#নেকড়ে_মানব,পর্ব:- ০৯
#আমিনা_আফরোজ
পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে তড়িৎ বেগে এগিয়ে চলছে একটি কালো রঙের গাড়ি। গাড়ির ভেতরে নিলয় ছাড়াও রয়েছে আরো তিনজন পুলিশ সদস্য। রাস্তাঘাট শূর্ণ্য, জনমানবের চিহ্ন নেই কোথাও। চারিদিক শুনশান, নিস্তব্ধ। কোথাও কোন প্রানের সাড়া অব্দি নেই। খা খা করছে চারিদিক। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সাথে বইছে দমকা হাওয়া। বৃষ্টির পানি এখনো লেগে আছে রাস্তাতে। দমকা বাতাসে তখন নাজুক অবস্থা নিলয়ের। হাত পা কাঁপছে। নিজের ভেতরে অন্য রকম এক উত্তেজনা কাজ করছে ওর। এত দিন যেই মানুষটাকে ধরার জন্য এত চেষ্টা করছে আজ তাকে পেয়েছে নিলয়। অবশেষে একটি বট গাছের পাশে এসে দাঁড়ালো নিযলয়দের গাড়ি। এখান থেকে পাহাড়ি এই আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে ওদের মিনিট পাঁচেক হাঁটতে হবে তারপর নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে ওরা।
গাছটার কোন ঘেঁসে গাড়িটিকে থামাতে বলল নিলয়। গাড়ি থেকে নেমে রমজান মিয়াকে বলল,
–” এখান থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটতে হবে রমজান মিয়া। ”
রমজান মিয়া এখনো কিছু জানে না । থানা থেকে নিলয়কে এমন হন্তদন্ত হয়ে বেরোতে দেখেই সে বুঝেছিল আবার কোন অঘটন ঘটেছে। এজন্য চুপচাপ নিলয়ের কান্ড দেখছে সে। নিলয়ের কথায় রমজান মিয়া বলল,
–” তাহলে এখানে অপেক্ষা করছি কেন আমরা? চলুন সামনে এগুনো যাক।”
–” সামনে তো যাবই। চলুন এখানে আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে পরা যাক।”
–” হ্যাঁ চলুন। ”
নিলয়রা যে রাস্তায় হেঁটে চলেছে সেইটা মাটির পাহাড়ি রাস্তা। বৃষ্টিতে রাস্তাটাতে কাঁদা হয়েছে, সেই সাথে জায়গাটা পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে। একটু হেরফের হলেই ধপাস হয়ে আছাড় খেতে হবে। রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল। বিদ্যুৎ না থাকায় পুরো এলাকাটা হয়ে আছে অন্ধকার। নিলয়রা টর্সের আলো জ্বালিয়ে সামনে এগোচ্ছে। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল দো-তোলা বাড়িটা। নিচের তলার কামরাতে তখনো মৃদু মৃদু আলো চলছিলো। নিলয় দ্রুত পা চালিয়ে ঘরটির সামনে এসে দাড়ালো। কাঠের দরজাটা ভেঙ্গে একপাশে পড়ে আছে । দরজার বাহিরে একজনের ভেজা পায়ের ছাপ। চাপের আকৃতি সাধারণ মানুষের দেখে কিছুটা বড়। হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে ভেসে এলো এক করুন আর্তনাদ। নিলয় দৌড়ে চলে যায় সেদিকে। ভেতরে মোমবাতির মৃদু আলোতে টেবিলের কোন খেসে একটা লোককে শুয়ে থাকতে দেখতে পায় নিলয়। ব্যাথায় ছটফট করছে লোকটি। নিলয় এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে উঠে বসায়। লোকটার চোখের চশমাটা ভেঙ্গে গালে লেগে খানিকটা কেটে গেছে। হাতে আর শরীরে অনেক আঁচড়ের দাগ। লাল রক্ত বেরোচ্ছে সেখান থেকে। আর গলা থেকে ফিনকে বেরুচ্ছে রক্তবিন্দু। লোকটা নিলয়ের দিকে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
–” ও কে ধরুন আপনারা। ও পালিয়ে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। সবাইকে শেষ করে দিবে ও।”
নিলয় লোকটার মুখের ওপর ঝুঁকে বলল,
–” কে ? কার কথা বলছেন আপনি? এখানে তো আপনি ছাড়া আর কেউ নেই? আর আপনার এই কেবিনের অবস্থাটাই বা এমন হলো কি করে? ”
–” ও এসেছিল, এসেছিল ও। আমাকেও সবার মতো শেষ করতে চেয়েছিল কিন্তু পারে নি। ”
–” কে এসেছিল?”
–” নেকড়ে মা………..
বাকি কথাটুকু শেষ করতে পারল না ভদ্রলোকটি। ভয়ে , ব্যাথায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে। নিলয় লোকটার বুকে কান রেখে বুঝল শ্বাস – প্রশ্বাস চলছে লোকটার। দ্রুত লোকটিকে রমজান মিয়ার সাহায্য কোলে তুলে ছুট লাগালো হাসপাতালের দিকে।
এদিকে রাত জেগে ঘরে বসে বই পড়তে নিভৃত। অন্যান্য দিন এ সময় অফিসে বসে বসে কাজ করে ও। আজ নাইট ডিউটি নেই তার। তাই আরাম করে বইয়ের নেশায় ডুবেছে নিভৃত । বইয়ের নেশা আগে থেকেই ছিল নিভৃতের মাঝখানে কাজের চাপে কিছুটা ভাটা পড়ে গিয়েছিল সে নেশা। হঠাৎ আচমকা দরজার ছিটকিনি খোলার আওয়াজ কানে এলো নিভৃতের। রাতের তখন দশটা বেজে দশ মিনিট। এতো রাতে বাসা থেকে বাহিরে বেরুলো কে? অয়ন নাকি অন্য কেউ?
বইটা খাটের এক কোনায় রেখে নিভৃত ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। হল ঘরে এসে দেখল ওদের বাসার মেইন দরজাটা খোলা। নিভৃত অয়নের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে অয়ন ওর ঘরে নেই। যা বোঝার বুঝে গেছে নিভৃত। তাই আর সময় নষ্ট না করে নিভৃত সেই খোলা দরজা দিয়ে বাহিরে বেরিয়ে এলো। বাহিরে তখন নিকষ কালো অন্ধকার। রাস্তার ল্যামপোস্টের আলোয় জ্বলছে না আজ। বৃষ্টি বাদলের দিন , বিদ্যুৎ না থাকারই কথা। নিভৃত আন্দাজ করে বাসা থেকে বেরিয়ে ডান দিকের পথ ধরলো। পথের নোংরা পানি পাড়িয়ে উপস্থিত হলো বড় একটি মাঠের সামনে। হঠাৎ তখনোই আকাশের কালো মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো পূর্ণিমার গোল চাঁদ। নিমিষেই চাঁদের আলোয় কেটে গেল সব অন্ধকার। চারিদিক ভেসে গেল চাঁদের আলোয়। হঠাৎ খুব কাছে কোথাও আর্তনাদের চিৎকার এলো নিভৃতেই কানে। ভাসা ভাসা কিছু শব্দ ইট পাথরের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে কানে বাজছিল ওর। নিভৃত সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাঠ পেরিয়ে পাশের বস্তির দিকে এগোলো। সেখান থেকেই ভেসে আসছে অস্পষ্ট শব্দগুলো।
বস্তি থেকে হাত দুয়েক দূরেই দেখা পেল এক শিশুর। মাটিতে শুয়ে আছে সে। অস্ফুট আর্তনাদ বেরুচ্ছে তার গলা থেকে। নিভৃত এগিয়ে গেল বাচ্চাটার দিকে। বাচ্চাটি অপরিচিত লোককে দিকে কঁকিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
–” ভাইজান আমার মা-বাবারে বাঁচান। ঐ রাক্ষস আমার বাবা-মা রে ম্যাইরা ফালাইবো।”
নিভৃত ভ্রু-কুচকে বলল,
–” কোথায় তোমার বাবা-মা?”
শিশুটি হাত তুলে অদূরে দাঁড়ানো বস্তিটিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
–” ঐখানে।”
–” ঠিক আছে তুমি এখানে থাকো ,আমি গিয়ে দেখছি কি হয়েছে।”
নিভৃত যখন বস্তিতে গিয়ে পৌঁছালো তখন সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে পুরো বস্তি। বস্তির ঘরগুলোর সামনে পড়ে আছে কতগুলো মৃত দেহ। চারিদিক মানুষের আহাজারি। স্বজন হারানোর ব্যথায় ব্যাথিত তারা। নিভৃত চারিদিকে করুন চোখে তাকাতেই বস্তির পাশ দিয়ে দ্রুত বেগে কাউকে বেড়িয়ে যেতে দেখলো । নিভৃতও অঙ্গাত ব্যাক্তিটির পিছু নিলো। হঠাৎ একটা বাসার পাশে এসে হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গেলো আগুন্তুক। নিভৃত এদিক -ওদিক পানে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলো না। তখনিই বাড়িটির পিছন থেকে বেড়িয়ে এলো একজন পুরুষ ও একটি নারী অবয়ব।
চলবে