টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),১২,১৩

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),১২,১৩
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-১২

‘কাকে ডাকছো এভাবে? কোন অফিসার?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রাহাত। জবাবে রিহান বললো, ‘পুলিশ অফিসার সঞ্জু। বাইরে অপেক্ষা করছেন তিনি ফোর্স নিয়ে। আর এই যে আমার শার্টের বোতামে নজর দাও। ক্যামেরা দেখতে পাচ্ছো? কানে নজর দাও। ব্লুটুথ ডিভাইস, দেখতে পাচ্ছো? সবকিছু মনিটরিং হচ্ছে বাইরে। নাজমুলের হত্যার দায়টা তো নিয়ে নিলে। এবার আমার মুক্তি।’

‘কিন্তু, ইংরেজদের দিকে তাকাও, সবাই প্রশিক্ষিত। বেঁচে ফিরতে পারবা তো?’

‘বাইরে পুলিশ ফোর্সটাও বড়ো আছে, ওরাও প্রশিক্ষিত।’

বাইরে গুলির আওয়াজ শোনা গেল। অবিরাম গুলি ছোড়া হচ্ছে৷ রিহান রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ওই যে, শুরু হয়ে গেছে তাণ্ডব।’

নেলসন পুনরায় দৌড়ে গেল করিডোরের দিকে। একটা পিস্তল হাতে অ্যাডিসনও বের হয়ে গেল, সাথে ছুটলো দুজন গার্ড। কক্ষে কেবল রিহান আর রাহাত। শুধু পেছন থেকে চেয়ারের সাথে হাত বাঁধা ওদের। রিহান মজা করলো রাহাতের সাথে, ‘নাতি, বেঁচে ফিরতে পারবো তো? বাইরে গোলাগুলি তো বেশি হচ্ছে, কারা মরছে বেশি?’

‘পুলিশরা মরছে নিশ্চিত।’

‘কিন্তু পুলিশ টিমটা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরা। ইনফরমেশনটা তোমাকে দিতে ভুলে গেছিলাম। চিন্তা করো না, আমি তোমাকে ওদের হাতে মরতে দিবো না। নাজমুল হত্যার অপরাধটা আগে নিজের ঘাড়ে নিবা, আদালতে স্বীকার করবা, তারপর যা খুশি করবা।’

রাহাত কোনো জবাব দিলো না। কারও দৌড়ের শব্দ এলো কানে। অ্যাডিসন! চেহারায় তাঁর ভয়। নিশ্চয়ই পুলিশের গুলিতে তাঁর সৈন্যদের ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে বাইরে। কেন শুধু শুধু এখানে মরতে এলি বেচারা! অ্যাডিসনের জন্য আফসোস হলো রিহানের। কিন্তু অ্যাডিসন কী করতে যাচ্ছেন? পিস্তল তাক করছেন রাহাতের দিকে। এখনও তিনি হয়তো রাহাতকেই নিজের বাবার হত্যাকারী ভাবছেন। নিজে তো বিপদে পড়েছেন তিনি, কিন্তু যা-ই হোক না কেন, নিজের বাবার হন্তারককে তিনি নিজ হাতে মারবেন। ট্রিগারে চাপ দিতে যাচ্ছেন তিনি। সাথে সাথে রিহান ডাইভ দিলো। তার ভারি মাথাটা জোরে আঘাত করলো অ্যাডিসনের পেটে। দুজনেই নিচে পড়ে গেল। অ্যাডিসনের হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে দূরে সরে গেল। পিস্তলটা তিনি পুনরায় ধরতে গেলে রিহান জোরে ঘুষি চালায় তাঁর মুখে। কোন ফাঁকে যেন সে তার হাতের বাঁধন খুলে ফেলে। তার সাথেই যে একটা ছোরা ছিল, তা হয়তো ইংরেজদের চোখে পড়েনি। ওটা দিয়েই সে বাঁধন কেটেছে। ওটা দিয়েই সে এবার জোরে আঘাত করলো অ্যাডিসনের বুকে। আর্তনাদ করে ওঠলেন অ্যাডিসন। রিহান ছোরাটা তুলতে তুলতে ইংরেজিতে বললো, ‘নিজের বাবার খুনিকে খুঁজতে এসে বড়ো ভুল করলি। আমিই তোর বাবাকে মেরেছিলাম সেই সময়। এখন তোকেও মারবো। ইংরেজ মারতে সে সময়ও ভালো লেগেছিল, এখনও ভালো লাগবে।’ বলেই পুনরায় ছোরার আঘাত করলো সে। নেলসন দৌড়ে এলো বাবার এই অবস্থা দেখে চিৎকার করে ওঠলো সে, ‘ড্যাড!’

রিহান ছোরার আঘাত করেই যাচ্ছে অ্যাডিসনের বুকে। নেলসন পিস্তল তুলে গুলি করতে চাইলে তার দিকে। পেছন থেকে অফিসার সঞ্জু এসে গুলি করে দিলো নেলসনের খুলি বরাবর। ট্রিগারে আর চাপ দিতে পারলো না নেলসন। ঢোক গিলেই পড়ে গেল সামনে। অ্যাডিসনও ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেল। এরপর রিহান ওঠে রাহাতের বাঁধন খুলতে খুলতে বললো, ‘ভয় নেই নাতি। তোমাকে বাঁচাতেই তো এতকিছু। দাদা হিসেবে এটা আমার কর্তব্য।’

বাঁধনমুক্ত হলো রাহাত। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, ‘আমাকে বাঁচাতে এসেছো? না-কি নিজেকে বাঁচাতে এসেছো? আমাকে উদ্ধার করতে না পারলে তো নিজেও খুনের মামলায় ফেঁসে যেতে। কী করে প্রমাণ করতে তুমি নাজমুলের হত্যাকারী নও?’

‘তাই তো রিস্কটা নিলাম। এবার বাকি কাজটা অফিসার সঞ্জু করবেন।’

হাতকড়া পরালো সঞ্জু রাহাতের হাতে। রিহান কৃতজ্ঞ হয়ে ধন্যবাদ জানালো সঞ্জুকে, ‘অফিসার, আপনি আমার প্রতি সদয় না হলে, আমি হয়তো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারতান না। ধন্যবাদ, সে সময় আমাকে পালাতে সহযোগিতা করার জন্য।’

‘হোয়াট! পুলিশ তোমাকে পালাতে সাহায্য করেছে?’ অবাক হলো রাহাত।

এবার সঞ্জু বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ, আমিই সাহায্য করেছিলাম। কারণ, আমি দেখছি একটা নির্দোষ লোক ফেঁসে যাচ্ছে। আর ওই সময় আমি আপনার লিজ নেয়া জায়গাটা পরিদর্শনে গিয়ে বুঝলাম, আপনি আসলে মিথ্যা বলছেন। গেইট-কিপার নাজমুলকে হত্যা করা হয়েছিল গেইটের পাশেই। ওখানেই তার রক্তের দাগ দেখেছিলাম আমি। কিন্তু, যে কবরটাতে ওকে পাওয়া যায়, সেটা খুনের জায়গা থেকে অনেকটা দূরে। কেন সে গেইটের পাশে খুন করে একটা লাশকে টেনে আরও দূরে নিয়ে যাবে? যেখানে গেইটের পাশেই সে মাটিচাপা দিতে পারতো লাশটাকে। আর কবরটাও ছিল অনেকটা গভীর। কেন সে এতটা গভীরে মাটি খুঁড়বে? এতটা সময় সে পেল কোথায়? যেখানে খুনটা করেই তার পালিয়ে যাওয়া উচিত। অতএব সন্দেহের তীরটা আপনার দিকেই যায় মি. রাহাত। হ্যাঁ, ওই গর্তটা ওই সময় রিহান সাহেবই করেছিল। কারণ, ওটাই তার উদ্দেশ্য ছিল। পরে রিহান সাহেবের সাথে কথা বলেই সব পরিষ্কার হয় আমার কাছে। ওই গর্ত থেকে উনি দামি একটা কঙ্কাল নিয়ে গেছিল, তাই তাঁকে ধরতেই আপনি খুনটা করেন। কারণ, খুনের দায়টা রিহান সাহেবের উপর চাপালেই আমরা সহজেই তাঁকে খুঁজে বের করতাম। এটাই ছিল আপনার পরিকল্পনা।’

রাহাত চুপ করে কেবল শুনলো কথাগুলো। তার এখন বলার কিছুই নেই। সঞ্জু পুনরায় বললো, ‘এখন তো নিজেই স্বীকার করলেন খুনটা আপনি করেছেন। আপনার সবকিছু রেকর্ড হয়ে গেছে। কেবল আদালত এখন আপনার শাস্তি দেয়াটাই বাকি। চলুন আমাদের সাথে।’ রিহানের সাথে হ্যান্ডশেক করে রাহাতকে নিয়ে চললো সঞ্জু। রিহানও বের হয়ে এলো ওখান থেকে। ফোনটা বের করে ইউসুফ সাহেবের নাম্বারে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই সে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার, আমার সুফিয়া কোথায়? কী অবস্থা ওর?’

‘হাসপাতালে আছে এখনও। জ্ঞান ফেরেনি।’

‘প্লিজ, ডাক্তারকে বলুন চেষ্টা চালিয়ে যেতে। সুফিয়া আমার সাথে শেষ সাক্ষাৎ না করে মরতে পারে না। আমি আসছি।’

একটা ট্যাক্সিতে ওঠে বসলো রিহান। ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে দ্রুত চালাতে বললো সে ট্যাক্সি। যেতে যেতে সে ইউসুফ সাহেবের কাছ থেকে হাসপাতালের ঠিকানাটা নিয়ে নিলো। যখন সে হাসপাতালে পৌঁছলো, ঘেমে পুরো ভিজে গেছে। ইউসুফ সাহেবের মুখোমুখি হলে, ইউসুফ সাহেব বললেন, ‘এখনও ভেতর থেকে কোনো ভালো খবর আসেনি। অজ্ঞান এখনও। ভেতরে যাওয়া যাবে না।’

রিহান আচমকা জড়িয়ে ধরলো ইউসুফ সাহেবকে। তারপর বাচ্চার মতো কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘স্যার, আমি ওর সাথে একটিবারের জন্য হলেও কথা বলতে চাই৷ ওর সাথে আমার অনেক কথা বলা বাকি। অনেক প্রশ্ন জমে আছে মনে। আমি আর নিতে পারছি না।’

‘শান্ত হও, রিহান, শান্ত হও তুমি।’ ইউসুফ সাহেব এই প্রথম রিহানকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখলেন। ইকবাল এগিয়ে এলো পাশে। রিহানের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন ইউসুফ সাহেব, ‘আমার ছোটো ভাই। তোমার ছোটো ছেলে।’

রিহান চোখ মুছে তাকালো। ইকবাল তখন বললো, ‘কী বলে ডাকবো তোমায় জানি না। বাবা ডাকবো? না-কি নাম ধরে ডাকবো। আমাদের মাঝে সম্পর্কটা বাপ-ছেলের। কিন্তু, এটা এমন এক সম্পর্ক, যা মানুষের সামনে প্রকাশ করা যায় না। লোকে হাসবে, সমাজ নিয়েই চলতে হয় আমাদের। ছেলের বয়স বাবার চেয়ে বেশি, এটা কেন তা যদি লোকজনকে আমরা বোঝাতে যায়, তবে আমাদেরকেই ওরা পাগল ভাববে। কিন্তু, তবুও তো বাবাকে অস্বীকার করা যায় না। বাবার আদর পাইনি, এখন অন্তত একবার বাবাকে জড়িয়ে ধরা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাই না।’ বলেই জড়িয়ে ধরলেন ইকবাল রিহানকে। তারপর কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বললেন, ‘কেন আমাদের সাথে এমনটা হলো? কেন নিয়তি তোমাকে অতীতে নিয়ে গেল? তোমার ওই একটা ভুলের জন্য কতগুলো মানুষ কষ্ট পেল!’ আবেগে ভারি হয়ে এলো ইকবালের কণ্ঠ। তারপর চোখ মুছে একপাশে সরে দাঁড়ালেন তিনি। রিহানও চোখ মুছলো। জবাব দেয়ার মতো ভাষা তার নেই। ইউসুফ সাহেব তার কাঁধ চাপড়ে বললেন, ‘এজন্য তুমি অনুশোচনা করো না। আমরা তোমাকে কখনও দোষ দিইনি। বরং, নিয়তির খেলা হিসেবে মেনে নিয়েছি। শুধু আফসোস একটাই, ভুল গাড়িতে যদি তুমি সে সময় উঠে না বসতে? তোমার এক ভুল, আর আমাদের এই পরিণতি। আমি, ইকবাল, আর আমার দুই ছেলে, সবাই তোমার বিশ মিনিটের ভুল। তোমার জীবনে যদি ওই বিশ মিনিটটা না আসতো!’

‘কিন্তু, আমি তো কাউকে বলিনি যে, আমার অতীতের পুরো সময় বর্তমানের বিশ মিনিটের সমান। ওই সময় আমার জীবন থেকে শুধু বিশ মিনিট কেটেছে, এটা আপনারা কীভাবে জানলেন?’

রিহান প্রশ্নটা করতেই ভেতর থেকে একজন বের হয়ে জানালো রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। একজন একজন করে দেখা করা যাবে। ইউসুফ সাহেব তখন রিহানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যাও, দেখা করে এসো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই একদিন জানতে পারবে।’

রিহান আর দেরি করলো না। দ্রুত ভেতরে গেল। কিন্তু, ভেতরে ঢুকেই কেমন যেন তার পা আর চললো না। ধীরপায়ে হাঁটতে লাগলো। সুফিয়ার সাথে দেখা হবে তার একটুপর, কেমন দেখতে লাগবে তাকে? রিহানকে দেখে কী অনুভূতি হবে সুফিয়ার মনে? অনেক বছর পর সুফিয়া তাকে দেখতে পাবে। তার শত প্রতীক্ষা আজ শেষ হবে। ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে কাছে চলে এলো রিহান। সুফিয়া তাকালো রিহানের দিকে। রিহানকে দেখেই চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়লো তার। চমকে ওঠলো রিহান। এই বৃদ্ধা মহিলাই কি তবে তার সুফিয়া? এই বৃদ্ধা মহিলাকে সে আগেও অনেকবার দেখেছে, তার আশেপাশে ঘুরতো। অনেক বছর হবে, প্রায় সাত-আট বছর। তখন থেকেই সে চিনে এই বৃদ্ধাকে। কথাও হয়েছে অনেকবার। কিন্তু, সুফিয়া কখনও নিজের পরিচয় দেয়নি। রিহানের চোখ বেয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সুফিয়া তুমি এত নিষ্ঠুর কী করে হলে? কেন আরও আগে নিজের পরিচয় দাওনি? কান্নায় ভেঙে পড়লো রিহান হাঁটুগেড়ে বসে।

[[চলবে…]]

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-১৩

সময়টা তখন ২০১০ এর মাঝামাঝি। রিহানের এখনও মনে আছে, তার বাবা রহমান সাহেব সে সময় বাসার জন্য নতুন ভাড়াটিয়া খুঁজছিলেন। বাইরের টু-লেট বোর্ডে দেয়া ছিল রিহানের নাম্বার। হঠাৎ একদিন তার নাম্বারে ফোন আসে। রিহান রিসিভ করেই সালাম। ওপাশ থেকে সালামের জবাব দিয়ে এক বৃদ্ধা মহিলা বললেন, ‘আমরা একটা বাসা খুঁজছিলাম, আপনাদের বাসাটা কি খালি আছে?’

‘জি, খালি আছে। আপনি এসে বাসাটা দেখতে পারেন।’

‘আমি বাসার বাইরেই দাঁড়িয়ে আছি। যদি একটু বের হতেন…’

‘আচ্ছা একটু অপেক্ষা করুন, আমি বের হচ্ছি।’

কিছুক্ষণ পর একটা টি-শার্ট আর ত্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরে রিহান বের হয়। একটা বৃদ্ধাকে সে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাসার সামনে, একটা প্রাইভেট কারের সাথে হেলান দেয়া, সাথে আরেকটা ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ে। সম্ভবত কাজের মেয়ে সে। রিহান দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘আপনি ফোন করেছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’ জবাব দেয় বৃদ্ধা। আমাদের আজকেই উঠতে হবে বাসায়।’

‘আজকেই ওঠবেন? দাঁড়ান, বাবাকে একটা ফোন করে জেনে নিই।’ বলে রিহান তার বাবাকে ফোন করে জানায় এ ব্যাপারে। তারপর ফোন কেটে দিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে। আজকেই উঠতে পারবেন। কিন্তু কজন থাকবেন আপনারা?’

‘আমরা দুজন। আমি আর ও।’ পাশের মেয়েটাকে ইশারা করলো বৃদ্ধা।

‘শুধু দুজন? সাথে কোনো পুরুষ লোক নেই আপনাদের?’

‘পুরুষ লোক আছে। আমার দুই ছেলে আর দুই নাতি। ওরা ওদিকে আরেকটা বাসা নিয়েছে। কিন্তু ওদিকের জায়গাটা আমার ভালো লাগে না, তাই এদিকেই আলাদা বাসা নিতে চাচ্ছি। আসলে আমরা এখানে নতুন জায়গা নিয়েছি। আমাদের নিজস্ব বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। যতদিন বাসা তৈরির কাজটা শেষ হবে না, ততদিন আমরা দুজন এখানেই থাকবো।’

‘ঠিক আছে, চলুন। আপনাদের বাসাটা দেখিয়ে আসি।’

‘না, না, দেখতে হবে না। আমরা আসলে সব জিনিসপত্র নিয়েই এসেছি। কয়টা রুম হবে এমনি?’

‘তিন রুম, আর একটা কিচেন। অ্যাটাচড বাথরুম।’

‘ঠিক আছে, চলবে।’

‘কিন্তু ভাড়া…’

‘ভাড়ার ব্যাপারে সমস্যা নেই। আপনারা যতটা দাবি করবেন, মাস শেষে দিয়ে দেবো।’

রিহান কথা বাড়ালো না। কারণ, বৃদ্ধা মহিলাকে সুবিধের মনে হয়েছে। সাথে প্রাইভেট কার, ঢাকা শহরে জায়গা কিনে নিজস্ব বাড়ি করবে ওরা, নিশ্চয়ই বড়োলোক ঘরের সম্ভ্রান্ত কোনো মহিলা হবেন। রিহান হেসে বললো, ‘ঠিক আছে…’

‘কিন্তু আমাকে একটু হেল্প করতে হবে যে। আমার জিনিসপত্রগুলো ভেতরে নিয়ে যেতে হবে। যদি দুইটা লোক ডেকে দিতেন? আমি পারিশ্রমিক দিবো।’

‘আমি আপনার নাতির বয়সী। আমাকে তুমি করেই বলুন প্লিজ। আমার নাম রিহান।’

‘বেশ! রিহান, তুমি তাহলে দুইটা লোক ডেকে দাও। আর আমার নাম সুফিয়া, আমাকে নাম ধরেই ডাকতে পারো।’

‘কিন্তু, বয়সে বড়ো কাউকে তো আমি নাম ধরে ডাকতে পারি না।’ কথা বলতে বলতে রিহান দুইটা লোক ডাকলো। ওদেরকে দিয়ে সুফিয়ার জিনিসপত্রগুলো ভেতরে নিয়ে যেতে লাগল সে।

‘আমাকে নাম ধরেই ডাকবা, যতদিন এখানে থাকি। আমরা দুজন বন্ধু। কেমন?’

‘ঠিক আছে।’ রিহান লজ্জা পেয়ে হাসলো। সেদিন থেকে সুফিয়ার সাথে তার ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে ওঠে। রিহান ভেবে পায় না। এত ধনী মহিলা, অথচ তার সাথে কত সাধারণভাবে মিশে। রিহানও খুব পছন্দ করে সুফিয়াকে। মাঝেমধ্যে দুজনে গল্প করে। নতুন কোনোকিছু রান্না করলে সুফিয়া প্রথমেই ডাকে রিহানকে, সাথে তার পুরো পরিবারকেও।

সরষে ইলিশের দাওয়াত দিলো একদিন রিহানকে৷ রিহান তা খেয়ে সুফিয়ার প্রশংসা করতো ভুললো না। ‘ওয়াও! এত স্বাদের খাবার তুমি নিজে বানিয়েছ?’

‘হ্যাঁ, তোমাকে যেদিন দাওয়াত দিই, সেদিন মনে করবা সব খাবার আমিই রান্না করেছি। এমনিতে সব কাজ করে মিনু।’

মিনু সুফিয়ার কাজের মেয়ে, সে রিহানের এঁটো খাবারগুলো নিয়ে যাচ্ছিল কিচেনে। একপাশে সোফায় বসে আছে সুফিয়া। আর রিহান খাবার টেবিলে বসে একটা টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে বললো, ‘সত্যি, তুমি অনেক ভালো রাঁধতে পারো। আজ থেকে আমার প্রিয় খাবার হয়ে গেল এই সরষে ইলিশ।’

‘এই রেসিপিটা কার কাছ থেকে শিখেছি, জানো?’

‘কার কাছ থেকে?’

‘আমার স্বামীর কাছ থেকে। আমার স্বামীর খুব প্রিয় খাবার ছিল এটা।’

‘আমিও একটু আধটু রাঁধতে পারি। কিন্তু এই রেসিপিটা পারি না। আমাকে শিখাবে, কীভাবে রাঁধতে হয় এটা?’

‘কেন নয়? চলো, তোমাকে শিখিয়ে দিই।’ বলেই দেরি করলো না। সুফিয়া রিহানকে কিচেনে নিয়ে গিয়ে রেসিপিটা শিখাতে লাগলো।’

কাজের ফাঁকে রিহান সুফিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘যার কাছে এই চমৎকার রান্নাটা শিখলে, সে এখন কোথায়?’

রিহানের এমন প্রশ্নে হঠাৎ সুফিয়ার মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভেবে বললো, ‘অনেক আগেই হারিয়ে গেছে সে। তবে তার স্মৃতিগুলো এখনও ধরে রেখেছি আমি। আমি তাকে আমার চারপাশে অনুভব করি। এখনও মনে হচ্ছে আমার আশেপাশেই আছে সে।’

‘আমি দুঃখিত মিস. সুফিয়া। আমি আসলে তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য কথাটা জিজ্ঞেস করিনি।’

সুফিয়া রাগের ভান করে কোমরে হাত রাখলো। তারপর নরম সুরে শাসিয়ে বললো, ‘তোমাকে না বলছি নামের আগে মিস. না বসাতে?’

‘প্লিজ, আমার ওভাবে নাম ধরে ডাকতে কেমন যেন লাগে। আমি বরং মিস. সুফিয়াই ডাকি প্লিজ। কিছু মনে করো না।’

‘ঠিক আছে। আমি একটু বুড়ো হয়েছি দেখে বন্ধু ভাবতে পারছো না, বুঝছি।’

‘প্লিজ… বোঝার চেষ্টা করো।’ হাতজোড় করলো রিহান। সুফিয়া হাসলো, আলতো করে রিহানের কানটা মলে দিয়ে বললো, ‘আরে পাগল, আমি মজা করছি। আমাকে মিস. সুফিয়াই ডাকো তুমি।’

রিহানও বোকার মতো হাসলো। তারপর বললো, ‘তোমাকে বুড়ি মনেই হয়না। চুলগুলো সাদা বলেই এখন ষাট-সত্তর বছর মনে হচ্ছে। কিন্তু চুলে কালারিং করলে মনে হবে, ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর।’

জোরে হেসে ওঠলো সুফিয়া। তারপর হাসি থামিয়ে দুষ্টুমি করে বললো, ‘তখন কি তুমি বিয়ে করবে আমাকে?’

‘তখন কেন? আমি তো এখনই তোমাকে বিয়ে করতে রাজি। তোমার আর বয়স কই হলো? চলো কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করি।’

‘তোমাকে আর ভাত দিবে না বাসায়। বলবে, হতচ্ছাড়া নব্বই বছরের বুড়ি একটাকে বিয়ে করেছিস, যার একপা পৃথিবীতে, আরেক পা কবরে।’

‘তোমার বয়স নব্বই?’

‘একানব্বই চলে। কী মনে হয় তোমার? কত যুগ পেরিয়ে এসেছি! কতকিছু দেখেছি!’

‘আমি তোমার বয়স আন্দাজ করেছিলাম। পয়ষট্টি বা সত্তর। এর বেশি না। এত শক্ত সামর্থ্য কী করে আছো।’

‘হা হা হা।’ এই প্রশংসাগুলো এই বুড়ির সামনে না করে, কোনো তরুণীর সামনে করো। কলেজে কোনো মেয়ে বান্ধবী আছে না-কি পছন্দের?’

‘না, না, নেই। ওহ্ মাই গড! আমি তো কলেজের কথা ভুলেই গেছি। আজ কলেজে যেতে হবে। রেসিপিটা তো শিখেই নিলাম। পরে একদিন তোমাকে আমি করে খাওয়াবো।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো রিহান। সুফিয়া বললো, ‘ঠিক আছে। সাবধানে যাও কলেজে।’

রিহান বের হয়ে গেল। সে বের হয়ে যেতেই সুফিয়া জানালার পাশে গ্রিল ধরে দাঁড়ালো। দূরের আকাশে চেয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, কী আশ্চর্য! যে সরষে ইলিশের রেসিপিটা সে ১৯৪৩ সালেই রিহানের কাছ থেকে শিখেছে, সেই রেসিপিটা এখন সে রিহানকে শিখাচ্ছে। আসলে কে কার গুরু? ভাবনাটা আসতেই আনমনে হাসলো সুফিয়া। ডুবে গেল সে পুরনো স্মৃতিতে। তখন তারা বিয়ে করে সবে তার দাদা জমিদার সলিমুদ্দিনের বাড়িতে ওঠেছিল। সুফিয়া আগে থেকেই রান্না পারতো। দাদা বাড়িতে রান্না করার মতো অনেক কাজের লোক থাকলেও মাঝেমধ্যে সুফিয়াও রান্না করতো। সেদিন রান্নাঘরে সে ইলিশ মাছ রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রিহান গিয়ে কয়েকটা ইলিশের টুকরো সরিয়ে রাখে। সুফিয়া জিজ্ঞেস করে, ‘কী ব্যাপার, মশাই? হঠাৎ রান্নাঘরে আপনার আগমন?’

‘আমিও রাঁধতে পারি, জানো?’

‘তো আজ কি রান্না করে খাওয়াবেন আমাদের?’

‘চলো, তুমি একটা রান্নার পদ শিখাই আজ। সরষে ইলিশ রাঁধতে পারো?’

‘না। শিখান দেখি…’

‘এটা আমি শিখেছি একটা বৃদ্ধা মহিলা থেকে। ওর নামটাও ছিল সুফিয়া। আচ্ছা, সেই সুফিয়া আর তুমি একজন নও তো?’

‘যাহ্, কী যে বলো, এত বছর কি আমি বেঁচে থাকবো? কতসালে শিখছিলেন?’

‘২০১০ সালে।’

‘এখন কেবল ১৯৪৩ সাল। ২০১০ সাল আসতে আসতে আমি মরে ভূত হয়ে আপনার ঘাড় মটকাতে যাবো। যাহোক, শিখান তো এখন। দেখি বৃদ্ধা মহিলা থেকে কেমন রান্না শিখেছেন।’

‘প্রথমে মাছগুলোকে লবণ আর হলুদ দিয়ে মাখিয়ে নিতে হবে।’ বলেই ইলিশের টুকরোগুলোকে রিহান হলুদ আর লবণ দিয়ে মাখতে লাগলো। সুফিয়া তার পাশে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলটা কোমরে প্যাঁচালো। তারপর স্বামীর কীর্তি দেখতে লাগলো। রিহান ইলিশের টুকরোগুলো একপাশে রেখে বললো, ‘এগুলো দশ-পনেরো মিনিট এভাবে থাকুক। এবার তুমি কিছু কালো সরষে, আর কয়েকটা কাচা মরিচ একসাথে পিষো। হালকা লবণ আর জল দিয়ো।’

সুফিয়া একটা বাটিতে কিছু সরষে নিয়ে, হালকা জল মিশিয়ে পিষতে লাগলো। রিহান তার মাথায় আঙুলের উল্টোপিঠ দিয়ে কিছুটা জোরে বাড়ি মারলো। ব্যথা পেয়ে ‘উফ’ করে ওঠলো সুফিয়া। রিহান বললো, ‘লবণ আর কাচা মরিচ একসাথে একই বাটিতে পিষতে বলছি।’

‘যান, আমি শিখবো না। মারছেন কেন আমাকে।’ গাল ফুলিয়ে একটা টুলে বসে পড়লো সুফিয়া। নিচের দিকে চেয়ে রইলো। রিহান তার হাত ধরে বললো, ‘আমি ব্যথা পাওয়ার মতো করে মারছি না-কি? একটু করে আঙুল লাগছে শুধু।’

‘আমি ব্যথা পাইছি।’ মাথা না তুলেই বললো সুফিয়া।

‘আচ্ছা বাবা স্যরি। উঠো, এই কান ধরলাম, আমি।’

রিহানকে কান ধরতে দেখে হেসে উঠলো সুফিয়া। রিহান বললো, ‘এখন খুশি তো। এবার আসো, শিখে নাও। সব একসাথে পিষতে বলছি, যাতে সরষেগুলো তিতা না হয়। বুঝছো?’

‘বুঝছি জনাব।’ বলেই সব একসাথে পিষতে লাগলো সুফিয়া। পিষার সময় গলার আওয়াজটা একদম ছোটো করে নিজে নিজে বলতে থাকে সে, ‘বয়সে প্রায় সত্তর বছর বড়ো আমি তার। আর আমার গায়ে হাত তুলে সে!’

রিহান পেছন থেকে সুফিয়াকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। তারপর কানেকানে বলে, ‘সত্তর বছর বড়ো তো কী হয়েছে? বিয়েই তো করে নিয়েছি।’

‘ছাড়েন। কেউ এসে পড়বে।’ খুন্তির গুঁতা দিলো সুফিয়া রিহানকে। রিহান হেসে সুফিয়াকে ছেড়ে দিলো। তারপর কীভাবে এখন ইলিশগুলো তেলে ভাজতে হবে হাতে ধরে ধরে শিখিয়ে দিলো।

পুরো ঘটনাটা মনে পড়তেই সুফিয়ার চোখ ভিজে ওঠলো। আজ রিহান যেভাবে তার প্রশংসা করছে, সেদিন সেও একইভাবে রিহানের প্রশংসা করেছিল। তারপর থেকে প্রায় সে সরষে ইলিশ রান্না করতো। সেদিন রিহান হয়তো মজা করেই বলেছিল যে, সুফিয়া নামে যে বৃদ্ধার কাছে সে রান্নাটা শিখেছে, সেই সুফিয়া আর তার বউ সুফিয়া দুজনই একই। সেদিন রিহান আর সুফিয়া কেউ-ই জানতো না যে, রিহানের কথাটা আসলেই সত্যি। সুফিয়া আজ বুঝতে পেরেছে, দুজনই আসলে একই সুফিয়া। রিহানের বুঝতে হয়তো আরও দেরি হতে পারে৷ হয়তো কোনোদিন না-ও জানতে পারে সে। কারণ, সুফিয়া কখনও নিজের পরিচয় প্রকাশ করবে না রিহানের কাছে। দূরের আকাশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চোখ মুছলো সুফিয়া। কখন যে দুপুর হয়ে গেল বুঝতেই পারলো না সে।

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here