Crush Villain,পর্ব ২৫,২৬

Crush Villain,পর্ব ২৫,২৬
লাবিবা ওয়াহিদ
পর্ব ২৫

– বুঝলাম তুমি আগেই বুঝে গেছো কিন্তু আমাকে তো বলতে দেয়ার সময় দেয়া উচিত ছিলো তাইনা?

– আপনি আগেই যা বলার বলে ফেলেছেন এখন আবার কোন রঙঢঙ করতে বলবেন? আমি এতো ন্যাকামি করতে পারি না তাই আগে বুঝেই রিং নিয়ে আপনার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে ফেলললাম।

আয়াফ নিঃশব্দে হাসলো। তারপর বলে,”ওকে বাবা বুঝলাম তুমি জনাবা বিদ্যাসাগরনী এখন রিং টা দেও পরিয়ে দেই!”

সানিয়া মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে রিংটা দিয়ে দিলো আর আয়াফ সেই রিং সানিয়াকে পরিয়ে দিলো। সানিয়ার সব কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে৷ তার ক্রাশ কি না তাকে ভালোভাসে তাও রিং পরালো। সত্যি-ই আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে তার দ্বিগুণ কিছু তিনি ফিরিয়ে দেন। আগে চাইতো একবার হলেও যেনো আয়াফের সাথে কথা বলার সুযোগ সে পায় কিন্তু না সুযোগ তো অনেক আগেই পেলো সাথে আজকে নিজের জম্মদিনে এমন একটা উপহার পেলো।

রিং পরিয়ে আয়াফ উঠে দাঁড়াতেই নীল আর যাহির মিলে কেক আনলো তারপর সানিয়ার সামনে রাখলো৷ সানিয়া আনন্দের মাঝেই কেক কাটে। সর্বপ্রথম আয়াফকে খাইয়ে দেয় তারপর একে একে সবাইকে। সবাই যে যার মতো মজা করছে তখনই সানিয়া সুযোগ বুঝে আয়াফের দু’গালে কেকের ক্রিম লাগিয়ে ভূত বানিয়ে দিলো৷ আয়াফ হোয়াট দ্যা… বলে কিছুটা চেঁচিয়ে উঠে আর সানিয়া খিলখিলিয়ে হাসছে।

আয়াফ মুগ্ধ হয়ে সানিয়ার হাসি দেখছে। পরে কি মনে করে যেনো আয়াফও সানিয়াকে ভূত বানিয়ে দেয়। সানিয়াও রেগে হাতে কেক নিয়ে আয়াফের দিকে ছুঁড়ে মারে আর আয়াফ সাথে সাথে সরে যায়। আয়াফ সরে যেতে দুর্ভাগ্যক্রমে আলিজার মুখে গিয়ে ক্রিমটা লাগে। আলিজা চোখ খুলে সামনে রেগে তাকাতেই দেখলো নীল দাঁড়িয়ে। সে ধরেই নিলো নীলই তাকে মেরে তাই সে কেক হাতে নিয়ে নীলের দিকে ছুঁড়ে মারে। বিষয়টা এতো জলদি জলদি হলো যে নীল বেকুব বনে গেলো। তারপর এরা দুজনও শুরু করলো কেকের ক্রিম ছুঁড়াছুঁড়ি।

সানিয়া আর আয়াফ কেক ছুঁড়াছুঁড়ি করতে করতে ছাদে এসে দাঁড়ায় আর আকাশে থাকা সেই গোলাকৃতির চাঁদটার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে৷ পরিবেশটাও কেমন ঠান্ডা, নরম, তুলতুলে। এ রাত যেনো লং ড্রাইভের জন্য পারফেক্ট। আয়াফ নিরবতা ভেঙে বলে,”চলো আমরা লংড্রাইভে যাই!”

– বুদ্ধিটা খারাপ না তবে আমি এই ভারি গাউন পরে যেতে পারবো না।

– ওকে চেঞ্জ করে এসো।

– আচ্ছা।

তারপর দুইজনই নিচে চলে এলো। সানিয়া এক রুমে গিয়ে এই গাউন খুলে নিজের জামাটা পরে নিলো। তারপর বাইরে বের হতেই দেখে আয়াফও রেডি। সানিয়া যতোক্ষণে চেঞ্জ করেছিলো ততোক্ষণে তার বন্ধুদেরবলে দিয়েছে যে তারা লং ড্রাইভে যাবে। দুইজন একসাথে বেরিয়ে গেলো। রাত প্রায় ১২ঃ৩০ মিনিট হবে। তবুও রাস্তা কতো ফাঁকা, কোনো মানুষজন নেই। মাঝে মধ্যে রাস্তার ধারের ফুটপাতে কিছু কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চলেছে যা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জানালা দিয়ে শো শো ঠান্ডা বাতাস সানিয়ার মুখে বারি খাচ্ছে আর তার চুলগুলো মুক্ত পাখির মতো উড়ছে। আয়াফ এই মোমেন্ট টা বেশ ইঞ্জয় করছে। বাতাসটা অনেকটা ফিল করার মতো একদম দূষণমুক্ত। হঠাৎ একটা ফ্লাইওভার দেখতে পায় সানিয়া। সাথে সাথে আয়াফকে গাড়ি থামাতে বলে।

– কেন এই মাঝরাস্তায় কেন থামাবো?

– আরে দেখেন ফ্লাইওভার কি সুন্দর লাগছে ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোতে। কোনো গাড়িও নেই মাঝে দিয়ে দুজন বেশ করে হাঁটতে পারবো এবং মনে আলাদা তৃপ্তিও পাওয়া যাবে। প্লিজ চলুন না আমার খুব ইচ্ছে এমন মাঝরাতে ফ্লাইওভারের মাঝে দিয়ে হাঁটার।

আয়াফ কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর সম্মতি দিয়ে বলে,”চলো তবে বেশি দূর যাবো না!”

– আচ্ছা!!(অত্যন্ত খুশি হয়ে)

আয়াফ গাড়ি একসাইডে পার্ক করে গাড়ি থেকে নামলো সাথে সানিয়াও।

দুজন মিলে পাশাপাশি হাঁটছে ফ্লাইওভারে। কিছুক্ষণ পরপর সানিয়ার গায়ে ঠান্ডা বাতাস লাগলেই শীতে কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাই দুইহাত জড়িয়ে একপ্রকার গুটিয়েই হাঁটছে সানিয়া। বিষয়টা আয়াফ খেয়াল করতেই নিজের হাতে থাকা জ্যাকেট টা সানিয়াকে জড়িয়ে দিলো। সানিয়া একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে আবারও হাঁটায় মন দেয়। দুজনের মাঝেই যেনো অনুভূতির ঝড় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু কেউ-ই মুখ ফুটে বলতে পারছে না। অনেকটা দোটানায় আছে দুজন। মাঝের কাছাকাছি আসতেই আয়াফ বে উঠে,”হয়েছে আর হাঁটা লাগবে না অনেক হেঁটেছি। এই মাঝরাতে মানুষ আমাদের দেখলে নির্ঘাত চোর ভেবে ধরে নিয়ে যাবে।”

সানিয়া ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,”ঠিক আছে চলুন। আমারও ইচ্ছা নেই জম্মদিনের দিন পুলিশের ডান্ডা পেটা খাওয়ার!”

সানিয়ার কথায় আয়াফ বাকা হাসে। তারপর দুজন ফ্লাইওভার থেকে নেমে গাড়িতে উঠে পরলো।

দুইজন লেকে পা ডুবিয়ে চিপস খাচ্ছে। সানিয়া আয়াফের কাধে মাথা রেখেছে আর আয়াফ প্যাকেট থেকে চিপস বের করে করে সানিয়ার মুখে পুরে নিচ্ছে। চারপাশে শুনশান, ঝিঝি পোকার ডাকসহ আরও টুকটাক শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবে বলা যায় চারপাশেই নিস্তব্ধতা! হালকা ঠান্ডা হাওয়াও রয়েছে। সানিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে,”আপনি সেদিন ওইভাবে এতো ড্রিংকস কেন করছিলেন? আপনি কি ড্রিংকস এ রেগুলার? আর রেগুলার হলেও মানুষ এভাবে এতোগুলা বোতল সাবাড় করে?”

আয়াফ নিঃশব্দে একটা হাসি দিয়ে বলে,”নাহ আমি রেগুলার না। বন্ধুরা জোর করলে দুই এক বার খাওয়া পরে বাট হাই ডোজের টা খেতে পারিনা কেমন গলা থেকে বুক ঝলসে উঠে আমার।”

– তো সেদিন ওভাবে খাচ্ছিলেন কেন?

– সে লম্বা কাহীনি অন্য একদিন শোনাবো।

– সত্যি তো?

– হুম।

– আচ্ছা এই টপিক বাদ এখন এটা বলেন তো কতোদিন হলো আপনি আমার প্রেমে পরেছেন?

– সেটা আমি জানিনা তবে কম করে হলেও ৬-৭ মাস তো হবেই।

– তো এতোদিন জানালেন না কেন?

– এমনি।

সানিয়া ভেংচি কাটলো আর আয়াফ ফিক করে হেসে দেয়। সানিয়া একমনে রিং টার দিকে তাকিয়ে রয়৷ তারপর কি মনে করে একটা সবুজ লতা ঘাসের থেকে ছিঁড়ে আয়াফের হাতে ধরিয়ে দিলো।লতাটায় একটা সুন্দর সাদা ফুল আছে। আয়াফ অবাক হয়ে বলে,”কি করবো এটা দিয়ে?”

– সুন্দর করে একটা রিং বানিয়ে দিবেন যেটার ঠিক মাঝখানে এই ফুলটা থাকবে।

সানিয়ার এই ছোট ছোট আবদার কেন জানিনা আয়াফকে খুব মুগ্ধ করে দেয়। আয়াফ সম্মতি জানিয়ে খুবই যত্নে সানিয়ার কথামতন একটা রিং বানিয়ে আয়াফ হাত বাড়ালো। আয়াফ হাত বাড়িয়ে দিতেই সানিয়া মুচকি হেসে নিজের ডান হাতটা আয়াফের হাতে রাখে। আয়াফ সেই সবুজ লতার রিংটা সানিয়ার অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিলো।

কিছুক্ষণ দুইজন সেখানে কাটালো। হঠাৎ আয়াফের কল আসতেই আয়াফ রিসিভ করে হ্যালো বললো। ওপাশে কি বললো সানিয়া শুনতে পেলো না। আয়াফ “ওকে” বলে ফোন কেটে সানিয়াকে তাড়া দিয়ে বলে,”এখন উঠতে হবে চলো এখান থেকে।”

– কিন্তু কেন আর কে-ই বা কল করেছে?

– সারপ্রাইজ!(টেডি স্মাইল দিয়ে)

একপ্রকার জোর করেই আয়াফ সানিয়াকে নিয়ে গেলো। হঠাৎ কোথায় এসে থেমে আয়াফ আর সানিয়া গাড়ি থেকে নামলো। সানিয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই একটা লাল কাপড় সানিয়ার চোখে বেধে দেয়। সানিয়া একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে কিন্তু আয়াফ ইচ্ছে করে উত্তর দিচ্ছে না। একসময় এক জায়গায় এসে দাঁড় করালো সানিয়াকে তারপর আস্তে করে চোখ খুলে দিলো। সানিয়া পিটপিট করে সামনের দিকে তাকাতেই হতবাক হয়ে গেলো। খুশিতে তার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে।

সানিয়া এখন তার স্বপ্নের লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে। হ্যাঁ তার স্বপ্ন এবং ভালোবাসা যেটার কাজ গতমাসে কিছু কারণে বন্ধ হয়ে গেছিলো। তার লাইব্রেরিকে এভাবে ফিরে পাবে কখনো ভাবতে পারেনি সে। ছলছল দৃষ্টিতে আয়াফের দিকে তাকাতেই আয়াফ সানিয়ার হাতে একটা ক্যাচি ধরিয়ে দিয়ে বলে,”নেও লাল ফিতাটা কেটে আপনার লাইব্রেরির উদ্ভোদন তো করেন ম্যাম!”

– আপনি এতোকিছু কি করে….

– বললাম না সারপ্রাইজ এখন যা বলেছি করো তাড়াতাড়ি বেশি সময় নেই তোমাকে আবার আলিজার বাসাতেও পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।

– কেন?(ভ্রু কুচকে)

– তো কি রাতটা আমার সাথে পার করার ইচ্ছা আছে নাকি?(বাকা চোখে)

সানিয়া নিঃশব্দে হাসে। তারপর ফিতাটা কেটে ভেতরে ডুকে। ভেতরের লাইটিং সিস্টেম, ফ্লোর, সেল্ফসহ খুবই উন্নতমানের। বইগুলোও খুব সুন্দর মার্জিত ভাবে সাজানো এবং বাকি জিনিসপত্র তো আছেই। সানিয়া আনমনে সবকিছুতে হাত বুলিয়ে দেখছে আর দেখছে। সে এতোটা খুশি কোনোদিন হয়নি যতোটা আজ রাত ১২টা থেকে এই অব্দি পাচ্ছে। মনে মনে আল্লাহর দরবারে লাখো লাখো শুকুরিয়া আদায় করছে। সে নিয়ত করেছে এখান থেকে গিয়েই তাহাজ্জুদ নামাজ এবং ফজরের নামাজ পড়ে তবেই সে দু’চোখের পাতা এক করবে। সানিয়াকে এতো খুশি দেখে আয়াফও আজ ভিষণ খুশি।

প্রায় কিছুক্ষণ পরই সানিয়াকে আলিজার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আয়াফও চলে গেলো। আলিজার সাথে রুহিও ছিলো। আলিজার বাবা মা আজ বাসায় নেই তাই আজ তাদের কোনো সমস্যা হবে না। সানিয়া নিজের নিয়ত অনুযায়ী ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নামাযে দাঁড়ায়। একেবারে ফজরের নামাজ পরেই ঘুমিয়ে যায়।

সকাল ৯ঃ১০ মিনিট!

সানিয়া, আলিজা আর রুহি! ৩জনই মরার মতো ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ-ই সানিয়ার ফোনে কল এলো। কিন্তু সানিয়া ঘুমাতে এতোটাই বিভোর রিংয়ের শব্দ তার কান অব্দি পৌঁছায়নি। রিং হতে হতে কল কেটে যায় এভাবে কয়েকবার কল আসতেই সানিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তবুও চোখ না খুলে ভ্রু কুচকে বালিশের কাছে হাঁতড়ে ফোন নিয়ে রিসিভ করে বলে,”হ্যালো কে?”

– সানিয়া আমায় বাচা ওরা আমায় জোর করে বিয়ে দিচ্ছে আমি ওই অমানুষটাকে কিছুতেই বিয়ে করবো না। আমায় মেরে ফেলবে ওই জানোয়ার।

বলেই ডুকরে কেঁদে উঠে রোজা। রোজার কথা শুনে সানিয়ার ঘুম উড়ে গেলো। সে লাফ দিয়ে উঠে বসে বলে,”হ্যালো রোজা তোকে কে বিয়ে করতে চাইছে কি হলো বল?”

– আমার বাসায় আয় আমাকে আটকে রেখেছে।

বলেই ফোন কেটে দেয় রোজা। সানিয়া হ্যালো হ্যালো অনেকক্ষণ করলো। যখন বুঝলো ফোন কেটে দিয়েছে তো আবার ফোন করলো কিন্তু আফসোস ফোন অফ। আমি জলদি করে আলিজা আর রুহিকে উঠানোর চেষ্টা করে ওয়াশরুমে দেই দৌড়। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি ফইন্নি গুলা এখনো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। মেজাজ ৭ম আসমানে চেপে বসলো, মন তো চাচ্ছে এইগুলারে বালিশচাপা দিয়ে মেরে ফেলি কিন্তু নাহ এখন সিরিয়াস কিছুই ঘটেছে। ভেবেই মাথা ঠান্ডা করে দুইটারে ওঠানোর চেষ্টা করতে লাগি। শেষে উপায় না পেয়ে বিছানার উপর উঠে দুইটার কোমড়ে ফুটবলের লাথি দিতে দিতে বলে,”ওই ফইন্নিরা মরার কতো আর কতো ঘুমাবি উঠ হারামীর শাশুড়ীসমূহ উঠ!”

লাথি খেয়ে দুইজনেই ব্যাথায় উঠে বসলো। ওরা কিছু বলার আগেই ওদের থামিয়ে বলি,”এতোকিছু বলার সময় নাই তাড়াতাড়ি রেডি হ রোজার বাসায় যেতে হবে ইমারজেন্সি। এখন প্রশ্ন করিস না যেতে যেতে বলবো, এখন তাড়াতাড়ি যাওয়াটা অধিক প্রয়োজন।”

রোজার কথা শুনে খারাপ কিছু হয়েছে ভেবে দুইজন দুই ওয়াশরুমে ঢুকলো। তারপর জলদি করে একপ্রকার দৌড়েই তিনজন বেরিয়ে গেলো। তাদের দেখে মনে হবে যেনো তাদের ট্রেন মিস যাবে কিন্তু না তাদের কলিজার বান্ধবী বিপদে পরেছে সেইজন্য!

চলবে!!!

Crush Villain
লাবিবা ওয়াহিদ
পর্ব ২৬

সানিয়া ফোনের উপর ফোন দিয়েই চলেছে আয়াফকে কিন্তু আয়াফের ফোন সুইচড অফ। ৩ জন মিলে মেইন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। একটা বাস তো দূরে থাক একটা খালি সিএনজি পর্যন্ত পাচ্ছে না। এখন যাবে কি করে সেটাই ভাবছে। এদিকে আয়াফকেও ফোনে পাচ্ছে না। পেলেও হয়তোবা সে এসে পিক করতো তাদের।আলিজা ফোনে কথা বলছে, “তাড়াতাড়ি আসো আমরা আমাদের বাসার মোড়েই আছি।”

বলেই আলিজা ফোন রেখে বলে,”দোস্ত চিন্তা করিস না নীলসহ সবাই আমাদের এখান থেকেই পিক করে নিয়ে যাবে।”

– কিন্তু আয়াফ কেন ফোন ধরছে না?

ওদের কথার মাঝেই দুইটা প্রাইভেট কার ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রথম গাড়ির সামনের গ্লাস খুলে নীল বলে উঠে,”তাড়াতাড়ি উঠো তোমরা!”

সানিয়া দেখলো পিছে আরও একটা গাড়ি এসে থামলো সেটায় আবরার আর মানিশা আছে। মাঝের টায় যাহির, তিনয় আর নিশি। সামনের টায় শুধুই নীল। তিনজন একসাথে নীলের গাড়িতে বসে পরে।যতো দ্রুত পৌঁছাতে পারে ততোই ভালো। প্রায় ২০ মিনিট লেগেছে ওদের রোজার বাসায় আসতে। এসে দেখে বাড়িটা কেমন যাকঝমক যেনো বিয়েবাড়ি। অনেক মানুষ যাওয়া আসা করছে। ভেতরে ঢুকে দেখে আয়াফ একজন মধ্যবয়সী লোকের সাথে তর্ক করেই চলেছে। লোকটাকে দেখে সানিয়ার চিনতে অসুবিধা হলো না। কারণ লোকটাই রোজার বাবা। আয়াফের পোশাক কালকের রাতেরই পোশাক যেনো পালটানোর সময় হয়ে উঠেনি তার৷ অদূরেই রোজা কনে সাজে অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে। আয়াফ বলে,”আপনি গুরুজন বলে রোজার সাথে এমন একটা দুশ্চরিত্র ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারেন না!”

– আমি কি করবো না করবো সেটা তোমার থেকে জেনে নেবো না আয়াফ বাবা। তোমার বাবা আমার যতোই বস হোক না কেন রোজা আমার মেয়ে। আর আমি বাবা হিসেবে আমার মেয়ের কোনটায় ভালো আর কোনটায় খারাপ সেটা নাহয় আমি দেখবো।

– আপনি ওর বাবা হলেও ও আমার বোন আর…

– ব্যাস আয়াফ বাবা ব্যাস! অনেক দয়া দেখিয়েছো আমাদের উপর আর দয়া দেখানো লাগবে না। আমরা গরিবরা আজ আছি কাল নেই তাই আমাদের চিন্তা আমাদেরই করতে দাও।

রোজার বাবার সাথে আয়াফ পারলো না। দূরে রোজার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে কিছুই করতে পারছে না। আয়াফ ভোরে বাসায় ফিরতেই তার মায়ের থেকে সবটা শুনে এখানে দৌড়ে আসে। সেই থেকেই এখনো আয়াফ এখানে। এখন আয়াফ জেনেশুনে কি করে ওই নেহাল নামক চরিত্রহীন ছেলের সাথে নিজের আদরের বোনের বিয়ে দিতে পারবে? সে পারবে না রোজার জীবন নষ্ট হতে দেখতে।

হ্যাঁ নেহালের সাথেই রোজার বিয়ে হচ্ছে। রোজাকে অতিরিক্ত ডিস্টার্ব করায় রোজা রেগে সেদিন দুইটা চড় দিয়ে দিয়েছিলো। চড়ের ঘা নেহালকে পশুতে পরিণত করে ফেলেছে। তাই সে রোজাকে টেনেটুনে রোজার বাড়িতে নিয়ে রোজার বাবা মায়ের পায়ের সামনে ধাক্কা দিতে ফেলে বলে,”আপনার মেয়ে কখন কোথায় কি করছে খবর রাখেন? এই সেই ছেলের সাথে টাইম স্পেন্ড করে, ঘুরাঘুরি করে এমন কি দেখলাম এক ছেলের সাথে একটা বিল্ডিং এ ঢুকছে। জানেন আপনাদের মেয়ে আমার সাথেও মেশার চেষ্টা করেছে এবং আমিও ওর সাথে মিশেছি। এখন আপনাদের সিদ্ধান্ত আপনারা আপনাদের মেয়েকে কি করবেন।”

এসব শুনে রোজা হতবাক হয়ে যায়। কিসব ভুলভাল আজেবাজে কথা বলছে এই নেহাল। রোজার মা রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় রোজার চুলের মুঠি ধরে ইচ্ছামতো মারধোর করে। রোজা বারবার বলেছিলো “মা আমাকে মেরো না আমি এসব কিছুই করিনি বিশ্বাস করো!” কিন্তু না রোজার মায়ের কান অব্দি কিছুই যায়নি। রোজার বাবা সব শক্ত চোখে দেখছিলো। নেহাল এসব দেখে আড়ালে একটা পৈশাচিক হাসি দেয়। রোজার মা তাকে এতোটাই মেরেছে যে রোজা মার খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পরে থাকে৷ রোজার মা ক্লান্ত হয়ে রোজার সামনে বসে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগে। নেহাল হঠাৎ-ই প্রস্তাব দেয়,”আপনারা যদি অমত না করেন তাহলে কালই আমি ওকে বিয়ে করবো ওর কুকর্ম জেনেও। বিশ্বাস করেন ওকে ভালোবেসে আগলে রাখবো বাকিটা আপনাদের সিদ্ধান্ত।”
বলেই নেহাল চলে আসছিলো এমন সময়ই নেহালকে পিছু ডেকে রোজার বাবা বলে উঠেন,”আমরা রাজি আছি। কালই ধুমধাম করে তোমাদের বিয়ে হবে।”

নেহাল শয়তানি হাসি দিয়ে পিছে না ফিরেই বলে,”আয়োজন শুরু করুন আসবো কাল আপনাদের জামাই হতে।”

বলেই নেহাল চলে গেলো। এরপর থেকে নেহালের কোনো খবরই পাওয়া যায়নি।

বিকাল ঘনিয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসলো এখনো নেহাল বিয়ে করতে আসেনি। এ নিয়ে আত্নীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের কানাঘুষা শুরু হয়ে যায় রোজাকে নিয়ে। রোজা কাঁদতে কাঁদতে এখন পাথরের ন্যায় বসে আছে। রোজার বাবা উতলা হয়ে আছে নেহাল কেন আসছে না এই ভেবে। হ্যাঁ সেই সকাল সাড়ে দশটা থেকে এখন সন্ধ্যা। নেহাল এখনো আসেনি। সানিয়া বাসায় জানিয়ে দিয়েছে সে এখন রোজার বাসায় এসেছে তাই তার বাসা থেকে আর খোঁজ নেয়নি। আয়াফ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,”এবার দেখলেন তো আপনার সেই সোনার টুকরা জামাই আসলো না, এখন? এখন কি করবেন? একদিনের একটা ছেলে এসে উল্টো পাল্টা বলে গেলো আর আপনারা এসব বিশ্বাসও করে রোজার উপর এতোটা অত্যাচার করলেন। বাহ এই আপনারা রোজার বাবা মা এতোটাই আপনাদের দায়িত্ব ওর প্রতি!”

রোজার বাবা নিজের নিচ কাজের জন্য মাথা নিচু করে ফেললেন। এদিকে পাড়া-মহল্লার এবং আত্নীয়স্বজনের উল্টো পাল্টা কথা তিনি নিতে পারছেন না। তিনি ছলছল চোখে আয়াফকে বলে,”এখন আমরা কি করবো বাবা? আজ মেয়েটার বিয়ে না হলে যে কখনো ওকে বিয়ে দিতে পারবো না। এমনিতেও মেয়েটাকে নিয়ে সবাই কিসব আজেবাজে মন্তব্য করা শুরু করেছে।”

– সেটা আপনার আগে ভাবা উচিত ছিলো চাচা। কিন্তু না আপনি আমাদের কথা শুনেছেন আর না রোজার। নিজের কপাল নিজে চাপড়ান সাথে রোজার জীবনও নষ্ট করে দেন।

রোজার পাশে থাকা রোজার মা ডুকরে কেঁদে উঠে। কি-ই না অত্যাচার করেছে দুইদিন ধরে তাও ওই একটা ছেলের কারণে। এমন সময়ই আরাভ জুরাইজ এসে হাজির। তাকে দেখে আয়াফ হেসে বলে,”আরে পিতাজি আপনি এসেছেন? দেখে যান আপনার বোনের কলিজার টুকরা কিসব অকাজ করে গিয়েছে।”

এখানের পরিস্থিতির কথা শুনে আরাভ জুরাইজ এমনেই দুশ্চিন্তায় শেষ এখন আয়াফের কথা শুনে তার গায়ে কাটা দিয়ে লাগলো। আয়াফ আবার বলে,”অন্যায় করা এবং অন্যায় সহ্য করা একই অপরাধ যা আপনি এই কয়েকটা বছর ধরে করে যাচ্ছেন। কি যেনো বলছিলেন আপনার সেই ভাগিনা মেন্টালি সিক! এতোই যদি ওর মেন্টালি প্রব্লেম তাহলে ওরে বাইরে বাইরে কেন ঘুরতে দেন? দেখতে পাচ্ছেন কতোগুলো মেয়ের জীবন, পরিবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। আজ দেখুন না রোজার জীবনটা নিয়ে কিভাবে খেললো!”

আরাভ জুরাইজ দূরে রোজার দিকে তাকালো। রোজার শুকনো মুখ দেখে আরাভ জুরাইজের বুক চিনচিন করে উঠলো। নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে রোজাকে তার এই অবস্থা সহ্য করতে পারছে না। এখন সে সবটা ক্লিয়ার করে ফেলেছে এবং বুঝেছে নেহালকে বাইরে বের করিয়ে সে কতোটা অন্যায় করে ফেলেছে। মুহূর্তে-ই আরাভ জুরাইজের চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো।

সানিয়া আগে এসব হিস্ট্রি না জানলেও সারাদিনে নীল, তিনয়, যাহির এবং মানিশার থেকে সব শুনেছে। শুধু সানিয়া নয় আলিজা আর রুহিও। সানিয়া মন থেকে ঘৃণা করে অনেকটা ঘৃণা করে ওই নেহালকে।রোজার বাবা বলে উঠে,”আচ্ছা এই ছেলেকে পরে দেখা যাবে কিন্তু আমার মেয়ে? মেয়েটার জীবন যে নিজ হাতে নষ্ট করে দিলাম!”

– কিছুই নষ্ট করেননি!(আয়াফ)

– মানে?(অবাক হয়ে রোজার বাবা)

– আজ বিয়ে হবে।(আয়াফ)

– কি বলছো তুমি বাবা? কে বিয়ে করবে রোজাকে?(রোজার বাবা)

আয়াফ আড়চোখে যাহিরের দিকে তাকালো। তারপর বলে,”নীল একটা শেরওয়ানীর ব্যবস্থা কর কোনো প্রশ্ন করিস না!”

আয়াফের কথামতো ঘন্টাখানেকের মাঝে নীল একটা শেরওয়ানী নিয়ে আসে। কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না আয়াফ ঠিক চাইছে টা কি?

আয়াফ শেরওয়ানী হাতে নিয়ে বলে,”যাহির এটা পরে রেডি হয়ে আয়।”

– হোয়ায়াট! আমি? কিন্তু কেন?

– কারণ রোজাকে তুই বিয়ে করবি!

– পাগল নাকি তুই?

– তুই রোজাকে মন থেকে পছন্দ করিসনি? সত্যি বলবি!

সাথে সাথে যাহির চুপসে গেলো। কি বলবে সে আয়াফ তো আগেই তার মনের কথা জেনে গেছে।

– বল হ্যাঁ কি না?

– হ্যাঁ কিন্তু…

– যেহেতু চাইতি এখন এই সুযোগ হাতছাড়া কেন করবি তুই? পরিস্থিতি আজ রোজার পক্ষে না থাকলেও তোর পক্ষে আছে তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করে বোকামি করিস না।

যাহির কিছুক্ষণ ভেবে শেরওয়ানী নিয়ে নীল আর তিনয়ের সাথে একটা রুমে চলে গেলো। রোজার বাবা অবাক হয়ে বলে,”এই ছেলে আমার মেয়েকে বিয়ে করবে?”

– হ্যাঁ চাচা। যাহির আমার বন্ধু এবং অনেক ভালো ছেলে। আজকালকার যুগে ওর মতো ছেলে হাতছাড়া করা বোকামি। ওর মা নেই, ওর বাবা ফরেইনে থাকে তাই এখানে ও একাই থাকে। চিন্তা করবেন না রোজার ভালোই হবে।

রোজার বাবা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”তুমি যা ভালো বুঝো তা-ই করো আমি আর কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে মেয়ের জীবন বিপদে ফেলবো না।”

বলেই রোজার বাবা আর মা ক্ষমা চেয়ে নেয় রোজার কাছে। রোজা প্রথমে চুপ থাকলেও পরে বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।

অবশেষে সব আত্নীয় এবং পাড়া প্রতিবেশীর মুখে চুনকালি লাগিয়ে রোজা আর যাহিরের বিয়ে সম্পন্ন হলো। ওদের বিয়ের কাজ মিটতেই আয়াফ নীল আর তিনয়কে বললো যেনো সানিয়া, রুহি আর আলিজাকে নিজেদের বাসায় পৌঁছে দেয়। ওরাও আয়াফের কথামতো তাই করলো। আয়াফ তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,”আজ বাধা দিও না আজ আমি নেহালের ব্যবস্থা করবোই।!”

আরাভ জুরাইজ কিছু বললো না শুধু এইটুকুই বলে,”আমাকেও তোর সাথে নিয়ে চল!”

আয়াফ সম্মতি জানালে বাপ বেটা মিলে কোথায় যেনো চলে গেলো।

নেহাল এবং একটা মেয়ে অন্তরঙ্গ অবস্থায় একটা রুমে। এমন সময়ই দরজা ঠাস করে খুলে ঢুকলো আয়াফ, আরাভ জুরাইজ আর তাদের পেছনে পুলিশ। এই অবস্থা আরাভ জুরাইজ একদমই আশা করেনি তাই সে জলদি করে ঘৃণায় পিছে ফিরে দাঁড়ায়। নেহাল চটজলদি মেয়েটাকে ছেড়ে শার্ট পড়তে পড়তে বেক্কলের মতো এক্টিং করার চেষ্টা করে বলে,”বাবা, আয়াফ তোমরা এখানে আর পুলিশ কেন?”

আয়াফ হেসে বলে,”মানে ব্রো সিরিয়াসলি এই অবস্থাতেও তুই পাগল হওয়ার এক্টিং করছিস? তোর খেলা শেষ নেহাল এখন যা ডান্ডা পেটা খেতে রিমান্ডে যা।”

নেহাল ভয়ে সুযোগ বুঝে পালাতে নিলেই আয়াফ তাকে ধরে ফেলে এবং বলে,”আরে আরে পালাচ্ছিস কোথায়? তোর যে এখনো অনেক শাস্তি পাওয়া বাকি। অনেক গেম খেলেছিস এখন তোর সব গেম ওভার! অফিসার আপনাকে অনেক প্রমাণ দিয়েছি এন্ড এখন নিজে সচোক্ষে দেখে নিলেন আর কোনো প্রমাণ লাগবে?”

অফিসার অগ্নিদৃষ্টিতে নেহালের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা ছেলে এতোটা নিচ হতে পারে তার জানা ছিলো না। নেহাল হুংকার ছেড়ে বলে,”আমি তোকে ছাড়বো না আয়াফ তোকে হাতের কাছে পেলে খুন করে ফেলবো!”

– আমাকে পরে দেখিস আগে এটা বল তুই এতোদিন পাগল হওয়ার এক্টিং কেন করেছিস?

নেহাল হেসে বলে,”যাতে তোর এই বুড়ো বাপ আমায় কিছুই বলতে না পারে! কারণ আমি জানতাম তোর বুড়ো বাপ কোনো কালেই তোকে আমার ক্ষতি করতে দিতো না!”

আরাভ জুরাইজ বেশ ভালো বুঝতে পারছে সে কতো বড় অপরাধ করেছে। রেগে নেহালের গালে দুইটা চড়ও লাগিয়ে দেয়। কিছু বলার আগেই পুলিশ টেনে হিঁচড়ে ওকে নিয়ে যায়। আরাভ জুরাইজ কপালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগে কতো বড় ভুলটাই না করেছে সে যার প্রতিটা কর্মফল এখন সে হাতেনাতে পাচ্ছে।

চলবে!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here