#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৪
#Esrat_Ety
রাওনাফ উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাত টা সরিয়ে নেয়। উর্বী মৃদু স্বরে আবারও বলে,”সরি।”
রাওনাফ উঠে মেডিসিন বক্স থেকে একটা পেইন কিলার আর এক গ্লাস পানি এনে উর্বীকে দেয়। উর্বী চুপচাপ ওষুধটা খেয়ে নেয়। তারপর খালি গ্লাসটা রাওনাফের হাতে দেয়। রাওনাফ গ্লাসটা যথাস্থানে রাখে। ঘুরে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বীর মুখে লালচে আভা। রাওনাফ অবাক হয়ে বলে,”এভাবে ব্লাশ করছো কেনো?”
উর্বী মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”আপনি তখন ওভাবে কোলে তুলে নিলেন কেন? ওরা কি ভাবলো!”
রাওনাফ খানিকটা অবাক হয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী একপলক রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নেয়।
রাওনাফ এসে উর্বীর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”ওরা কি ভাবলো মানে! তুমি ইনজিয়্যুরড। আর কিভাবে আনতাম?”
উর্বী প্রচন্ড অস্বস্তিতে পরে যায়। কেনো যে সে এই টপিক টা ওঠালো। লোকটাকেও অস্বস্তিতে ফেলে দিলো। লোকটা তো স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করেছে। উর্বীর যায়গায় রুমা বা শর্মী শায়মী হলেও এমন ভাবেই আনতো! এটা তো অস্বস্তিকর কিছু না। সে খামোখাই জিনিসটাকে বাকা করে দেখছে। হতে পারে রাওনাফ করীম খানের তিন ছানা কিছুই মনে করেনি।
রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। ফজরের আযান দিয়ে দিয়েছে। আজ রাওনাফ মসজিদে যায়নি। ঘরেই সালাত আদায় করে নেয়। উর্বী একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মানুষটার দিকে। তার গালদুটো তখনও লালচে হয়ে ছিলো। রাওনাফের ভাষায় “ব্লাশ করছিলো।”
“দায়িত্ব” বলে পুরুষের টুকটাক কেয়ার গুলো পেলে একজন নারীর মনে সহস্র প্রজাপতি উড়তে শুরু করে দেয়। সেই প্রজাপতি ওড়ার দৃশ্য যদি সেই পুরুষটি দেখতে পেতো তবে ভীষণ লজ্জায় পরে যেতো সেই নারী। ভাগ্যিস এমনটা হবার কোনো সুযোগ নেই, বেঁচে গিয়েছে উর্বী এই বয়সে এমন লজ্জার হাত থেকে।
কিছুক্ষণ প্রজাপতি গুলো উড়াউড়ি করে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে,এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। উর্বী রাওনাফের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। মোনাজাত ধরে এতক্ষণ সময় নিয়ে কি চাইছে লোকটা সৃষ্টিকর্তার কাছে? নিশ্চয়ই বাচ্চাদের জন্য। মায়ের জন্য। শিমালার জন্য।
আর উর্বীর জন্য? উর্বী কী তার মোনাজাতে স্থান পেয়েছে? দায়িত্ব বলে আগলে নিয়েছে, মোনাজাত অবধি পৌঁছাতে পেরেছে কি?
উর্বী কিছু ভাবতে চায়না। সম্পর্কের সমীকরণ মেলাতে সে দক্ষ নয়। সে শুধু জানে এই লোকটা তার স্বামী, আর অদৃশ্য কিছু তাকে বাধ্য করেছে লোকটার উপর মানসিক ভাবে নির্ভরশীল হতে।
চোখ ঘুরিয়ে আবারও রাওনাফকে দেখে উর্বী। লোকটাকে প্রথম দেখায় খুবই সাধারণ চেহারার একজন ছাপোষা পুরুষ মনে হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে লোকটাকে উর্বীর চোখে সুদর্শন ঠেকছে। সবথেকে সুন্দর কপালের ঠিক মাঝখানে কালচে দাগ টা। সিজদা দিতে দিতে দাগটা পরেছে। কিন্তু রাওনাফের ঘন কালো চুলের রহস্য উর্বীর জানা হলো না আজও। জিজ্ঞেস করে দেখবে সে হেয়ার কালার করে কি না? না না! এটা তো অভদ্রতা!
রাওনাফ সালাত আদায় করে উঠে জায়নামাজ তুলে রাখে। উর্বী চোখ সরিয়ে নেয়। রাওনাফ এসে তার পাশে বসে। উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”হাঁটাচলা করার প্রয়োজন নেই। আর হাঁটতে পারবেও না। ক্রাচ নামিয়ে দিচ্ছি। প্রয়োজনে সেটা ব্যবহার করবে।”
উর্বী বাধ্য মেয়েদের মতো মাথা ঝাঁকায়। রাওনাফের মুখে তার যত্ন নিয়ে কথা শুনে মনে আবারও প্রজাপতি উড়তে শুরু করে দেয়। উর্বীর খানিকটা অস্বস্তি বোধ হয় নিজেকে দেখে। এই বয়সে টিনেজ মেয়েদের মতো বুক ধুকপুক করা,এটা একটু বেশি বেশি লাগছে উর্বীর কাছে।
রাওনাফ বলে,”ঘুম পেলে ঘুমাও”
উর্বী বসে থাকে। রাওনাফ একবার তার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”শুতে চাও? আমি হেল্প করবো?”
উর্বী কথা না বলে মাথা ঝাঁকায়। প্রজাপতি উড়ছে তো উড়ছেই। রাওনাফ উঠে তাকে ধরে। রাওনাফের হাতের সাবধানী স্পর্শে উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ তাকে দেখছে না। এটা উর্বীর কাছে স্বস্তির ব্যাপার। রাওনাফ তাকে দেখলে সে তাকাতো কিভাবে?
বিছানায় শুইয়ে দিতে গেলে উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না। আমি বসে থাকবো।”
_ওহ। ওকে!
কথাটি বলে রাওনাফ উর্বীকে বিছানায় হেলান দিয়ে ঠিকঠাক ভাবে বসিয়ে দেয়। মৃদু স্বরে বলে,”আই থিংক তোমাকে বারো মাস আমার হসপিটালে রাখাটাই বেটার হবে মৃদুলা উর্বী! ওখানে নার্স রয়েছে। এখানে নার্সদের কাজটা আমাকে করতে হয় অলওয়েজ!”
উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে মাথা নিচু করে। মনের প্রজাপতি গুলো উড়ছে। আরো উঁচুতে উড়ছে।
রাওনাফ উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিতে থাকে। উর্বী জিজ্ঞেস করে,”কোথাও যাচ্ছেন?”
_কফি! যেটা আমার না হলে চলে না।
কথাটা বলতে বলতে রাওনাফ নিজের হাত উল্টে পাল্টে দেখে। নখের দাগগুলো কালচে হয়ে উঠেছে। সে গম্ভীর কন্ঠে উর্বীকে বলতে থাকে, “বাই দ্যা ওয়ে, তুমি তো বোধ হয় ঘুমাবে না। তোমাকে একটা কাজ দিয়ে যাই!”
_কি কাজ?
উর্বী উৎসাহী হয়ে প্রশ্ন করে!
রাওনাফ ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা একটা বক্সের মধ্যে থেকে একটা নেইল কাটার বের করে উর্বীর দিকে এগিয়ে দেয়। উর্বী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। রাওনাফ নিচুস্বরে বলে,”হাতের নখ গুলো কেটে ফেলো।”
উর্বী অবাক হয়ে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দরজা চাপিয়ে। উড়তে থাকা প্রজাপতি গুলো ডানা ভেঙ্গে ধপপ করে নিচে পরে যায়। উর্বী বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”কি আজব লোকরে বাবা !”
***
বাড়িতে প্রবেশ করেই রওশান আরার চোক্ষু চড়কগাছ। চেঁ’চি’য়ে বলে ওঠে,”একি! একি হাল!”
রাওনাফ সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে লোকজনকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলো। আসবাবপত্র যা ভাঙচুর হয়েছে সব সরিয়ে নিয়ে গোছগাছ করা হচ্ছে।
মায়ের দিকে রাওনাফ একপলক তাকায়। কিন্তু কোনো জবাব দেয় না। রওশান আরা আবারও বলে,”আরে এসব কি! কি হয়েছিলো রাওনাফ?”
_চোর এসেছিলো মা।
রাওনাফ ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়।
রওশান আরা হতভম্ব হয়ে যায়,”চোর এসেছিলো?”
_হ্যা। গতকাল রাতে।
_এসব কে করেছে? চোর ভাঙচুর করেছে?
_না, চোর এসেছিলো চুরি করতে। ভাঙচুর করেছে তোমার পুত্রবধূ আর তোমার নাতি নাতনি।
_কেন?
হতভম্ব ভাব কাটছে না রওশান আরার। রাওনাফ বলে,”কেন আবার। চোর ধরতে গিয়ে!”
রওশান আরা চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। রাওনাফ বলে,”কোথায় যাচ্ছো মা?”
_আমার ঘরে!
_এতো উতলা হবার কিছু নেই। চোর কিছু নেয়নি তোমার স্বর্ণালংকার!
মায়ের সাথে হালকা মজাটা করে রাওনাফ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসে। কিন্তু এখন ভাবার বিষয় মা কি রিয়্যাক্ট করবে।
রওশান আরা চেচায় না। রাওনাফের দিকে ক’ট’ম’ট দৃষ্টি দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”তুই তো ইদানিং ভালোই মশকরা করছিস আমার সাথে।”
রাওনাফ চুপ। রওশান আরা বলে,”বৌমা কোথায়?”
_ঘরে!
_ঘরে কি করছে!
_গিয়েই দেখো।
উর্বীকে দেখে রওশান আরা দ্বিতীয় বারের মতো চিৎকার দিয়ে ওঠে।রাওনাফ মায়ের চিতকার শুনে দোতলায় চলে যায়। উর্বী শাশুড়িকে আস্বস্ত করে বলে,”মা শান্ত হোন। আপনার এভাবে চেঁচানো বারণ।”
রওশান আরা উর্বীর দিকে এগিয়ে যায়। একবার কপালের ব্যান্ডেজ, একবার পায়ের ব্যান্ডেজের দিকে তাকায়। রাওনাফ ঘরে ঢোকে। রাওনাফ করীমের তিন ছানাও ঘরে ঢোকে দাদীর চিৎকার শুনে।
মাকে থামাতে রাওনাফ বলে,”কাঁচ ঢুকেছে পায়ে। তিন-চার দিনে সেরে যাবে।”
রওশান আরা বিছানায় বসে পরে, হতভম্ব হয়ে বলে, “আরে এই মেয়ের এতো ফাড়া কেন? সবসময় সবকিছু এর সাথে ঘটে কেনো! কি করছিলে মেয়ে? চোরের সাথে কাবাডি খেলছিলে?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। শর্মী ফিক করে হেসে ফেলে। রওশান আরা বলতে থাকে,”রাওনাফ তোর জাহানারা খালাকে ফোন দে।”
_কেন মা?
_ওদের বাড়ির ওখানে একজন হুজুর আছে। উনি পানি পড়ে দেয়। বৌমার জন্য আনবো আমি। ওনার দেওয়া পানি পড়া খেলে ফাড়া কে’টে যাবে ।
রাওনাফ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”ডিসগাস্টিং মা!”
শর্মী,শায়মী নাবিল তিনজনই ফিক করে হেসে দেয়। রওশান আরা নাতী নাতনির দিকে চোখ গরম করে তাকাতেই সবাই চুপ হয়ে যায়। রওশান আরা বলতে থাকে,”তোর ফোন দিতে হবে না। আমিই নিজেই ফোন দেবো।”
কথাটি বলে রওশান আরা চলে যায়। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এসব ঝাড়ফুঁক একেবারেই এলাউ করবে না। মা জোর করলেও না। বুঝেছো?”
উর্বী হাসি চাপিয়ে রেখে মাথা নাড়ায়। সে বুঝেছে। রাওনাফ এবার তার তিন ছানার দিকে তাকায়, তারপর একপলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বলে,”এমন সিচুয়েশনে সবসময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে আমাকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করবে। হটকারী হয়ে দৌড়াদৌড়ি, লম্ফঝম্প করবে না।”
উর্বী অবাক হয়ে রাওনাফের দিকে মুখ তুলে তাকায়, হুট করে বলে ওঠে,”মাথা ঠান্ডা রেখে আপনাকে ফোন দেবো কিভাবে? আমরা কি চোরকে বলবো,”চোর ভাই চোর ভাই, আমরা একটু এ বাড়ির কর্তা রাওনাফ করীম খানকে ফোন দেবো। আপনি পাঁচ মিনিট দাঁড়ান! আর সে বলবে,”জে আইচ্ছা আফা,আপনে ফোন দেন। আমি এইখানে খাড়ায়া আছি। একটুও নড়বো না”
কথাগুলো অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে বলে ওঠে উর্বী।
পুনরায় রাওনাফ করীমের ছানারা হেসে ওঠে। শর্মী আর শায়মীর সাথে পাল্লা দিয়ে হাসছে নাবিল।
রাওনাফ থতমত খেয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”আচ্ছা আমি একটু আসছি।”
রাওনাফ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তার তিন ছানারা হাসি থামিয়ে দেয়। উর্বী নাবিলের দিকে তাকায়। উর্বীর চোখে চোখ পড়তেই নাবিল পুনরায় চোখ মুখ কঠিন করে ফেলার বৃথা চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কাজ হয়না। অতঃপর সে মুখ লুকাতে চলে যায়। খানিক বাদেই চলে যায় শর্মী আর শায়মী।
উর্বী একদৃষ্টে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে আনমনে হাসতে থাকে। একটা অন্যরকম আনন্দময় সুখানুভূতিতে আলোড়িত হয় তার চিত্তমহল। মানুষ গুলো অদ্ভুত, পুরো অদ্ভুত। কিন্তু মানুষগুলো কি ভয়ংকর চমৎকার! উর্বীর সকাল থেকে রাত কাটে এই মানুষগুলোর সান্নিধ্যে। যে মানুষগুলোর উর্বীর জীবনে আসার কথা ছিলো না। উর্বী ভাবতে থাকে, কি বিচিত্র জীবনের গোলকধাধা। কিছু মানুষ জীবনের “ভুল” হয়ে আসে। আর কিছু মানুষ ভুল করে এসে ফুল হয়ে থেকে যায়। এরা কি ফুল হতে পেরেছে উর্বীর জীবনে?
****
বিছানায় খালি গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলো উচ্ছাস। পিঠে একটা বিরাট ক্ষতের দাগ দৃশ্যমান। ভার্সিটি লাইফের শুরুতে একদিন মারামারি করতে গিয়ে পেছন থেকে ছু’ড়ি দিয়ে কোপ বসিয়ে দিয়েছিলো আততায়ী। তখন থেকে দাগটা নিয়ে ঘুরছে সে। সময়ের সাথে সাথে দাগ সাধারণত বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু উচ্ছাসের হয়েছে উল্টো। দাগটা দেখলে মনে হয় কেনো শিল্পী আর্ট করেছে। একটা নকশার মতো দেখতে।
হাতের অ্যালবাম টা উল্টে পাল্টে দেখছে উচ্ছাস। পুরো অ্যালবাম জুরে উর্বী আর উচ্ছাসের ছবি। ছবিতে তেইশ বছরের উর্বী আর বর্তমানের উর্বীর মধ্যে কোনো পার্থক্য উচ্ছাস দেখে না। আগেও যেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগতো, এখনও লাগে। কিছু রিংক্যালস পরতে শুরু করেছে শুধু। আর একটু মোটা হয়েছে তবে সেটুকুতে সৌন্দর্যে ভাটা পরেনি মোটেও। বরং বেরেছে। আরেকটা পরিবর্তন হয়েছে, চুল কেটেছে। কত লম্বা লম্বা চুল কে’টে ফেলেছে, উচ্ছাসের পছন্দের ছিলো উর্বীর চুল। কেটে ফেলেছে বেয়াদবটা।
কল হিস্ট্রিতে উচ্ছাসের সাথে উর্বীর তের মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ডের রেকর্ড পরে আছে। সেদিন নেশা করে ফোন দিয়েছিলো উর্বীকে। কিছু কিছু মনে আসছে। পুরোটা নয়। নিশ্চয়ই খুব গালাগালি করেছিলো উর্বীকে!
“ভাই।”
সজীব দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায়। উচ্ছাস উঠে বসে। কালো রঙের শার্ট টা গায়ে চাপিয়ে নেয়। সজীব হাতের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,”কাকা।”
_অভিনন্দন বলে দে।
কথাটি বলে উচ্ছাস সিগারেট ধরায়। সজীব তবুও দাঁড়িয়ে থাকে ফোন হাতে নিয়ে। উচ্ছাস বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোনটা নিয়ে কানে ধরে। ওপাশ থেকে শাখাওয়াত চৌধুরী কিছু বলার আগেই উচ্ছাস বলে ওঠে,”অভিনন্দন মিনিস্টার সাহেব! জয়ের জন্য আপনাকে অভিনন্দন। এই মার্ডারার উচ্ছাসকে কেনো মনে পরলো! কাউকে খু’ন করতে চান? দেখুন আমি দরাদরি করতে পছন্দ করি না আগেই বলে দিলাম। একটা খু’ন তিন লাখ, দুইটা খু’ন পাঁচ লাখ।”
কথা গুলো বলে উচ্ছাস হেসে ওঠে। শাখাওয়াত চৌধুরী চুপ করে থাকে। হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে গেলে উচ্ছাস বলে ওঠে,”কেনো ফোন দিয়েছো?”
_বাড়ি চলে এসো। গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
শাখাওয়াত কথাটি বলে ফোন কে’টে দেয়। উচ্ছাস বসে বসে সিগারেট পোড়াতে থাকে। সজীব উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে আছে। উচ্ছাস বলে,”কিছু বলবি?”
_ভাই। এখন বাদ দেন না। অনুরোধ করছি। সেদিন ধরা পরলে কি হতো ভাবতে পারেন?
উচ্ছাস চুপ করে থাকে। সজীব এক প্রকার চেঁ’চি’য়ে বলে,”ভাই কি পেয়েছেন ঐ মেয়ের মধ্যে। এখন তো বুড়িও হয়ে গিয়েছে প্রায়। হাত বাড়ালেই কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে পেতে পারেন আপনি। আপনি ফ্রান্স চলে যান ভাই।”
_জ্ঞান দেওয়া হয়ে গেলে এখান থেকে যা।
সজীব বলতে থাকে,
“আপনাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো ভাই। তার সাথে দেখা করেন। সময় কাটান। উর্বীর কথা মাথাতেই আসবে না আর!”
উচ্ছাস হাসে। বলে,”হোটেলে যেতে বলছিস? চেষ্টা করেছিলাম। হয়নি। ঐসব ন্যাস্টি মেয়ে দেখলেই মাথায় রক্ত উঠে যায় আমার। ছোঁয়া তো দূরের কথা। ওরা কেউ আমার উর্বীর মতো নয়।”
সজীব চুপ করে থাকে। উচ্ছাস বলতে থাকে,”বাবা গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে। কয়দিন বেরিয়ে আসি কি বলিস! উর্বীকে বিয়ে করে আমি এমনিতেও ঐ বাড়িতে যাবো না। আলাদা বাড়িতে উঠবো। তার আগে কিছুদিন ঘুরে আসি!”
সজীব দাঁড়িয়ে থাকে। উচ্ছাস হাত বাড়িয়ে ফোনটা নেয়। ডায়াল করে উর্বীর নাম্বার। দুদিন ধরে লাগাতার সুইচস্টপড বলছে নাম্বারটা। খুব সম্ভবত আবারও নাম্বার পাল্টেছে বোকা মেয়েটা!
****
পায়ের ব্যাথাটা পুরোপুরি না সারলেও হাঁটাচলা করতে বেগ পেতে হয় না এখন। ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে পারে উর্বী। প্রয়োজনীয় কাজ বলতে রাওনাফের এটা সেটা এগিয়ে দেওয়া, জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখা। সবকিছু এলোমেলো না থাকলেও উর্বী এলোমেলো করে আবারও গুছিয়ে রাখে। উর্বীর ভালো লাগে। তবে কাজটি করে উর্বী খুবই সাবধানে, রাওনাফের চোখে পরলে নির্ঘাত উর্বীকে আবারও আক্তারুজ্জামানের কাছে পাঠাবে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু লোকটা কি করে বুঝবে এসব করতে উর্বীর নিজেকে কতটা পরিপূর্ণ লাগে! পুরুষের তো এসব অনুভূতি বোঝার কথা নয়। তার ওপর রোমান্টিসিজম আর রাওনাফ বিপরীতমুখী। যার কাছে রোমান্টিকতা মানে চেপে ধরে বৌকে কমলার জুস খাওয়ানো,বৌকে নখ কাটতে বলা, বৌকে উঠতে বসতে স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান দেওয়া। উর্বী মাঝে মাঝে ভাবে শিমালা একে সহ্য করতো কিভাবে!
বাইরে রওশান আরার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। রওশান আরা চেঁচাচ্ছে সামিউলের উপর। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে সকালে, সামিউলেরা সিলেট থেকে ফিরেছে। রওশান আরা উর্বী,মোহনা আর অন্তরার জন্য হুজুরের থেকে ঝাড়-ফুক দেওয়া পানি এনেছে। এটা খেলে কোনো বালা-মসিবত আসবে না নাকি! রওশান আরাকে খুশি রাখতে উর্বী বুদ্ধিমতি মেয়েদের মতো পানির বোতলটা নিয়ে নিয়েছে। খাবে না এসব, তবুও শাশুড়িকে শান্ত রাখতে করেছে। মোহনার জন্যেও পার্সেল করে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু উল্টো ঘটেছে অন্তরার ক্ষেত্রে, সামিউল তার বৌকে এসব খেতে দেবে না তাই মায়ের সাথে তর্কাতর্কি করছে। এই মা-ছেলেতে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। বাকিরা সবাই দর্শক হয়ে দেখে।
বাইরে রাওনাফের গাড়ির হর্ন বেজে ওঠে। আজ ডাক্তার একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছেন। উর্বী খুশি হতে গিয়েও হয়না। তার খুশি হয়ে কি লাভ। ডাক্তার সাহেব থোরাই তার সাথে রোমান্টিক কিছু মুহূর্ত কাটাবে! সে শুধু কপাল কুঁ’চ’কে কিছুক্ষণ উর্বীর দিকে তাকিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করে বলবে,”ঘুম কম হচ্ছে? এসো তোমার প্রেশার চেক করি! তুমি পানি কম খাও মনে হচ্ছে। এক কাজ করবে,তুমি আর শর্মী রোজ পানি খাওয়ার একটা সময়সূচি করে ফেলবে। ওভাবে হাটছো কেনো, এসব কি বাজে খাবার খাচ্ছো! আমাকে বলো নি কেনো, এই ওষুধ টা খাও, ঐ ওষুধ টা খেও না।”
অসহ্য! অসহ্য! অসহ্য! নিরামিষ হবার লিমিট ক্রস ফেলেছে এই ভদ্রলোক!
ঘাড় ঘুরিয়ে উর্বী শিমালার ছবি দেখে, বিড়বিড় করে বলে,”সব রোমান্টিকতা আপনাকে দিয়ে দিয়েছে। আমার জন্য শুধু আছে,”মৃদুলা উর্বী, বেশি করে পানি খাও, এভাবে শুয়েছো কেনো? এতে ব্যাক পেইন হয়। রোজ এক গ্লাস আনারের জুস খাও। খালি পেটে লেবু পানি খাও। সর্দি হয়েছে? ”
কথা গুলো বিড়বিড় করতে করতে উর্বী হেঁসে ফেলে। নিজেকে নিজে বলে,”খুব বাড়াবাড়ি করছো তুমি উর্বী। কিশোরী মেয়েদের মতো ছটফটানি। তোমার বয়সের সাথে যাচ্ছে না এসব! তোমাকে এবার সাইক্রিয়াটিস্ট নয়, ডিরেক্ট পাবনা মেন্টাল হসপিটালে শিফট করতে হবে।”
ক্লান্ত ভঙ্গিতে রাওনাফ ঘরে ঢোকে। উর্বী ঘুরে মানুষটাকে দেখে। রাওনাফ উর্বীর দিকে একপলক তাকিয়ে শুকনো হাসি হাসে। ব্যস! সেই নির্মল হাসি দেখে উর্বীর সব বিরক্তি কেটে যায় আনরোমান্টিক রাওনাফের প্রতি। মুগ্ধতায় ভরে যায় তার দু’চোখ, আবারও উড়তে শুরু করে সহস্র প্রজাপতি।
রাওনাফ হাত থেকে এ’প্রো’ন আর স্টেথোস্কোপ উর্বীর হাতে দিতে দিতে বলে,”দেখে মনে হচ্ছে পানি খাচ্ছো না। ডিহাইড্রেটেড লাগছে। খুব গরম পরছে। বেশি বেশি পানি খাবে।”
উর্বী পুনরায় বিরক্ত হয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। উড়তে থাকা সহস্র প্রজাপতি আবারও ডানা ভেঙ্গে ধপপ করে নিচে পরে যায়।
বিরস মুখে আলমারির কাছে যায় সে। রাওনাফ ওয়াশ রুমে ঢোকে। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে হতভম্ব হয়ে রাওনাফ তাকিয়ে থাকে উর্বীর দিকে।
উর্বীর এক হাতে জগ আর আরেক হাতে গ্লাস। সে শুধু জগ দিয়ে গ্লাসে পানি ঢালছে আর খাচ্ছে।
রাওনাফ এগিয়ে এসে হাত থেকে তোয়ালে রেখে বলে,”কি করছো! এতো পানি খাচ্ছো কেন!”
_আপনিই তো বললেন খেতে!
_তাই বলে এভাবে,একবারে? কিছুক্ষণ পর পর খাবে।
_কিছুক্ষন পর পর পারবো না। এই যে, পুরো এক সপ্তাহের পানি আজ খেয়ে নিলাম। আগামী এক সপ্তাহে আপনি ভুলেও জিজ্ঞেস করবেন না আমি পানি খেয়েছি কি না। তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে শর্মীর পাপা!
কথা গুলো হুমকির মতো করে বলে ওঠে উর্বী। রাওনাফ চোখ বড় বড় করে উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর নরম গলায় বলে,”আর ইউ ওকে!”
_নো আ’ম নট ! প্লিজ স্টপ ট্রিটিং মি লাইক আ কিড!
হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে থাকে উর্বী। রাওনাফ হতভম্ব হয়ে দেখতে থাকে উর্বীকে। চাঁপা স্বভাবের মৃদুলা উর্বীর এই রুপের সাথে রাওনাফের এইমাত্র পরিচয় হলো।
****
“তোমাকে বড্ড খাটাই আমি?”
সামিউলের দিকে তাকিয়ে অন্তরা বলে ওঠে। সামিউল মাথা নিচু করে বৌকে ফুট মাসাজ দিচ্ছিলো। মাথা তুলে অন্তরার দিকে তাকিয়ে হাসে, দুষ্টুমির সুরে বলে,”তা বৈ কি।”
অন্তরা চুপ করে থাকে। সামিউল বলতে থাকে,”তোমার এই অবস্থা হবে জানলে আমি কখনো বাচ্চা চাইতাম না তোমার কাছে।”
_এভাবে কেনো বলছো। ওর জন্য হলেও তো মা আমাকে কাছে টেনেছে। এসব শারীরিক যন্ত্রনা সেই আনন্দের কাছে কিছুই না।
সামিউল হাসে। অন্তরা মন খারাপের মতো করে বলে,”আই উইশ এই আনন্দ যেন আমার লাইফ থেকে ফুরিয়ে না যায়!”
***
রাওনাফ ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। লন্ডনের “দ্যা আওয়ার্স” হসপিটালের একজন প্রফেসরের সাথে তাদের মান্থলি কনফারেন্স মিটিং চলছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, রাওনাফ ল্যাপটপের সামনে বসে থাকলেও তার দৃষ্টি উর্বীর দিকে। কিছুক্ষণ পরপর উঠে ওয়াশরুমে যাচ্ছে। খামখেয়ালিপনা করে তিন জগ পানি খাওয়ার পরিনাম। এমন লেজেগোবরে অবস্থা দেখে রাওনাফ আনমনে হেসে ফেলে, বয়স বেড়েছে কিন্তু আচরণ এখনও কিছুটা শিশুসুলভ। কে ভেবেছিলো চাঁপা স্বভাবের মৃদুলা উর্বী নামের ত্রিশের ভদ্রমহিলার আড়ালে এমন কেউ লুকিয়ে ছিলো। শিমালাও ছিলো কিছুটা এরকম, দায়িত্বশীল তবে অগোছালো।
হঠাৎ শিমালার কথা মনে পরতেই রাওনাফের চোখ মুখে ছেয়ে যায় গ্লানি। এভাবে একজনের সাথে আরেকজনকে মিলিয়ে দেখা মোটেও সমীচিন নয়। ভুল এটা! রাওনাফ চোখ সরিয়ে নেয়। ওপাশ থেকে ডক্টর স্টিফেন বলে ওঠে,”আর ইউ লিসেনিং মি ডক্টর আর.কে? ”
স্টিফেনের ডাকে রাওনাফের ঘোর কাটে। কনফারেন্স মিটিং শেষ করে ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। উর্বী আরো একবার ওয়াশরুমে ঢোকে। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলে রাওনাফ মুখ ঘুরিয়ে নিশ্চুপ হাসতে থাকে। উর্বী কপাল কুঁচকে রেখেছে। বিরক্ত লাগছে তার। রাওনাফ মজার ছলে এক গ্লাস পানি ঢেলে উর্বীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”নাও। ওয়াশরুমে যেতে যেতে হাঁপিয়ে উঠেছো। তোমার পানি খাওয়া দরকার!”
উর্বী রাগী রাগী মুখ করে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ হাসছে, স্নিগ্ধ,নির্মল হাসি।
চলমান…..
[ খোলাবার্তা: ঘটনা হচ্ছে আমার ইনসমনিয়া রয়েছে। তার ওপর পরিক্ষার টেনশন। পড়তে পড়তে তখন রাত আড়াইটা বাজে, ঘুমও আসছিলো না আর পড়তেও ইচ্ছে করছিলো না আর। ব্যস লিখে ফেললাম পর্বটা সাড়ে চারটা পর্যন্ত জিরিয়ে জিরিয়ে। এক্সাম দিয়ে আসলাম,এখন আমার চোখে রাজ্যের ঘুম। আমি এখন ঘুমাবো। ঘুম থেকে উঠে যেন দেখি কমেন্ট বক্স ভর্তি আপনাদের ভালোবাসা নইলে 🔪💣]