#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),১৪,১৫ (শেষ পর্ব)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-১৪
শুক্রবার। কলেজ বন্ধ। রিহানের সারাদিন কোনো কাজ নেই আর। সুফিয়াকে সে বলেছিল নিজে একদিন সরষে ইলিশ করে খাওয়াবে। সুফিয়া তাকে রেসিপিটা শিখিয়েছে, এখন সে কতটুকু শিখতে পেরেছে সেটা তো দেখাতে হবে। তাই বাজারে গিয়ে সে তাজা দেখে মাঝারি সাইজের একটা ইলিশ কিনে আনলো। মাছ নিয়ে সে সুফিয়ার বাসায় এসে কলিং বেল বাজালো। সুফিয়া দরজা খুলে বললো, ‘আরে রিহান সাহেব যে! হাতে মাছ, কী ব্যাপার?’
‘সরষে ইলিশ করে খাওয়াবো তোমাকে, তাই মাছ নিয়ে এসেছি।’ হাতের মাছটা তুলে দেখালো রিহান।
‘আরে পাগল, তুমি বললে আমি নিজেই মাছ এনে রাখতাম। তুমি আনতে গেলে কেন? দেখো তো কাণ্ড! আসো ভেতরে আসো।’
রিহান ভেতরে ঢুকলো। সুফিয়া মিনুর উদ্দেশ্যে ডাক দিলো, ‘মিনু এদিকে আয় তো, মাছটা নে। সুন্দর করে কেটে ধুয়ে রাখ কিচেনে।’
মিনু এসে রিহানের হাত থেকে মাছটা নিয়ে কিচেনে চলে গেল। সুফিয়া রিহানকে সোফায় বসতে বললো। তারপর সে ভেতরের কক্ষে গিয়ে দুইটা পাঁচশো টাকার নোট এনে রিহানের দিকে বাড়িয়ে দিলো। রিহান ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘না, না, মিস. সুফিয়া, তুমি এটা কী করছো? আমাকে টাকা দিচ্ছ কেন?’
‘দেখো তো তুমি হুট করে একটা মাছ কিনে আনলে। কলেজে গেলে বাবা হয়তো কিছু হাত-খরচা দেয়। তা থেকে তুমি জমাও। এখন সবটা মাছ কিনতে চলে গেল।’
‘আমার টাকা আছে মিস. সুফিয়া। তোমাকে একটা কথা বলি, কাউকে বলবা না কিন্তু।’
‘বলো…’
‘আমি গোপনে একটা টিউশন করি। মাস শেষে আমার হাতে ভালো একটা অ্যামাউন্ট থাকে। বুঝছো?’ কণ্ঠটা নিচু করলো রিহান।
‘হয়ছে, ওটা আলাদা ব্যাপার। তুমি এই টাকাটা নাও। আমি খুশি হয়ে দিচ্ছি। না নিলে কিন্তু কষ্ট পাবো।’ বলেই নোট দুইটা সুফিয়া রিহানের পকেটে ভরে দিলো। রিহান আর না নিয়ে থাকতে পারলো না। সুফিয়াও সোফায় বসলো রিহানের পাশে। একটাই সোফা। বাসাটা থেকে খুব শীঘ্রি চলে যাবে, তাই একটাই কিনেছে সে। সাথে দুইটা খাট, একটা টেবিল, আর দুইটা চেয়ার কিনেছে। এই বাসায় সুফিয়ার আসবাবপত্র বলতে এগুলোই। বাসায় উঠার পরেরদিনই সে এগুলো কিনেছে।
‘মিনু মাছ কাটতে কাটতে চলো আমরা গল্প করি।’ বললো সুফিয়া।
‘কী গল্প করবো? আচ্ছা বলো, তোমার তো দুই ছেলে আর দুই নাতি আছে। ওরা তোমার সাথে দেখা করতে আসে না কেন? এখানে তোমরা এসেছো প্রায় দুইমাস হয়ে যাচ্ছে। একদিনও আসেনি।’
‘ওরা তো কাজে ব্যস্ত। দুই ছেলের এখানে ব্যাবসা আছে। তাছাড়া নতুন বাড়ি করা হচ্ছে, আর নতুন একটা অফিস করা হচ্ছে, ওখানে সময় দিতে হয় ওদের। বড়ো নাতিটাও আলাদা একটা ব্যাবসা শুরু করেছে। ছোটো নাতিটাও মেডিকেলে পড়াশোনা শেষ করে নতুন ডাক্তার হয়েছে। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। ওখানে কথা বলার মতোও কেউ নেই। এখানে তুমি আছো, তোমার পরিবার আছে। সবাই মিশুক। ভালোই সময় কাটে।’
‘বাড়ির কাজ শেষ হলে তো চলে যাবে। তখন আবার একা হয়ে যাবে না?’
‘তা তো হবোই। বই পড়ে সময় কাটাতে হবে তখন।’
‘আগে কোথায় থাকতে?’
‘শ্রীপুরে। ওখানেও আমাদের নিজস্ব বাড়ি আছে। ছেলেদের সব ব্যাবসা ঢাকাতেই। তাই চলে আসতে হচ্ছে।’
‘আমরাও এই জায়গাটাতে নতুন, জানো? এক বছর হয়েছে আমরা এখানে এসেছি। এদিকে জায়গার দাম কম। সস্তায় পেয়েছিল, তাই বাবা এখানে বাড়ি করে। তাছাড়া আমার কলেজটাও এখানে। তাই সবদিক চিন্তা করে বাবা এদিকে জায়গা কিনে।’
‘তা তোমাদের আগের বাসা কোথায় ছিল?’
‘গফরগাঁওয়ে। আমার দাদা বাড়ি আছে ওখানে এখনও।’
‘গফরগাঁওয়ে আমি গিয়েছিলাম। ৯৭ সালের দিকে। ওখানে একটা বৃদ্ধাশ্রম করে দিয়েছিলাম সেই সময়। ওখানেও রিহান নামের একটা বাচ্চা ছেলেকে চিনতাম, আট নয় বছরের। ওটা আবার তুমি নও তো? আমি তাকে একদিন অনেকগুলো চকলেট আর একটা ঘুড়ি কিনে দিয়েছিলাম।’
রিহানের মুখটা হা হয়ে গেল হঠাৎ। অবাক হয়ে তাকালো সে সুফিয়ার দিকে। সুফিয়ার সারা চেহারাটা একবার দেখে নিয়ে বললো, ‘ওটা তুমি ছিলে? ওহ্ মাই গড! আমার এখন ঘটনাটা মনে পড়ছে। ওই সময় বৃদ্ধা এক মহিলা আমাকে খুব আদর করেছিল।’
‘সত্যি সত্যি ওটা তুমি ছিলে!’ সুফিয়াও অবাক হওয়ার ভান করলো। অবশ্য সে জানে ওটা আসলে এই রিহানই ছিল। রিহানের ছোটোবেলা থেকেই সে তার আশেপাশে ঘুরতো। মাঝেমধ্যে সামনে যেত, মাঝেমধ্যে আড়াল থেকে দেখত। রিহানের বেড়ে উঠা সে নিজ চোখে দেখেছে।
‘হ্যাঁ, ওটা আমিই ছিলাম। ওহ্ মাই গড! আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, তোমাকে আবারও এভাবে দেখবো!’ মুখে হাত দিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলো রিহান।
‘তোমার দাদা-বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে আমি আশ্রমটার কাজ শুরু করি সেই সময়। একদিন পথ দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি থেকে তোমাকে দেখি, কিউট একটা বাচ্চা। তারপর গাড়ি থেকে নেমে তোমাকে চকলেট আর একটা ঘুড়ি কিনে দিই। এরপর অনেকটা বছর তো হয়ে গেল! দিনগুলো কীভাবে যে কেটে যায়!’ আনমনা হয়ে ভাবতে দেখা গেল সুফিয়াকে। সেই সময় সে গফরগাঁওয়ে তাদের যে ভিটেটা ছিল, ওখানে একটা বৃদ্ধাশ্রম করতে গিয়েছিল, রিহানের ব্যাপারে তখনই খোঁজ নিয়ে জানতে পারে। একদিন গাড়ি থেকে সে রিহানকে দেখে। গাড়ি থামিয়ে সে ছোট্ট রিহানকে ডাকে। রিহান প্রথমে ভয় পায় ছেলেধরা মনে করে। সুফিয়া এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘ভয় পেয়ো না। আমি ছেলেধরা নয়। তোমার নাম রিহান না?’
‘ছোট্ট রিহান সে সময় অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ‘আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?’
‘গতকাল এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন বাচ্চাকে দেখলাম তোমার নাম ধরে ডাকতে।’
‘ওহ্!’ মাথা চুলকালো রিহান। অপরিচিত একটা বৃদ্ধাকে আর কী বলবে সে বুঝতে পারলো না। সুফিয়া তার দুই গাল টেনে বললো, ‘তুমি অনেক কিউট। চকলেট খাবে? চলো তোমাকে চকলেট কিনে দিই, ওই দোকানে চকলেট পাওয়া যায়?’ একটা দোকানের দিকে ইশারা করলো সুফিয়া।
‘হ্যাঁ, ঘুড়িও পাওয়া যায়।’
‘ঘুড়িও পাওয়া যায়? ঘুড়ি নিবা তুমি?’
রিহান মাথা চুলকাতে চুলকাতে দ্রুত উপর-নিচ মাথা দোলায়। সুফিয়া তাকে দোকানে নিয়ে গিয়ে অনেকগুলো চকলেট আর একটা ঘুড়ি কিনে দেয়। তারপর রিহানের গালে একটা চুমু খেয়ে বলে, ‘খুশি হয়ছো তুমি?’
রিহান আবারও উপর-নিচ মাথা দোলায়। খুশি হয়েছে সে। সুফিয়া তখন বলে, ‘তাইলে আমার গালে একটা চুমু দাও।’
রিহান সুফিয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বোকার মতো হাসে। আরও কয়েকজন বাচ্চা এসে তখন তাকে উৎসাহ দিলে, সে সুফিয়ার গালে একটা চুমু দিয়ে দৌড় দেয়। সুফিয়া হাসতে থাকে তার দৌড়ানি দেখে। তারপর সে বাচ্চাগুলোকেও চকলেট কিনে দেয়। ঘটনাটা মনে পড়তেই হাসলো সুফিয়া। রিহান বললো, ‘মিস. সুফিয়া, সত্যি তোমাকে চিনতেই পারিনি। কত বছর আগে দেখেছি! তাছাড়া আমি তখন ছোটো ছিলাম।’
‘ঠিক আছে, সমস্যা নেই। এখন তো চিনছো।’ হাসলো সুফিয়া। আরেকটা ঘটনা মনে পড়লো তার। তবে ওটা রিহানের সামনে প্রকাশ করলো না সে। রিহান তখন মাধ্যমিক স্কুলে পড়তো। ওই সময় সে একটা ছেলের সাথে ঝগড়া করে ছেলেটাকে ধাক্কা দেয়। একটা ইটের সাথে আঘাত লেগে ছেলেটার মাথা ফেটে যায়। রক্ত দেখে রিহান ভয় পেয়ে যায়। তারপর স্যারের ভয়ে সে কয়েকদিন স্কুলেও যায়নি। ঘটনাটা জানতে পারে সুফিয়া। প্রথমে সে ওই ছেলেটার বাড়িতে যায় যাকে রিহান মেরেছে। ছেলেটার বাবা-মার হাতে কিছু টাকা দিলে ওরা খুশি হয়। সুফিয়া তাদেরকে অনুরোধ করে রিহানকে যাতে ক্ষমা করে। তারপর সুফিয়া রিহানের স্কুলে গিয়ে স্যারদেরকে অনুরোধ করে, যেন রিহানকে কোনো মারধর না করে। ওকে যেন বুঝিয়ে স্কুলে নিয়ে আসে আবার। সে সময় স্যারেরা অবশ্য সুফিয়ার অনুরোধটা রাখে।
‘মিস. সুফিয়া, কী ভাবছো?’ রিহানের ডাকে ভাবনা থেকে ফিরলো সুফিয়া।
‘ভাবছি, কীভাবে জীবন থেকে একানব্বইটা বছর চলে গেল! আহা জীবন!’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সুফিয়া। ‘হয়ছে, ওঠো তো এবার। তোমার পরীক্ষা দেবে, কীভাবে সরষে ইলিশ বানাতে হয়।’ বলেই উঠে দাঁড়ালো সুফিয়া। রিহানও উঠে সুফিয়ার পিছুপিছু কিচেনে এলো। মিনু ইলিশ মাছটা কেটে সুন্দর করে ধুয়ে রেখেছে ততক্ষণে। সুফিয়া রিহানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হুমম… শুরু করো।’
রিহান হাত ধুয়ে মাছের টুকরোগুলোতে হলুদ আর লবণ মাখতে লাগলো। সুফিয়া তার পাশে দাঁড়ালো। ঠিক যেভাবে ১৯৪৩ সালে দাঁড়িয়েছিল। যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সুফিয়া সেই সময়ের মতো করে শাড়ির আঁচলটা কোমরে প্যাঁচালো, যেন সময়টাতে ফিরে গেছে সে। রিহান মাছের টুকরোগুলোতে হলুদ আর লবণ মাখিয়ে নিয়ে একপাশে সরিয়ে রাখলো। তারপর একটা বাটিতে কালো সরষে আর হালকা জল মিশিয়ে পিষতে লাগলো। পেছন থেকে সুফিয়া রিহানের মাথায় আঙুলের উলটোপিঠ দিয়ে কিছুটা জোরে আঘাত করলো। রিহান ‘উফ’ করে ওঠলো। সুফিয়া হেসে বললো, ‘এভাবে শিখিয়েছি? লবণ আর কাঁচামরিচ কই? সব একসাথে পিষতে হবে। নয়তো তেঁতো তেঁতো লাগবে।’
‘ঠিক আছে, লবণ আর কাঁচামরিচ দিচ্ছি।’ বলেই বাধ্য ছেলের মতো রিহান বাটিতে কয়েকটা কাঁচামরিচ আর হালকা লবণ মেশালো৷ পাশে দাঁড়িয়ে সুফিয়া মিটমিট করে হাসতে লাগলো। সাতষট্টি বছর পরে এসে সে তার প্রতিশোধটা নিতে পেরেছে। মিষ্টি একটা প্রতিশোধ।
[[চলবে…]]
#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:- ১৫ (শেষ পর্ব)
বড়ো ছেলে ইউসুফের ফোন পেয়ে সুফিয়া ছেলের বাসায় এলো। নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছে সে। শহরের জ্যাম কাটিয়ে আসতে আসতে তার একটু বেশিই সময় লেগেছে। সুফিয়াকে দেখে ছেলে ইউসুফ বললো, ‘মা, তোমার এতক্ষণ লাগছে কেন? আমিও আরও চিন্তা করছিলাম। ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছিলাম।’
‘আরে জ্যামে পড়ছিলাম। কী জন্য ডেকেছিস বল। কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘মা, ইকবাল আমেরিকায় স্থায়ী হতে চাচ্ছে।’
‘কেন? রাহাত আর শহিদের সাথে তার আবারও ঝগড়া হয়েছে নিশ্চয়ই?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোর ছেলে দুইটাও হয়েছে বেয়াদব। পড়ালেখা করেছে। অথচ চাচার সাথে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় জানে না।’
‘মা, ওভাবে বলো না। মা মরা দুই ছেলে আমার। মায়ের আদর ছাড়া বড়ো হয়েছে। তাই একটু ওরকম।’
‘তাই বলে চাচার সাথে এমন করবে? ইকবাল আমেরিকা থেকে এসেছে তিনমাসও হয়নি। এখন আবার চলে যেতে চাচ্ছে। আমার ছেলেটাকে তোরা একটু শান্তিতে দেশে থাকতে দিতে পারিস না? কই? ইকবাল কোথায়?’
‘আছে, ঘরে।’
সুফিয়া ইকবালের কক্ষে এসে ছেলের মাথায় হাত বুলালে, ইকবাল বলে উঠে, ‘মা, তুমি আমাকে বাধা দিয়ো না। আমার এই দেশটা সত্যি আর ভালো লাগছে না। দেখো, শহিদ আমার কী অবস্থা করেছে, আমার গায়ে হাত তুলেছে। রাহাতও মারতে এসেছে আমাকে। এখানে থাকলে আমাকে ওই দুই ভাইয়ের হাতে খুন হতে হবে।’
‘আচ্ছা, সম্পদের জন্য এমন ঝগড়াঝাঁটি, অশান্তি হচ্ছে, তাই তো? ইউসুফ, একটু এদিকে আয় তো…’ ইউসুফকে ডাকলো সুফিয়া। তারপর বললো, ‘আজকেই তুই একজন উকিলের সাথে কথা বলবি, আমি আমার সব সম্পদগুলো তোদের প্রত্যেকের নামে ভাগ করে দিবো।’
‘মা, এত তাড়াতাড়ি…’
‘যা বলছি, তাই কর। আজকেই একজন উকিল ডেকে আন।’
‘ঠিক আছে মা, তবে আজকে পারবো না। আজকে একটু কাজ আছে। কাল ডাকি?’
‘বেশ! কাল আমি আবারও আসবো। ওদিকের খবর কী? বাড়ির কাজ শেষ হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, মা। খুব শীঘ্রই আমরা নতুন বাড়িতে উঠবো। মা, তোমার সাথে আরেকটা কথা ছিল?’ ইতস্তত করে বললো ইউসুফ।
‘কী কথা?’
ইউসুফ তার মাকে আড়ালে নিয়ে এলো। গলার আওয়াজটা নিচু করে প্রশ্ন করলো, ‘মা, তুমি আমার বাবাকে খুঁজে পেয়েছো?’
ইউসুফের হঠাৎ এমন প্রশ্নে সুফিয়া যেন হকচকিয়ে গেল। ‘তুই… তুই কীভাবে জানলি?’
‘তুমি যেখানে বাসা নিয়েছো, ওদিকে গিয়েছিলাম। একটা ছেলেকে দেখেছি আমি বাইশ-তেইশ বছর বয়সী। দেখতে অনেকটা আমার বাবার মতো। আমি সেই কবে আমার বাবাকে দেখেছিলাম। ১৯৬৪ সালে। বাবা তখন আরও বয়স্ক ছিল। এখন এই ছেলেটাকে দেখে কেমন যেন আমার বাবার মতো মনে হয়েছে। সত্যি কি…’
‘হ্যাঁ, ওটাই তোর বাবা। কিন্তু, তুই এই কথাটা কারও সামনে কখনও প্রকাশ করবি না।’
‘ঠিক আছে, মা। প্রকাশ করবো না। কিন্তু, ও কি জানে সবকিছু?’
সুফিয়া হেসে বললো, ‘ও কী করে জানবে পাগল? আমি তো কিছু বলিনি। আর বললেও কি সে বিশ্বাস করবে? সে আমাকে চিনবে আজ থেকে আরও সাত বছর পর। কারণ, ২০১৭ সালেই সে অতীতে যাবে। তখনই আমার সাথে পরিচয় হবে তার।’
‘আমাদের জীবনটা এমন হলো কেন মা? বাবাকে আমরা দুই ভাই পাইনি। আমি কিছুটা হলেও বাবার আদর পেয়েছিলাম। কিন্তু ইকবাল, সে তো দেখেওনি বাবাকে। দেখেছে হয়তো, কিন্তু তার মনে নাই। এখন আমরা আমাদের বাবাকে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু পারছি না পরিচয় দিতে, আর পারছি না বুকে টেনে নিতে।’
‘সব, আমারই ভুল বাবা, তোরা আমাকে ক্ষমা করে দিস বাবা।’ ছেলের গালে হাত বুলালো সুফিয়া। ইউসুফ তার হাতটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে বললো, ‘ছি মা, যেদিন তোমায় অপরাধী মনে করবো, সেদিন যেন আমার মৃত্যু হয়। আমার মা কোনো ভুল করেনি। এটা কেবলই আমাদের একটা নিয়তি।’
ছেলের কথা শুনে সুফিয়ার চোখে পানি চলে এলো। চোখ মুছে বললো, ‘থাক তোরা তাইলে। আমি আবার আসবো।’
‘আরেকটা কথা মা…’
‘বল…’
‘তুমি আমাদের সাথে এই বাসায় থাকোনি, কারণ বাবার জন্য তাই না?’
সুফিয়া হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। ইউসুফ বলে, ‘কেউ যে কাউকে এত ভালোবাসতে পারে, আমি তোমাকেই দেখেছি মা। বাবার জন্য তীর্থের কাকের মতো আমি তোমাকেই প্রতীক্ষা করতে দেখেছি। তোমার মতো মা পেয়ে আমি গর্ববোধ করছি। তোমাকে আজ একবার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে মা।’ বলেই মাকে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে কাঁদলো মা ছেলে। তারপর নিজেদের সামলালো ওরা। ইউসুফ পুনরায় মাকে প্রশ্ন করে, ‘বাড়ির কাজ তো প্রায় শেষ। তুমি কি চলে আসবা? না-কি ওখানেই থাকবা?’
‘চলে আসবো বাবা। ওর থেকে দূরে থাকতে পারি না। আবার কাছাকাছি থাকাটাও খুব কষ্টের। পরিচয় দিতে পারি না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। অনেকটা বছর তো প্রতীক্ষা করেই কাটিয়েছি। আর না হয় কয়েকটা বছর, আর কতকালই বা বাঁচবো?’
‘এমন কথা বলো না মা। তুমি আরও অনেক বছর বাঁচবে।’
সুফিয়া হাসলো। ছেলের কথার জবাবে কিছুই বললো না। সে জানে তার মৃত্যু কবে হবে। আর আট বছর বাঁচবে সে। ওই বছরের কত তারিখে, কয়টার সময়, কীভাবে মরবে সে, তাও জানে। পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী হয়তো সে, যে তার মৃত্যুর কথা অনেক বছর আগে থেকেই জানে।
‘ঠিক আছে। থাক তোরা। কাল উকিল ডেকে আনিস। আমিও আসবো।’ বলেই ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে সুফিয়া বের হয়ে এলো।
পরদিন রিহানের ফোনে কল করে সুফিয়া তাকে ডাকলো। দুই মিনিটেই রিহান এসে হাজির।
‘মিস. সুফিয়া, আমায় ডেকেছো?’
‘হ্যাঁ, রিহান, তোমার বাবাকে এই প্যাকেটটা দিয়ো।’ একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো সুফিয়া রিহানের দিকে।
‘কীসের প্যাকেট এটা?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রিহান।
‘এখানে তিন মাসের বাসা ভাড়া আছে। গত মাসেরটা দেয়া হয়নি। ওটাসহ এই মাসের বাসা ভাড়া, এবং সামনের মাসেরটা অগ্রীম।’
‘অগ্রীম কেন?’
‘দুঃখিত, রিহান। আমরা আজকেই চলে যাবো। আমাদের বাড়ির কাজ শেষ। আমরা ওই বাড়িতে ওঠবো। হুট করে এই বাসাটা আগে থেকে না জানিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি, তাই অগ্রীম বাসা ভাড়াটা দিয়ে দিচ্ছি।’
রিহান প্যাকেটটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আশেপাশে তাকায় সে, মিনু তখন জিনিসপত্রগুলো একটা একটা করে গোছাচ্ছিল। রিহান সুফিয়ার উদ্দেশ্যে আবেগি কণ্ঠে বলে উঠে, ‘মিস. সুফিয়া, খুব মনে পড়বে তোমার কথা। এত অল্প সময়ে মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে, আমি তোমার মতো কাউকে দেখিনি। শেষ বারের মতো আমাকে আরেকবার সরষে ইলিশ করে খাওয়াবে?’
সুফিয়া উপর-নিচ মাথা দোলায়। কান্না সামলানোর চেষ্টা করছে সে। রিহানের হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে বলে, ‘যাও, তাজা দেখে একটা মাছ কিনে আনো। ফেরার সময় আমার জন্য আরেকটা জিনিস আনতে পারবা?’
‘কী জিনিস?’
‘আমার জন্য তোমার টাকা দিয়ে দুইটা গাঁদা ফুলের মালা আনতে পারবা?’
‘আনবো মিস. সুফিয়া।’
রিহান বের হয়ে গেল বাজারের উদ্দেশ্যে। সুফিয়ার সেই সময়ের কথাটা মনে পড়লো। সেই সময় রিহান তার বাবা জাফর মাস্টারের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে তার জন্য দুইটা গাদা ফুলের মালা কিনেছিল। তারপর কেমন যেন বোকার মতো দাঁড়িয়ে পেছন থেকে বলেছিল, ‘আপনার জন্য দুইটা মালা আনছি। গাঁদা ফুলের মালা।’ ঘটনাটা মনে পড়তেই আনমনে হাসলো সুফিয়া। চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো সাথে।
রিহান বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে ফিরলো। সাথে নিজের টাকা দিয়ে দুইটা গাঁদা ফুলের মালাও কিনে আনলো সুফিয়ার জন্য। ইলিশ মাছটা মিনুর হাতে দিয়ে সুফিয়া রিহানকে বললো, ‘মালা দুইটা আমার খোপায় বেঁধে দিতে পারবা একটু?’
‘হ্যাঁ পারবো। কিন্তু তুমি বুড়ো বয়সে হঠাৎ খোপায় মালা পরতে চাও কেন?’
‘বুড়ো বয়সে কি মালা পরা যায় না?’
‘যায়। আচ্ছা পরাচ্ছি।’ রিহান সুফিয়ার খোপা করা সাদা চুলে মালা দুইটা পরিয়ে দিলো। তারপর বললো, ‘মিস. সুফিয়া, তুমি তরুণ বয়সে অনেক সুন্দরী ছিলে নিশ্চয়ই? ছেলেরা তোমার পিছুপিছু ঘুরতো?’
‘সুন্দরী ছিলাম কি না জানি না। তবে আমার বরের চোখে সুন্দরীই ছিলাম। তরুণ বয়সে তো শুধু ব্রিটিশদের অত্যাচার দেখেছি। তখন ছেলেরা পিছুপিছু ঘুরছে কি-না তা দেখার সুযোগ পাইনি। চলো, আমার হাতে শেষ বারের মতো সরষে ইলিশ খাবে।’ বলেই কিচেনের দিকে পা বাড়ালো সুফিয়া। রিহানও এলো। তারপর মিনুসহ তিনজনে মিলে সরষে ইলিশ বানিয়ে খেলো।
সেদিনের পর থেকে সুফিয়ার সাথে রিহানের আর তেমন দেখা হয়নি। একবার সুফিয়াকে সে গাড়ি নিয়ে যেতে দেখেছিল। রিহান ‘মিস. সুফিয়া বলে ডাকও দিয়েছিল। সুফিয়া হয়তো শুনেনি। আরেকবার দেখেছিল একটা অফিসের সামনে। রিহান তখন পড়ালেখা শেষ করে একটা চাকরির খোঁজ করছিল। ভাইভা দিতে গিয়েছিল সে। কিন্তু ভাইভা ভালো না হওয়ায় মন খারাপ করে বের হয়েছিল সে। তখন সুফিয়ার সাথে দেখা।
‘মিস. সুফিয়া, তুমি এখানে! অনেক দিন পর। কেমন আছ?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? একটা বিজনেস মিটিংয়ে এসেছিলাম। তুমি এখানে কেন?’
‘আমিও ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। এখানে ভাইভা দিতে এসেছিলাম। কিন্তু, ভাইভা তেমন ভালো হয়নি।’
‘চিন্তা করো না, পরেরবারের জন্য প্রস্তুতি নাও। আমার একটু তাড়া আছে। যেতে হবে।’ বলেই সুফিয়া চলে যায় গাড়ি নিয়ে।
সেইবার রিহানের ভাইভা খারাপ হলেও, কেমন করে যেন সে চাকরিটা পেয়ে যায়। ইউসুফ সাহেব নিজে তার বাড়িতে গিয়ে জয়েনিং লেটার দিয়ে আসে। সেদিন রিহান ব্যাপারটা বুঝেনি। আজ মুমূর্ষু সুফিয়ার পাশে বসে সে বুঝতে পারছে, সেদিন আসলে সুফিয়ার কারণেই চাকরিটা পেয়েছিল। সুফিয়া হয়তো ছেলেকে সুপারিশ করেছিল। ইউসুফ সাহেব যে সুফিয়ার ছেলে সে জানতো না তখন। আজ সবকিছু জানে সে৷ ইউসুফ শুধু সুফিয়ার ছেলে নয়, তারও ছেলে। রিহান হাঁটুগেড়ে তখনও কাঁদতে থাকে। সুফিয়া শোয়া অবস্থায় অক্সিজেন মাস্কটা খুলে রিহানের দিকে হাত বাড়ালো। রিহান তার হাতটা দুহাতে শক্ত করে ধরে কাঁদতে লাগলো। সুফিয়ারও চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে লাগলো। তবুও সে কাঁপা কণ্ঠে রিহানকে শান্ত করতে চাইলো, ‘রিহান, কেঁদো না। আমার হাতে সময় খুব কম৷ ছয়টা বিশ মিনিট হতে আর কতক্ষণ বাকি দেখো।’
রিহান অবাক হয়ে ঘড়িতে তাকায়। তারপর কাঁদতে কাঁদতে সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আর দশ মিনিট বাকি।’
‘আজ ৯-ই জুলাই।’ অস্ফুটে বললো সুফিয়া।
‘সুফিয়া, তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?’ সুফিয়ার আচরণে ভয় পেল রিহান। সুফিয়া হাসলো। ‘যাক, শেষ মুহূর্তে অন্তত মিস. শব্দটা বাদ দিয়েছো। আমাকে নাম ধরেই ডেকেছো। ইউসুফ আর ইকবাল কোথায়? আমার ছেলে দুইটাকে একটু ডাকো। শেষবারের মতো একটু দেখি।’
‘না সুফিয়া, তুমি এভাবে কথা বলো না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’ রিহান এবার বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললো।
সুফিয়ার শ্বাস নিতে কষ্ট হলো। অনেক কষ্টে বললো, ‘কেঁদো রিহান প্লিজ। তোমার কান্নামুখ দেখে আমি মরতে চাই না। আমি জানতাম এই দিনটা আসবে। তুমিই আমাকে বলেছিলে এই দিনটির কথা।’
‘আমি তোমাকে এমনটা কখনও বলিনি। তুমি মরবে না সুফিয়া।’ রিহানের কান্না বেড়ে গেল।
‘ইউসুফ আর ইকবালকে ডাকো প্লিজ।’ দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো সুফিয়ার। অক্সিজেন মাস্কটা আবার পরে নিলো সে। রিহান ‘ডাক্তার ডাক্তার’ বলে চিৎকার করে ওঠলো। একজন ডাক্তার আর দুজন নার্স দৌড়ে এলো। সাথে ইউসুফ সাহেব আর ইকবালও ঢুকলো। ডাক্তার সুফিয়াকে ধরতে চাইলে সুফিয়া হাতজোড় করে, তারপর অক্সিজেন মাস্কটা আলগা করে বলে, ‘ডাক্তার, আমাকে দুইটা মিনিট কথা বলতে দিন।’
ডাক্তার একপাশে সরে দাঁড়ালো। সুফিয়া তার দুই ছেলের উদ্দেশ্যে বললো, ‘বাবা, তোরা দুইভাই একসাথে থেকো। আর তোদের হাতে আমি আমার রিহানকে আমানত দিয়ে গেলাম। ওকে দেখে রেখো।’
ইউসুফ সাহেব এবং ইকবালও হাঁটুগেড়ে বসলো রিহানের পাশে। তাদের চোখেও জল। মাকে স্পর্শ করে বললো, ‘মা, তুমি এভাবে বলো না। তুমি ঠিক হয়ে বাড়ি ফিরে যাবে।’
সুফিয়া দুই ছেলের উদ্দেশ্যে বললো, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিস বাপ। তোদেরকে কখনও বলিনি এই দিনটার কথা। এই দিনটার ব্যাপারে তোদের বাবা আমাকে বায়ান্ন বছর আগেই সতর্ক করেছিল। আজ সেই দিন।’
রিহান এবার অনুরোধের সুরে বললো, ‘প্লিজ, আমাদের এভাবে ছেড়ে যেয়ো না। তোমাকে পেয়েছি আমি, আবার হারিয়ে ফেলতে চাই না। অনেক কথা বলার বাকি আমার। অনেক প্রশ্ন আছে আমার। অনেক কিছু জানার বাকি।’
সুফিয়া অক্সিজেন মাস্কটা মুখে চেপে ধরে অন্য হাত দিয়ে ইশারা করে একটা কলম চাইলো। একজন নার্স দৌড়ে গিয়ে একটা কলম এনে দিলো। কলমটা নিয়ে সুফিয়া রিহানের হাতে একটা তারিখ লিখলো। ০২-ই জুন, ২০২২। তারিখটা লিখে সে আবার অক্সিজেন মাস্কটা খুললো, তারপর রিহানের হাতটা শক্ত করে ধরে, অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলো, ‘তোমার সব প্রশ্নের জবাব পাবে ওইদিন।’ বলেই ধীরে ধীরে চোখ বুজতে লাগলো সুফিয়া। একটু পর নিস্তেজ হয়ে গেল। তখনও সে রিহানের হাতটা শক্ত করে ধরেছিল। রিহান ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো বাচ্চাদের মতো। সুফিয়া আর নেই।
(সমাপ্ত)