টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),০২,০৩

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),০২,০৩
লেখা: ShoheL Rana শামী
পর্ব:-০২

কয়েকটা শপিংমল ঘুরে রিহান দুটো শাড়ি কিনলো সুফিয়ার জন্য। নীল আর খয়েরি রঙের শাড়ি দুটোতে সুফিয়াকে নিশ্চয়ই খুব ভালো মানাবে। শাড়ি পরে সে রিহানের সামনে লাজুকমুখ নিয়ে যখন দাঁড়াবে, লজ্জায় তার দিকে তাকাতেই পারবে না। রিহান আলতো করে তার মুখটা তুলে কপালে চুমু খাবে। সুফিয়া পালাতে চাইবে, রিহান তার হাতটা টেনে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে নেবে। ভাবতেই রিহানের ঠোঁটে মৃদু লাজুক হাসি ফুটে ওঠলো। আচমকা তার ভাবনায় ছেদ পড়লো খানিক দূরে এক দীর্ঘদেহী লোককে দেখে। দেখেই লোকটাকে চিনতে পারে সে। এই লোকের নেতৃত্বেই চট্টগ্রামে তার উপর কয়েকবার হামলা হয়েছিল। রিহান লোকটার পিছু নিলে লোকটা টের পেয়ে যায়, তারপর প্রাণপণ দৌড়াতে থাকে। রিহানও শাড়ির প্যাকেটটা একহাতে শক্ত করে ধরে দৌড়াতে থাকে লোকটার পিছুপিছু। কিন্তু আফসোস, লোকটাকে সে হারিয়ে ফেলে একটা ভিড়ের মাঝে। রিহান আশেপাশে লোকটাকে বেশ কিছুক্ষণ খুঁজে ব্যর্থ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। চট্টগ্রামে হামলার ব্যাপারে সে আরও সিরিয়াস হয় এবার। তারমানে ওরা কেউ হাইজ্যাকার ছিল না। এখান থেকেই ওরা তাকে ফলো করে চট্টগ্রামে যায়। তারপর ওখানেই হয়তো মেরে ফেলার উদ্দেশ্য ছিল তাদের। রিহান ভেবে পায় না, কারা ওরা? কেন তাকে মারার জন্য ঢাকা থেকেই চট্টগ্রামে যায়? কে পাঠিয়েছিল ওদের?

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রহমান সাহেব বাড়ির বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে একটা পত্রিকা পড়ছিলেন। পত্রিকা পড়তে পড়তে বেশ কয়েকবার তিনি মোবাইলের স্ক্রিনে টাইম দেখে যাচ্ছেন। কিছুটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছে তাঁকে। কিছুক্ষণ পর তাঁর স্ত্রী রাহেলা বেগম এসে সামনে এক-কাপ চা রাখলেন। রহমান সাহেব স্ত্রীর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার ছেলে কি ফিরেছে?’

‘না, ফিরেনি এখনও। তুমি একটা ফোন করে দেখো তো… ছেলেটা এখনও এলো না কেন?’

‘আরে সেই চেষ্টা কি বাদ রেখেছি? তোমার ছেলের ফোন বন্ধ। তোমার ছেলেটা আমাদের জ্বালিয়ে খাবে।’

‘এভাবে বলছো কেন? আমার অসুস্থ ছেলেটার কোনো বিপদ হলো না-তো? তুমি একটু বের হয়ে খোঁজ নাও তো।’

‘আমার পাঞ্জাবিটা নিয়ে এসো। আমি বের হয়ে দেখি…’

কথপোকথনের মাঝখানে রিহান প্রবেশ করলো ঘরে। বাবা-মার উদ্দেশ্য সে প্রশ্ন ছুড়লো, ‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে? কোথায় বের হচ্ছে বাবা?’

ছেলেকে দেখে যেন কলিজায় পানি ফিরলো বাবা-মার। রাহেলা বেগম দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সারা শরীরে হাত বুলালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত দেরি করে ফিরেছিস কেন বাপ? আমাদের টেনশন হয় না?’

‘তোমাদের বউমার জন্য দুটো শাড়ি কিনতে গিয়েছিলাম। দেখো তো শাড়ি দুইটা কেমন হয়েছে?’

রাহেলা বেগম শাড়ি দুটো নিয়ে খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একটু ফোন করে জানাতে পারতি আমাদের। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছিস।’

‘স্যরি মা। ফোনে চার্জ ছিল না আসলে। শাড়ি দুইটা দেখো, সুন্দর না? সুফিয়াকে মানাবে? বাবা দেখো তো?’ একটা শাড়ি বাবার দিকে বাড়িয়ে দিলো রিহান। রহমান সাহেব শাড়িটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। তারপর বললেন, ‘হুমম, খুব মানাবে। কিন্তু বাবা, তুই যে আমাদের টেনশনে ফেলে দিস এভাবে। আমাদের কথা কি একবারও ভাবিস না?’

‘মা, তোমরা কি আমাকে এখনও অসুস্থ ভাবো? বাবা? আমি বারবার বলছি আমি অসুস্থ না। আমার মাথা ঠিক আছে। তোমরা আমার জন্য চিন্তা করো না।’

‘চিন্তা না করে কি উপায় আছে আমাদের? আমি কী বলি শুন, কিছুদিন চাকরি থেকে ছুটি নে। বাসায় থাক কিছুদিন। সুফিয়া প্রেগন্যান্ট না? ওকে সময় দে। সুফিয়ার পাশে থাক।’ সুফিয়ার দোহাই দিলেন রহমান সাহেব। সুফিয়ার কথা বলাতে হয়তো রাজি হবে সে, কিন্তু রহমান সাহেবকে হতাশ করে সে বললো, ‘না বাবা, অফিসে সবে প্রমোশন পেয়েছি। আগামীকাল অফিসের সব দায়িত্ব আমি বুঝে নেবো। এখন ছুটি নেয়া যাবে না। সুফিয়াকে দেখাশোনা করার জন্য তো তোমরা আছো। রিতা আছে। এই রিতা এদিকে আয় তো…’ দরজায় দাঁড়িয়ে রিহানের বোন রিতা তাদের কথপোকথন শুনছিল। রিহান ছোটোবোনকে ডাক দেয়। রিতা কাছে এলে রিহান তাকে একহাতে আলতো করে ধরে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর ভাবিকে দেখতে পারবি না?’

রিতা বাবা-মার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে রিহানের দিকে তাকায়। তারপর মাথা দুলিয়ে অস্ফুটে শব্দ করে, ‘হু… পারবো।’

‘এই তো আমার লক্ষ্মী বোন। কাল অফিসের সব দায়িত্ব বুঝে নেবো। তারপর অফিস থেকে ফিরে তোর যা যা লাগে কিনে দেবো। বাবা আর মাকেও কিনে দেবো। কেমন?’

রিতা মাথা দোলায়। রিহান শাড়ি দুটো নিয়ে ভেতরে গেল সুফিয়ার কাছে। রাহেলা বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে আফসোস করে বলতে থাকে, ‘আমার ছেলেটার পাগলামি দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। কেন তুমি ওকে ভালো একটা ডাক্তার দেখাচ্ছো না?’

‘আমি কীভাবে ডাক্তার দেখাবো? তোমার ছেলে তো নিজেকে সুস্থ মনে করে।’

রাহেলা বেগম চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন ভেতরে।

পরদিন অফিসে রিহানকে সংবর্ধনা দিলো চিফ হওয়ার জন্য। অধীনস্থরা ফুলের তোড়া দিলো। সংবর্ধনা শেষে ইউসুফ সাহেব রিহানকে নিজের চেয়ারে নিয়ে গিয়ে বসালেন। তারপর অনুরোধের সুরে বললেন, ‘নিজ হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা আমার অফিস। একটু দেখেশুনে রেখো। সবদিকে খেয়াল রেখো।’

‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। আমি সব সামলে নিবো। আপনার কাছ থেকে অনেককিছু শিখেছি। আপনার সম্মান অটুট রাখবো।’

ইউসুফ সাহেব মৃদু হাসলেন। তারপর হেসে বের হয়ে যেতে চাইলে, পেছন থেকে রিহান বলে উঠে, ‘স্যার, আপনাকে আমার খুব আপন মনে হয়।’

ইউসুফ সাহেব ঘুরে রিহানের দিকে তাকালেন। চোখে তাঁর প্রশ্ন। রিহান পুনরায় বলে উঠে, ‘আপনার নাম শুনলে আমার দাদার কথা মনে পড়ে যায়। আমার দাদার নামও ছিল ইউসুফ।’

‘নামের মিল থাকার কারণেই কি আপন মনে হয়? না-কি অন্য কোনো কারণে?’

‘ঠিক কী কারণে জানি না স্যার। তবে মনে হয়, আপনি আমার কাছের কেউ।’

ইউসুফ সাহেব হাসলেন। তারপর আলতো করে রিহানের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তিনি তাঁর হাসির মাধ্যমে রিহানকে অনেককিছু বুঝিয়ে দিলেন, কিন্তু রিহান বুঝতে পারলো কি-না কিছুই বোঝা গেল না তার ভাবমূর্তি দেখে। ভাবলেশহীন হয়ে সে অনেকক্ষণ ঠাঁই বসে রইলো চেয়ারে।

বিকেলে সূর্যের তেজটা নরম হয়ে আসছিল। সেই সময় সঞ্জু কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিয়ে রাহাতের সাথে দেখা করতে আসে৷ কিছুক্ষণ তারা রাহাতের নতুন অফিসটাতে বসে চা নাস্তা খায়। তারপর রাহাতের সাথে বের হয়ে আসে বাইরে। রাস্তার ওপাশে রাহাতের লিজ নেয়া বিশাল জায়গা৷ আনুমানিক ছয়-সাত একর তো হবেই। ঢাকা শহরে যে এখনও এত বিশাল ফাঁকা জায়গা অবশিষ্ট আছে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। অবশ্য শহরের এ সাইডটা একটু গ্রামের মতো। লিজ নেয়া পুরো জায়গাটার চারপাশে দেয়াল তোলা হয়েছে, দেয়ালের উপর কাঁটাতার। অফিসের মুখোমুখি অবস্থানে একটা বড়ো আকারের গেইটও করা হয়েছে। সেই গেইটে পাহারা দিতো নাজমুল। নাজমুলের জায়গায় আজ নতুন একজন গেইট-কিপারকে দেখা গেল। সঞ্জু তার দিকে কিঞ্চিৎ তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল সঙ্গীদের নিয়ে। তার পাশাপাশি হেঁটে চললো রাহাত। হাঁটতে হাঁটতে সে সঞ্জুর উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে লাগলো, ‘আসলে এ জায়গাটা আমি বিশ বছরের জন্য লিজ নিই। এখানে একটা ইটখোলা নির্মাণ হবে। ওদিকটাতে হবে একটা জুট মিল। এগুলোর পাশাপাশি এখানে আরও কিছু প্রজেক্ট করার চিন্তাভাবনা করছিলাম সামনে, কিন্তু আফসোসের বিষয় দেখুন, কাজটা শুরু করার মুহূর্তেই একটা মার্ডার হয়ে গেল।’

সঞ্জু চারপাশে চোখ বুলালো। শ্রমিকরা নিজেদের নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের দিকে তাকিয়ে সঞ্জু রাহাতকে প্রশ্ন করে, ‘আনুমানিক কতজন শ্রমিক কাজ করে এখানে?’

‘তিনশো জন। সরকারের অনুমতির জন্য নির্মাণ কাজ শুরু করতে একটু বিলম্ব হয়েছে। তিনদিন আগেই কেবল অনুমতিপত্র পাই। তারপর কাজ শুরু করি, সেদিন রাতেই ঘটনাটা ঘটে।’

‘কেউ হয়তো চায় আপনি প্রজেক্টটা অফ করে দিন। কেউ হয়তো আপনার ভালো চায় না।’

‘সেটা রিহান নামের লোকটা যখন ধরা পড়বে তখনই জানা যাবে।’

‘আচ্ছা, নাজমুলের লাশটা আমরা একটা গর্ত থেকে উদ্ধার করি। একটা কবরের মতো গর্তটা। গর্তটা কি আগে থেকেই ছিল? না-কি…’

‘না, না, গর্তটা হয়তো রিহান নিজেই করে। তারপর নাজমুলকে মাটি চাপা দিতে চেয়েছিল। পরে সময় এবং সুযোগ না পেয়ে অর্ধেক মাটিচাপা দিয়ে পালিয়ে যায়।’

‘কিন্তু, কী উদ্দেশ্য হতে পারে তার?’

‘সেটা আপনারাই খুঁজে বের করুন না হয়।’

‘ঠিক আছে। আপনার প্রজেক্টের সফলতা কামনা করছি। আমরা যত দ্রুত সম্ভব রিহানকে ধরার চেষ্টা করবো।’

‘ধন্যবাদ অফিসার, খুশি হলাম আপনাদের কাজে।’ হ্যান্ডশেক করে পুলিশদের বিদায় দিলো রাহাত।

রিতাকে নিয়ে শপিংয়ে বের হয়েছিল রিহান। সুফিয়া প্রেগন্যান্ট বলে সে তাকে সাথে নিয়ে যায়নি। সবার জন্য শপিং করে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। প্রমোশন উপলক্ষে সে সবাইকে একটু খুশি করতে চেয়েছে। বাসায় এসে সবাই মিলে ওরা শপিং-সামগ্রী দেখছিল খুশিমনে। সেই সময় উপস্থিত হয় সিরাজ সাহেব৷ তাঁকে দেখে রহমান সাহেব বললেন, ‘আরে সিরাজ যে? কী মনে করে এলে?’

রাহেলা বেগম সোফা দেখিয়ে বললেন, ‘বসেন ভাই সাহেব, বসেন। আগে তো প্রায় আসতেন। এখন আর আসেন এদিকে তেমন। আমাদের হয়তো ভুলে গেছেন।’

সিরাজ সাহেব বসলেন, তারপর হেসে বললেন, ‘আসলে ভাবি কাজের চাপে আসা হয় না। আপনারা হয়তো ভাবছেন ওই ঘটনার কারণে আমি আসি না। আসলে তা না। ওইজন্য আমাদের কোনো দুঃখ নেই। আমাদের মেয়ের মাশাআল্লাহ ভালো ঘরেই বিয়ে হয়েছে। আজ যে জন্য আসা ভাবি। রহমানের কাছে শুনলাম রিহান না-কি বিয়ে করেছে। তাই বউমাকে একটু দেখতে এলাম।’

সিরাজ সাহেবের কথা শুনে রিতা, রাহেলা বেগম এবং রহমান সাহেব পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলেন৷ সিরাজ সাহেব ওদের ভাবমূর্তি দেখে কিছুই আন্দাজ করতে পারলেন না। পুনরায় বললেন, ‘কই? বউমাকে ডাকেন। একটু দেখে যাই…’

‘আমি দেখাচ্ছি, আমার সাথে এসো সিরাজ।’ বলেই সিরাজ সাহেবকে রিহানের কক্ষে নিয়ে গেলেন রহমান সাহেব। তারপর খাটের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘ওই যে, নতুন শাড়ি পরে খাটে বসে আছে রিহানের বউ।’

‘কই? খাটে তো কেউ নেই। আমি তো কাউকে দেখছি না।’ অবাক হলেন সিরাজ সাহেব। রহমান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আমরাও কাউকে দেখছি না। কিন্তু আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ভান করে চলতে হয় যে, এখানে আরও একজন আছে, রিহানের স্ত্রী। আসলে পুরোটাই তার কল্পনা। এখানে কেউ নেই। সুফিয়া নামের কেউ নেই ওর জীবনে। আমার ছেলেটা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে দিনদিন।’ শেষের দিকে রহমান সাহেবের গলা ভারি হয়ে এলো৷ নীরবে চোখের কোণের জল মুছলেন তিনি।

[[চলবে…]]

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২)
লেখা: ShoheL Rana শামী
পর্ব:-০৩

বন্ধুকে সান্ত্বনা দেন সিরাজ সাহেব। কাঁধে হাত রেখে নির্মল কণ্ঠে বলেন, ‘আমি বলি কী রহমান, রিহানের অসুখটা আরও বাড়ার আগেই ওকে একটা ডাক্তার দেখাও।’

‘আরে অসুখ আর বাড়বে কী? বেড়েই তো গেছে। কত চেষ্টা করেছি ডাক্তার দেখাতে, কিন্তু ও রাজি না।’

এই ফাঁকে রিহান সিরাজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আঙ্কেল, আমি একদম ঠিক আছি, আমার জন্য বাবাকে চিন্তা করতে নিষেধ করে দেন।’

‘বাবা রিহান, তোমার অবস্থাটা তো আমরা স্বচক্ষে দেখছি। তোমার আসলেই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।’

‘আঙ্কেল আপনিও? ঠিক আছে, আমি ডাক্তারের পরামর্শ নেবো শীঘ্রি। এবার হ্যাপি সবাই?’ সবার দিকে তাকালো রিহান। রিহানের কথায় যেন সবাই প্রশান্তি ফিরে পেল।

ডাক্তার শহিদ শহরের নামকরা একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। বয়স তেত্রিশ আনুমানিক। প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন। তারই দ্বারস্থ হয় রিহান। সাথে তার বাবা-মাও যায়। ডাক্তার শহিদ রোগীর অসুস্থতার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, রহমান সাহেব সবকিছু খুলে বলেন। তারপর ডাক্তার রোগীকে থাকতে বলে বাকিদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে। সবাই বেরিয়ে গেলে ডাক্তার রিহানকে জিজ্ঞেস করে, ‘নাম?’

‘রিহান…’

নামটা শুনে কয়েকমুহূর্ত রিহানের চেহারার দিকে চেয়ে থাকে ডাক্তার। তারপর জিজ্ঞেস করে, ‘উনারা যা বলে গেলেন, সেই সম্পর্কে আপনার কী মতামত?’

‘ডাক্তার সাহেব বিশ্বাস করুন, আমি মোটেও অসুস্থ না।’

‘আচ্ছা বিশ্বাস করলাম, আপনার বক্তব্য বলুন। উনারা কেন আপনাকে অসুস্থ ভাবছেন?’

‘ওঁদের দিক থেকে ওঁরা ঠিক। আসলে আমারই দোষ। আমি ওঁদের সামনে প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যাচ্ছি। ওঁরা যে বলছে আমি কাল্পনিক কারও সাথে সংসার করি। ব্যাপারটা আসলে এমন না।’

‘তবে?’

‘আসলে ওঁদের দেখানোর জন্যই এমনটা করি আমি, যাতে আমায় ওঁরা অসুস্থ ভাবে। কারণ, আমার এনগেজমেন্ট করার কথা ছিল। আমিও রাজিও ছিলাম। কিন্তু বিশ মিনিটের একটা সময় সবকিছু উলটপালট করে দেয়। আমি হঠাৎ করে অতীতে চলে যায়। নিজেকে আবিষ্কার করি হঠাৎ ১৯৪২ সালে।’

রিহানের কথা শুনে ডাক্তার শহিদকে অবাক হতে দেখা গেল না। গভীর মনোযোগ দিয়ে রিহানের কথা শুনতে লাগলো সে। রিহান বলতে লাগলো, ‘অতীতে আমি অনেকদিন আটকে থাকি, ভেবেছিলাম কখনও ফিরতে পারবো না ওখান থেকে। ওখানেই আমার সম্পর্ক হয় সেই সময়ের এক মেয়ের সাথে। ডাক্তার সাহেব, আপনি কি আমার কথা শুনছেন?’

ডাক্তার শহিদ রিহানের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এমনভাবে শুনছিল, যেন কথার মাঝেই সে হারিয়ে গেছে। হঠাৎ রিহানের শেষের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনছি, বলুন। মেয়েটার নাম কী?’

‘সুফিয়া। ওর বাবার নাম ছিল জাফর। একজন স্কুলের শিক্ষক। আমি ওখানে ওদের বাসায় থাকতাম। এর আগে অবশ্য আরেকটা বাসায় থাকতাম…’

‘আচ্ছা, আপনি অতীত থেকে ফিরে এসে কী করলেন বলুন। অতীতে কী হয়েছে, না হয়েছে এগুলো শুনতে চাচ্ছি না। কেন বাসার লোক আপনাকে অসুস্থ ভাবছে?’

‘অতীতে আমি অনেকদিন কাটালেও সেটা ছিল বর্তমান সময়ের বিশ মিনিটের সমান। আমার জীবনের এই বিশ মিনিট সময়টা আমার সবকিছু পালটে দিয়েছে। এনগেজমেন্টে প্রথমে রাজি থাকলেও পরে আমি আর রাজি হয় না। কারণ, আমার জীবনে তখন মিশে গেছে সুফিয়া। ওকে ছাড়া আমি আর কাউকে আমার জীবনে ভাবতে পারি না। তাই এনগেজমেন্টটা বন্ধ করার জন্যই আমি অভিনয় করতে লাগলাম যে আমার সাথে আমার স্ত্রী সুফিয়া থাকে। তাকে আমি অতীতে গিয়ে বিয়ে করে এনেছি। এসব কথা শুনে বাড়ির সবাই আমাকে পাগল ভাবতে শুরু করে। আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিল তাঁরা যেন আমাকে পাগল ভেবে এনগেজমেন্টটা ক্যানসেল করে দেয়।’

‘এনগেজমেন্ট ক্যানসেল হওয়ার পরও তবে অভিনয় করে গেলেন যে?’

‘কারণ, যার সাথে আমার এনগেজমেন্ট হওয়ার কথা ছিল, তার পরিবারের সাথে ওই ঘটনার পর আমাদের সম্পর্কটা প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। হুট করে যদি বলতাম আমি সব অভিনয় করেছি, তবে আমার পরিবার অনেক কষ্ট পেত। তাই আমি সময় এবং সুযোগ খুঁজছিলাম, যাতে একবার মিথ্যে মিথ্যে ডাক্তার দেখিয়ে বলতে পারি আমি সুস্থ হয়ে গেছি। গতকাল সেই সুযোগ পেয়ে গেলাম। সিরাজ আঙ্কেল, মানে যার মেয়ের সাথে আমার এনগেজমেন্ট হওয়ার কথা ছিল, তাঁর ভুল বোঝাটাও ভাঙলো। এবার আমার আর সুস্থ হতে আপত্তি নেই। ডাক্তার সাহেব, আপনি আমাকে এই হেল্পটুকু করুন।’

‘মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনাকে মিথ্যে চিকিৎসা করবো?’

‘প্লিজ… ডাক্তার…’ হাতজোড় করলো রিহান।

‘স্যরি মিস্টার, ডাক্তারি পেশাটা কোনো মজা করার বিষয় নয়। আমি আপনাকে এই হেল্পটুকু করতে পারছি না।’

‘ডাক্তার প্লিজ। ডাক্তারের ধর্মই তো মানুষের উপকার করা। আমাকে আমার পরিবারের সাথে ভালোভাবে থাকতে হেল্প করুন। প্লিজ…’

ডাক্তার শহিদ কিছুক্ষণ গভীরভাবে কী যেন ভাবলেন, তারপর বলে উঠলেন, ‘ঠিক আছে, আমরা আপনাকে হেল্পটুকু করবো। এইজন্য আপনাকে আগামী তিনদিন আমাদের ক্লিনিকে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে।’

‘মিথ্যে চিকিৎসা।’ ডাক্তারকে সংশোধন করে দিলো রিহান।

‘হুমম, মিথ্যে চিকিৎসা। তবে মাঝেমধ্যে আপনাকে ইনজেকশন দেয়া হবে। এতে ভয় পাবেন না। আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।’

‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ডাক্তার।’ ডাক্তারের হাতদুটো ধরে হাসিমুখে কৃতজ্ঞতা জানালো রিহান।

একটা পুলিশ-ভ্যান এসে থামলো রহমান সাহেবের বাড়ির সামনে। পুলিশ অফিসার সঞ্জু ভ্যান থেকে নেমে বাড়ির ভেতর ঢুকে কলিং বেল বাজালো। দরজা খুলে দিলেন রাহেলা বেগম। সামনে পুলিশ অফিসারকে দেখে বিস্মিত হয়ে স্বামীকে ডাকলেন তিনি। রহমান সাহেব এসে সঞ্জুর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি এখানে? কাকে চান?’

‘এটা কি রিহানদের বাড়ি?’

‘জি। রিহান আমার ছেলে।’

‘আপনার ছেলেকে ডাকুন।’

‘কেন? কী করেছে আমার ছেলে?’

‘খুন। খুন করেছে আপনার ছেলে।’

‘খুন!’ একসাথে চমকে ওঠেন রহমান সাহেব এবং রাহেলা বেগম। ‘কী বলেন? আমার ছেলে খুন করবে কেন? ও তো দুদিন ধরে ক্লিনিকে ভর্তি আছে।’

‘খুনটা আরও আগে করেছে।’

‘অফিসার, আপনি কি বুঝতে পারছেন কার দিকে আঙুল তুলছেন? আমার ছেলে কয়েকমাস ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ। একটা মানসিকভাবে আনস্ট্যাবল ছেলে খুন করবে কীভাবে? আর কী কারণ থাকতে পারে তার খুন করার?’

‘আপনার ছেলে মানসিকভাবে অসুস্থ?’

‘জি।’

‘কোন ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছে?’

রহমান সাহেব ঠিকানা দিলেন। তারপর বললেন, ‘অফিসার প্লিজ, আমার ছেলেকে কিছু করবেন না। আমার ছেলে কোনো খুন করতে পাারে না।’

‘দেখুন, এ পর্যন্ত সকল প্রমাণ আপনার ছেলের বিরুদ্ধে। খুনের রাতে আপনার ছেলেকে ঘটনাস্থলে দেখা গেছে, এবং তাও দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকেছে সে। যদি সবকিছু মানসিক অসুস্থতার মধ্যে করে থাকে, তবে আদালতে মাফ পেতে পারে৷ কিন্তু যদি সে সুস্থ অবস্থায় করে, তবে আদালত সিদ্ধান্ত নেবে আপনার ছেলেকে কী করা হবে।’

কথাগুলো বলে সঞ্জু চলে যেতে লাগলো। রিহানের বাবা-মা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার গমনপথে চেয়ে রইলো। তাদের পাশে ভয়ে ভয়ে এসে দাঁড়ালো রিতা। তাঁদের সাথে এসব কী ঘটে চলেছে কিছুই বুঝতে পারলো না তাঁরা।

ক্লিনিকের বেডে শুয়ে আছে রিহান। চোখদুটো বারবার বুজে আসছে তার। কী একটা ইনজেকশন দেয়া হয়েছে তাকে, তারপর থেকে এই অবস্থা। কোনোমতে চোখ খুলে রাখতে পারছে না সে। জগতের ঘুম নেমে আসতে চাইছে তার চোখে। আশেপাশে আরও কয়েকটা বেডে মানসিক রোগীরা শুয়ে আছে। কেউ কেউ হাসি-ঠাট্টা করছে, পাগলামি করছে। রিহান তাদের কথাগুলো শুনছে কেবল, চোখ খুলে দেখতে পারছে না কাউকে। ডাক্তার শহিদের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘রিহান সাহেব… রিহান সাহেব…’

‘এ্যা…?’ চোখ না খুলেই অস্ফুটে শব্দ করলো রিহান।

‘আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?’

‘এ্যা…’ চোখ খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করলো রিহান।

‘শুনুন, চোখ খুলতে হবে না। আপনাকে অজ্ঞান করার ইনজেকশন দেয়া হয়ছে৷ কিছুক্ষণ পর অজ্ঞান হয়ে যাবেন। দুইঘণ্টা পর আরেকটা ইনজেকশন দেয়া হবে। আগামীকাল আপনি চলে যেতে পারবেন। সাথে আমাদের মেডিকেল সনদও পাবেন।’

রিহান কোনো জবাব দিলো না। পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে গেছে সে। খানিক পর সেখানে উপস্থিত হলো পুলিশ অফিসার সঞ্জু। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে সে রিহানের ব্যাপারে প্রশ্ন করলো, ‘কী অবস্থা এখন ওর?’

‘ট্রিটমেন্ট চলছে। কিন্তু আপনার উপস্থিতির কারণ?’

‘আমরা ওকে অ্যারেস্ট করতে এসেছি। মার্ডার করেছে সে।’

‘হোয়াট! একটা পাগলে মার্ডার করেছে?’ হেসে ওঠলো ডাক্তার শহিদ।

‘এ্যাভিডেন্স তো তাই বলছে৷ ও কি আসলেই পাগল?’

‘আলবত পাগল। কোনো সন্দেহ আছে?’

‘আপনিই বলুন?’

‘যেকোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করালে, পাগলই বলবে সবাই। এখন অজ্ঞান করা হয়েছে তাকে।’

‘আচ্ছা, ট্রিটমেন্ট চালু রাখুন। রিলিজ দেয়ার আগে আমাদেরকে জানাবেন। কার্ডটি রাখুন। এই নাম্বারে ফোন দিবেন।’ ডাক্তারের দিকে একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল সঞ্জু৷

রাহাতের সামনে অপরাধীর মতো মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন। রাহাত তাদের উপর প্রচণ্ড চটে গেছে। উত্তেজিত হয়ে হাত-পা ছুড়তে লাগলো সে। তারপর একজনের শার্টের কলার চেপে ধরে চিৎকার করতে করতে বললো, ‘কেন তোদের পেছনে এত টাকা খরচ করি আমি, কেন? জবাব দে, কেন? পুলিশের আগে একটা লোককে খুঁজে বের করতে পারলি না? কী করে লোকটাকে তোদের আগে খুঁজে পেল পুলিশ?’

উত্তেজিত রাহাতের কথার জবাবে কেউ কিছু বলতে পারলো না। রাহাত লোকটার কলার ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘রিহান এখন কোথায়? পুলিশ কি ওকে থানায় নিয়ে গেছে?’

‘না বস।’

‘তবে?’

‘শুনলাম একটা ক্লিনিকে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে।’

‘খোঁজ নে কোথায় ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে। ওকে পুলিশে নিয়ে যাওয়ার আগে আমার কাছে নিয়ে আয়। আমি ওকে নিজ হাতে মারবো। যা…’ ধমক দিয়ে সবাইকে বের করে দিলো রাহাত। তারপর রাগে কাঁপতে লাগলো। রিহানকে একবার সামনে পেলে বুক থেকে কলিজাটা বের করে নেবে সে।

‘স্যার… স্যার… ওঠুন স্যার… স্যার… স্যার…’ কেউ একজন রিহানের গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে কেউ তাকে ডাকছে। রিহান চোখ খুলতে পারছে না। শুধু একটা মেয়েলি কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, তাও অস্পষ্ট। একটু একটু করে জ্ঞান ফিরছে তার। মেয়েটার গলা আবারও শোনা গেল, ‘স্যার… স্যার…’

‘হু…’

‘স্যার উঠুন, নয়তো আপনার সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

রিহান কোনো জবাব দিলো না। মেয়েটার কথা হয়তো তার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। মেয়েটা জোরে তার গায়ে ধাক্কা দিলো, ‘স্যার, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? স্যার… স্যার…’

‘হু…’

‘প্লিজ ওঠুন স্যার। আপনার ভয়ানক বিপদ হতে চলেছে। ডাক্তার শহিদ আপনাকে পুরোপুরি পাগল বানিয়ে দেবে। একটু পর আপনাকে যে ইনজেকশনটা দিবে, তাতে আপনি পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবেন।’

রিহানের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। মেয়েটা এই মুহূর্তে কী করবে কিছুই বুঝতে পারলো না। পাশে কয়েকটা পাগলের অট্টহাসি শোনা গেল। তারা মেয়েটার কাণ্ড দেখে হাসছে।

[চলবে…]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here