#নয়নাভিরাম,পর্ব-৭,৮
♡আরশিয়া জান্নাত
০৭
আকাশটা ঋতুর রাণীর আগমনে যেন একটু বেশিই আনন্দিত হয়। সাদা তুলোর মতোন মেঘ বুকে নিয়ে ছড়ায় অপার সৌন্দর্য। শরৎ মানেই বোধহয় নীল সাদার ছড়াছড়ি। নদীর কোল ঘেঁষে সাদা কাশবন আর আকাশে সাদা মেঘ!
হাইওয়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। ঢাকা থেকে খানিকটা দূরে আমাদের গন্তব্য। এই গন্তব্যে আমার একমাত্র সঙ্গী আরশান আহমেদ!
অনেক ধরেই ভাবছিলাম সেই জায়গাটায় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার কথা, যান্ত্রিক শহুরে জীবনে থেকে থেকে তাঁর মন প্রাণ কেমন মিইয়ে গেছে। (আমার মন অবশ্য কখনওই মিইয়ে যায় না। আমি সবসময় প্রাণবন্ত আর সজীব,হিহি )
তার উপর ছ্যাঁকা খেয়ে আধমরা হয়ে আছে। এমন মানুষকে আগের ফ্লোতে আনতে এইটুকু সাহায্য মিমি করতেই পারে।
–আপনার কি ভয় করছে মিঃ?
–আমাকে বলছেন?
–হ্যাঁ আর কাকে বলবো?
–আমার কেন ভয় করবে?
— এই যে আমার সঙ্গে যাচ্ছেন। এমনও তো হতে পারে আমি আপনাকে কিডন্যাপ করার উদ্দেশে নিয়ে যাচ্ছি? আপনি তো জায়গাটা চেনেন না তার উপর আমার গাড়িতেই যাচ্ছেন। অনেক কিছুই তো ঘটতে পারে!
আরশান হোহো করে হেসে বললো, মিস মিমি আপনি কি জানেন মাঝেমধ্যে আপনি উল্টো রোল প্লে করেন? এই প্রশ্নগুলো আমার করা উচিত ছিল,
–আপনি আমায় কিডন্যাপ করবেন না। করে বিশেষ লাভ হবেনা,
–কেন কেন লাভ হবে না কেন?
— কি পণ চাইবেন? টাকা নাকি প্রপার্টিজ? এসব কিছুই তো চাই না আপনার। তাহলে লাভ কোথায়?
— ভেবে বলছেন?
–হুম অবশ্যই।
–মেয়ে হয়ে এতো কনফিডেন্ট? জানেন তো মেয়েদের কত রিস্ক?
— হুরর আপনি ওরকম নাকি! এইটুকু ভরসাযোগ্য না হলে নিশ্চয়ই আপনাকে সঙ্গে নিয়ে আসতাম না।
–আপনি আমায় ভরসা করেন?
— হ্যাঁ করবো না কেন?
–এমনো তো হতে পারে আমি খুব খারাপ। যতোটুকু চেনেন বা জানেন তার সবটা সঠিক নয়।
আমি তাঁর চোখে চোখ রেখে বললাম, যদি ধরেও নিই আমার মানুষ চেনার ক্ষমতা নেই তবুও বলবো আপনার ক্ষেত্রে আমার ধারণা এক বিন্দুও ভুল হয় নি। ইনফ্যাক্ট আপনাকে আমি যতোটুকু ভরসা করি তাঁর চেয়েও অনেক গুণ বেশি আপনি ডিজার্ভ করেন।
“এতো ভরসা করবেন না মিস মিমি! আমার ভয় হয় সেটা রক্ষা করতে পারবো কি না,,,,”
“ভয় পেতে থাকুন। আমার কি?”
তারপর জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্যে মনোনিবেশ করলাম। ভীতু লোক একটা এমন কথার পিঠে কি বলতে হয় তাও জানেন না।
“শান্তির পরশ” ইনস্টিটিউট এর সামনে আমাদের গাড়ি থামলো। ড্রাইভার চাচার সাহায্যে গাড়ি থেকে চকলেট বক্স আর খেলনা নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই এক ঝাঁক জান্নাতী পাখি আমায় ঘিরে ধরলো।
এবার অনেকদিন পর আসায় তাঁদের সকলের উচ্ছাস অনেক বেশি। সবাইকে চকলেট আর খেলনা দিতে দিতে কুশল বিনিময় করে নিচ্ছি পেছনে তাকিয়ে দেখি আরশান দূর থেকে বোকার মতো চেয়ে আছে। আমি তাঁকে ইশারা করলাম এদিকে আসতে। সে আসতেই তাঁকে বললাম, হাবলুর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে হেল্প করুন না!
সবাইকে সবকিছু দেওয়ার পর সিড়িতে বসতেই হুইলচেয়ারের আওয়াজ তুলে মুনা এসে বললো, আমার চকলেট কোথায় আমার কথা কি ভুলে গেছে কেউ?
আমি উঠে গিয়ে তাঁর সামনে হাঁটুভাজ করে বসে বললাম, আপনার কথা ভুলে যাবে এমন গোস্তাখী করার সাহস আছে নাকি কারো রাজকুমারী সাহেবা?
মুনা চেহারার গাম্ভীর্য ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা করে বললো, এখন এসব বলে তো কাজ হবেনা। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করুন।
আমি চকলেট আর তাঁর প্রিয় ডেইজি ফুলের তোড়া দিয়ে বললাম,এই যে দেখুন আপনার প্রিয় ফুল আর চকলেট!
মুনা তাঁর বিশ্ববিখ্যাত হাসি দিয়ে গলা জড়িয়ে বললো, এতোদিন আসো নি কেন মিমিপু? কত মিস করেছি জানো?
–অনেক বিজি ছিলাম যে ময়না। আপুর বিয়ে পরীক্ষার চাপ সব মিলিয়ে পাহাড় সমান ভার! সেই ভারে আমি নুইয়ে গেছিলাম দেখো এখনো কেমন কুঁজোবুড়ির মতো হাঁটছি।(অভিনয় করে দেখালাম)
মুনাসহ সব বাচ্চারা হাসতে লাগলো।
মুনা ইশারা দিয়ে কাছে ডেকে বলল,উনি কে?
আমি ফিসফিস করে বললাম, ট্রয় রাজ্যের রাজকুমার! তোমার সঙ্গে দেখা করতে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে এসেছে। অভ্যর্থনা জানাবে না??
এই যে রাজকুমার সাহেব এদিকে আসুন।আমাদের রাজকন্যা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।
আরশান এসে বসতেই মুনা বললো, আপনি দেখতে আসলেই রাজকুমারের মতো! এতো সুন্দর ছেলে আমি আগে দেখিনি। আপনি বুঝি মিমি আপুর রাজকুমার?
আরশান হাসি দিয়ে মুনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো, মুখে কিছুই বলতে পারলো না।
সবার সঙ্গে হৈ চৈ শেষে আরশানকে সেই এরিয়াটা ঘুরে দেখালাম। খুব সুন্দর সবুজ উদ্যানের পাশেই বিশাল বড় দীঘি। ঘাটে পা ভিজিয়ে বসে বললাম, জীবনটা কেমন?
আরশান নিঃশব্দে অপরপাশে বসলো। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে ঘোরে আছে। তাঁর অনুভূতি আমি ঠিক বুঝতে পারছি। দাদাজান যখন প্রথমবার আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল আমি অন্য ভুবনে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তখন থেকে জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে গেছে।
“সুস্থতা অনেক বড় একটা নেওয়ামত তাই না? আমরা একটু কষ্ট পেলেই ভাবি সৃষ্টিকর্তা বুঝি কেবল আমাকেই কষ্ট দিচ্ছেন। সব পরীক্ষা আমাকেই দিতে হচ্ছে। উনিশ থেকে বিশ হলেই ভেবে বসি জীবনটাই বৃথা! আমার কিছু নেই, আমার অনেক দুঃখ আরো কত কি ভাবনা! ওদেরকে দেখুন ওরা কেউ কিন্তু স্বাভাবিক না। ওরা তবুও জীবনটাকে সাজানোর স্বপ্ন দেখছে। হাসছে গাইছে খেলা করছে দিন শেষে আল্লাহকে কৃতজ্ঞতায় স্মরণ ও করছে। সমাজ এদের দেখে এড়িয়ে যায়,বাবা-মা নানা বিপাকে পড়ে। যদিও এখন অনেকটা বদলেছে তাও তো বিড়ম্বনা তো আছেই। এরা যদি এতো কিছুর পরো ভালোভাবে বাঁচতে পারে আমরা কেন সব পেয়েও হাসিমুখে বাঁচতে পারবো না? জানেন আমার যখনই ডিপ্রেশন হয় আমি এখানে চলে আসি। নতুনভাবে সব শুরু করার উদ্দীপনা পাই।”
“আপনার ডিপ্রেশন হয় মিস মিমি?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমাদের জেনারেশনটাই এমন কেউ ডিপ্রেশন ছাড়া নেই! পার্থক্য এই কেউ গা ঝেড়ে এড়িয়ে যায় আর কেউ পুষে রেখে থেমে যায়। choice is yours…
_____________
এতো বড় একটা বক্স হাতে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যে কতটা অস্বস্তিকর তা কি আমার ফ্রেন্ডরা জানে না! এই হলো বন্ধুত্ব? দুই দিন আগে থেকে বলে রেখেছি এবার আমার দাদা-দাদীর পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী গ্র্যান্ড করে সেলিব্রেট করবো। কাউকে না জানিয়ে এই আয়োজন করছি তাই ওরা যেন হেল্প করে। কিন্তু বলে লাভ হলো কি সেই তো আমাকেই একা একা সব করতে হচ্ছে।ডেকোরেশন এর আইটেম কিনতে এসেছি সেই কখন ভেবেছি এর মধ্যে কেউ না কেউ এসেই যাবে কিন্তু কারো খবর নাই। ফোন নিয়ে কল করে সামনে এগোতেই একজনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে চেঁচিয়ে বললাম, আরেহ মিয়া আন্ধা নাকি চোখে দেখবার পান না?
সে চমকিত গলায় বললো, আরেহ ম্যাডাম আপনি! কি সৌভাগ্য আমার আপনার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল!
আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি সে আর কেউ না ঐ মেহবুব শালা!
“এতো বড় বক্স হাতে নিয়ে অযথা কেন কষ্ট করছেন। দিন দিন আমি এগিয়ে দিচ্ছি, ”
“না না ঠিক আছে। ধন্যবাদ”
” আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন? আসলে আমি ফোন স্ক্রল করে এগুচ্ছিলাম তাই খেয়াল করিনি। আমি খুবই দুঃখিত।”
“সমস্যা নাই ঠিক আছে। আচ্ছা আমি যাই আমার অনেক কাজ আছে”
” একটু ওয়েট। আপনার নামটাই তো জানা হলো না। আর কনট্যাক্ট করার তো কোনো ওয়ে-ই পাচ্ছি না। ফেসবুক আইডি টা অন্তত দিতে পারতেন!”
আমি রাগ কন্ট্রোল করে বললাম, আসলে ভাইয়া লাস্ট মান্থে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এই যে জিনিসপত্র দেখছেন এগুলো আমার হাজবেন্ডকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য কিনেছি। আজ তাঁর বার্থডে তো, নাহয় সে-ই আসতো আমার সঙ্গে। তিনি আবার আমায় একা ছাড়তেই চান না। তো এখন আর নাম ঠিকানা বা অন্য কিছু জেনে কি করবেন বলুন? তারচেয়ে বরং অন্যদিকে মনোনিবেশ করুন, গুড লাক। আর হ্যাঁ দোআ করবেন আমাদের জন্য কেমন?
তারপর আমি একপ্রকার পালিয়ে এলাম ওখান থেকে। যাক বাবা এবার নিশ্চিত তাঁর পিছু ছুটেছে।
নীলা– শোন দোস্ত কেকের দায়িত্ব তুই নিস না। ঐটা আমার উপর ছাইড়া দে। তুই বরং ডেকোরেশনে মন দে।
ছোটন– না না তোরে ডেকোরেশনেও আসতে হবে না এইটা আমি আর ইলহাম ম্যানেজ করতেছি। তুই বরং অন্য কিছুতে মন দে।
আমি রাগে লাল হয়ে বললাম, তোরা আমারে ভাবোস টা কি আমি সব ধ্বংস করি!
ওরা সবাই চিৎকার করে বলে উঠলো, আমরা শুধু এটা ভাবি না বরং বিশ্বাস করি
আমারে কেউ ভালোবাসেনা,হুহ!!!
_______________
দাদীজানকে সাজাবো এমন প্ল্যান করে তাঁর রুমে যাচ্ছি তখন দেখি দাদীজান মুখ চেপে কাঁদছেন। দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরেই এভাবে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছেন। আমি দরজা আটকে তাঁর সামনে বসে বললাম, কি হয়েছে দাদীজান এভাবে কাঁদছো কেন?
তিনি কোনো কথাই বলছেন না। বহুবার জিজ্ঞাসা করার পরও কোনো উত্তর না পেয়ে আমি বললাম,তুমি যদি না বলো আমি চেঁচিয়ে সবাইকে বলে দেবো।
দাদীজান কান্না আটকে বললো, বুবুন আমি এতো বছর সংসার করছি ভুল ভাবনায় ডুইবা। আমি ভাবতাম তোর দাদা আমারে ভালোবাসে। কিন্তু আইজ বুঝলাম তাইনে আমারে না অন্য জনরে ভালোবাসতো।
–আরেহ ধুরর এসব ভেবে কান্না করতেছো খালি খালি। দাদাজান তোমারেই ভালোবাসে, আর কাউরে ভালোবাসার সময় কই হু?
— তুই দেখ এই মাইয়ার ছবি তাইনে এখনো যত্ন কইরা রাখছে। একবার ভাবছি বাক্সটা খুইলা দেখমু, কিন্তু মনে হইলো যদি আরো গোপন তথ্য পাই এই ডরে আর ধরিনাই। বুবুন রে নারীজাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ হইছে স্বামী। এই স্বামীর ভালোবাসার ভাগ কাউরে দেওন যায় না। অথচ আমারডা তো অনেক আগেই ভাগ হইয়া আছিল।
“দাদীজান, মানুষের জীবনে অতীত থাকা কি খুব অন্যায়? ধরলাম তোমার কথাই সত্যি দাদাজান অন্য একজনকে ভালোবাসতো কিংবা তাঁকে ভুলতে পারেনাই। কিন্তু তাই বলে তোমাকে কি এক বিন্দুও অবহেলা করেছে নাকি আজ পর্যন্ত তোমার মনে হয়েছে উনি তোমাকে কম ভালোবেসেছে? তাহলে আজ এতো বছর পর কেন এসব ঘেঁটে কষ্ট পাচ্ছ?”
“এক বুন্দা লেবুর রস পড়লে এক হাঁড়ি দুধ ফাইটা যায়। এখন তো লাগতাছে তাইনে আজীবন অভিনয় কইরা গেছে। অন্তর থেইকা ভালোবাসেন নাই। যদি বাসতো তাইলে এসব আগলাইয়া রাখতো তুই ই ক?”
আমি নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম। আসলেই তো! তবে কি দাদাজান দায়িত্বে পড়েই অভিনয় করে গেছেন? কিন্তু তিনি তো বলেছেন তিনি দাদীজানকেই ভালোবাসেন, যদিও অতীত ভুলতে পারেন নি।
আচ্ছা তবে কি ছেলেরা কেবল দায়িত্বে বাঁধা পড়ে অভ্যাসেই এগিয়ে যায়, মন ঠিকই পড়ে থাকে আগের জনের কাছে? মিঃ আরশান ও বুঝি কখনোই পাস্ট ভুলে আমায় ভালোবাসবেন না? তাঁর প্রতি যে আমার সাগরসম প্রেম জমে আছে তাতেও বুঝি মন ভরবে না?
চলবে,,,,
#নয়নাভিরাম (পর্ব-৮)
♡আরশিয়া জান্নাত
এতো সুন্দর করে ডেকোরেশন করা ছাদটায় গালে হাত দিয়ে বসে আছি সবাই। দাদীজানের আজকেই সব জানতে হলো! এতো এতো প্ল্যানিং সব বুঝি ভেস্তে গেল। মন খারাপের পাশাপাশি বিরক্ত ও লাগছে খুব। মনে মনে একটা অপেক্ষা দাদাজান নিশ্চয়ই দাদীজানের মান ভাঙিয়ে ছাদে নিয়ে আসবেন, তারপর আমরা সবাই হৈ হুল্লোড় করবো।
ফাহিম— মিমি মন খারাপ করো না। এটা তোমাকে একদম মানাচ্ছে না।
ছোটন— ঠিক বলছোস ফাহিম। এই মিমি চল তো আমরা গিয়ে উনাদের টেনে নিয়ে আসি। এই বুড়ো বয়সে এসব নিয়ে বাড়াবাড়ির কি আছে।
নীলা— তোরা ছেলেরা ঠিক থাকলে এমন হতোনা। তোদের মনে থাকে এক বাইরে আরেক।
ইলহাম– এসব ফাও কথা। এখন পুরুষজাতীকে অসম্মান করে বিদ্বেষ ছড়াবিনা নীলা ভানু।
নীলা– ভানু ডাকবিনা । ভানু হবে তোর বৌ আমি না।
ছোটন– উফফ তোরা ঝগড়া থামাবি। কোথায় সল্যুশন বের করার চেষ্টা করবি তা না খালি ঝগড়া।
আমি উঠে বললাম তোরা থাক আমি আসছি।
নীলা– তুই আবার কই যাস?
আমি– শেষ ট্রাই করে আসি আসলে আসবে না আসলে আমরা একাই পার্টি করমু।
তখনই দাদাজান দাদীজানকে নিয়ে ছাদে আসলেন। পেছনে আপু ভাইয়ারা সবাই এলো।
দাদাজানের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই তিনি ইশারায় বললেন সব ঠিক আছে।
আমি দাদীজানকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তোমাকে একদম নতুন বৌয়ের মতো লাগছে দাদীজান।
তারপর কেক কেটে ফটোসেশন হলো, অনেক হৈচৈ করে খাওয়া শেষে গানের আসর বসলো। শেষ ভালো যার সব ভালো!
__________
দেখতে দেখতে কেটে গেল অনেকগুলো মাস। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সবে বাবার অফিসে জয়েন করেছি। নীলা বিয়ে করে রাজশাহী চলে গেছে, ছোটন নিজের শহরে বিজনেস স্টার্ট করেছে,ইলহাম মালয়েশিয়ায় । ঢাকায় এখন বন্ধু বলতে কেবল ফাহিম ই আছে। তাঁর সাথে আমার সপ্তাহে একদিন হলেও দেখা হয়। বাকি সবাই যার যার জীবন নিয়ে মহাব্যস্ত। জীবনটা মাঝেমধ্যে অদ্ভুত মনে হয়। বন্ধুরা সব দূরে সরে যায় ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। আগের হাসি আড্ডা গান মনে পড়লে এখনো আনমনেই হেসে ফেলি কখনো বা চোখের কোণ ভিজে আসে। সময়ের রেষানলে পড়ে আমরা সবাই এগিয়ে যাই নতুন মানুষের ভীড়ে।
আমি ভেবেছিলাম আরশান আমার মনের অনুভূতি একটু হলেও টের পাবে, কিংবা তাঁর মনেও আমার জন্য কিছুটা হলেও ভালো লাগা থাকবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। সে যখন হাসিমুখে বলেছিল এক সপ্তাহ পর সিঙ্গাপুর যাচ্ছে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এমন নয় যে আমি আগে থেকে জানতাম না সে যাবে। তবু আশা ছিল যাওয়ার আগে কিছু একটা বলে যাবে, আমার প্রত্যাশাই আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছিল হয়তো। আমি তাকে আমার বেস্ট হাসি দিয়ে বিদায় জানিয়েছিলাম। সে জীবনে অনেক বড় হোক, অনেক অনেক সফল হোক মন থেকে সেই কামনা করেই উল্টোপথে বাসায় ফিরেছিলাম।
বাসায় ফিরে টেবিলের উপর চিপস দেখে অভ্যাসগত প্যাকেট খুলে খেতে খেতে রুমে গেছি অমনি ভুবনফাটানো চিৎকারে আমার কান ধরে গেল।
“ফুপ্পি তুমি আবার আমার চিপস খেয়ে ফেলছো। তোমার জন্য আমি চিপস রেখে শান্তি পাই না। আমার চিপস দাও”
আমি ডোন্ট কেয়ার মুডে বললাম, এখানে কারো নাম লেখা আছে? আমি পেয়েছি খাচ্ছি, তাতে কার কি হু??
“ঐ দেখো বড় করে R লেখা। R দিয়ে রিধি, তো আছে তো নাম লেখা। এটা আমার চিপস দাও আমারে,,,,”
“R দিয়ে রুমাইসা ও হয়। এই বাসায় আমিও আছি তো এটা আমার।”
রিধি এবার কান্না করতে করতে আম্মুকে ধরে আনলো,
“দেখো না দাদু ফুপ্পি আমার চিপস খেয়ে ফেলছে। এত বড় মেয়ে বাচ্চার চিপস খায়।”
“মিমি তুই কি বড় হবিনা? ভাইজীর চিপস কেউ খায়? কেন অযথা কাঁদাচ্ছিস বলতো?”
“তুমি এই পিচ্চি বুড়ির জন্য আমাকে বকছো? আমি বাচ্চা না তোমার? আমার জন্য চিপস থাকেনা কেন আমিও এখন কান্না করবো। আর শুনো আমি যে এই কিটক্যাট টা এনেছি এটা কাউকে দিবো না। যে একটু চিপস খেলে এতো কান্না করে তাঁকে আর কিচ্ছু কিনে দিবো না আমি”
রিধি চোখ মুছে বললো, দাদু তুমি যাও তো। আমার ফুপ্পি কে বকো না। আমার ফুপ্পিই তো চিপস খেয়েছে তো কি হয়েছে। বাবাইকে বলে আরো টিপস আনাবো। তারপর দুজন মিলে খাবো। ফুপ্পি আমি না তোমার ছোট্ট মা আমাকে চকলেট দেবেনা হু?
“এহহ এখন আসছে আমার ছোট্ট মা। ”
“ফুপ্পিইইইইইইইই”
” হাহাহা । নে মা ধর তোর চকলেট তাও গলারে শান্তি দে। কোন দিন যে আমার কানের পর্দা ফাটে আল্লাহ!”
ক্যাফেটেরিয়ায় বসে ফাহিমের অপেক্ষা করছি, গতকাল রাতে টেক্সট করলো আর্জেন্ট মিট করতে। অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পরও বলেনি কিছু। সামনের টেবিলে বসা কাপলের ঢং দেখছি বসে বসে। ভালোই লাগছে খারাপ না, মেয়েটা খুব মিষ্টি ধরনের বোঝাই যাচ্ছে। আমি বসে বসে তাদের সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হচ্ছি।
“স্যরি স্যরি লেট হয়ে গেল অনেক! বিরক্ত হও নি তো?”
“আরেহ না। বিরক্ত হবার কিছু নেই বেশ ইনজয় করছিলাম।”
“তাই নাকি? কি দেখছিলে ঐ কাপলকে?”
“হু”
“তুমি পারোও বটে! অন্যকে দেখে কি মজা পাও বলো তো?”
” ভালোবাসার মানুষদের একসঙ্গে দেখতে ভালো লাগে। চাইলেও নজর সরাতে পারিনা!”
“তুমি একা আছ কেন? কাউকে সঙ্গী করে তুমিও তেমন হয়ে যাও?”
“ভাবছি বৈরাগী হবো। বিয়েশাদী বাদ, পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়াবো আর বিন্দাস লাইফ লিড করবো।”
“এসব একা করার কি দরকার। এমন কাউকে চুজ করো যে তোমার মতো ভবঘুরে হবে। দুজন মিলে সবটা ঘুরে দেখবে!”
আমি মুচকি হেসে বললাম, কেন ডেকেছিস বললি না তো?
ফাহিম চোখ নামিয়ে কি সব ভাবলো। তারপর দম ছেড়ে বললো, মিমি আমরা খুব ভালো বন্ধু রাইট?
“সন্দেহ আছে?”
“প্রশ্ন না সহজ উত্তর দিও”
“ওকে!”
“তোমার কি মনে হয় আমাদের মাঝে সমঝোতা কেমন? মানে আমরা কি চাইলেই বেটার এক্সাম্পল হতে পারি?”
“এসব প্রশ্ন করছিস কেন? মনে হচ্ছে প্রপোজ করবি হেহেহে”
“করলে কি খুব বড় অপরাধ হবে?”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভাব বোঝার চেষ্টা করলাম। ফাহিম মোটেও ফান করার মতো ছেলে না,খুব রিজার্ভ আর হেল্পফুল ছেলে। সবসময় আমার আশেপাশে ছায়ার মতো ছিল। ও যদি আজ সত্যি সত্যিই প্রপোজ করে বসে না করার কি কোনো পথ থাকবে?
ফাহিম বোধহয় আমার মনের ভাব বুঝতে পারলো,শান্তস্বরে বললো, মিমি অস্থির হয়ো না। তোমার আনসার যাই আসুক আমাদের বন্ধুত্বে বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়বে না আই প্রমিজ!
তবে আমার মনে হলো বলে ফেলাটা আবশ্যক রেজাল্ট যাই আসুক! না বলতে পারার গ্লানির চেয়ে এটাই ভালো হবে।
মিমি আমি তোমাকে ভার্সিটির সেই ফার্স্ট দিন থেকে পছন্দ করি। তোমার দুষ্টুমি, হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েও হাসতে হাসতে খুন হওয়া, মানুষের বিপদে এগিয়ে যাওয়া কিংবা জীবনের সকল সমস্যাকে তুড়ি মেরে এড়িয়ে যাওয়া সবকিছু আমার পছন্দ। তুমি যখন হাসো আমার মনে হয় না এই পৃথিবীতে কান্না বলে কিছু আছে! দেখা হলেই যেভাবে পিঠ চাপড়ে বলো “কিরে শালা আছিস কেমন!” এটাতেও আমি মুগ্ধতা খুঁজে পাই। আমি প্রথমে ভেবেছি সবসময় আশেপাশে থাকি বলে মায়ায় পড়েছি বোধহয়। কিন্তু দিন যতো গেছে মায়া কাটেনি বরং পরিপূর্ণ ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছে। এখনো তোমার সব সেই প্রথম দিনের মতোই আমার ভালো লাগে, তোমার দোষগুণ সব নিয়েই তোমাকে ভালো লাগে। তোমার হাসি যেমন ভালো লাগে তেমনই তোমার রাগে ভ্রু কুঁচকে তাকানোটাও ভালো লাগে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা একটুও কমেনা বরং নতুর করে দ্বিগুণ হারে বাড়ে। আমি বহুবার চেষ্টা করেছি এসব অনুভূতি ঝেড়ে ফেলতে। কিন্তু তুমি মানুষটাই এমন যাকে একবার ভালোবাসা শুরু করলে সেটা কখনোই থামানো যাবেনা।
মিমি আমি তোমাকে ভালোবাসি। কতোটা ভালোবাসি তা প্রকাশ করার সাধ্য নেই আমার।
বলা শেষ করেই উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফাহিম দৌড়ে চলে গেল।
আমি হতভম্ব হয়ে ফাহিমের সব কথা শুনলাম। কি বললো ফাহিম এগুলো! এতোশত অনুভূতি জমিয়ে রেখে ছিল আমার জন্য, কই আমিতো কখনোই বুঝতে পারিনি? এমন করে এতোটা বছর যে মানুষটা ভালোবেসেছে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া টা অন্যায় হবে না?
_____________
আমি আরশান কে ভালোবাসি। এই অদ্ভুত সত্যিটা টের পেয়েছি বহু আগেই। আমি সর্বদা ছুটে চলা মেয়ে, সেই প্রথম তাঁর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে থমকে গেছিলাম। আমার জীবনে এমন অনুভূতি আর কখনো হয়েছিল কি না আমার মনে পড়ে না। একটা মানুষের বকাবকিতেও কেউ প্রেমে পড়তে পারে তা কি বিশ্বাসযোগ্য? মনের অনিয়ন্ত্রিত আবেগকে রাগে রুপান্তরিত করতে চেয়েছি। শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে তথ্য যোগাড় করা, কল করে হুমকি ধামকি দিবে এমন প্ল্যান করেও তাঁকে কত কি বুঝিয়ে গেছি, সান্ত্বনা দিয়েছি পরম আপনজনের মতো। তারপর নিজের বোকামিতে কপাল চাপড়েছি।
ক্লাসের মেয়েরা যখন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকতো ইচ্ছে করতো সবকটার চোখ খুলে মার্বেল খেলি! যার সামনে দাঁড়ালেই হাঁটু কাঁপতো বলে স্কার্ট পড়া শুরু করেছিলাম, ফোনের অপরপাশে বসে কথার ফাঁকে ইচ্ছে করে থেমে তাঁর নিঃশ্বাস শোনার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতাম। তাঁকে একটুখানি হাসাতে কত কি করেছি! তাঁর হাসিতে যে আমার চোখ প্রশান্ত হতো, মনের মাঝে চলতো অকৃত্রিম তান্ডব! কতো রাত যে এই ভেবেই কেঁদেছি মানুষটা তাঁর প্রাক্তনকে ভালোবাসে, তাঁকে ভুলতে পারছে না একটুও! অথচ সে কখনওই জানতে পারেনি সেসব, সে জানতো মিমি কখনোই কাঁদে না। মিমির মনে কোনো কষ্ট নেই। আরশানকে সে ভালোবাসে এটা ভাবতেই যে তাঁর চোখ ভরে আসতো সেটা কি আরশান জানবে?
কত মানুষ ই তো ভালোবাসে। ভালোবাসলেই কি কেউ কাঁদে? বিরহ ছাড়া এখানে কান্না আসবে কেন? এখানে তো সুখের অনুভূতি হবার কথা ছিল তবে আমার কেন এতো কান্না পেত? তবে কি আমি ভালোবাসতে পারিনা? এই যে মানুষটা নেই তারপরও তো আমি রোজ তাকে মিস করি। তার কথা ভেবে ঘুমোতে যাই। আমার সকাল হয় তার ছবি দেখে, এই তিন বছরে সে তো একবারও আমার খবর নেয় নি। ভুলক্রমেও টেক্সট করে জিজ্ঞাসা করেনি কেমন আছি। সেই মানুষটার অপেক্ষা করা বোকামি ছাড়া আর কি হবে?
তবুও আমি অজানা অপেক্ষায় আছি। সে ফিরবে আমার নয়নাভিরাম হয়েই চোখ জুড়াবে। হয়তো এসে বলবে, মিস মিমি আপনার কনট্যাক্ট নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, জানেন কত খুঁজেছি? আমি তো ভেবেছি দেশে ফিরে দেখবো আপনি বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছেন। যাক বাবা আমার সেই দূর্দিন এলো না!
ইশ সে কি পারে না আমার এই মিষ্টি কল্পনাগুলো সত্যি করে দিতে??
।
“মা এখন তোমার ছেলে প্রস্তুত। এবার তুমি তোমার মনের ইচ্ছে পূরণ করো”
আফরোজা আহমেদ ছেলের দিকে চেয়ে মুচকি হাসি দিলেন।
চলবে,,,,