ছেঁড়া বাঁধন,পর্ব- ১
(নূর নাফিসা)
.
.
সন্ধ্যায় কলিং বেল বাজলে ফাইজা বুঝতে পারলো নওরিনের টিচার এসেছে। তাই কিচেন থেকে বের হয়ে দরজা খুলতে যেতে যেতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“নওরিন, টিভি অফ করো মা। টিচার এসেছে।”
কার্টুন শেষ করতে না পারায় নওরিনের মুখে বিরক্তির ছাপ পড়লো৷ গাল ফুলিয়ে টিভি অফ করে রিমোর্ট রেখে এগিয়ে গেলো টেবিলের দিকে। ফাইজা দরজা খুলতেই সাবিহা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে সালাম দিলো। সালামের জবাবটা ফাইজা মনে মনে দিয়েই হালকা মাথা নাড়লো। যেন মাথা নেড়ে বুঝানো হয়েছে সে সালামের জবাব দিয়েছে। সাবিহা ভেতরে আসতেই সে দরজা লাগিয়ে আবার কিচেনে চলে গেছে। নওরিন ভদ্র মেয়ের মতো বই খাতা বের করছে। সাবিহাকে দেখে গোমড়া মুখে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম, মিস।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। মনটা খারাপ কেন বেবিটার?”
“তুমি আরেকটু পরে এলে কি হতো? আমার একটুই বাকি ছিলো কার্টুনটা!”
“ওপ্স! কিন্তু আমি তো জানতাম না তুমি কার্টুন দেখছিলে। তবে তো একটু পরেই আসতাম।”
“তবে কি আমি এটুকু শেষ করে নিবো আগে?”
“এখন টিভি অন করতে গেলে তো তোমার আম্মু আমাকে সহ বকা দিবে। পড়া শেষে আমরা দুজন মিলে আবার টিভি দেখবো, ওকে?”
“ওকে।”
নওরিন আবার পেন্সিল, খাতা বের করায় মনযোগ দিলো। গাল ফোলা কমতে শুরু করেছে। ফাইজা একদিকে ভাত বসিয়ে অন্যদিকে মাংস রান্নার ব্যবস্থা করছে। ফ্রিজ থেকে আদা-রসুনের বাটিটা বের করার সময় চোখ পড়লো চমচমের দিকে। গত রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় নোমান নিয়ে এসেছিলো। বাবা-মেয়ে দুজনেই চমচম পছন্দ করে তাই প্রায়ই নিয়ে আসে। একবার মনে হলো সাবিহাকে চমচম আর পাউরুটি নাস্তা দেওয়া যাক। প্লেট হাতে নিয়ে চমচম তুলতে গেলে আবার মনটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। না, নাস্তা দিবে না তাকে। আবার প্লেট রেখে দিলো সে। মনযোগ দিলো রান্নায়। খালি হাতেই গিয়ে একবার দেখে এলো নওরিন পড়ছে কি না। মেয়েটা মনযোগ দিয়ে লিখছে, সাবিহার হাতে ফোন ছিলো। ফাইজার উপস্থিতি টের পেয়েই যেন ফোনটা টেবিলের উপর উল্টে রেখে দিলো। তাকিয়ে রইলো নওরিনের লেখার দিকে। ছোটখাটো নিশ্বাস ফেলে আবারও চলে গেছে কিচেনে। হাতে নিয়ে নিয়েছে এক পিস লেবু। মাংসের গন্ধটা ইদানীং একটু বেশিই অসহ্য লাগে বিধায় একটু পরপরই নাকের কাছে লেবু তুলে ঘ্রাণ নিচ্ছে। ঘন্টাখানেক পর আবারও কলিং বেল বাজলো। ফাইজা দরজা খুলে দেখলো নোমান চলে এসেছে। গত একমাস যাবত সে তাড়াতাড়িই অফিস থেকে ফিরে। আগে আরও ঘন্টা দুয়েক দেরি করে ফিরতো। যাইহোক, ফাইজা কখনো তার কারণ জিজ্ঞেস করেনি। করার প্রয়োজনও নেই৷ যার অফিসের খবরাখবর তার হয়েই থাকুক। ফাইজার সামনে দিয়েই ঘড়ি খোলায় ব্যস্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলো নোমান। তবে রুমের দিকে যেতে যেতে ব্যস্ততার মাঝেও পাশের রুমে দরজা বরাবর পড়ার টেবিলের দিকে একবার তাকালো। সাবিহাও তাকিয়েছে। নোমান যেমন হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি অবস্থা, সাবিহা?”
সাবিহাও হাসিমুখে মিষ্টিকণ্ঠে জবাব দিলো,
“এইতো, ভাইয়া। কেমন আছেন আপনি?”
“ভালো।”
নওরিন বললো,
“বাবাই, আমার পেন্সিল বক্স কিন্তু শেষ হয়ে গেছে। এই একটাই ছিলো।”
হাতের পেন্সিলটা তুলে দেখালো নওরিন। নোমান পাশের রুমে যেতে যেতে জবাব দিয়ে গেলো,
“ঠিক আছে। এনে দিবো।”
ফাইজা আবার কিচেনে এসে মাংসের লবণটা টেস্ট করতে গিয়েও পারেনি, ওদিকে নোমানের ডাক পড়ে গেছে। ফাইজা চুলা অফ করে আঙুল চেটে গরুর মাংসের লবণ দেখতে দেখতেই বেরিয়ে এসেছে। লবণ তো ঠিক আছে। কিন্তু নোমান ঠিক নেই। দরজার সামনে আসতেই দেখতে পেলো নোমানের ভ্রু কুচকানো চোখ! শার্টের বোতাম অর্ধেক খুলে আটকে ছিলো। বাকিটুকু আবার খুলতে খুলতে মেজাজি গলায় বললো,
“বিছানার উপর লবণ ছিটানো কেন? আর এগুলো এখানে রাখার জায়গা? সরাও এখান থেকে!”
তার ধমকের কোনো প্রত্যুত্তর করলো না ফাইজা। চুপচাপ এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে। লবণ তো ছড়ানো ছিলো না। তবে সন্ধ্যার আগে তেতুল খেয়ে তেতুল এবং লবণের কৌটোটা বিছানাতেই রেখে গিয়েছিলো ভুলক্রমে। এখন নোমান না দেখেই হয়তো কৌটোর উপর বসে পড়েছে আর লবণ পড়ে গেছে। ফাইজা লবণ ও তেতুল হাতে তুলে বিছানা ঝেড়ে দিলো সাথে সাথেই। এগুলো নিয়ে যাওয়ার সময় তার মুখভঙ্গি আরেকবার দেখতে মোটেও ভুলেনি সে। ইশ! কি রাগ, কি তেজ! অথচ রুমের বাইরে তখন কি সুন্দর হাসিটাই না দেখা গেলো আর সেই রুম ফেলে এই রুমের দিকে অগ্রসর হতেই মেজাজ সপ্তমে! বুকের কষ্ট সম্মুখে শক্ত একটা গিট দিয়ে নিশ্চুপ চলে গেলো ফাইজা।
পড়া শেষ করে নওরিন রিমোর্ট হাতে নিয়েছিলো টিভি দেখার জন্য। ওদিকে নিজের জন্য একটু ঝাল করে আমের টক রান্না বসালো ফাইজা। বাকি রান্না শেষ। নওরিনের মুখে টিভির কথা কানে ভেসে আসতেই আন্দাজ হলো পড়া শেষ। তাই এগিয়ে এসে দেখলো, পড়া শেষই এবং নওরিন টিভি অন করে টিচারকে তার কার্টুন সম্পর্কে বলছে। সাবিহাও যেন আরাম করে বসেছে তার সাথে টিভি দেখার জন্য। ফাইজা এসে বললো,
“কি, পড়া শেষ?”
সাবিহা জবাব দিলো,
“হ্যাঁ, ভাবি। এই মাত্র শেষ হলো।”
“ওকে। আসুন তবে। সাবধানে যাবেন।”
ফাইজার মুখের বাক্যটুকু যেন পছন্দ হলো না। সে তো আর এখানে থাকতে আসেনি। এভাবে সাথে সাথেই যাওয়ার জন্য বলার কি আছে! আযব! ধীর নিশ্বাস ফেলে ব্যাগ হাতে উঠতে ব্যস্ত হলো সাবিহা। ফাইজা মেয়ের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
“নওরিন, তুমি টিভি কেন অন করছো এখন? অফ করো!”
নওরিন নত গলায় মিনমিন করলো,
“পড়া তো শেষই, আম্মু।”
“ক্লাসের হোমওয়ার্ক করবে কে?”
“হোমওয়ার্ক তো বিকেলে করেছি আম্মু।”
“তাতে কি হয়েছে? সামনে পরীক্ষা, আর পড়া নেই তোমার? অফ করো টিভি! সারাদিন টিভি নিয়ে বসে থাকে!”
হাত থেকে রিমোর্ট নিয়ে নিলো ফাইজা। নওরিনের মুখ আবারও গোমড়া হয়ে গেছে। এইতো, কান্না করাটুকু বাকি এখন। বড্ড অভিমানী তার নওরিন। সাবিহা চলে যেতেই সে দরজা লক করে আবার মেয়ের কাছে এলো। নওরিন খাতা খুলতে যাচ্ছিলো। ফাইজা খাতা বন্ধ করে দিয়ে এবার নরম গলায় বললো,
“ওকে, দেখবে টিভি। তার আগে ভাত খাবে। বাবাই খেতে বসবে, একসাথে খাবে। চলো।”
মন খারাপ কমিয়ে খাতাপত্র আবার গুছাতে শুরু করেছে নওরিন। ফাইজা তাদের খাবার রেডি করার জন্য সেখান থেকে কিচেনের দিকে যাওয়ার সময় নোমান বের হলো রুম থেকে। এতোক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে সে। হাতে টাকা নিয়ে বেরিয়েছে। ফাইজাকে দেখে বললো,
“সাবিহা চলে গেছে?”
“হ্যাঁ।”
“আজ ত্রিশ তারিখ, মাসের টাকাটা মনে করে দিয়ে দিবে না তুমি!”
সামান্য মেজাজ প্রকাশ পেলো এই কথাতেও। ফাইজা কণ্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখেই প্রত্যুত্তর করলো,
“আজ মাত্র মাস শেষ হয়েছে।”
“তাইতো দিবে৷ মানুষের টাকার প্রয়োজন পড়তে পারে না? আটকে রাখবে কেন!”
“আটকে রাখিনি। ত্রিশ তারিখেই দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কালকেও দেওয়া যাবে।”
তার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো ফাইজা। সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ফালতু মেজাজ হজম করার এনার্জি তার নেই। বাবা মেয়েকে খাবার দিলো প্লেটে। গরুর মাংস দেখে নোমান বলেই ফেলেছিলো,
“মাংস রান্না করেছো, সাবিহাকে এখানে খেয়ে যেতে বলতে।”
“প্রয়োজন মনে করিনি।”
“কেন?”
“আমার ইচ্ছে হয়নি তাই।”
কথাটুকু বলেই উঠে গেলো টক রান্না কতটুকু হয়েছে তা দেখতে। নোমান পাঁচ সেকেন্ড সময় নিয়ে তার দিকে স্থির তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মনযোগ দিলো। নওরিন তার বাবাকে জিজ্ঞেস করছিলো,
“বাবাই, আমাকে কি আবারও এক বক্স পেন্সিল এনে দিবে? ওগুলোর মতোই? সাথে একটা ম্যাংগো ফ্লেভার রাবার আনবে কি? আমার কাছে তো ওই রাবারগুলোই ভালো লাগে বেশি। তুমি অন্যগুলো নিয়ে আসো শুধু। আমার এসবে কোনো ফ্লেভারই নেই।”
“এতো কথা কেন বলছো? চুপচাপ খাও।”
গলায় মেজাজ ছিলো না, তবে কথায় রসও ছিলো না৷ ব্যাস, তো! নওরিনের মুখ বন্ধ হতে এটুকুই যথেষ্ট। নওরিন প্লেটে তাকিয়ে চুপচাপ ভাত নাড়তে লাগলো। ফাইজা এগিয়ে এসে বললো,
“কি ব্যাপার, খাচ্ছো না কেন?”
“তুমি খায়িয়ে দাও। আমার ভালো লাগছে না খেতে।”
“আমার পক্ষে এখন খায়িয়ে দেওয়া সম্ভব না, মা। তুমি নিজ হাতে খাও।”
“সবাই শুধু আমাকে বকো। খাবোই না আমি।”
নওরিন উঠে চলে গেলো পাশের রুমে। নোমান নিজের খাওয়ায় ব্যস্ত। তার সেদিকে মাথা ব্যাথা নেই কারণ এটা মা মেয়ের ব্যাপার। অথচ তার কথায় যে অভিমান জন্মে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে নওরিনের, সেদিকে তার খেয়ালই হয়নি। কিন্তু ফাইজা ঠিকই বুঝেছে বাবার কথা মানে লেগেছে। সে ধীর নিশ্বাস ফেলে প্লেট নিয়ে মেয়ের পিছু পিছু গেলো। টিভিটা অন করে মেয়ের কোলে রিমোর্ট রেখে পাশে বসে বললো,
“আম্মু তো অসুস্থ, তুমি দেখছো না? আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি খায়িয়ে দিচ্ছি। তবে তাড়াতাড়ি গিলতে হবে। হুম?”
নওরিন সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। হলেই বা কি, বাচ্চাদের বাচ্চামো স্বভাবের পরিবর্তন আছে নাকি আবার! ফাইজা তার মুখে খাবার দিয়ে ধমক দিলেই কেবল গিলে নিচ্ছে। ধমক না দিলে মুখে খাবার নিয়ে টিভির দিকে এক মনে তাকিয়েই থাকছে! “গিলো! গিলো!” বলতে বলতেই প্লেট খালি করেছে ফাইজা। মেয়েকে খায়িয়ে এসে দেখলো নোমান খাওয়া শেষ করে উঠে গেছে। প্লেট তুলে নিয়ে ধুয়ে দুটো চমচম দিয়ে এলো নোমানকে। নওরিনকে ডেকে খাবে কি না জিজ্ঞেস করলে সে দৌড়ে এসে একটা নিয়ে চলে গেল টিভির কাছে। তার কার্টুন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন কার্টুন দেখলেও তার তৃপ্তি মিটবে না। এতো পাগল! তাদের খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে রেখে এবার নিজের জন্য এক মুঠ ভাত তুলে নিলো প্লেটে। খেতে একদমই ইচ্ছে করছে না। শারীরিক কিংবা মানসিক, কোনোভাবেই যার একটু শান্তি নেই তার আবার খাওয়ার রুচি আসবে কোত্থেকে? তবুও পেটটাকে শান্ত রাখতে টক দিয়ে এই একমুঠ ভাত গলধকরণ করলো ধীরে ধীরে। নওরিনকে খায়িয়ে দিতেও বোধহয় এতখানি সময় লাগেনি তার। লোকটা মাংস দেখে সাবিহাকে খাওয়ানোর কথা ঠিকই বললো, অথচ তার স্ত্রী যে প্লেটে এক টুকরো মাংস নিলো না তা এসে একবার দেখলো না। তার সামনে খেতে বসে যে মাছ মাংস ছাড়া একটু ডাল কিংবা তরকারির ঝোল নিয়ে ভাত গিলে যায়, তখনও একবার চোখ তুলে দেখেনা। চোখে পড়লেও মুখ ফুটে একবার জিজ্ঞেস করে না যে, মাছ মাংস নিচ্ছে না কেন? এইটুকু খাবার খেয়ে উঠে যাচ্ছে কেন? শরীর কি বেশিই খারাপ নাকি? রাখে না এই খবরটুকু। অথচ এই লোকটার হাত ধরেই একদিন চিরচেনা পরিবার ত্যাগ করে চলে এসেছিলো সে!