নেকড়ে_মানব,পর্ব:-১৫

#নেকড়ে_মানব,পর্ব:-১৫
#আমিনা_আফরোজ

বনের আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলছে নিলয়রা। নিলয়দের দলের প্রথমে রাইফেল উঁচিয়ে সামনে এগিয়ে চলছে নিলয় তারপর প্রফেসর আর নিভৃত শেষে বাকি পুলিশ সদস্যরা। সবার হাতে রাইফেল লোড করা আছে রুপোর বুলেট। বুলেটগুলো অবশ্য প্রফেসর প্রথমে তার সঙ্গে করে আনা হোলি ওয়াটার দিয়ে ধুয়ে তারপর নিলয়দের হাতে দিয়েছিলেন। বনের দুপাশে রয়েছে বড় ডালপালা যুক্ত গাছের সারি। তার পাশ দিয়েই চলে গেছে ছোট ঝোপযুক্ত গাছের সরু রাস্তা। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে গাছের পাতাগুলো। বুনো ফুলের ঝাঝালো গন্ধে ভরে গেছে পুরো জায়গাটা। অপার্থিব সেই সুগন্ধে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে নীলয়েরা। এলোমেলো পায়ে এগিয়ে চলেছে ওরা।

মৃদু আলোর ঝলকানিতে পিট পিট করে চোখ খুলল আয়মান। মাথার পিছন দিকটা এখনো তীব্র ব্যাথা করছে আয়মানের । জ্ঞান ফিরতে মনে পড়ল দুপুরের ঘটনাটা। গতরাতে নেকড়ে মানবটা হাসপাতাল থেকে উঠিয়ে নেকড়েটিলার এই গহিন অরণ্যে নিয়ে আসে। পিশাচটা অবশ্য ডক্টর আয়মানকে বনের মাঝে এক ভগ্ন কুঠিরে রেখেছে। তবে খাবার জুটে নি তার কপালে। একে তো অসুস্থ শরীর তার ওপর অনেকক্ষণ না খাওয়া তাই আর শরীর সাঈদী ছিল না ডক্টর আয়মানের। ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ছিলেন তিনি। কিন্তু জন্তুটা হয়তো এত সহজে মুক্তি দিতে চাইনি ডক্টর আয়মানকে । তাই গহীন অরণ্য থেকে ফল এনে খেতে দিয়েছিল তাকে। ডক্টর আয়মান সে ফল সানন্দে গ্রহণ করেছিল কেননা আগে তার জীবন বাঁচানো ফরজ। খাবার দেওয়ার পর শয়তানটা আবারও চলে যায় বাহিরে। তবে এইবার সেই বিশালদেহী নেকড়ে মানবের রূপ ছেড়ে সাধারণ মানুষের রূপে চলে গেল বাহিরে। খাবার খাওয়ার পর ডক্টর আয়মান একটু সুস্থ বোধ করেন। ক্লান্তিতে মেঝেতেই আবারো ঘুমে তলিয়ে যায় ডক্টর আয়মান।

ঘুম ভাঙ্গলে ডক্টর আয়মান দেখে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলছে। বাড়িটা বহু পুরোনো হবার দরুন ঘরের দরজাটা নেই। তবে গত রাত থেকে ঘরের সামনে দুজন নেকড়ে পাহারা দিচ্ছিলো তাকে। সুশান্তই তাকে পাহারা
দেবার জন্য ঐ নেকড়ে সৈন্যদের বহাল করেছিল এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই ডক্টর আয়মানের। তাই স্বভাব বশত দরজার দিকে চোখ যেতেই খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন তিনি। গতরাত থেকে যে দুইজন নেকড়ে সৈন্য পাহারা দিচ্ছিলো তাকে তাদের আর দেখতে পেলেন না তিনি। দরজার অপাশটা তখন ফাঁকা। ডক্টর আয়মান এইবার একটু এগিয়ে এসে পূর্ণ দৃষ্টি ফেললেন বাহিরের দিকে। কিন্তু না দেখতে পেলেন কোন নেকড়ে সৈন্য আর না দেখতে পেলেন সেই সুশান্ত নামের নেকড়েটি। আর সময় নষ্ট করলেন না ডক্টর আয়মান। চটজলদি বেরিয়ে এলেন কুঠির থেকে। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন এখানে থাকলে অবধারিত মৃত্যু হবে তার। মৃত্যু থেকে এই নরক ছাড়া মুক্তি হবে না তার। কুঠির ছেড়ে বেশ কিছুটা দূরেই চলে এসেছিলেন তিনি। প্রায় বড়কল গ্রামের কাছাকাছি যখন পৌঁছেছেন ঠিক তখনি পিছন থেকে শুনতে পেল এক হিংস্র গর্জন। ডক্টর আয়মান ভয়মিশ্রিত চোখে তাকালো পিছন দিকে। দেখল তার থেকে হাত দুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল দেহী নেকড়ে। বাদামী লোমে ঢাকা তার পুরো শরীর, চোখ দুখানা লাল টকটকে। নেকড়েটা আয়মানকে দেখে আবারো গর্জে ওঠল। নেকড়ের হিংস্র গর্জনে কেঁপে উঠল পুরো নেকড়ে টিলা। অতঃপর পলকের মাঝেই ডক্টর আয়মানকে আর কোন সুযোগ না দিয়েই নেকড়েটা আয়মানকে ছুড়ে ফেললেন দূরে গাছের কাছটায়। গাছের সাথে ধাক্কা লেগে মাথার পিছন দিকটায় বেশ ব্যাথা পায় ডক্টর আয়মান। তীব্র ব্যাথায় চোখ বুজে আছে তার। ধীরে ধীরে সঙ্গা হারান ডক্টর
আয়মান। ডক্টর আয়মান সঙ্গা হারানোর পর নেকড়েটা এগিয়ে এলো সেদিকে। তারপর ডক্টর আয়মানের সঙ্গা হারানো দেহটা হাতের মুঠোয় নিয়ে আবারো গহিন অরণ্যের দিকে যেতে লাগল।

ডক্টর আয়মানের জ্ঞান ফিরেছে মিনিট পনেরো আগে। তবে এখনো চুপচাপ বসে আছে সে। মাথার যন্ত্রণাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। এক ধ্যানে কেবল তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। যেন মাটি ফুঁড়ে কিছু বের করতে চাইছে। এমন সময় ভারী পায়ের আওয়াজ এলো ডক্টর আয়মানের কানে। মেঝে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সরিয়ে সে দিকে তাকালো ডক্টর। দেখল সুশান্ত নামের সেই নেকড়েটি এসেছে। তবুও ঠাঁই বসে রইল ডক্টর। নেকড়েটি ডক্টর আয়মানের সামনে এসে দাঁড়ালো । তারপর ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল,

–” কি ব্যাপার ব্যাপার ডাক্তার। এভাবে চুপচাপ বসে আছো যে । আবারো পালানোর ফন্দি আঁটছে নাকি?”

ডক্টর আয়মান এবারো কিছু বলল না। কেবল মুখটা ঘুরিয়ে নিলো জানালার দিকে। বাহিরে তখন অন্ধকার নেমেছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠেছে। চাঁদের আলোয় বাহিরেটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তিনি। হঠাৎ পাশের কোন গাছ থেকে শোনা গেল প্যাঁচার কর্কশ ডাক। ধ্যান ভাঙ্গল ডক্টর আয়মানের। এদিকে ডক্টর আয়মানকে চুপ করে থাকতে দেখে আবারো হেসে ওঠল সুশান্ত নামের ছেলেটা। অতঃপর বলল,

–“জানো তো ডাক্তার তোমাকে কেন এই জঙ্গলে নিয়ে এসেছি ? ওহো তুমি জানবে কি করে তুমি তো আমার হাতে বন্দি এখন। তুমি যদি ওই পুলিশ ছোকরা দুটোকে আমার সত্যিকার এর পরিচয় না দিতে তবে আমি তোমাকে এখানে নিয়ে আসতাম না কিন্তু কি করবো বলো , তুমি তো আবার সত্যবাদী যুধিষ্ঠির কি না সবকিছু সত্যই বলা চাই তোমার। যাই হোক, তুমি যে আমাকে পছন্দ করো না তা আমি বেশ বুঝতে পারি আমি । আজ তো পূর্ণিমা । আর কিছু সময় পরে আমার দলের আরো একজন সৈন্য বেড়ে যাবে জানো তো। সেই সৈন্য টির নাম জানো তুমি ?”

প্রশ্নটা করেই ক্ষণকাল তাকিয়ে থাকলো ডক্টরের দিকে তারপর আবারো বলতে লাগলো,

-“থাক তোমাকে আর কষ্ট করে কিছু বলতে হবে না। আমি নিজেই তার নাম তোমাকে বলে দিচ্ছি । আমার পরবর্তী নতুন নেকড়ে সদস্যের নাম ডক্টর আয়মান।”

কথাগুলো বলে হো হো করে বিকট শব্দে হাসতে লাগলো নেকড়ে। ডক্টর আয়মান তখন বিশ্ময় দৃষ্টিতে তাকালো সামনের দিকে। ডক্টর আয়মানের দৃষ্টি উপেক্ষা করে নেকড়টা আবারো চাপা গলায় বলল,

–” আমি নেকড়ে বলে আমাকে তোমার পছন্দ নয় তাই না ডাক্তার। কিন্তু আর কিছুক্ষণ পরে তুমি নিজেই একটা নেকড়েতে পরিণত হবে। তখন তোমাকেও সবাই জন্তু, শয়তান, পিশাচ বলে ডাকবে যেমনটা আমায় ডাকে সবাই। কি ডাক্টার এখন তোমার আর নিজেকে দেখে ঘৃনা করবে না তো?”

ডক্টর আয়মান এখনো নির্বিকার। গলা দিয়ে যেন আজ আর কোন কথা বেরুচ্ছে না ওর। ডক্টর আয়মানের এমন অবস্থা দেখে সুশান্ত বেশ খুশি হলো। অতঃপর অট্টহাসি দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। এখন অনেক কাজ বাকি আছে ওর। সামনে লড়ায়টা যে ওকে বেশ ভোগাবে এ নিয়ে সে বেশ চিন্তিত। আরো খানিকটা তার সৈন্যদেরকেও তৈরী করতে হবে। তাই আর এখানে অযথা সময় নষ্ট করল না সুশান্ত। তার এখানের কাজটা শেষ হয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

চলবেম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here