টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),০৮,০৯

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),০৮,০৯
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০৮

রাহাতের হাতে কঙ্কালটির ডিএনএ রিপোর্ট এসে যখন পৌঁছে, তখন যেন সে পৃথিবী জয় করেছে, এমন আত্মহারা। রিপোর্টগুলো সে পত্রিকায় প্রাপ্ত ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলো, সাথে নিজের সমস্ত পরিচয়, যাতে পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য থেকে ওরা তার সাথে যোগাযোগ করে কঙ্কালটি নিয়ে যায়। রাহাত বেশ খুশি, কঙ্কালের ডিলটা সম্পন্ন হলেই তার হাতে দুইশো কোটিরও অধিক টাকা এসে পড়বে। রাহাত খুশিতে সামিদকে জড়িয়ে ধরলো। হাসতে হাসতে বললো, ‘সামিদ, ভাবতে পারো আমাদের অবস্থানটা কোথায় হতে চলেছে? তোমরা চাইলে আমার তরফ থেকে একটা পার্টি নিতে পারো এখনই।

‘বস, আমার একটু সন্দেহ আছে এখানে।’ উদ্বিগ্ন দেখালো সামিদকে।

‘কী সন্দেহ?’

‘বস, লোকটা এত সহজে কঙ্কালটা দিয়ে দিলো। কিন্তু চাইলেই সে আমার সাথে একটু ঝামেলা করতে পারতো কঙ্কালটা যখন নিচ্ছিলাম। কিছুই করলো না। কিছুটা সন্দেহ তো থেকেই যায়। কঙ্কালটা আসলেই জনসনের তো?’

‘আহ্ সামিদ, তুমি বড্ড সন্দেহপ্রবন। লোকটা কি জানতো যে আমরা তার পিছু নেবো? যদি জানতো, তবেই না পূর্বে সতর্ক হয়ে আরেকটা রাখতো সাথে। এখন আমরা হুট করে তাকে ধরে নিয়ে আসি, কঙ্কাল বদলাবার সময় কোথায় পাবে সে?’

‘তবুও লোকটাকে আমার সুবিধের মনে হয়নি।’

‘১৯৪২ সালে গিয়ে লোকটা ব্রিটিশ মেরে এসেছে। বিপজ্জনক তো হবেই। তবে, কঙ্কালের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো।’

‘লোকটা কি আসলেই অতীতে গিয়েছিল বস?’

‘হ্যাঁ, অতীতে গিয়েছে। এতক্ষণেও বুঝোনি তুমি? যার কঙ্কালটা আমরা খুঁজছি সেই ব্রিটিশকে রিহান নিজেই মেরেছে।’

‘তা তো বুঝছি। কিন্তু কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না। এভাবে কি অতীতে যাওয়া যায়?’

‘যায় না। কিন্তু লোকটা কোনো একভাবে অতীতে গেছে এটা তুমি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করে নাও।’

‘কিন্তু লোকটার ব্যাপারে আপনি এতকিছু কীভাবে জানেন বস?’

সামিদের দিকে কয়েকমুহূর্ত চেয়ে থাকে রাহাত। তারপর কাঁধে আলতো করে হাত চাপড়ে বললো, সব প্রশ্নের উত্তর জানতে নেই সামিদ। কঙ্কালটা যে আমাদের হাতে এসেছে, এই খুশিতে তোমরা পার্টি করো।’ বলেই রাহাত চলে যেতে লাগলো।

বাড়ির সামনে একটা ট্যাক্সি থেকে নেমে রিহান ভাড়া দিচ্ছিলো। সে সময় একটা পুলিশ-ভ্যান এসে থামে তার পাশে। পুলিশ-ভ্যান থেকে অফিসার সঞ্জু নেমে প্যান্ট ঠিক করতে করতে এগিয়ে এসে বলে, ‘মি. রিহান, এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেলেন? ভালো ডাক্তারের সেবা নিয়েছিলেন নিশ্চয়ই।’

‘আমি অসুস্থ ছিলাম না।’ সঞ্জুর দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো রিহান। ভাড়া পেয়ে ট্যাক্সিটা তাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

‘জানি। আপনার ডাক্তার ইতোমধ্যে আমাকে সেটা জানিয়েছেন। হয়তো আপনি মানসিক ভারসাম্যহীন সাজতে চেয়েছিলেন, যাতে নাজমুল হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যেতে পারেন, তাই না মি. রিহান?’

‘আমি কোনো খুন করিনি।’ বলেই বাড়ির বারান্দার দিকে তাকালো রিহান। ওখানে তার বাবা রহমান সাহেবের সাথে চোখাচোখি হলো তার। রহমান সাহেব ছেলের অবস্থা দেখে নিচে নেমে আসতে লাগলেন।

‘আপনি খুন করেছেন না-কি করেননি সেটা থানায় প্রমাণিত হবে। চলুন আমাদের সাথে। আসুন, গাড়িতে ওঠুন।’

দ্রুতপায়ে রহমান সাহেব হেঁটে আসতে আসতে সঞ্জুর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘অফিসার, আমার ছেলেকে ছেড়ে দিন। ও খুন করেনি।’

‘কিছু মনে করবেন না রহমান সাহেব। আমাদের দায়িত্বটা আমাদেরকে পালন করতেই হবে। আপনার ছেলে নির্দোষ হলে ফিরে আসবে। ভয় কীসের?’

‘না, আমি আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে দেবো না।’ রিহানের হাত ধরে থাকলেন রহমান সাহেব। রিহান তার বাবাকে বুঝিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলো। তারপর নিজে সে পুলিশ-ভ্যানে উঠে বসলো।

ডাক্তার শহিদ নিজের ক্লিনিক থেকে বের হচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে কোথা থেকে যেন হাজির হলো রিহান। তাকে আকস্মিক দেখে কিছুটা অবাক হলো শহিদ। তবে খুশিই হয়েছে সে। ‘রিহান সাহেব যে! মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।’

‘মেয়েটা কোথায়? শান্তা?’

‘চলুন দেখিয়ে আসি।’ কিছুটা হেঁটে একটা বেডের দিকে ইশারা করলো শহিদ, ‘ওই যে।’

রিহান দেখলো, একটা মেয়ে প্যারালাইজড রোগীর মতো হা করে উপরদিকে তাকায় আছে। দেখে কষ্ট হলো রিহানের। মেয়েটার এমন অবস্থার জন্য সে নিজে দায়ী।

‘মেয়েটাকে সুস্থ করে তুলো।’ বললো রিহান।

‘কিন্তু কিছু ফর্মালিটি যে পূরণ করতে হবে আপনাকে।’

‘যা করার দ্রুত করো। আমার পেছনে পুলিশ। পালিয়ে এসেছি আমি। যেকোনো মুহূর্তে এখানে পুলিশ চলে আসতে পারে।’

‘সমস্যা নেই, আপনি বলার পর থেকে আমি উইলের কাগজ সাথে সাথেই রাখি। শুধু আপনার একটা কলমের খোঁচা প্রয়োজন।’

‘দাও, সাইন করে দিচ্ছি। এসব সম্পত্তির উপর কোনো লোভ নেই আমার।’

শহিদ উইলের কাগজটা এগিয়ে দিলে, রিহান তাতে সাইন করে দিলো। তারপর শহিদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এবার মেয়েটাকে সুস্থ করে তুলো।’

‘তা তো তুলবো। শান্তাকে আমি ভালোবাসি, তাকে বিয়ে করবো। সুস্থ তো করতেই হবে। কিন্তু, তার আগে দাদা নাতি মিলে একটু জড়িয়ে ধরি।’ হেসেই জড়িয়ে ধরলো শহিদ রিহানকে। তারপর কানেকানে ফিসফিস করে বললো, ‘কিছুক্ষণ পর আমার লোকেরা এক বৃদ্ধা মহিলাকে তুলে নিয়ে যাবে। মহিলাটার বয়স ৯৫-১০০ হবে। আমার লোকেরা তাকে মেরেও ফেলবে। জানেন সে কে? আপনার সুফিয়া।’

‘হোয়াট!’ শহিদকে দুহাতে ঠেলে সরিয়ে দিলো। ‘প্লিজ এমনটা করো না। তোমার লোকদের ফিরে আসতে বলো। আমাকে সুফিয়ার সাথে শেষ দেখাটা অন্তত করতে দাও।’

‘আহ্, বুড়িটার উপর সব রাগ আজ মিটিয়ে নেবো। ছোটোবেলা থেকেই শত অপমান গায়ে মেখে বড়ো হয়েছি। কেন জানো? ওই বুড়িটার জন্য। আর তোমার জন্য। তোমরা যদি এমন বিয়েটা না করতে আমার বাবারও জন্ম হতো না, আমারও জন্ম হতো না। আমার বাবা তো আরও বেশি অপমান সহ্য করেছে। লোকে আমাদের দেখে টিটকারি দেয়, পাগল বলে। বলে, আমার দাদির অবৈধ সন্তান আমার বাবা৷ ভবিষ্যত থেকে কেউ একজন গিয়ে তাকে বিয়ে করেছে, এগুলো তার বানানো গল্প। সবাই বলে, কেউ একজন আমার দাদির সাথে দুয়েকদিন ফুর্তি করেছে, তারপর পালিয়ে গেছে। এসব কথা গায়ে মেখে মেখে বড়ো হয়েছি আমরা। লোকে আমাদেরকে নিচু চোখে দেখে। একসময় পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে আমরা দুই ভাই আলাদা হয়ে যায়।

‘আরেক ভাই কে?’

‘রাহাত খান। এখনও পরিচয় হয়নি ওর সাথে?’

‘হয়েছে। খুব ভালো করে পরিচয় হয়েছে ওর সাথে।’

‘তবে তো নিজের আরেক শত্রুর সাথে ইতোমধ্যে তোমার পরিচয় ঘটে গেছে। তুমি তোমার সুফিয়াকে দেখতে উদগ্রীব হয়ে আছো। আর আমরা তোমার অসহায়ত্ব দেখতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি। আমাদের দুই ভাইয়ের জীবনটাকে তুই বিষিয়ে তুলেছিস।’ চিৎকার করে উঠে জোরে পা চালালো শহিদ রিহানের পেটে। ছিটকে দূরে গিয়ে পড়লো রিহান। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে বললো, ‘সুফিয়ার প্লিজ কোনো ক্ষতি করো না।’ হাতজোড় করলো রিহান।

‘হ্যাঁ, এক্সাক্টলি। তোর এই অসহায়ত্বটাকেই আমি দেখতে চাইছি। তোর সুফিয়াকে তুই দেখতে চাইবি, কিন্তু দেখতে পাবি না।’ হাতঘড়িতে টাইম দেখে নিলো শহিদ। ‘আর ত্রিশ মিনিট সময় আছে তোর হাতে। পারলে গিয়ে বাঁচিয়ে নে ওকে।’

রিহান আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত বের হয়ে গেল ক্লিনিক থেকে। ফোনটা বের করে ইউসুফ সাহেবের নাম্বারে ডায়াল করলো সে। কিন্তু, সংযোগ পেল না। অনেকবার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হলো। এদিকে ইউসুফ সাহেবের বাসার ঠিকানাটাও তার জানা নেই। কী করবে বুঝতে পারছে না। অফিসে বেশ কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করলো সে। কিন্তু কেউ জানে না ইউসুফ সাহেবের ঠিকানা। আসলে তিনি একা থাকতে পছন্দ করেন। তাই নিজের পার্সোনাল কোনোকিছুই কাউকে জানতে দেন না। শেষে কূল-কিনারা না পেয়ে রাস্তায় হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো রিহান। সুফিয়ার সাথে বুঝি আর কখনও দেখা হবে না তার। যা হয়েছে সব অতীতেই হয়েছে।

ফোনটা বেজে ওঠলো রিহানের। রিসিভ করতেই রাহাতের রুক্ষ গলা শোনা গেল, ‘আহ্ রিহান সাহেব, আহ্! কী গেইমটাই না খেললেন আমার সাথে। আমি তো ভাবতেও পারিনি। শেষ পর্যন্ত কার না কার কঙ্কাল একটা আমাকে ধরিয়ে দিলেন, আর জনসনের কঙ্কালটা নিজেই রেখে দিলেন? বোকা বনে গেলাম!’

‘আমি তো বলেছি ওটা তুমি কখনও পাবে না। কিন্তু, তুমি যদি একটু সৎ হতে, যদি তোমার আসল পরিচয়টা দিতে, যদি বলতে তুমি আমারই বংশধর, তবে কঙ্কাল কেন, নিজের জীবনটাই দিয়ে দিতাম। কিন্তু তুমি এমনই এক শয়তান, মানুষের আবেগ নিয়ে খেলতেও দ্বিধাবোধ করো না।’

‘আহ্, আস্তে রিহান সাহেব আস্তে, কানে লাগছে আপনার কথাগুলো। তবে অবাক হলাম, শেষ পর্যন্ত আমার পরিচয়টা জেনেই ছাড়লেন?’

‘হ্যাঁ জেনেছি, আমার নিজের রক্ত থেকে একটা শয়তানের জন্ম হয়েছে। একটা না, অবশ্য দুইটা শয়তানের জন্ম হয়েছে৷ কী করে পারলে তুমি নিজের দাদি সম্পর্কে এমন মিথ্যা কথা বলতে? কী করে পারলে অন্য একজনের কবর দেখিয়ে বলতে এটা সুফিয়ার কবর? অবশ্য আমি সেদিনই বুঝেছিলাম যে তুমি মিথ্যা বলছো৷ যে লোকটা এতটা পাষাণ, এতটা লোভী তার মনে কখনও কোনো বৃদ্ধা মহিলাকে রাস্তায় অসহায় পড়ে থাকতে দেখলেও মায়া জন্মাবে না। কিছু অর্থের জন্য তুমি নিরীহ একটা গেইট-কিপারকে খুন করেছো, আর তুমি কি-না গেছ বৃদ্ধা সুফিয়াকে মায়া দেখাতে? কোনোটাই আমি বিশ্বাস করিনি। তাই নকল কঙ্কালটাই তোমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। যেদিন জনসনের কঙ্কালটা আমি তুলে আনি, সেদিন আরও একটা কঙ্কাল আমি সংগ্রহ করি, কারণ এমন কিছু একটা ঘটবে আগে থেকেই সন্দেহ ছিল কিছুটা।

‘হা হা হা’ হাসলো রাহাত। তারপর বললো, ‘বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয় মি. রিহান। কিন্তু আমার একটা অভ্যাস, যেটা অর্জন করতে আমি একবার লেগে পড়ি, সাকসেস না হওয়া পর্যন্ত থামি না। কঙ্কালটা নিজেই আমার হাতে তুলে দিবেন আপনি। কেন জানেন?’

চুপ করে শুনতে লাগলো রিহান। দম নিয়ে রাহাত পুনরায় বলতে লাগলো, ‘কারণ, আমি একটু পরই খুন করতে যাচ্ছি আপনার ঔরসজাত সন্তানকে। যিনি সম্পর্কে অবশ্য আমার বাবা, ইউসুফ খানকে। নিজের বাবাকে খুন করতে কষ্ট হবে, তাই আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। তোমার হাতে সময় আছে বিশ মিনিট৷ এর ভেতর কঙ্কালটা নিয়ে হাজির হও। নয়তো উনাকেই লাশ হিসেবে দেখতে হবে।’

ফোন কেটে গেল। রিহান জোরে চিৎকার করে ওঠলো রাস্তায়। এবার সত্যি নিজেকে খুব অসহায় লাগছে তার। একদিকে ইউসুফ সাহেব, তার নিজেরই ছেলে, অন্যদিকে সুফিয়া, কাকে বাঁচাতে ছুটে যাবে সে। কিন্তু সুফিয়ার ঠিকানাটাও তো সে জানে না। কীভাবে বাঁচাবে সে তাকে? এদিকে সময় দ্রুত কেটে যাচ্ছে।

[[চলবে…]]

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০৯

‘বস, আগেই বলেছিলাম লোকটাকে আমার সুবিধের মনে হয়নি। দেখলেন তো কেমন বোকা বানালো আমাদের?’ রাহাতের উদ্দেশ্যে বললো সামিদ। রাহাত সে সময় এদিক থেকে ওদিকে উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করছিল। কিছুক্ষণ আগেই যুক্তরাজ্য থেকে তাকে কনফার্ম করেছে, তার দেয়া ডিএনএ রিপোর্টটা ওদের রিপোর্টের সাথে মিলেনি। তারপর থেকেই উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করে যাচ্ছে সে এভাবে। সব রাগ গিয়ে পড়েছে রিহানের উপর। রিহান যে এভাবে ডাবল গেইম খেলবে সে ধরতেই পারেনি।

একপাশে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে ইউসুফ সাহেবকে। হাত আর চোখ বাঁধা। তবুও পেছনে দুজন গার্ড পিস্তল হাতে পর্যবেক্ষণে রেখেছে তাঁকে। তবে নিজেকে ছাড়ানোর কোনো চেষ্টা তাঁর মাঝে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো শত কষ্টে তাঁর ইচ্ছেশক্তি সব অবশ হয়ে গেছে। অথবা নিজ ছেলের এমন আচরণ দেখে তিনি বড়োসড়ো শক খেয়ে গেছেন। ইউসুফ সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো রাহাত। তারপর কোমরে দুহাত রেখে সে বললো, ‘বাবা, অনেকদিন পর বাপছেলে এভাবে মুখোমুখি হবো ভাবতে পারিনি। সেই যে আমরা আলাদা হয়ে গেছিলাম, মাঝখানে মনে হয় আর দেখা হয়নি। কত বছর হবে যেন? আট-নয় বছর হবে নিশ্চয়ই।’

‘হ্যাঁ, এই দীর্ঘ সময়টা আমি আমার দুই ছেলের কাছ থেকে দূরে আছি। কিন্তু সবসময় তোদের খোঁজ রাখতাম, কেমন আছিস, কোথায় থাকছিস। শুনেছি বিয়ে করেছিস, বাবা হিসেবে আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করিসনি, তাতে আমি দুঃখ পাইনি। তবে আজ যে দুঃখটা আমার মনে দিলি, শুধু ভাবছি মুহূর্তটা আসার আগে যদি মরণ হতো আমার! বাবা হিসেবে আমি ব্যর্থ এক বাবা।’

‘আসলেই ব্যর্থ বাবা তুমি। নয়তো নিজ সন্তানের কথা চিন্তা না করে তুমি অর্ধেক সম্পদ উইল করে দিতে না কোথাকার কোন এক লোকের নামে।’

‘সেই লোকটা আমার বাবা, আর তার নামে যে সম্পদ উইল করা হয়েছে, সেই সম্পদের মালিক আমার মা, মানে তার স্ত্রী।’

‘বাবা, ওটা স্রেফ একটা দুর্ঘটনা ছিল। এই যে তুমি, আমি আর শহিদ, আমরা হলাম সেই দুর্ঘটনার ফসল। লোকটা অতীতে গেছে, সে জানতো যে সে ওই সময়ের কেউ নয়, তবুও সে বিয়ে করেছে সেই সময়ের একটা মেয়েকে। তাদের এই ভুলটার জন্য সারাজীবন আমরা লাঞ্ছনা সহ্য করেছি। বাবা, তুমিও তো কম অপমানিত হওনি, তবে তুমি কী করে রিহান নামের লোকটার পক্ষে কথা বলছো? তোমার এখন উচিত লোকটাকে কাছে পেয়েছো, এবার সকল লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নেয়া।’

‘আমি সেটা পারবো না। কারণ আমি তোর মতো না। তুই তোর নিজের পিতাকে হত্যা করতে পারলেও, আমি সেটা পারবো না।’

‘আহ্ বাবা, নীতিকথা বন্ধ করো তোমার। তুমি সব লাঞ্ছনা ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি, শহিদও ভুলেনি। আমরা দুইভাই আমাদের প্রতিশোধ নেবো, লোকটাকে তিলে তিলে শেষ করবো। তুমি তাকে বাবা হিসেবে স্বীকার করলেও, আমি তাকে কখনও আমার দাদা হিসেবে মেনে নেবো না।’

‘বস…’ পেছন থেকে ডাকলো সামিদ।

‘হুমম, বলো।’ ঘুরে তাকালো রাহাত।

‘বস, এবার বুঝেছি কেন আপনি এতকিছু জানেন রিহানের ব্যাপারে। আসলে গল্পটা আপনারই পূর্ব বংশের গল্প জানা ছিল না আমার।’

রাহাত মাথা দুলালো কেবল। তার ফোনটা বেজে ওঠলো। রিহান ভিডিয়ো কল দিয়েছে। কয়েক মুহূর্ত ভেবে ফোনটা রিসিভ করলো রাহাত। স্ক্রিনে রিহানের হাস্যোজ্জ্বল মুখ ভেসে ওঠলো। রাহাত ভেবে পেল না, এই সময়ে লোকটার মুখে হাসি কেন? লোকটা পাগল হয়ে গেল না তো? না-কি অন্য কোনো ফন্দি এঁটে ফেলেছে ইতোমধ্যে?’

‘কী মি. রিহান, এই মুহূর্তে আপনার মুখে তো হাসি আশা করিনি।’ ভ্রু কুঁচকালো রাহাত।

‘হাসি কী আর নিয়ম মেনে আসে মি. রাহাত, ওরফে আমার নাতি?’ ব্যঙ্গ করলো রিহান। ‘যে জন্য ফোন দিয়েছি শুনো। এই যে আমার হাতে একটা রিপোর্ট দেখতে পাচ্ছো, এটাই হলো কঙ্কালটার ডিএনএ টেস্টের আসল রিপোর্ট। তুমি যদি আমাকে একটা উপকার করো, তবে কঙ্কাল এবং রিপোর্ট দুইটাই তোমার হাতে তুলে দিবো, আর তুমি যুক্তরাজ্যের সেই লোকগুলোর কাছে মেইল করে পাঠাতে পারবে। আর তুমি যদি আমার উপকারটা না করো, তবে কী করতে যাচ্ছি তা তুমি ভাবতেও পারবে না।’

‘তা কী করতে যাচ্ছেন শুনি?’

‘কঙ্কালটা আমি গভীর সাগরে ফেলতে যাচ্ছি। চোখের সামনেই জলে ডুববে দুইশো কোটি টাকার সম্পদ। তোমার আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।’

‘না, মি. রিহান। আপনি এমনটা করবেন না। বলুন আপনার কী উপকার করতে হবে?’

‘এইতো পয়েন্টে আসছো। তোমার ভাই শহিদের কিছু লোক সুফিয়াকে তুলে নিয়ে গেছে। তুমি তাকে বাঁচিয়ে আনবা। বাবার সাথে তোমার সম্পর্ক ভালো না থাকলেও, ভাইয়ের সাথে নিশ্চয়ই ভালো সম্পর্ক আছে তোমার।’

‘বেশ, আমি দাদিকে বাঁচিয়ে নেবো। তবে তুমি কঙ্কালটার কোনো ক্ষতি করবে না।’

‘টাইম দশ মিনিট। এর ভেতরেই সুখবরটা না পেলে আমি কী করবো বুঝতেই তো পারছো।’ ফোন কেটে দিলো রিহান।

ঠিক দশমিনিট পর রাহাতের ফোন এলো। ফোন রিসিভ করে রিহান সুখবরটা জানতে চাইলো, তখন রাহাত দুর্বল কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘এমনটা কেন করলেন মি. রাহাত? কেন আপনি শহিদকে মেরে ফেললেন?’

‘হোয়াট! শহিদকে মেরে ফেলছি মানে? আমি কখন মারলাম ওকে?’

‘এই যে, ওর লাশটা পড়ে আছে ওর ফ্ল্যাটে। বুকে আর কপালে দুইটা গুলি লেগেছে। তার সাথে আরও কয়েকজনের লাশ আছে।’

‘সুফিয়া? সুফিয়া কোথায়?’ উত্তেজিত হলো রিহান।

‘দাদি কোথাও নেই।’

‘মিথ্যা বলছো তুমি। তুমিই মেরেছো হয়তো সবাইকে, যেভাবে তোমার গেইট-কিপারকে মেরেছ। আর সুফিয়াকে নিয়ে গেছ।’

‘আমি মারিনি আমার ভাইকে।’ চিৎকার করে ওঠলো রাহাত। ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক আমার ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ তেমন হতো না। কিন্তু আমরা পরস্পরকে ভালোবাসতাম। কারণ আমরা দুইভাই একইভাবে লাঞ্ছিত হয়ে বড়ো হইছি।’

রিহান এবার চিন্তায় পড়ে গেল। শহিদকে রাহাত না মারলে কে মারবে? আর সুফিয়া? সে কোথায়? তাকে কে নিয়ে গেছে? সুফিয়ার এই বয়সে তার এত শক্তি থাকবে না যে নিজেই সবাইকে মেরে পালিয়ে যাবে। তবে কী ঘটলো তার সাথে?

‘শুনুন মি. রিহান, ভাই হারিয়েছি, আফসোস নেই। বাবাকেও হয়তো হারাবো, নিজ হাতে মারবো আমি। এসব না চাইলে কঙ্কালটা আমার হাতে তুলে দিন। তারপর আপনার সাথে আমার ঝামেলা শেষ হবে।’

‘বেশ! কঙ্কালটা আমি দেবো। তবে ডিল হয়ে যাক একটা। ইউসুফ সাহেবকে আমার কাছে নিয়ে আসুন।’

‘ওকে ডান। কোথায় মিট হবে বলুন।’

দুজনে সম্মতি হলো দেখা করতে। তারপর দুজনে ঠিক করলো কোথায় দেখা করবে। ঠিক দু’ঘণ্টা পর ওরা দেখা করলো। দুজনের হাতেই ছিল পিস্তল। তবে কেউ ঝামেলা করলো না কারও সাথে। রিহান রাহাতের হাতে কঙ্কালটা তুলে দিলো, তারপর ইউসুফ সাহেবকে নিয়ে ফিরে চললো। ফিরতে ফিরতে রিহান তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ডাক্তার শহিদ মারা গেছে, শুনছেন?’

‘না।’ শহিদের মৃত্যু খবর শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না ইউসুফ সাহেব। তবে চোখ বেয়ে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। হাত দিয়ে তা মুছতে মুছতে বললো, ‘ওর এমন পরিণতি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি আমার ছেলে দুইটাকে মানুষ করতে পারিনি। আসলে বাবারা কেমন তা তো আমি খুব একটা জানি না। বাবার আদর আমি পাইনি। তাই হয়তো বাবা হিসেবে আমিও ব্যর্থ। তবে, শেষবারের মতো ওর লাশটা একবার দেখাতে নিয়ে যাবে আমাকে?’

‘ওর ফ্ল্যাটেই ওকে মারা হয়েছে। হয়তো এতক্ষণে পুলিশ এসে নিয়ে গেছে লাশটা। আপনি থানায় খোঁজ নিলেই পাবেন। আমি পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি, জানেন তো?’

‘বেশ, আমিই খোঁজ নেবো। আমার মায়ের খবর কিছু জানো?’

‘না, শহিদের লোকেরা সুফিয়াকে তুলে নিয়ে গেছিল। হয়তো শহিদের ফ্ল্যাটেই নিয়ে গেছিল সুফিয়াকে। পরে সবাইকে কে যেন মেরে সুফিয়াকে নিয়ে যায়।’

‘আমি জানি কে করেছে এই কাজটা। এই কাজ একজনের দ্বারাই সম্ভব।’

‘কে সে?’

‘ইকবাল। আমার ছোটো ভাই।’

‘ছোটো ভাই আপনার? মানে? কেমন ছোটো ভাই?’

‘আমার এক মায়ের পেটের ভাই।’

‘সুফিয়ার ছেলে? সুফিয়া কি আবারও বিয়ে করেছিল?’

‘না। বিয়ে করেনি। আমরা দুইভাইয়ের জন্মদাতাও একজন। সেটা তুমি।’

‘তবে কি সেই সময় সুফিয়ার জমজ বাচ্চা হয়েছিল?’

‘না।’ মুখে হাত দিয়ে খকখক করে কাশলেন ইউসুফ সাহেব, ‘ইকবাল আমার চেয়ে বিশ-বাইশ বছরের ছোটো।’

‘তাহলে ওর বাবা আমি কেমনে হবো? আমি যখন অতীত থেকে আসি, তখন তো সুফিয়ার গর্ভে শুধু আপনিই ছিলেন।

‘কারণ, তুমি আরও একবার অতীতে গিয়েছিলে পরে। আমাদের সময়ের ছিল ১৯৬৪ সাল, আর তোমার সময়ের ২০২২ সাল।’

‘হোয়াট!’ হাজারো বিস্ময় ঘিরে ফেলে রিহানের সারা চেহারা। ‘আমি দ্বিতীয়বারের মতো আবারও অতীতে গিয়েছি?’

‘হ্যাঁ, আমাদের সাথে থেকেছো, আমাকে আদর করেছো। ইকবালের নামটা তুমি নিজেই রেখেছিলে সেই সময়।’

‘ইকবালের নাম আমি নিজে রেখেছি?’

‘হ্যাঁ। আমরা কিছুদিন খুব সুখে কাটিয়েছিলাম সেই সময়। তারপর আবার সবকিছু আগের মতো হয়ে যায়।’

অবাক হয়ে চেয়ে থাকে রিহান ইউসুফ সাহেবের দিকে। এখন কেবল ২০১৮ সাল চলে। তারমানে আর ৪ বছর পর সে পুনরায় অতীতে যাবে।

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here