ডিভোর্স পেপার সামনে আর কলম হাতে নিয়ে একবার তার স্বামী নিরবের দিকে তাকায় তন্নি। নিরব যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন তন্নি সাক্ষর করবে পেপারে। তন্নি মেকি হাসে এতোটাই অসহ্যকর হয়ে গেছে সে যে তার থেকে মুক্তি পেতে অস্থির হয়ে আছে।
আর কিছু ভাবলো না সে আর কারো দিকে তাকালো না। নিজের চোখের পানি মুছে কলমটা শক্ত হাতে ধরল। হাত কাপছে তার বুকটা ভার হয়ে গেছে। মাথাটা দু পাশে ঝাকিয়ে ডিভোর্স পেপারটা কাছে নিয়ে সাক্ষর কর দিল। অবশেষে বিচ্ছেদ ঘটে গেল তাদের। তন্নির চোখ দিয়ে দূ ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
নিরব খুশিতে উঠে দাড়ালো। তার মুখে যেন বিজয়ের হাসি। তন্নি অবাক হলো একটা সময় এই ছেলেটার পাগলামোতেই তন্নির পরিবার রাজি হয় তন্নিকে ওর সাথে বিয়ে দিতে। আজ সেই ছেলেটাই তন্নির থেকে মুক্তি পেয়ে কতটা খুশি।
তন্নি উঠে দাড়ালো তন্নির বাবা তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে–“বাবা চলো যাওয়া যাক।”
তুষার নিজের মেয়ের দিকে তখনও তাকিয়ে আছে। মেয়েটার কতটা কষ্ট হচ্ছে তা সে বাবা হয়ে অনুভব করতে পারছে। ২ বছরের সম্পর্কের জন্য নিরব ৪ বছরের সংসার ভেঙ্গে দিল।
তুষার তন্নির হাতটা শক্ত করে ধরল নিরবের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,–” আজকে যেই মেয়ের জন্য আমার মেয়েকে ঠকাইছো একদিন সেই মেয়ে তোমাকে কাঁদাবে। ”
তুষারের কথায় নিরব উচ্চ স্বরে হেসে উঠে। তুষার কপাল কুচকে ফেলে। নিরব হাসি থামিয়ে বলে,–” তাই নাকি এক্স শ্বশুরমশাই।”
তন্নি ঘৃণায় নাক চিটকায়। তুষার রাগি গলায় নিরবের দিকে আঙ্গুল তুলে বলে,–” বেয়াদব ছেলে একদিন তুমি এসে আমার মেয়ের পায়ে ধরবা যেন সে তোমার জীবনে আবার ফিরে আসে।”
তুষার আর দাড়ায় না তন্নিকে নিয়ে চলে যেতে শুরু করে। নিরব সেখান থেকে দাড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে,–“আপনার ঐ সেকেন্ড হ্যান্ড মেয়ের কাছে নিরব কখনো যাবে না।”
এই কথা কানে যেতেই তন্নির ইচ্ছে করে মরে যেতে। তুষার আর এক সেকেন্ড ও সেখানে দাঁড়ায় না তন্নিকে নিয়ে চল আসে।
————
তন্নি চলে যেতেই নিরব ফোন বের করে নিজের গার্লফ্রেন্ড বৃষ্টিকে কল দেয়। দুই তিনবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করে বৃষ্টি।
–” হ্যালো।”
বৃষ্টির গলা শুনে বা পাশে বুকে হাত দিয়ে নিরব বলে,–” হায় কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেল।”
নিরবের কথায় বৃষ্টি হালকা হেসে বলে,–” কি বলবে বলো”
নিরব বলল,–” বলতে তো অনেক কিছু ইচ্ছে করে মেরি জান কিন্তু এখন আপাতত বলতে চাইছি যে তোমার পরিবারের কাছে আমার পরিবার কালকে আসবে।”
বৃষ্টি খুশি হয়ে বলে,–” সত্যি! ”
নিরব বলল,–” হুম।”
বৃষ্টি উৎসুক হয়ে বলল,–” তার মানে তোমার ডিভোর্স হয়ে গেছে? ”
নিরব বলল,–“হ্যা।”
বৃষ্টি খুশিতে ফোনের অপাশে লাফিয়ে উঠলো। এটা বুঝতে পেরে নিরব হাসলো। বৃষ্টি নিজেকে সামলে বলে,–” অপেক্ষায় থাকবো কাল বাই।”
নিরবও বাই বলে কেটে দিল কল। অবশেষে তার ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। নিরবের মা রুনা এসে নিরবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,–” বৃষ্টি মেয়েটা অনেক ভালো। বেশ করেছিস এই তন্নি শাঁকচুন্নিকে ডিভোর্স দিয়ে। তোর বাবা থাকলে আজ তিনি খুশি হতেন।”
মায়ের কথায় নিরব রুনাকে জড়িয়ে ধরে বলল,–” আমি জানি তো মা।”
নিরবের বাবা অনেক আগেই মারা গেছে। শুধু তার মা বেচে আছে। নিরবের আর কোনো ভাই বোন নেই।
——————
রান্নাঘরে দাড়িয়ে রান্না করছে তন্নি তার পাশেই তার মা মিশমি তার দিকে তাকিয়ে আছে। তন্নি গম্ভীর গলায় বলে, –” কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
মিশমি কান্না ভেজা গলায় বলে, –” দেখছি আমার ছোট মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে যে মায়ের কাছে থেকেও নিজের কষ্ট গুলো লুকিয়ে রাখছে।”
তন্নি চট করে চোখ বন্ধ করে নেয়। গলাটা কেমন ধরে আসল তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে। তন্নি নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।
মিশমি কিছু বলে না তন্নিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে। কাদুক না মেয়েটা কাদলে মনটা হালকা হবে। তন্নি কিছুক্ষণ কান্না করে নিজেকে সামলে সোজা হয়ে আবার রান্নার দিকে মনযোগ দেয়। মিশমি নিজের গলা ঝেড়ে বলে– ” মা নিজের জীবনটা আবার সাজা নতুন করে। ”
তন্নি কাপা কাপা গলায় বলে,–” সাজাবো মা একটু সময় দাও।”
মিশমি কিছু বলে নাহ। তুষার তখন বসার ঘরে বসে ছিল। মিশমি গিয়ে তার পাশে এসে বসে। তুষার মিশমির দিকে তাকিয়ে বলে– ” মেয়েটা সামলাতে পারবে তো?”
মিশমি আশ্বাস দিয়ে বলে– “চিন্তা করো না তন্নি সামলাতে পারবে। ”
তুষার কিছু বলে না মিশমির হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে। তন্নির জীবনের এই ঘটনার জন্য তুষার নিজেকে দায়ী ভাবছে।
—————–
খাবার টেবিলে বসে আছে তন্নি,তুষার আর মিশমি। তন্নি স্বাভাবিক আচরণই করছে। তন্নি মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে– ” কি হলো খাচ্ছো না যে!”
তন্নির কথায় মিশমি তার দিকে তাকায় মাথা নাড়িয়ে বুঝায় কিছু হয় নি। তন্নি বুঝতে পারে বিষয়টা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তন্নি দুজনকেই বলতে থাকে, –” মা বাবা প্লিজ তোমরা স্বাভাবিক হও। তোমরা এমন বিহেভ করলে আমি স্বাভাবিক জীবন এ ফিরবো কি করে? তোমরা এভাবে মন খারাপ করে থাকলে তোমাদের দেখে বার বার আমার ঐ ঘটনা মনে হবে। আর যা ঘটে গেছে তা তো আর মন খারাপ করে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।”
মিশমি আর তুষার দুজনই ভাবে সত্যিই তো যা ঘটে গেছে তা তো বদলানো যাবে না। তন্নিকে স্বাভাবিক রাখতে হলে তাদের স্বাভাবিক থাকতে হবে।
——————–
সকাল ১১ টা বাজে তন্নির ফোনটা ভেজে উঠে। তন্নি রান্না ঘর থেকে ছুটে আসে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে বড় বড় অক্ষরে নিরব লিখা। তন্নি চমকে যায় শ্বাস ঘন হয়ে আসে বুক ধরফর করতে থাকে।
ফোন রিং হতে হতে ফোন কেটে যায় তন্নি ফোন ধরে না। আবার ফোনটা বেজে ওঠে এবারও নিরব কল দিয়েছে। তন্নি একটা বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোনটা রিসিভ করে ঝাঁজালো গলায় বলে,–“কি হয়েছে কল দিচ্ছেন কেন?”
নিরব বিরক্তিকর হাসি দিয়ে বলে– ” ওহ হ্যালো তোর মতো মেয়ের সাথে পিরিত করতে কল দেই নি।”
তন্নি বিরক্ত নিয়ে বলে,–” কি বলবে বলো?”
নিরব হেসে বলে,–” আজকে তো আমার আর বৃষ্টির বিয়ের তারিখ ঠিক হবে।”
তন্নি মেকি হেসে বলে,–” ভালো তো। আচ্ছা রাখি আমার কাজ আছে। ”
তন্নি নিরবকে আর কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দেয়। বুকটা খুব যন্ত্রণা করছে। পাশে থাকা গ্লাসের পানিটা ঢকঢক করে শেষ করে ফেলে দম নেয় সে। ফোনটা অফ করে দিয়ে একটু স্বাভাবিক হয়ে বাহিরে যায়।
বাহিরে আসতেই মিশমি জিজ্ঞেস করে, –“কি হয়েছে এত দেরি করলি যে।”
তন্নি মাথা নাড়িয়ে কিছু না বলে আবার নিজের কাজে মন দেয় সে। নিরব কল দিয়েছে ব্যাপারটা লুকিয়ে গেল। মা বাবা জানতে পারলে শুধু শুধু চিন্তা করবে। তন্নি ভয়ে আছে আবার যদি নিরব কল দেয় ও নিজেকে আর সামলাতে পারবে না। তাই আজ তুষার আসলে সে তার বাবাকে বলবে নতুন সিম কিনে আনতে।
—————-
বিকেলের দিকে তুষার বাসায় আসে। আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসে। তখন বেলা ৪ টা বাজে মিশমি হালকা খাবার বানিয়ে আনে বিকেলের জন্য। তুষার আর তন্নি বসে টিভি দেখছিল। টিভি দেখতে দেখতে তন্নি বলে,–“বাবা আমাকে একটা নতুন সিম কিনে দিও।”
তুষার বলে,–“আচ্ছা। ”
তন্নি আর কিছু বলে না বাবার কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকে। তুষারও কিছু বলে নাহ চেয়েছিল জিজ্ঞেস করতে নিজের জীবন নিয়ে কি চিন্তা করলো কিন্তু করলো না সে মনে করে তন্নিকে আরো সময় দেওয়া উচিত।
হঠাৎ তন্নি পড়ে যায় বসা থেকে। তুষার আর মিশমি আৎকে উঠে। তন্নি ফ্লোরে পড়ে যায় তার হাত পা কুচকে আসতে থাকে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মিশমি দৌড়ে যায় পানি আনতে আর তুষার তন্নিকে তুলে সোফায় শুইয়ে দেয়।
অনেক্ষণ পানি ঢালার পর তন্নি স্বাভাবিক হয়। তুষার চিন্তিত হয়ে বলে,–” তুই ঠিক আছিস তো? হঠাৎ এমন হলো কেন?”
তন্নি সোজা হয়ে বসে হালকা দম নেয় তারপর বলতে থাকে, –“এটাই প্রথমবার নাহ এর আগেও অনেকবার হয়েছে এমন। প্রথম হয়েছিল এমন সেইদিন যে দিন নিরব আর বৃষ্টির প্রেমের বিষয়ে জেনে ছিলাম। ”
তুষার চিন্তিত গলায় বলে, –” ডাক্তার দেখাস নি?”
তন্নি না করল। তুষার চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিয়ে জানালো কাল হসপিটালে ডাক্তার দেখাতে যাবে।
চলবে
#অন্যরকম_ভালোবাসা
পর্ব১
#মৌমিতা_শবনাম
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/