নয়নাভিরাম,পর্ব-৫,৬

#নয়নাভিরাম,পর্ব-৫,৬
♡আরশিয়া জান্নাত
০৫

“আমাদের এই সুন্দর জীবনটা কেঁদে কাটানোর জন্য বা রাগ করে দুঃখে থাকার জন্য খুব ছোট। আপনার অভিমান অভিযোগ যতো দীর্ঘ হবে প্রশান্তির সময় ততোই সংকীর্ণ হবে। কি দরকার মন খারাপ করে এই সুন্দর সময়গুলো অযথাই নষ্ট করার? তাঁর চেয়ে বরং হাসিমুখে প্রতিটি দুঃখ উড়িয়ে দিন, তাঁকে পুষে রেখে মনটাকে ভারাক্রান্ত করবেন না।”

“কে আপনি? আপনাকে তো চিনলাম না? নাকি ভুল নাম্বারে ফোন করে এসব বলছেন?”

“নাহ মিস্টার আরশান আহমেদ। আমি আপনাকেই ফোন করেছি। আমাকে আপনি চিনবেন না বলতে পারেন আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী! ”

“হাহ! শুভাকাঙ্ক্ষী,, ”

“জ্বি! একটা অনুরোধ করি রাখবেন?”

“শুনি আগে? ”

“অনেক রাত অবধি ভবঘুরের মতো রাস্তায় হাঁটবেন না। ঢাকা শহরে এটা খুব রিস্কি। তাছাড়া বাসায় নিশ্চয়ই আপনার পরিবার চিন্তিত থাকে! আমি বিশ্বাস করি এই পৃথিবীতে পরিবারের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কেউ হতে পারেনা। তাই অন্য কারো জন্য অন্তত মা-বাবাকে কষ্ট দেবেন না প্লিজ? জীবনটা ফের গুছিয়ে নিন। প্রফুল্ল থাকুন আর ভরসা রাখুন যা হয় ভালোর জন্য হয়। ”

তারপর ফোন কেটে গেল,,

আরশান দীর্ঘক্ষণ সেই অচেনা প্রাইভেট নাম্বারটার দিকে চেয়ে প্রতিটি কথা মনে মনে রিপিট করলো। কে এই মেয়ে যে এতো কিছু বলল? সে কি চেনা কেউ নাকি গুপ্তচর?
সেই থেকে সে মেয়েটিকে অনেক খুঁজেছে, চেনাজানা সকলের গলা মন দিয়ে শুনেছে। অনেক পুরনো ফ্রেন্ড, ক্লাসমেটদের কনট্যাক্ট করেছে। কিন্তু না কারো সাথেই মিললো না। অথচ তাঁর মনে হচ্ছিল এ কন্ঠস্বর অচেনা নয়। ভার্সিটির কেউ হবে এই কথা তাঁর মাথায় আসেনি, কারণ এখানে তাঁর পার্সোনাল নাম্বার দেওয়া হয়নি কাউকে। সেদিন যখন শপিং মলে মিমির সঙ্গে তাঁর দেখা হলো মিমির গলা শুনে তাঁর সন্দেহ হয়। কিন্তু মিমির মতো কেউ এতো গুছিয়ে কিছু বলতে পারে এ তাঁর বিশ্বাস হতে চাইলো না। তাছাড়া মেয়েটার সাথে শুরু থেকেই তাঁর ইঁদুর বিড়াল টাইপ সম্পর্ক, যতোবার দেখা হয়েছে ততোবারই ছোটখাটো এক্সিডেন্ট হয়েছে; হয় পড়ে গেছে নাহয় ব্যথা পেয়েছে। এই মেয়ে আর যাই হোক তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে না,আর এসব ব্যক্তিগত কথা জানার ও কথা না,,,,
কিন্তু কথায় বলে কেউ কখনোই নিশ্চয়তা দিয়ে কিছু বলতে পারেনা,ভাগ্যের পরিহাস খুবই রহস্যজনক।
গতকাল সন্ধ্যায় ফয়েজ স্যার ফিরেছেন শুনে তাঁর বাসায় গিয়েছিল আরশান। স্যারের সঙ্গে বসে কথা বলার সময় স্যারের ফোনে কল আসে। তখন স্যারের স্ত্রী কল রিসিভ করে হাসিমুখে বললো,নাও তোমার প্রিয় ছাত্রী ফোন করেছে।
স্যারের ফোনের সাউন্ডে সমস্যা থাকার কারণে তিনি লাউডস্পিকারে রেখে কথা বলেন। গলা শুনেই আরশান চমকে উঠে। স্যারের খোঁজখবর নিয়ে কল রাখতেই তিনি প্রফুল্ল গলায় বললো,বুঝলে আরশান মিমি মেয়েটা আমার খুব প্রিয় স্টুডেন্ট। সবসময় ফোন করে খোঁজ খবর নেয়,এই যে মাদ্রাজ গেলাম তোমার আন্টির কাছে ফোন করে রোজ খবর নিয়েছে। মেয়েটা খুব দুষ্ট প্রকৃতির,কিন্তু মনটা একদম কাঁচের মতো স্বচ্ছ।
আরশান নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো, আপনার ডিপার্টমেন্টের রুমাইসা তেহজীব মিমির কথা বলছেন?
–হ্যাঁ হ্যাঁ। বাহ এ ক’দিনে সবার নাম ও মুখস্থ করে ফেলেছ দেখছি!
–না আসলে ও বেশি দুষ্টুমি করে তো তাই আর কি,,
স্যারের স্ত্রী বললো, ওকে এই দুষ্টুমির জন্যই বেশি ভালো লাগে। শুরুতে যদিও বিরক্ত লাগতো।

বহুদিনের পাজেল সলভ হওয়ায় আরশান যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
“রুমাইসা মেয়েটা শুধু দুষ্ট-ই না গোয়েন্দা ও বটে! ”

___________

আঙ্কেল আন্টিকে নিয়ে দরজায় নক করতেই আপু দরজা খুলে দিলো। আমাদের একসঙ্গে দেখে আপু যেন ভুত দেখেছে এমনভাবে চমকে গেল।
— কিরে আপু এভাবেই চোখ বের করে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি ভেতরে ঢুকতে দিবি।
আপু হকচকিয়ে বললো, আস্সালামু আলাইকুম আসুন ভেতরে আসুন।
তারপর আপু দৌড়ে উপরে চলে গেল।আমি আঙ্কেল আন্টিকে বসিয়ে আম্মুকে আর দাদীজানকে ডেকে আনলাম,আব্বু আর দাদাজান ও এসে যোগ দিল।
আম্মু ফিসফিসিয়ে বললো,যা তো মিমি তাশফীকে বল পরিপাটি হয়ে আসতে।
আমি আপুর কাছে যেতেই আপু আমায় জড়িয়ে ধরে বললো,মিমি মিমি তুই বেস্ট। তোকে আমি কত্তগুলি বকা দিছি আর তুই কিনা,,,
–আমি কি ? আমি কিছুই করিনাই।আর তুই এতো খুশি হচ্ছোস কেন, যেন তোর বফের মা বাবা আসছে বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে?
আপু আমার দিকে চেয়ে বললো, ঢং করতেছোস নাকি সত্যি? আঙ্কেল আন্টি কেন আসছে তাহলে?
— উনাদের তুই চিনিস নাকি? উনারা তো আমার নামে বিচার দিতে আসছে, তাঁদের গাড়ির কাঁচ ভেঙে ফেলছি যে,,,
— সত্যি? তুই উনাদের গাড়ির কাঁচ ভেঙে ফেলছোস আল্লাহ! দুনিয়ায় আর কারো গাড়ি চোখে পড়ে নাই উফ উফ।
–আমি কি জেনেশুনে করি নাকি? যাই হোক এই জামা পাল্টা তো ফকিন্নির মতো লাগতেছে তোকে। আন্টিতো মনে করছে তুই আমাদের কাজের মেয়ে।
আপু মুখ কালো করে বললো, সত্য এটা মনে করছে? ধুরর
–এতো ঢং করিস না সুন্দর একটা ড্রেস পড়ে নীচে আয়।
–ক্যান আমি যামু ক্যান?
–ওমা কেউ আসলে পরিচয় করায় আম্মু জানোস না যেন? এখন কি বলবে এই কাজের বেটির মতো মেয়েটা আমার বড় মেয়ে?
আপু সন্দিহান চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ড্রেস পাল্টে হালকা সাজুগুজু করলো।
(আমার বোনটা যে পরীর চেয়ে সুন্দর সে খবর কি কেউ জানে??)
দুই পক্ষের কথাবার্তা শেষে সাকিব ভাইয়া আপুর হাতে আংটি পড়িয়ে দিলো। পনেরোদিন পর তাঁদের বিয়ে ঠিক হলো। আমি সেই খুশিতে বসা থেকে উঠতে গিয়ে সাইড টেবিলে রাখা সিরামিকের শোপিস ভাঙতে গিয়ে বাঁচিয়ে ফেললাম।সবাই আমার এহেন কান্ডে হাসতে লাগলো।
আল্লাহ বাঁচাইছে হাহ!

রাতের আকাশটা বেশ পরিষ্কার আজকে, পুরো আকাশ তাঁরায় ঝলমল করছে। আমি মাদুর পেতে কানে ইয়ারফোন গুঁজে ছাদে শুয়ে আছি। নীচে আপু আর আম্মু কান্নাকাটি করছে, আমার বুঝে আসেনা বিয়ে ঠিক হলে এতো কান্নাকাটির কি আছে। এতোদিন আপু বিয়েতে রাজী হতো না বলে রাগারাগি করতো, আর এখন রাজী হয়েছে তাও কষ্ট পাচ্ছে। মানুষের মন যে কি চায় মানুষ নিজেও জানেনা। তাঁরার দিকে চেয়ে আঁকিবুকি করতে করতে হঠাৎ স্টার ফল হলো, তাৎক্ষণিক উইশ করে বসলাম, আল্লাহ সবার জীবনের দুঃখগুলো ভ্যানিশ করে দাও!
স্টার ফলে উইশ করলে সত্যি হয় কি না জানিনা।তবুও উইশ করতে ভাল্লাগে। আল্লাহর কাছে চাইলে তিনি কখনোই বিরক্ত হন না,বরং না চাইলে রাগ করেন। আল্লাহ কত্ত ভালো তাই না?

বেশ কিছুদিন পর,,,,
আরশান ফোন হাতে নিয়ে ভাবছে মিমিকে কল দেবে কি দেবেনা। একবার ভাবছে কল দিয়ে কথা বললে বোধহয় মনটা ভালো হতো, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে কি না কি ভাবে! মন ভাঙার পর মানুষ সাধারণত এমন কারো সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করে যে তাঁর অনুভূতিগুলো মন দিয়ে শুনবে, তাঁর কষ্ট বুঝবে। মিমিকে সে এখন অবধি কিছু বলেনি, না তাঁর সঙ্গে সেরকম কোনো বন্ডিং আছে। তাও কেন জানি তাঁর মনে হচ্ছে মিমির সঙ্গে কথা বললেই শান্তি লাগবে। সেদিন যে মেয়েটা অচেনা হিসেবে এতো সুন্দর করে কথা বললো, ব্যথার মলমের মতো মনের যন্ত্রণা দূর করলো তাঁর সঙ্গে কথা বলে মন ভালো করার লোভ তো হবেই!
এখানে কেউ লোভী বললেও আরশানের একটুও গাঁয়ে লাগবেনা। কিন্তু কোথাও যেন একটু বাঁধছে আচ্ছা মেয়েটা কি আবার ভুলক্রমেও কল করতে পারেনা? এই যে এতোদিন হয়ে গেল এক্স টিচার হিসেবেও তো খবর নিতে পারে নাকি?
ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই চমকে উঠলো আরশান কাঁপা হাতে কল রিসিভ করতেই,
“আস্সালামু আলাইকুম স্যার। ভালো আছেন?”

“ওয়ালাইকুম আস্সালাম। ভালো আছি আপনি?”

“আমি সবসময় বিন্দাস থাকি। ফোন করায় ডিস্টার্ব হয়েছেন? অবশ্য ডিস্টার্ব হলেও কি? আমি কারো মুডের উপর ডিপেন্ড করে চলতে পারিনা। কথা বলতে ইচ্ছে করেছে তাই কল করেছি,,”

“এটা তো ব্যাড ম্যানার্স মিস রুমাইসা! যাই হোক আমি ডিস্টার্ব ফিল করছিনা। আপনি বলুন কি খবর আপনার হঠাৎ কি মনে করে ফোন করলেন?”

“সত্যি টা বলি। শুনে হাসবেন না কিন্তু?”

“জ্বি বলুন হাসবোনা”

“আপনি হাসতে জানলে তো হাসবেন। একটা মানুষ এতো কম কিভাবে হাসে আমি বুঝি না। যাক কথা হচ্ছে একটু আগে আমার হিচকি উঠেছিল। এখন বইলেন না কিছু চুরি করে খেতে গিয়ে উঠেছে। আমি আবার গুঁড়ো দুধ ছাড়া কিছুই চুরি করে খাই না। আজকে গুঁড়োদুধ শেষ তাই এটা হবার সম্ভাবনা নেই। এই অকারণ হিচকি উঠে মূলত কেউ আমাকে স্মরণ করলে। তো আমি আমার ল’ অনুযায়ী হিচকি উঠলেই পরিচিত সকলের নাম নেই। যে স্মরণ করছে তাঁর নাম নিতেই হিচকি বন্ধ হয়ে যায়,,,”

“এমন হয় নাকি! এটা কোনো লজিক হলো ?”

“আমি কিন্তু বহুবার প্রমাণ পেয়েছি।”

“আজকে ভুল প্রমাণিত হয়েছে আপনার ল’ ,আমি মোটেও আপনাকে স্মরণ করছিলাম না।”

” সিরিয়াসলি? নাকি মিথ্যা বলছেন? ইগোতে লাগবে স্বীকার করলে? ”

“এখানে ইগোতে লাগার কি আছে মিস রুমাইসা?”

” মানুষের তো কত কি ভাবনা থাকে। যেমন আমরা বাঙালিরা প্রাণখুলে হাসতেও ভয় পাই পাছে লোকে যদি সস্তা টাইপ মানুষ ভাবে! সেখানে এমন স্বীকারোক্তি তো মহাপাপ পর্যায়ে চলে যাবে,,,”

“আপনি কি সবসময় এমন বেশি কথা বলেন? ”

“জ্বি আমি সবসময় বেশি কথা বলি। মানুষের মধ্যে দুটো বৈশিষ্ট্যর একটি থাকে। কারো বেশি মুখ চলে আর কারো হাত চলে। আমার দুটোই বেশি চলে, আমি যেমন বেশি কথা বলি তেমনই বেশি টইটই করে জিনিসপত্র নষ্ট করি। আম্মু বলে আমার কোনোকিছুতেই কন্ট্রোল নেই,”

“বাহ! ভালো তো। তা এই পর্যন্ত কি কি ভেঙেছেন শুনি?”

“বলবো না জনাব! এমনিতেই আপনি আমাকে পছন্দ করেন না তার উপর লিস্ট শুনলে ফোন রিসিভ করতেও ভয় পাবেন।”

” এর সঙ্গে ফোন রিসিভের সম্পর্ক কি?”

“যদি ভেবে বসেন আমার কথায় আপনার ফোন গরম হয়ে ব্লাস্ট হবে? হিহিহিহি ”

আরশান এবার না হেসে পারলো না। শব্দ করেই হাসতে লাগলো। এতো হাসি সে আগে হেসেছে কি না মনে পড়ে না। তাঁর হাসির শব্দ শুনে আফরোজা আহমেদ ছেলের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালেন।

“আপনি অনেক মজার মানুষ মিস রুমাইসা। আপনার সঙ্গে কথা বললে কারোই মন খারাপ থাকবে না। হার্টের পেশেন্ট এর উচিত আপনার সঙ্গে থাকা। ”

“এতোগুলো প্রশংসা একসঙ্গে করবেন না। এটা আমার হজম হয় না। আপনার মন খারাপ ছিল তাই না?

আরশান কিছুক্ষণ থেমে বললো,কি করে বুঝলেন?

“প্রশংসা বাক্যে মানুষের মনের অবস্থাটা শোভা পায়। মন খারাপ ছিল বলেই এটা মেনশন করেছেন,,”

আরশান মিমির কথায় অবাক না হয়ে পারলো না। মেয়েটা সত্যিই ম্যাজিক জানে!

চলবে,,,,,

#নয়নাভিরাম (পর্ব-৬)

♡আরশিয়া জান্নাত

“আল্লাহ আমার এখনো বিয়ে হয় নাই, এতো তাড়াতাড়ি আমারে অপয়া বানাইও না। আমারে কেউ বিয়ে করবে না। আল্লাহ গো আমার আঙুল দুইটা নাকি আবার কেটে ফেলে। ও আম্মু ও আব্বু আমার আঙুল খুলতেছে না তো। আপুরে তোর বোন সারাজীবনের জন্য এভাবে আঙুল ধরে থাকবে। নেহিইইইইইই ”

আপু বিরক্তস্বরে বললো, উফফ মিমি এতো চিল্লাইস না তো। কিছু হবেনা সামান্য গ্লু তে আঙুল কাটা লাগে নাকি!

“তোর কি তোর তো আজ বিয়ে হয়ে যাবে নাচতে নাচতে চলে যাবি। তোর জন্য আমার সব শেষ। উহু উহু ,,,”

আব্বু বিচলিত কন্ঠে বললো, আহা মামণি প্যানিকড হচ্ছ কেন। রিলেক্স! দেখি পানিতে হাত চুবিয়ে দেখো তো নিশ্চয়ই আঠা ছেড়ে দিবে।

“আব্বু চামড়া খুলে চলে আসে যদি? একমাত্র বোনের বিয়েতে কব্জি ডুবিয়ে খেতে পারবোনা??”

“ধুরর বোকা মেয়ে কিচ্ছু হবেনা। যা বলছি করো”

তারপর ঠান্ডা পানিতে কিছুক্ষণ হাত ভিজিয়ে রাখতেই আঠা ছেড়ে দিলো। আমি আঙুল নাচিয়ে বললাম , ওরে আল্লাহ বাঁচাইছে। আমার আঙুল ঠিকঠাক আছে।

আপু– ড্রামা কুইন একটা। তোর চিল্লাচিল্লিতে মাথা ধরে গেছে আমার। আর জীবনে ধরিস সুপারগ্লু।

“এজন্য বলে ভালো করতে নেই। তোর জিনিস ঠিক করতেই তো ,,,”

“আমার জিনিস মানে? কি ধ্বংস করলি আবার??”

আমি কাঁচুমাচু করে বললাম, ঠিক করে ফেলছি তো, ধ্বংস হয়নাই।

“কি ঠিক করলি দেখি?”

আমি তখন না চাইতেও আপুর ফেভারিট কলমদানিটা এগিয়ে দিলাম। এটা আপু কক্সবাজার থেকে এনেছিল। সবসময় এক্সট্রা কেয়ার করে রাখতো। কাল রাতে হলুদ ফাংশনের পর রুমে এসে উড়াধুরা সব ছুড়ে ফেলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সকালে সব গোছাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কলমদানিটা নীচে পড়ে বড় ঝিনুক দুটো খুলে গেছিল। আপু টের পাওয়ার আগেই গ্লু দিয়ে ঠিক করতে গেছিলাম। তখনই গ্লু লেগে আমার আঙুল আটকে গেছে,,,

কলমদানির বিশেষ ক্ষতি না হওয়ায় এ যাত্রায় বেঁচে গেছি। তবু আপু বারবার করে বলেছে, আমি যাওয়ার পর আমার জিনিস একটাও তুই ধরবিনা।আমি পরে এসে সব তালাবন্ধ করবো।

“হুহ ঢং! করুক গিয়ে তালাবন্ধ Who cares?”

সারাটাদিন কাটলো মহাব্যস্ততায়। এর ফাঁকে আমার ইনভাইট করা গেস্টদের ফোন করে মনে করিয়ে দিলাম কেউ যেন মিস না করে। সন্ধ্যায় সাজুগুজু করে নায়িকা সেজে বড় ভাইয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে সবাইকে রিসিভ করছি তখন আমার ফ্রেন্ডরা এলো।
ইলহাম, ওমা এটা কে ? বাপরে আটা ময়দা সব খরচ করছোস দেখি!
“হয় আজকে কত্তজন আইবো, একটু সুন্দর না দেখাইলে চলে? বড় বোনের বিয়েতেই তো ছোট বোইনের লাইন হয় জানোস না?”

“ওহ এই ব্যাপার! ”

“যা তোরা ভেতরে গিয়ে বস। আবার আমার সুন্দরী কাজিনদের দিকে নজর দিস না।”

ইলহাম, নিজের বেলা ষোলোআনা পরের বেলা এক আনাও না? আমরা ক্যান নজর দিমুনা? পছন্দ হলে প্রপোজ ও করমু।

“তোরে কেউ গনায় ও ধরবে না।”

ভাইয়া বললো, তুই বরং ওদের নিয়ে যা আমি এদিকটা সামলাচ্ছি।

আমি বললাম, না ভাইয়া আমার স্পেশাল গেস্ট আসবে।উনাদের রিসিভ করেই চলে যাবো। নীলা তোরা গিয়ে ভেতরে বসতে পারবি না?”

নীলা, আরেহ সমস্যা নাই আমরাই তো। চল গিয়ে বসি।
সবাই চলে যাওয়ার পর ফাহিম হঠাৎ ফিরে এসে বললো, মিমি তোমাকে আজকে দারুণ লাগছে। এতো সুন্দর করে না সাজলেও পারতে,,

আমি হেসে বললাম, মাশাআল্লাহ বল শালা। নজর লাগবে।
ও মাথা চুলকে মুচকি হেসে চলে গেল।

ফয়েজ স্যার আর ম্যাডাম আসতেই উনাদেরকে নিয়ে ছোট ভাইয়ার দায়িত্বে দিয়ে আমি গেইটে এসে অস্থিরভাবে অপেক্ষা করছি। কে জানে উনি আসবেন কি না!
ওদিকে বরপক্ষ চলে এসেছে। গেইট ধরে অনেক হৈ চৈ হলো, বহু বাকবিতণ্ডার পর সাকিব ভাইয়াকে সাদরে বরণ করে স্টেজে বসিয়েই আমি ফের ছুট লাগালাম কিন্তু না তাঁর কোনো খবর নেই।
ফোন করে জিজ্ঞাসা করতেও কেমন জানি লাগছে, তিনি তো বলেছিলেন অবশ্যই আসবেন। তবে কি কোনো কাজে আটকে গেছেন?
কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেল। আগে বললেই পারতো আসবেনা তবে তো আর এতোক্ষণ অপেক্ষা করতাম না ,ধুরর।
_____________

পরদিন বেলা এগারোটার দিকে এসে আম্মু ডাকাডাকি শুরু করলো,আমি মরার মতো ঘুম ভেঙে বিরক্তস্বরে বললাম, ঘুমাতে দাও আম্মু আমি অনেক টায়ার্ড।
“তোর গেস্ট টিচার আর তাঁর মা এসেছে মিমি। তাড়াতাড়ি উঠ ”

আমার চোখের রাজ্যের ঘুম মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। আমি লাফ দিয়ে উঠে বললাম, আরশান আহমেদ এসেছেন??
” হ্যাঁ! তুই ফ্রেশ হয়ে আয় তো ।আমি একা আর ক’দিক সামলাবো।”

হুহ কাল এতো সুন্দর করে সেজেগুজে ছিলাম তখন আসেনি, এখন এই কামলার বেশে আছি আর এলো! ঘুমের কারণে চোখমুখ ফুলে বিছরি চেহারাটাই দেখাতে হবে ওহ নো!!

চটজলদি ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমে যেতেই দেখি দাদীজান সেখানে বসে কথা বলছেন। যাক তাও ভালো একা তো বসিয়ে রাখেনি।

“আস্সালামু আলাইকুম আন্টি ভালো আছেন?”

“ওয়ালাইকুম আস্সালাম। এখন এসে খুব ডিস্টার্ব করলাম না তো? ”

“আরেহ না না কি যে বলেন! ভালো আছেন স্যার?”

“হ্যাঁ ভালো আছি। আসলে আমি খুব দুঃখিত মিস রুমাইসা। গতকাল আসবো বলেও আসতে পারিনি। তাই মা বলছিলেন,,,”

“ভালো করেছেন আপনারা এসেছেন। এখন লাঞ্চ না করে যেতে দিচ্ছিনা।”

” না মা আজ না অন্য একদিন। এখন আমাদের হসপিটাল যেতে হবে, ভাবলাম এই পথেই তো যাচ্ছি দেখা করে যাই বরং।”

“হসপিটাল যাচ্ছেন মানে? কারো কিছু হয়েছে নাকি? আপনি সুস্থ আছেন?”

“মা সুস্থ আছেন। গতকাল বিকেলে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। উনাকে হসপিটালাইজ করানো হয়েছে, সেজন্যই বিয়েটা এটেন্ড করতে পারিনি”

“বলেন কি! এখন কেমন আছেন তিনি? বেশি সিরিয়াস কিছু হলো?”

“আলহামদুলিল্লাহ মোটামুটি ভালোই আছেন,তেমন সিরিয়াস কিছু না ”

আম্মুর নাস্তা নিয়ে এসে বললেন, আপনাদের কে ঠিকঠাক আপ্যায়ন ও করতে পারছিনা কিছু মনে করবেন না।

আন্টি– কি যে বলেন আপা! আমরা এসে বরং আপনাদের বিপাকে ফেললাম। গতকাল তো আসতে পারিনি তাই প্রেজেন্টটাও দেওয়া হলোনা।এটা প্লিজ রাখেন আর অনেক দোআ রইলো তাদের প্রতি।
আম্মু– এসবের দরকার ছিল না ওদের জন্য দোআ করেছেন এতেই অনেক হবে।
__________

ফেইক আইডি দিয়ে নিপুণের আইডি স্ক্রল করছে আরশান। এটা তাঁর অপ্রিয় অভ্যাস। এতোদিনের ভালোবাসা তো চাইলেই সহজে ভোলা যায় না। টাইমলাইন জুড়ে নতুন মানুষটার সাথে অসাধারণ কাপল ফটোর ছড়াছড়ি। নিপুণ অনেক সুখেই আছে হয়তো। গেল মাসে বিয়ে করে ফরেনে শিফট করেছে। এই বিলাসবহুল জীবনটাই চেয়েছিল বোধহয়, যার সামনে চার বছরের ভালোবাসা ফিকে পড়ে গেছে।
সিগারেট এর প্যাকেটটা হাতে নিতেই মিমির কথা মনে পড়লো তাঁর,
“টাকা দিয়ে স্মোকিং না করে বরং ঐ টাকাটা গরীব কাউকে দিয়ে দেবেন,এতে অন্তত একবেলা পেট পুরে খেতে পারবে। নিজের তো ক্ষতি করছেনই সাথে পৃথিবী টাকেও দূষিত করছেন”

“আমি একজন স্মোক ছাড়লেই নিশ্চয়ই পৃথিবী দূষিত হওয়া থেকে বেঁচে যাবে না! আর আপনিই তো বলেছিলেন হাসিমুখে দুঃখ উড়াতে। এটা ছাড়া দুঃখ উড়ানো সম্ভব? ”

“আমি থেকেই শুরু হয় আমরা। একজন দুজনের সচেতনতায় দূষণ ঠেকবে না ঠিক, তবে নতুন করে তৈরি 0.00009% হলেও দূষণ কমবে তাই না? আর কে বলেছে এটা ছাড়া দুঃখ উড়ানোর উপায় নেই? হাজার হাজার উপায় আছে। উপায় না জানলে আমাকে বলবেন। আমি বলে দিবোনে।”

“আপনি খুব সাংঘাতিক মানুষ! আপনার সঙ্গে কথা বলে পারবোনা। ”

“আপনিও না কেমন রসকসহীন মানুষ! এটাকে কিন্তু চাইলে সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারতেন। কিন্তু না সেসব আপনার মাথাতেই নেই। আচ্ছা চার বছর রিলেশনে ছিলেন কিভাবে? প্রেমিকদের বৈশিষ্ট্য তো একটাও নেই দেখছি!”

“হয়তো সেজন্যই ছেড়ে গেছে,,,,”

“আবার সেন্টি খাবেন না প্লিজ! আপনাকে একটা বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাবো। এক্সামটা শেষ হতে দিন,,,,,,”

আজকাল সবকিছুতেই মিমির কথা মনে পড়ে। মেয়েটা তাঁর কঠিন অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে ,,,,,,,

আরশানে মা আফরোজা বেডরুমে বসে তাঁর স্বামী নিজাম আহমেদ কে বললেন, অনেকদিন ধরে একটা কথা বলবো ভাবছি ,

“কি কথা?”

“আরশানের বিয়ের ব্যাপারে”

“ও কি এখনই বিয়ে করতে রাজী আছে? তোমাকে বলেছে নাকি পছন্দের কেউ আছে?”

“আরেহ না না। ও কিছু বলেনি এ ব্যাপারে। আমিই বলছি”

“এখনো ক্যারিয়ার গুছিয়ে আনলোনা, তুমি হঠাৎ বিয়ের কথা ভাবছো?”

“ক্যারিয়ারের সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক? বিয়ে হলে আল্লাহ এমনিতেই বরকত দিবেন। ছেলেমেয়ে বিয়ের বয়স হলে এসব দুনিয়াবী কারণ দেখিয়ে পেছানোর মানে হয় না।তাছাড়া আল্লাহর রহমতে আমাদের কন্ডিশন তো এতো খারাপ না যে ছেলের বৌকে খাওয়াতে পারবোনা?”

“আফরোজা তা বলিনি। কিন্তু, ”

“কোনো কিন্তু না, আমার মনে হয় এখন সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই বেটার,,”

“আচ্ছা দেখো কেউ তোমার ছেলেকে মেয়ে দিবে কিনা ”

“এই কথা কেন বললে? কোনদিকে নেই আমার ছেলে? তুমি ইচ্ছে করে এসব বলো তাইনা?”

“হাহাহা। মজা করছিলাম, তা তোমার পছন্দসই কেউ আছে নাকি?”

“হুম! আছে বলেই তো দেরি করতে চাইছি না,,,”

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here