#নেকড়ে মানব,পর্ব:-০৪
#আমিনা আফরোজ
ইঞ্জিনের শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে নীল রঙের এক গাড়ি। সময় তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। স্টিয়ারিং এ হাত রেখে এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে এক মধ্য বয়সী যুবক। সদ্য পুলিশ ফোর্স এ জয়েন করেছে সে। নাম আয়ান। মধ্যবৃত্ত পরিবারের বড় ছেলে সে। আয়ানের পাশেই কপালে হাত দিয়ে বসে রয়েছে নিলয়। আশেপাশের গাড়ি থেকে আসা যান্ত্রিক শব্দে কিছুটা বিরক্ত সে। তবে ফুরফুরে হাওয়ায় এখন কিছুটা স্বস্তি বোধ করছে ও। সময়ের গতিতে সবুজ গাছপালা আর পাহাড়ি রাস্তাকে পিছনে ফেলে নিলয়দের গাড়ি এসে পৌঁছালো বড়কল গ্রামে। গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে সবাইকে নিয়ে কাজে
লেগে পড়ল নিলয়। প্রথমেই তাদের তিনটে তাঁবুর পাশে আরো দুইটা বড় তাবু টাঙ্গানোর কাজ সেরে ফেলল সে। নিলয়ের ধারনা মতে আজ থেকে বেশ কয়েকটা দিন এখানেই কাটাতে হবে তাদের।
তাবু ফেলতে ফেলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো ধরনীতে। নিলয়ের কথামত এখানে অবস্থানরত বাকি পুলিশ সদস্যরা দিনের বেলায় মাটির চুলা বানিয়ে রেখেছিল। তাই নিলয় আর দেরি না করে সন্ধ্যার আগেই রান্না চাপিয়ে দিতে বলল রমজান মিয়া আর আয়ানকে। বাকিরা অবশ্য সাহায্য করল ওদের। এতো জনের রান্না একা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। রান্না শেষ হলো সন্ধ্যার অনেক পরে। ধরনীর আলো ততক্ষনে গ্রাস করে নিয়েছে নিকষ কালো অন্ধকার। সন্ধ্যা ঘনাতেই নিশ্চুপ হয়ে গেলে চারিদিক । যেন এক অদৃশ্য কোন শক্তি মন্ত্রবলে পুরো গ্রামটাকে নিশ্চুপ করে দিয়েছে। নিস্তব্দ এই অন্ধকারে নিলয়দের প্রতিটি তাঁবুতে জ্বলে ওঠেছে কুপ বাতির হলদে আলো । প্রতিটি তাঁবুতে দেখলে মনে হচ্ছে যেন গহিন অরণ্যে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা জোনাকির আলো। রাতের খাবার শেষে সবাই লেগে গেল নিজ নিজ দ্বায়িত্বে। আজ সবাই আগেই খাওয়া শেষ করেছে। গত দিনের থেকেও আজ পাহারা আরো দ্বিগুন করে দিয়েছে নিলয়। সবার সাথে সেও রাতের এই নিস্তব্ধতায় একা একা তাঁবুর বাইরে পাহরা দিচ্ছে।
পুরু বড়কল গ্রাম নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে কিছু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। আজও রাতের নীল আকাশের বুকে উঠেছে পূর্ণিমার রুপালি গোল চাঁদ। চারিদিক ভেসে যাচ্ছে সেই চাঁদের আলোয়। রাত তখন দুটো বাজে। গহিন অরণ্যে তখন বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। আজও একইভাবে শোনা গেল আরও একটি আর্তনাদ। আর্তনাদ যে বনের ভেতর থেকেই আসছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই নিলয়ের। তবে কি আজও পাওয়া যাবে আরও একটি রক্তশূন্য লাশ? শূণ্য হয়ে যাবে কি অন্য কোন মায়ের কোল? নাকি হারিয়ে যাবে অন্য কোন পরিবারের এমন কোন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যার উপর নির্ভর করে পুরো পরিবার?
আর্তনাদ শোনামাত্রই আর দেরি না করে নিলয় তাঁবুর বাহিরে থাকা কিছু সদস্য আর রমজান মিয়াকে নিয়ে ছুটে গেল মনের গহীনে । অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও আছে কোন লাশ খুঁজে পাওয়া যায় নি ।তবে আর্তনাদে শুনতে পাওয়া গিয়েছিল তবে কি তা একান্তই নিলয়ের ভ্রম ছিল। কিন্তু শুধু যদি নিলয়ের ভ্রমই হতো তবে শুধু নিলয়ের একা হতো , একসাথে এত লোকের ভ্রম হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। অবশেষে হার মেনে আবারও তাঁবুতে ফিরে এলো সবাই। বাকি রাতটুকু আরো সজাগ থাকল সকল পুলিশ সদস্য । আজকের ব্যাপারটি নিয়ে বেশ চিন্তিত নিলয় । কিছু যে একটা গন্ডগোল আছে তা বেশ বুঝতে পারছে ও। তবে কি হত্যাকারী আরো সাবধান হয়ে গেল? সে কি লাশটিকে সরিয়ে ফেলেছে অন্য কোথাও ? তবে বন ছাড়া আর কোথাই ই বা সরাতে পারে লাশটি? নিলয় ভাবল দিনের বেলায় আরো একবার যেতে হবে নেকড়ে টিলার গহিন অরণ্যে। রাতে খুব একটা ভালো করে খুঁজতে পারে নি তারা। এখন শুধু ভোর হবার অপেক্ষা। অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন কিছু করার নেই তাদের।
ভোর হতেই আবারো সবাইকে নিয়ে নিলয় বেরিয়ে পড়ল নেকড়ে টিলার গহীনে । এই নেকড়ে টিলার নামটি বেশ ভুতুড়ে শোনায় ওর কাছে। বনের ভিতরে তন্নতন্ন করে লাশ খুঁজে চলেছে নিলয় । অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে একটি গাছের নিচে পাওয়া যায় একটি মাথাবিহীন লাশ। লাশটির কাছে এগিয়ে গেল নিলয়। তবে এবারে পাওয়া লাশের সাথে পূর্ববর্তী লাশগুলোর বেশ কিছু পরিবর্তন পাওয়া গেল। প্রথম পরিবর্তন , এবারে লাশের মাথা তার দেহ থেকে আলাদা করা হয়েছে যেন লাশটিকে সনাক্ত করা না যায়। শুধু তাই নয় হৃদপিন্ডের সাথে সাথে পেটের নাড়িভুঁড়িও বের করে ফেলা হয়েছে। পেটের নাড়িভুড়ি গুলো অবশ্য লাশের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থায় দেখতে পাওয়া গেল। তবে হৃদপিন্ডের খোঁজ পায়নি তারা । হয়তো মৃত ব্যক্তিটির হৃদপিন্ডটি সাথে করে নিয়ে গেছে খুনিটি। লাশের এমন অবস্থা দেখে গা গুলোতে লাগলো নিলয়ের। তাই লাশ থেকে একটু দূরে সরে এলো সে। দূর থেকেই রমজান মিয়াকে বলল,
–” লাশটিকে পোস্টমডার্মে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।”
–” ঠিক আছে স্যার।”
–” আর হ্যা এই রিপোর্টের সাথে গতকালের রিপোর্টাও এখানে পাঠাতে বলবেন।”
–” ওকে স্যার।”
রমজান মিয়ার সাথে কথা শেষ করে দেখল ভোর হতেই তবুর চারিপাশে গ্রামবাসীদের ভীর জমে গেছে। ভীড় জমবে নাই বা কেন? পরপর চার চারটা খুন হয়ে গেল এই নেকড়েটিলায়। মৃত্যুর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে পুরো গ্রামবাসী। এই নেকড়ে টিলা নিয়ে গ্রামবাসীদের মুখে একটি গল্প শোনা যায়।
প্রায় 200 বছর আগে এই কিলায় বাস করত সিভিয়ার এক বিরল প্রজাতির লোক। তারা নাকি মন্ত্রবলে মানুষের বদলে নেকড়ের রূপও ধারণ করতে পারত। তার পর থেকেই এই টিলার নামকরণ করা হয় নেকড়ে টিলা। কালের বিবর্তনে সেইসব নেকড়ে মানবের কোন অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে কিন্তু গ্রামবাসীদের মনে আজ এর প্রভাব রয়ে গেছে। তারা বিশ্বাস করে এই টিলার কোন এক গহীনে আজও নেকড়ে মানব তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে শত শতাব্দী ধরে। নিলয় কাছে এইটা অবশ্য নিছক কোন গল্প কাহিনী মনে হয়েছে।
বরকল গ্রামের চারটি খুনের এখন পর্যন্ত কোন সুরাহা খুঁজে পাইনি পুলিশ ফোর্স। নিরুপায় হয়ে বসে আছে তারা। এছাড়া আর কিই বা করবে তারা? নিলয় আজ পর্যন্ত কোন কেসে হার মানেনি কিন্তু আজ তার ক্যারিয়ারে ব্যর্থতা দাগ লেগে গেছে।
রাঙ্গামাটি জেলার বড়কর গ্রামের লোকেরা এখন আর এই গ্রামে থাকে না। গ্রাম ছেড়ে মূল শহরে পাড়ি জমিয়েছে সবাই। নিজেদেরকে আর এই গ্রামে নিরাপদ ভাবে নি তারা তাই গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে দূর শহরে। শহরের বস্তিতে থাকে এখন তারা। জীবিকার তাগিদে জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন পেশার সাথে। বরকল গ্রামটি এখন জনমানব শূন্য হয়ে পড়ে আছে। নিশ্চুপ এই গ্রামটি যেন আরো নিরব হয়ে গেছে আগের থেকে। জনমানবহীন গ্রামটি পড়ে আছে টিলার এক কোণে । বাড়িগুলো ঠিক তেমনি পড়ে আছে শুধু নেই জনমানব।
রাঙ্গামাটি শহরে এসেও শান্তিতে নেই শহরের মানুষজন। এখানেও শুরু হয়ে গেছে হত্যাযজ্ঞ। তবে একটি জিনিস খেয়াল করেছে নিলয়। এখন শুধু মাত্র পূর্ণিমার দিনগুলোতে ঘটছে নির্মম হত্যাকাণ্ডের তান্ডব। তবে অমাবর্ষার দিন গুলোতে কোন হত্যাযজ্ঞ হচ্ছে না । তার সাথে আরও একটি ঘটনা ঘটে গেছে রাঙামাটির মর্গে। মর্গে রাখা সে বড়কল গ্রামের খুন হওয়া চারটি লাশ গুলোর মধ্যে তিনটি লাশই হঠ্যাৎ করে গায়েব হয়ে গেছে নিমিষের মাঝেই। যে লাশটি খুনি নাড়িভুঁড়ি বের করে রেখেছিল শুধু সেটিই একাই পড়ে রয়েছে মর্গের ঠান্ডা শীতল ঘরে। মর্গে রাতে পাহারা দেওয়া কিশোর ছেলেসহ লাশগুলো কাটার জন্য যে ডোম রেখেছিল সেও নিখোঁজ হয়ে গেছে সেই ঘটনার পর থেকেই। শোনা যায় ঘটনার রাত থেকে তাদেরকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও ।
চলবে