছি মামনী। ভীষণ!”
শায়মী হাসে। রাওনাফের চোখ খুঁজছে নাবিলকে। শায়মী বলে,”কাকে খুজছো?”
_সে কোথায়? গোল্ডেন পায়নি বলে মন খারাপ?
_জানিনা। দেখে তো মনে হয়নি।
রাওনাফ নাবিলের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর দরজা ধাক্কাতে থাকে। খানিক বাদে নাবিল দরজা খুলে দেয়। রাওনাফ ছেলেকে দেখে, তারপর নরম গলায় বলে,”বাবা এসব রেজাল্ট….”
_আই নো পাপা,তোমার কাছে ম্যাটার করে না। আমি মন খারাপ করে নেই পাপা, মোটেও নেই। আমি বিন্দাস আছি। আমি তোমার ছেলে! চিল!
রাওনাফ হাসে, ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”প্রাউড অফ ইউ বেটা!”
উর্বী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। সে যত দেখছে এই পরিবারটিকে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। বাবা-সন্তানদের কি চমৎকার সম্পর্ক। উর্বীর যখন পাঁচ বছর বয়স, উপমার তখন এক বছর। তার বাবা হঠাৎ স্ট্রোক করে মা’রা যান। উর্বী ঠিক জানেই না বাবা কেমন হয়। রাওনাফের তার ছেলেমেয়েদের প্রতি অগাধ স্নেহ দেখলে উর্বীর মন ভরে যায়, সবসময়। উর্বী রাওনাফ করীম খানের এই রুপটাকেও ভীষণ পছন্দ করে, ভীষণ।
***
অন্তরার মন ভালো করার জন্য রাওনাফ একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। সে সামিউলকে আর অন্তরাকে চট্টগ্রাম পাঠিয়েছে মোহনা আর শাফিউলের কাছে। যায়গা পরিবর্তন করলে মন ভালো হবে তাই। অবশ্য এই উদ্যোগটা রাওনাফ নিয়েছে রওশান আরার কথায়। তা অবশ্য কেউ জানে না। রওশান আরা বলতে দেয়নি। শুধু উর্বী জানে।
এই বাড়ির সব মানুষ গুলো কি আদুরে, কারো মধ্যে বিন্দুমাত্র অন্ধকার উর্বী খুঁজে পায় না। সবটা কি এতটাই সাদা? উর্বীর কালো অতীত নিয়ে জরিয়ে গিয়েছে এই সাদা মানুষগুলোর সাথে। কি অদ্ভুত!
হাত বাড়িয়ে উর্বী ফোনটা নেয়। ভেবেছে সে রাওনাফকে ফোন দেবে। ব্যস্ততায় রাওনাফ না দিক ফোন, সে দেবেই। তাতে যদি ডাক্তার তাকে হ্যাংলা মহিলা ভাবে,ভাবুক। স্বামীর নৈকট্য পেতে চাওয়া কোনো হ্যাংলামো নয়, এটা কোনো নির্দিষ্ট বয়সের ছকবাঁধা নিয়ম না। জীবনের সাতটা বছর অন্ধকার কারাগারের মতো জীবন কে’টেছে উর্বীর। এখন সে মুক্ত। বাইরের মানুষ কি বুঝবে মুক্তির আনন্দ? উর্বী আনন্দ প্রকাশ করবে না? সব মেয়ের মতো তারও মনের কোথাও সুপ্ত বাসনা ছিলো একটা সংসারের, আজ সেটা তার হয়েছে, সে মুক্ত স্বাধীন পাখির মতো হুটোপুটি করবে না?
ভাবুক উর্বীকে হ্যাংলা সবাই। উর্বী তার স্ত্রী হবার সব শর্ত পালন করবে এবং সব চাহিদা পো’ষণ করবে যা আর পাঁচটা সাধারণ স্ত্রী করে। এই জীবন উর্বীকে বাঁধতে চাইছে, উর্বীও লাই দেবে এই জীবনকে, তার চাহিদাকে, তার বাসনাকে। অবশ্যই দেবে।
ফোনের লক খুলে রাওনাফকে ফোন দেওয়ার আগেই টুং টাং আওয়াজে একটা নোটিফিকেশন চোখে পরে উর্বীর। সে কৌতুহলবশত মেসেজটি ওপেন করে। এই আ’ই’ডিটা কার উর্বী জানে না। কিছু ছবি পাঠানো হয়েছে উর্বীকে। ছবি গুলো দেখে উর্বীর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। সে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। উচ্ছাস একটি বার্তাও পাঠিয়েছে,”সেদিন সম্ভবত গালাগাল করেছি তোমাকে। সরি পাখি। ভুল হয়েছে। আর করবো না। আর এই ছবিগুলো দেখো। কি সুন্দর লাগছে আমাদের।”
উর্বী সাথে সাথে আ’ই’ডিটাকে ব্লক করে দিয়ে বসে থাকে। খুঁজে খুঁজে ঠিকই পেয়ে গিয়েছে উচ্ছাস উর্বীকে। উর্বী কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। রাওনাফকে বলে দেবে! কিন্তু কি হবে! যদি কোনো স্টেপ নেয় তবে জানাজানি হবে আবারও। আবারও সবাই উর্বীর দিকে আঙুল তুলবে। সবাই তাকে নষ্টা বলবে, উর্বী চাইলেও পারবে না ঢাকতে তার কলঙ্ক। সবাই যে রাওনাফ নয়। সবাই উর্বীকে থু’তু দেবে। আবারও নেমে আসবে উর্বীর জীবনে সেই দুর্যোগের ঘনঘটা। কথা শুনিয়ে শুনিয়ে মে’রে ফেলবে উর্বীকে! কিভাবে সবটা ম্যানেজ করবে উর্বী!
উর্বীর শরীর কাঁপতে শুরু করে। সে নিজের ফেসবুক আ’ই’ডি টাকেই ডিলিট করে দেয়। কিছু ব্যবহার করবে না সে! সে গুটিয়ে নেবে এই সবকিছু থেকে। তার গন্ডি হবে শুধু এই বাড়ি, এই সংসার, এই মানুষগুলো, আর রাওনাফ। কেউ তার নাগাল পাবে না।
চলমান….
২৫ পর্বের ২য় অংশের লিংক কমেন্টে 👇