#নেকড়ে_মানব,পর্ব:-০৫
#আমিনা_আফরোজ
সময় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল সবে। রাঙামাটির দুই কামড়ার ছোট একটি ছোট্ট ঘরে অন্ধকারে ঠাঁই বসে আছে নিলয়। ধরনীতে তখন আধার ঘনিয়ে এসেছে। চারিদিক ছেয়ে গেছে আবছা অন্ধকারে। আজকাল সন্ধ্যা ঘনাতেই এই পাহাড়ি এলাকাটি একবারে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। অতঃপর রাতের গাঢ় অন্ধকার ঘনে আসলেই শহরের অলিগলিতে শুরু হয় নির্মম হত্যাযজ্ঞ । রাতের অন্ধকারে লাল টকটকে রক্তে ভেসে যায় শহরের প্রতিটি পিচ ঢালা রাস্তা।
রাঙামাটিতে যখন এমন হুলস্থুল ভয়াবহ কান্ড ঘটে চলেছে ঠিক সেই সময় নিভৃত নামের এক সাতাশ বছরের যুবক চাকরির সুবাদে পাড়ি জমাল রাঙামাটির দিকে। সে জানত না ভবিষ্যতে কি বিভিষিকাময় ঘটনা ঘটতে চলেছে তার সাথে। জানলে হয়ত সে পাড়ি জামাতো না কলঙ্কিত সেই শহরটির উদ্দেশ্যে।
বাস স্ট্যান্ড এ বাসের জন্য দাড়িয়ে আছে নিভৃত। গন্তব্য রাঙামাটির পাহাড়ি অঞ্চল। বাস আসতে দেরি হচ্ছে দেখে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে নিউজফিড স্কল করে চলেছে অবিরত। এমন সময় তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক বলে ওঠলেন,
–” রাঙামাটি কি এই প্রথম যাচ্ছেন মশাই?”
প্রশ্নটি শুনে নিভৃত পাশে তাকিয়ে দেখল একজন ভদ্রলোক পরনে পায়জামা, পাঞ্জাবি , মুখে কয়েক দিনের না কামানো দাড়ি আর এলোমেলো চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশে। নিভৃত লোকটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
–“তা আপনি কি করে জানলেন?”
–” আসলে আপনি যে রাঙামাটির টিকিট কেটেছেন তা আমি দেখেছি। তাছাড়া রাঙামাটির বাস আসার সময় জানতে চায় কেবল যারা প্রথমবার যায় ।
নিভৃত মনে মনে ভাবল কথাটা একেবারে ভুল বলেনি ভদ্রলোক । নিভৃতের প্রথম পোস্টিং রাঙামাটিতে। তাই এই প্রথম রাঙ্গামাটি যাচ্ছে সে। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে নিভৃত । চাকরিটা যতই বেসরকারি হোক না কেন তবুও আজকের দিনে চাকরির বাজারে এটিই সোনার হরিণ। তাই আর দেরি করে নি নিভৃত। অফিস থেকে সমস্ত কাগজ তুলতে তুলতে দেরি হয়ে গেল ওর । বাসা আসার কথা নয় টায় কিন্তু এখন বাজে নয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। তবুও এখনো বাস আসার নাম গন্ধ নেই। যদিও রাঙামাটি পৌছিতে পৌঁছাতে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে আজ তবুও বাস না আসায় একটু চিন্তিত সে। রাঙ্গামাটিতে নিভৃত থাকবে ওর এক দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের বাসায় । তাই চিন্তা হচ্ছিল এজন্যই চেইন মাস্টারের কাছে ও জিজ্ঞেস করছিল কখন বাসটা আসবে।
ভদ্রলোকটি তারপর থেকেই ঘুরঘুর করছে নিভৃতের আশেপাশে। যা রিতিমত বেশ বিরক্ত লাগছে এখন নিভৃতের। বাস যখন স্টেশনে ঢুকলো তখন রাত দশটা। বাসে ওঠে নিভৃত ওর নির্ধারিত সিটে এসে বসল। সেই ভদ্রলোকটাও নিভৃতের ওঠা বাসে ওঠে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল ওর দিকে। দুর্ভাগ্য বশত ভদ্রলোকটির এগিয়ে এসে ঠিক নিভৃতের পাশের সিটে বসে পড়লেন। অতঃপর দু’জনের চোখাচোখি হতেই লোকটা মিশকে একটা হাসি দিল। লোকটির এমন হাসি দেখেই নিভৃত মনে মনে বলে ওঠল,
–” আজা শান্তিতে যেতে পারব না বোধহয় । লোকটা সারাটা রাস্তা জ্বালিয়ে মারবে আমার সাথে। ”
যাইহোক কিছুক্ষণ পর বাস চলতে শুরু করল। শিরশির ঠান্ডা হাওয়ায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা বুঝতেই পারে নি নিভৃত। আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখে ভদ্রলোকটি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভদ্রলোকটির দিকে তাকাতেই বলে উঠলো ,
–” আপনিতো বেশ ঘুমান মশাই। অনেকেই একটু আগে নেমে গেল ।”
–” তো আপনি নামবেন কোথায়?”
–” রাঙ্গামাটি ।”
হঠাৎ করে ভদ্রলোকটির একটি কথা শুনে মনে মনে নিভৃত ভাবল বোধহয় ভদ্রলোকটি আসলেই পাগল। ভদ্রলোকটি কোন ভনিতা ছাড়াই বলে উঠলেন,
–” রাঙ্গামাটির নেকড়ে টিলায় নেকড়ে মানব আছে মশাই।”
এমন চাঞ্চল্যকর কথাটি শুনার পরেও নিভৃতকে চুপ থাকতে দেখে ভদ্রলোকটি আবারো বলে উঠলেন,
–” কি বিশ্বাস করছেন না তো ? প্রমাণ দিল বিশ্বাস করবেন তো ?”
নিভৃত একটু আগ্রহ নিয়ে তাকাল তার দিকে ।
–” আপনি যদি দেখতে চান তবে দেখাতে পারি।”
এইবার একটু মজা পেল নিভৃত। তাই মজা করেই সে বলে উঠলো,
–” কই আগে তো কখনো শুনিনি এমন কথা?
–” আহা এখনো তো কেউ জানে না, তবে এখন জানবে সবাই।”
লোকটির কথায় কেমন যেন লাগল নিভৃতের। তাই জিঙ্গেস করল,
–” আপনার নেকড়ে মানব এর গায়ের রং কি? আর দেখতেই বা কেমন? ”
–” আপনাকে তো স্বচক্ষে দেখাতে চাইলাম তখনই নাহয় দেখে নিবেন।”
কথাটি বলেই ভদ্রলোকটি বিশ্রি হাসি দিল। নিভৃত আর কিছু বলে নি ভদ্রলোকটিকে। মুখ ফিরিয়ে চুপচাপ বসে রইল নিজের জায়গায়। লোকটি তখনো হাতের কড় গুনতে গুনতে মুখে বিড়বিড় করেই চলেছে। মনে হলো যেন হিসেব কষছে কত লোক মারা যাবে।
কিছুক্ষণ পর একটা স্থানে বাস দাঁড়িয়ে গেল রাতের জন্য কিছু বুঝতে পারল না নিভৃত তবে যেকোনো রয়েছে তা বুঝতে পারল সে একটু পর লোকটি নিভৃতে কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো এখানে বাস কিছুক্ষণ দাঁড়াবে আমি যখন বলবো তখন আপনি আপনার মাথা যাতে বের করে সামনের দিকে তাকাবেন। নিভৃত এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিল যে ওর মাথা কাজ করছিল না তখন। তাই ভদ্রলোকের কথামতো জানলা দিয়ে মাথা বের করে সামনের দিকে তাকাল সে।
আকাশে থমথমে চাঁদের আলো। সামনে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলটা ঘন হলেও চাঁদের আলোয় সব দেখা যাচ্ছিল। তবে জঙ্গলটা খুব একাকী মনে হচ্ছিল আজ নিভৃতের কাছে। চারিদিকে নাম না জানা ছোট বড় হরেক রকমের বাহারী গাছ। সামনের এক নাম না জানা বড় গাছটির দিকে অজান্তেই চোখ গেল নিভৃতের। নিভৃত মুগ্ধ হয়ে সেই দিকেই তাকিয়ে রইল প্রায় বেশ কিছুক্ষণ।
–“এইবার সামনের ওই বড় গাছটির নিচে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন তো কিছু দেখতে পান কি না?”
ভদ্রলোকের কথায় স্তম্ভিত ফিরে পেল নিভৃত। সম্ভিত ফিরে পেতেই একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখল দূরের সেই নাম-না-জানা বড় গাছ তলায়। ঐ গাছটার নিচে ভালো করে তাকিয়ে দেখল একটি লোক উবু হয়ে বসে আছে তার নীচে । আরো ভালো করে তাকিয়ে দেখল লোকটার সারা গা লোমে ভর্তি। প্রায় মিনিট পাঁচেকের মাথায় বাস আবার চলতে শুরু করলো সামনের দিকে। ভদ্রলোকটি এবার একটু জোরেই শিস বাজালো। শিসের শব্দ শুনে গাছের নিচে বসে থাকা অদ্ভুত লোকটি এইবার মুখ তুলে তাকালো আমাদের দিকে । নিভৃত যেন স্পষ্ট দেখতে পেল লোকটির জ্বলজ্বল করা চোখ দুটি। ঠিক যেমন রাতের অন্ধকারেও বিড়ালের চোখ জ্বলতে দেখা যায়।
গাড়িতে থাকাকালীন বাকি সময়টুকু আর কোন কথা হয়নি ভদ্রলোকটির সাথে। রাঙামাটি পৌঁছাতে প্রায় অনেক রাত হয়ে গেল নিভৃতের। তবে বাস থেকে নামার আগেই নিভৃত ওর সেই ভাইকে ফোন দিয়েছিল যেন বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে সে। কারন নিভৃত তো তেমন কিছুই চেনে না এখানকার। কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে থামলো রাঙ্গামাটির মেইন বাস স্ট্যান্ড এ। বাস থেকে নেমে নিভৃত দেখল ওর সেই দুঃসম্পর্কের ভাই অয়ন দাঁড়িয়ে আছে ওর জন্য। ইস বেচারা যে আজ রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন নি তা বেশ বুঝতে পারল নিভৃত। মনে মনে কিছুটা অনুশোচনাও হচ্ছিল তার জন্য। তবে নিভৃত যখন গাড়িতে উঠেছিল তখনও ঢাকাগামী বাসটির দিকে তাকিয়ে দেখল বাসে বসে থাকা ভদ্রলোকটি গাড়ির সাথে হেলান দেয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
চলবে