টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),১০,১১

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),১০,১১
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-১০

খুব শীঘ্রই সাফল্যের আরেক ধাপ অতিক্রম করবে রাহাত খান। তাই সে ভীষণ খুশি। ইংরেজদের সাথে ডিলটা সম্পন্ন হতে খুব বেশি দেরি নেই আর। ওরা আজই বাংলাদেশে এসে পৌঁছাবে। তারপর দু’পক্ষের মাঝে ডিল হবে। খুশিতে পায়চারি করছে রাহাত। সময় যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। এত দেরি হচ্ছে কেন ওরা বাংলাদেশে ল্যান্ড করতে? বেশ কিছুক্ষণ পর একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো। মুহূর্তেই রিসিভ করলো রাহাত।

‘হ্যালো…’

‘মি. রাহাত, আমরা বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছি।’ ওপাশ থেকে কেউ একজন ইংরেজিতে বলে ওঠলো।

‘জি, আপনারা সরাসরি আমার এখানে আসবেন? না-কি অন্য কোথাও যাবেন?’ রাহাতও ইংরেজিতে কথপোকথন করতে লাগলো ফোনে।

‘আমরা প্রথমে হোটেলে ওঠবো, আগামীকাল আমরা আপনার সাথে ডিল করবো।

‘বেশ। আমরা অপেক্ষা করবো আপনার জন্য।’

শহিদের লাশটা ইউসুফ সাহেবের হাতে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। ছেলের লাশটা পেয়ে কেন জানি তাঁর কান্না পাচ্ছে না। একপাশে দাঁড়িয়ে তিনি ছেলের লাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। পাশ থেকে পুলিশ অফিসার সঞ্জু বলে উঠলো, ‘ছেলের লাশ দেখেও কোনো বাবা যে এভাবে শান্ত থাকতে পারে, আজ প্রথম দেখলাম।’

মুহূর্তেই কোনো জবাব দিলেন না ইউসুফ সাহেব। কয়েক মুহূর্ত ভেবে তিনি বলতে লাগলেন, ‘চোখের জল তো সব আগেই শেষ হয়ে গেছে অফিসার। তাই ঠিক সময়ে ফেলার মতো অবশিষ্ট জল আর নেই চোখে। ভেতরটা শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। নয় বছর আগে আমার দুই ছেলে আমার সাথে সম্পর্ক শেষ করেছিল, শুধুমাত্র সম্পদের জন্য। আজ নয় বছর পর এক ছেলের৷ লাশ ফিরে৷ এসেছে, হয়তো অন্য ছেলেটারও লাশ দেখতে হবে। আজ আমার শুধুই আফসোস হচ্ছে আমার ছেলের জন্য। যে সম্পদের জন্য সে বাপের সাথে সম্পর্ক শেষ করেছিল, সেই সম্পদের একটা ছোটো কণাও সে মৃত্যুর পর নিয়ে যেতে পারলো না। ওদের মা মারা যাওয়ার পর, ওরা দুজন ছিল আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্টই পেয়েছি আমি ওদের কাছে। আজ আমার চোখের জল ফেলার দিন নয়। আজ দিনটা কেবল আফসোসের।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ইউসুফ সাহেব।

‘আপনার ছেলেকে কে মারতে পারে বলে আপনার ধারণা?’

‘কেউ মারেনি। ও নিজের দোষেই মরেছে।’

‘শুনেছি আপনার ছোটোভাই দেশে এসেছেন। ইকবাল নাম। কোন দেশে যেন থাকেন উনি।’

‘আমেরিকায়। ওখানেই থাকে সে। দেশে আসে না।’

‘আপনার দুই ছেলের সাথে ঝগড়া করেই না-কি উনি আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন। ওখানেই স্থায়ীভাবে থাকেন। জানতে পারলাম কয়েকদিন ধরে আপনার ভাইকে দেশে দেখা যাচ্ছে। হুট করে তার দেশে আসার কারণ কী?’

‘তা তো বলতে পারি না আমি। আমার সাথে যোগাযোগ হয়নি ওর।’

‘শহিদের মৃত্যুর দিন উনাকে তার ফ্ল্যাটের নিচে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল। কয়েকজন সাক্ষী দিয়েছে।’

‘এখন আপনারা কী করতে চান?’

‘কিছুই না। জাস্ট জানতে চাইলাম। আমাকে একটা প্রশ্নের জবাব দিন। এখন আপনার মা কোথায়?’

‘জানি না।’

‘থানায় জিডি করেছেন?’

‘না।’

‘কারণ, আপনি জানেন আপনার মা নিরাপদে আছেন। অবশ্য নিরাপদেই থাকার কথা। আপনাদের দুই ভাইয়েরই প্রিয় মা উনি। ইকবাল সাহেবের ঠিকানাটা জানলে বলুন।’

‘জানি না আমি।’

‘সমস্যা নেই। আমরা খুঁজে বের করে নেবো। আপনার অপর ছেলেরও যেন এমন অবস্থা না হয়, দোয়া রইলো। আর আপনার জন্য এখন কেবল সমবেদনা জানানো ছাড়া কিছুই করার নেই। আসি তবে।’ অফিসার সঞ্জু তার পুলিশ সদস্যদের নিয়ে চলে যেতে লাগলো। ইউসুফ সাহেব ছেলের লাশ থেকে চোখ সারালেন না।

রাতের বেলায় ইউসুফ সাহেব নিজের কক্ষে বসে আছেন আলোটা নিভিয়ে। চেয়ারে দোল খাচ্ছেন তিনি। দরজার ওপাশ থেকে একজন পরিচারিকা এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার, চা আনবো আপনার লাইগা?’

‘নাহ্, আনতে হবে না।’

‘স্যার আপনে এইভাবে আন্ধারে বইয়া থাকলে মন তো আরও পুড়বো। লাইটডা জ্বালায় দিমু?’

‘নাহ্, দিস না। আমাকে একটু আঁধারে থাকতে দে। নুরি…’

‘কন স্যার, কিছু লাগবো।’

‘না, কিছু লাগবে না। তুই আমার রক্তের কেউ না, তবুও তুই আমার জন্য যতটুকু ভাবিস, আমার রক্তের সম্পর্কের ছেলে দুইটা যদি একটু ভাবতো। আমার বাকি ছেলেটা যদি ভালো হয়ে গিয়ে আমার বুকে ফিরে আসতো!’

‘স্যার, একদিন সব ঠিক অইয়া যাইবো।’

‘আচ্ছা, যা তুই…’

নুরি চলে গেল। ইউসুফ সাহেবের ফোনে কল এলো। অপরিচিত নাম্বার। রিসিভ করলেন তিন। ওপাশ থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠ শোনা গেল, ‘ভাই…’

‘কে? ইকবাল?’

‘হ্যাঁ ভাই। চিনতে পারছো আমাকে?’

‘হ্যাঁ, চিনতে পারছি। তুই কোথায়?’

‘আমি হাসপাতালে। ভাই, আমি একটা অপরাধ করে ফেলেছি। তোমার ছেলেটাকে আমি নিজ হাতে খুন করেছি। আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?’

‘সে তার কর্মফল ভোগ করেছে।’

‘আমি মারতে চাইনি ভাই। আমি যদি ওকে না মারতাম, তবে সে মাকে মেরে ফেলতো। মা এখন আমার কাছে। কিন্তু অবস্থা খুব খারাপ। আইসিইউতে আছে।’

‘হোয়াট! কোন হাসপাতালে? আমি আসছি।’

ইকবাল হাসপাতালের ঠিকানা দিলে, ইউসুফ দ্রুত বের হয়ে যায় ঘর থেকে।

হোটেলের একটা কনফারেন্স কক্ষে বসে আছে দু’পক্ষ। একপাশে রাহাত এবং তার সৈন্যরা, অন্যপাশে ইংরেজদের দলটা। ওদের দলের সবার শরীরের দিকে তাকালে মনে হবে একেকটা বডি বিল্ডার। সবাই প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারী। সশস্ত্র অবস্থায় ওরা দাঁড়িয়ে আছে। একজন বসে কথা বলছে, সে-ই হয়তো তাদের বস। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। রিহানের সাথে হ্যান্ডশেক করলো সে। নিজের নাম বললো সে নেলসন। জনসনের নামের সাথে কিছুটা মিল আছে। জনসনেরই হয়তো কোনো আত্মীয় হবে সে, ভেবে নিলো রাহাত।

একটা বাক্সে ছিল জনসনের কঙ্কালটা। রাহাত বাক্সটা খুলে দেখালো নেলসনকে। তারপর হাসিমুখে ইংরেজিতে বললো, ‘দুঃখিত মি. নেলসন। আমরা প্রথমে ভুল রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম। এটাই জনসনের আসল কঙ্কাল। প্রয়োজনে আপনারা আবারও ডিএনএ টেস্ট করতে পারেন।’

‘না মি. রাহাত, তার আর দরকার নেই। শেষবার যে রিপোর্ট আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন, ওটা আমাদের রিপোর্টের সাথে মিলেছে। তারমানে জনসনের কঙ্কালটা নিশ্চয়ই আপনার কাছেই আছে।’ ইংরেজিতেই বললো নেলসন। ঠোঁটের কোণে তার অস্পষ্ট হাসি লেগে আছে।

‘তবে ডিলটা হয়ে যাক। দেরি করছি কেন আমরা?’ রাহাতের যেন তর সইছে না আর।

নেলসনের গার্ডদের হাতে কয়েকটা ব্রিফকেস ছিল। একটা ব্রিফকেস নিয়ে রাহাতের দিকে এগিয়ে দিলো নেলসন। ব্রিফকেসটা খুললো রাহাত। ওখানে চকচক করছে সব ইংরেজ নোট।

‘বিশ মিলিয়ন পাউন্ড পুরস্কার দেয়ার কথা আপনাকে। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রাখছি, আর কঙ্কালটা আমরা নিচ্ছি।’

রাহাত কঙ্কালের বাক্সটা ওদের হাতে তুলে দিলো। ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না সামান্য একটা কঙ্কালের জন্য এতগুলো অর্থ পুরস্কার দেবেন আপনারা। আমি কি জানতে পারি, এই সামান্য কঙ্কালটা কেন এত দামি দিয়ে নিচ্ছেন?’

‘এটা আপনার কাছে সামান্য হতে পারে, তবে আমাদের কাছে নয়। জনসন আমাদের দেশের একজন বীর, যাকে স্বয়ং উইনস্টন চার্চিলও অনেক পছন্দ করতেন। এবং তিনিও জনসনের খোঁজ করেছিলেন পুরস্কারের বিনিময়ে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি জনসনের লাশের খোঁজ করেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গেছেন জনসনের লাশ বা কঙ্কাল যেন খুঁজে এনে জাতীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়। আমরা সেই দায়িত্বই পালন করছি। কিন্তু এটা খোঁজার পেছনে আমাদের আরও একটা উদ্দেশ্য আছে।’

‘কী সেই উদ্দেশ্য?’

‘আমাদের আসল উদ্দেশ্য কঙ্কালের খোঁজ করা নয়। আসল উদ্দেশ্য হলো, কঙ্কালটার খোঁজ কে জানে? সেই মানুষটার খোঁজ করা।’ বলেই পিস্তল তাক করে রাহাতের সঙ্গীদের দিকে গুলি করলো নেলসন। সাথে সাথে নেলসনের সঙ্গীরা গুলি করলো। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলে গুলির শব্দটা বেশিদূর যায়নি। মুহূর্তেই রাহাতের সব সঙ্গীরা গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল নিচে। নিজেদের পিস্তল বের করার সময়ও পেল না। রাহাত পিস্তল বের করলে, তার মুখে জোরে ঘুষি চালিয়ে পিস্তলটা কেড়ে নিলো নেলসন। রাহাতের ঠোঁট কেটে রক্ত বের হলো। দাঁতে দাঁত পিষে সে উচ্চারণ করলো, ‘ধোঁকা!’

নেলসন হেসে ইংরেজিতে বললো, ‘অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছি এই দিনটার জন্য। আমরা জানতাম জনসনকে কেউ একজন খুন করেছিল। এবং লাশটা সে এমন এক জায়গায় পুঁতে রেখেছিল, যা আর কেউ জানতো না। উইনস্টন চার্চিল নিজে খোঁজ নিয়েছিলেন সে সময়, খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, যে লোকটা জনসনকে খুন করেছে, সেই লোকটা ২০১৭ সাল থেকে অতীতে গিয়েছিল। তাই সেই সময় তিনি কিছুই করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত আফসোস নিয়েই মারা যান। সেই দায়িত্ব এখন এসে পড়ে আমার উপর। আমি কে জানো? জনসনের নাতি। আমার বাবা এখনও বেঁচে আছে, তার বাবার খুনিকে নিজ হাতে খুন করার জন্য।’ পৈশাচিকভাবে হেসে ওঠলো নেলসন।

[[চলবে…]]

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-১১

রাহাত বুঝতে পেরেছে অনেক বড়ো ভুলে পা দিয়ে ফেলেছে। একটু বেশিই লোভ করে ফেলেছিল সে। এখন তার মাসুল দিতে হচ্ছে। তার সব সঙ্গীরা লাশ হয়ে পড়ে আছে নিচে। সামিদও পড়ে আছে। একটু একটু করে নড়ছিল সে। নেলসন তার দিকে পিস্তল তাক করে পুনরায় গুলি করলো। একটা গোঁৎ শব্দ করে নিস্তেজ হয়ে গেল সামিদ। আঁতকে ওঠলো রাহাত। এই প্রথম হয়তো এতটা ভয় পেয়েছে সে। জীবনের জন্য মায়া হচ্ছে তার। তার আরও একটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। ওরা সবাইকে মেরে ফেলেছে, শুধু তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তারমানে ওরা তাকে এখনই মারতে চায় না। কথা চালিয়ে যাওয়ার কিছুটা সময় অন্তত পাওয়া গেল। রাহান ভাবতে লাগলো, কীভাবে এখান থেকে বেঁচে ফেরা যায়।

‘দেখুন, আপনাদের বুঝতে একটু ভুল হয়েছে। আমি কখনও অতীতে গিয়ে কাউকে মারিনি। তবে আমি এমন একজনকে জানি, যে অতীতে গিয়েছে, এবং এই কঙ্কালটা আমি তার কাছ থেকেই নিয়েছি।’ শেষ চালটা চালালো রাহাত। আর মনে মনে প্রার্থনা করলো যেন ওরা কথাটা বিশ্বাস করে নেয়। আর এটা তো মিথ্যাও কোনো কথা না। রিহানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো নেলসন। ‘কঙ্কালটা তুমি আরেকজনের কাছে পেয়েছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘আর সে তোমাকে কঙ্কালটা দিয়ে দিলো দামি জানা সত্ত্বেও?’

কয়েকমুহূর্ত ভেবে জবাব দিলো রাহাত, ‘না, দিতে চাইনি। আমিই জোর করে নিয়েছি।’

‘তুমি কী করে জানলে কঙ্কালটা তার কাছে আছে?’

রাহাত এবার পুরোপুরি ফেঁসে গেল। এখন যদি বলে, সে রিহানের নাতি। তবে আর রেহাই নেই, তাকে এবং রিহানকে একসাথে মারবে ওরা। রিহানের সাথে তার সম্পর্ক আছে, এটা মোটেও ফাঁস করা যাবে না। কিন্তু কিছু একটা এখন না বললে, নেলসন সন্দেহ করবে, তাই রাহাত বললো, ‘পত্রিকায় দেখেছিলাম, পরে খোঁজ পাইছি কেউ একজনের কাছে এরকম একটা কঙ্কাল আছে।’

‘কেউ একজনের কাছে এরকম একটা কঙ্কাল আছে, আর সে নিউজটা সবাইকে বলে বেড়িয়েছে? মিথ্যা বলো আমার সাথে?’ জোরে পা চালালো নেলসন রাহাতের বুকে। অনেকটা রেগে গেছে সে এবার। রাহাত কিক খেয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিল। অসহায়ভাবে উঠে বসলো সে আবার। নেলসনকে বুঝানোর চেষ্টা করতে লাগলো, ‘দেখো, আমি মিথ্যা বলছি না। আমি কখনও অতীতে যাইনি…’

নেলসন এবার আরও বেশি রেগে গিয়ে রাহাতের খোলা মুখে পিস্তলের মুখটা ঢুকিয়ে দিলো। ভয় দেখালো ট্রিগার চেপে দেয়ার। আর মুখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলো চুপ থাকতে। সে থেকে রাহাত আর মুখ খুললো না। নেলসন কার সাথে যেন ফোনে কথা বললো। ফোনের কনভারসেশন শুনে রিহান বুঝলো, নেলসনের বাবা বাংলাদেশে ল্যান্ড করবে খুব শীঘ্রি। তারপর তিনিই হয়তো রাহাতকে নিজ হাতে খুন করবে। তার বাঁচার কোনো পথ হয়তো আর খোলা নেই।

রাতেই এসে পৌঁছালেন নেলসনের বাবা ক্রিস্টোফার অ্যাডিসন। বয়স আশি-বিরাশি হবে তাঁর। তবে এখনও শক্ত সামর্থ্য। কলপ করা চুল আর ক্লিন শেভ করা চেহারাটা বয়স যেন তার অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। নেলসন তার বাবাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালো হোটেলে। অ্যাডিসন তখন উত্তেজিত। কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় যেন তাঁর নেই। প্রথমেই তিনি তাঁর বাবার খুনিকে দেখতে চাইলেন। নেলসন বাবার উদ্দেশ্য ইংরেজিতে বললো, ‘শান্ত হও বাবা। আমরা লোকটাকে আটকে রেখেছি তুমি নিজ হাতে মারবে বলে। চলো, নিয়ে যায় তোমাকে তার কাছে।’

নেলসন বাবাকে রাহাতের কাছে নিয়ে এলো। একটা কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়েছে রাহাতকে। পাশে কয়েকজন দীর্ঘদেহী পিস্তল হাতে পাহারা দিচ্ছে তাকে। দরজার সামনে এবং করিডোরেও তাদের কয়েকজন গার্ড পাহারা দিচ্ছে। অ্যাডিসন রাহাতের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মুখটা নিচু করে ছিল রাহাত। মার খেয়ে শরীরটা দুর্বল হয়ে গেছে তার। অ্যাডিসন তার মুখটা উপরে তুললেন। তারপর নিজ ভাষায় বললেন, ‘ওহ্ হো! তুমিই তাহলে সেই ব্যক্তি যে আমার বাবাকে খুন করেছিলে।’

‘স্যার, বিশ্বাস করুন। আমি আপনার বাবাকে মারিনি। আমি কখনও অতীতে যাইনি। আপনারা ভুল মানুষকে শাস্তি দিচ্ছেন।’ হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বললো রাহাত কথাগুলো।

‘১৯৪২ সালের সেই দিনটি ছিল আমার জন্মদিন, জানো? আমি তখন খুব ছোটো ছিলাম। আমার ষষ্ঠ জন্ম-বার্ষিকী ছিল ওটা। সেই সময় এখানেই থাকতাম আমরা স্বপরিবারে। আমার এখনও মনে আছে, একটা খোলা মাঠে আমি ঘোড়ার উপর বসেছিলাম সেদিন। আমার বাবা এলেন আমার কাছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ক্ষমা চাইলেন। তারপর বললেন তাঁকে একটু ক্যাম্পে যেতে হবে। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ, সন্ধ্যার পরপরই আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠান শুরু হবে। তবে, বাবা আমাকে সান্ত্বনা দিলেন যে, তিনি ঠিক সময়ে উপস্থিত হবেন। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। ওটাই ছিল বাবার সাথে আমার শেষ কথপোকথন।’ থামলেন অ্যাডিসন। রাহাত মুগ্ধ শ্রোতার মতো কথাগুলো শুনতে লাগলো। অ্যাডিসন দম নিয়ে পুনরায় বলতে লাগলেন, ‘পরে মি. উইনস্টন নিজ দায়িত্বে খোঁজ করেন আমার বাবার। মসজিদের এক লোকের কাছে জানা যায়, সেই রাতে মসজিদে দুজন অতিথি আসে। একজন পুরুষ, অন্যজন নারী। পুরুষ লোকটা না-কি কয়েকজন ব্রিটিশকে হত্যা করে সেই রাতে। তাদের মধ্যে আমার বাবা জনসনও ছিল। তিনি যে গাড়িটা নিয়ে বের হয়েছিল, গাড়িটা ওখানেই পাওয়া যায়।’

‘কিন্তু আপনার বাবার হত্যাকারীকে ২০১৮ এসে খোঁজ করছেন কেন? আপনারা কী করে জানলেন তাকে এই সময়ে পাওয়া যাবে?’ সাহস করে প্রশ্নটা করলো রাহাত।

‘সেই সময় লোকটা না-কি মসজিদে বিয়ে করে ওই মেয়েটাকে। বিয়ে করার সময় লোকটা নিজের পরিচয় বলতে গিয়ে বলেছিল, সে ভবিষ্যত থেকে অতীতে গেছে। মি. উইনস্টন তার সম্পর্কে আরও অনেক খোঁজ নেন। তাকে ব্রিটিশরা যে জায়গা থেকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে এসেছিল, সেই জায়গায় খোঁজ নিয়েছিল। ওখানেও একই তথ্য পাওয়া যায়। এসব তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও, কথাটার উপর ভরসা করেছিলেন। তাই তিনি বলে গেছেন এই সময়টাতে এসে যেন আমরা জনসনের ব্যাপারে খোঁজ করি। এতগুলো বছর আমরা অপেক্ষা করেছি শুধুমাত্র তোমার জন্য। আজ নিজ হাতেই আমি তোমার দেহ থেকে কলিজাটা বের করে নেবো। আমাকে পিতৃহারা করার মাসুলটা আজ তোমাকে দিতেই হবে।’ কথাগুলো বলার সময় অ্যাডিসনের চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছিল। পাশে তাঁর ছেলে নেলসন দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে হাত বাড়িয়ে একটা পিস্তল নিলেন অ্যাডিসন। রাহাত ভয়ে বলে উঠলো, ‘স্যার, স্যার, আমার কথা শুনুন। আমি খুন করিনি আপনার বাবাকে।’

‘চুপ কর বাস্টার্ড!’ শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে রাহাতের মুখে ঘুষি চালালেন অ্যাডিসন। বাইরের করিডোরে তখন শোরগোল শোনা গেল। সাথে সাথে গুলির শব্দও এলো কয়েকটা। অ্যাডিসন অবাক হয়ে তাকালেন ছেলের দিকে। নেলসন দৌড়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলির শব্দ হলো। তারপর নেলসন একজনকে ধরে আনলো ভেতরে। অ্যাডিসন উত্তেজিত হয়ো জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হচ্ছে এসব বাইরে?’

‘বাবা এই লোকটা আমাদের উপর হামলা করেছে। বাইরে আমাদের কয়েকজন গার্ডকে মেরে ফেলেছে সে।’

রাহাত দেখলো, যে লোকটাকে ওরা ধরে এনেছে, ওটা রিহান। রিহানের চেহারায় কোনো ভয় দেখতে পেল না সে। অ্যাডিসন চিৎকার করে উঠলো, ‘একেও বেঁধে ফেলো। আজ দুইজনকে একইসাথে মারবো।’

রাহাতের যেন এটাই সুযোগ নিজেকে এই বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার। তাকে মুক্ত করতেই যেন ভাগ্য রিহানকে এখানে টেনে এনেছে। রাহাত সময় ব্যয় না করেই বলে ফেললো, ‘স্যার, স্যার, এই সেই লোক, যে আপনার বাবাকে মেরেছে। এই লোকটাই অতীতে গিয়েছিল।’

‘অতীত! আমি কখন অতীতে গেলাম? কীসের অতীত?’ রিহান অবাক হওয়ার ভান করলো। তখন অ্যাডিসন বলে উঠলো, ‘যেই মারোক, তোমাদের দুজনের মধ্যে একজন তো হবেই। এখন দুজনকেই মেরে ফেললে, আমার প্রতিশোধটাও নেয়া হবে। তাই আমার মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে লাভ নেই।’

রাহাতকে হতাশ দেখা গেল। তার শেষ সুযোগটাও মিস হয়ে গেল। রিহানকে তার পাশে বাঁধা হলো। রাহাত তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন এসেছ এখানে? কী উদ্দেশ্য তোমার?

‘তোমাকে ফলো করছিলাম। পরে দেখি তুমি বিপদে পড়েছো। দাদা হিসেবে আমি বসে থাকতে পারিনি। ছুটে এলাম বাঁচাতে।’ এমনভাবে কথাগুলো বললো রিহান, যেন তার কিছুই হয়নি। রাহাত বুঝলো, সে ব্যঙ্গ করছে তার সাথে। দাঁতে দাঁত ঘষে সে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন এসেছ বলো। দেখো, আজ তোমার জন্যই আমাকে মরতে হচ্ছে এভাবে। সব তোমার কর্মফলে।’

‘আসলেই আমি তোমাকে বাঁচাতে এসেছি। তোমাকে না বাঁচালে, আমি নাজমুলের খুনের দায়ে ফেঁসে যাবো। আমার পেছনে পুলিশ তাড়া করছে।’

‘হা হা হা।’ হেসে ওঠলো রাহাত। ‘আমাকে বাঁচাতে এসেছো? এখন দেখো নিজেও মরতে বসেছো আমার সাথে। তুমি কি ওদের হাত থেকে বাঁচতে পারবে ভেবেছো?’

‘কিন্তু আমি মিথ্যা মামলার আসামি হতে চাই না। যে খুনটা তুমি করেছো, সেই খুনের দায় আমি নিতে চাই না।’

‘এখন আর কী হবে এসব বলে। হ্যাঁ, আমিই করেছি খুনটা। কিন্তু, তুমি দায়টা নিলে বড়োজোর কয়েকটা বছর জেল খাটতে। এখন কী হলো? সামনের মিনিটটাও আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অনিশ্চিত।’

‘আমার আর আফসোস নেই। যাক, তুমি অন্তত সবার সামনে স্বীকার তো করলে যে খুনটা তুমি করেছো।’ হাসলো রিহান।

‘সবার সামনে স্বীকার করছি মানে কী? কী বলতে চাচ্ছো তুমি?’ অবাক হলো রাহাত।

‘কিছু না। অফিসার, আপনার এন্ট্রির টাইম হয়েছে। আপনার ধামাকা এন্ট্রি চাই কিন্তু।’ চোখ বন্ধ করে গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বলে ওঠলো রিহান। রাহাত আরও বেশি অবাক হলো। এই লোকটা পাগল হয়ে যায়নি তো। এভাবে কাকে ডাকছে সে? কে এন্ট্রি নেবে?’

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here